Site icon Mati News

কবুতর পালনের যাবতীয় খুঁটিনাটি ও ব্যবসার কৌশল

বাংলাদেশে পোষা পাখি হিসেবে কবুতর অত্যাধিক জনপ্রিয় এবং ব্যবসায়িক প্রয়োজনে কবুতরের লালন পালন ও ফার্ম দেয়া ব্যাপক আকর্ষণীয় ও লাভজনক। পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা ও আগ্রহ রয়েছে এমন অনেকেই নিজের বাসা বাড়িতে কবুতর লালন পালন ও পরিচর্যা করতে ভালোবাসেন। আমাদের দেশে এই পাখি গুলো ঘরে ঘরে পালিত হয়ে আসছে অনেক লম্বা সময় ধরে এবং এদেরকে শান্তির প্রতীক হিসেবেও গণ্য করা হয়ে থাকে। অন্যান্য গৃহপালিত গবাদি পশু কিংবা পাখির তুলনায় কবুতর পালনে অনেক কম পরিশ্রম করতে হয় এবং এতে বেশ অল্প পরিমাণ মূলধন লাগে। আপনার হাতে যদি ভালো পরিমাণ অবসর সময় থাকে এবং পাখির প্রতি আপনার মনে অগাধ ভালোবাসা থেকে থাকে তাহলে খুব সহজেই আপনি আপনার বাসার ছাদে কিংবা বারান্দায় কবুতর লালন ও পরিচর্যা করতে পারবেন।

বাচ্চা কবুতরের (স্কোয়াব) মাংস অনেক সুস্বাদু, উচ্চমাত্রায় পুষ্টিকর এবং আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য পুনরুজ্জীবনী ভূমিকা পালন করে। তাছাড়া মার্কেটপ্লেস গুলোতে স্কোয়াবের চাহিদা এবং দামও বেশ। এছাড়াও ভালো বংশোদ্ভূত ও মানসম্মত কবুতরও বিভিন্ন উদ্দেশ্যের জন্য মার্কেটপ্লেস গুলোয় অনেক বেশি চাহিদাসম্পন্ন, যেমন- রেসিং, ব্রিডিং ইত্যাদি। ঠিক এই কারণেই বাংলাদেশের মানুষের জন্য একটি অতিরিক্ত উপার্জনের পথ এবং বিনোদনের মাধ্যম হয়ে উঠেছে।

প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় আধুনিক পদ্ধতিতে কবুতর পালন করাটা আসলে অধিক লাভজনক। অতএব, সঠিক ভাবে একটি কবুতরের ফার্মের ব্যবসা শুরু করা এবং সফল হওয়ার জন্য আপনাকে লালন পালনের আধুনিক পন্থাগুলো অবলম্বন করতে হবে এবং আপনার পাখিগুলোর ভালো করে যত্ন নিতে হবে। আজকে আমরা কবুতর পালনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিক, সুযোগ সুবিধা এবং কীভাবে বাসায় বসে এই লাভজনক ব্যবসাটি শুরু করা যায় সে সব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।

কবুতর ফার্ম দেয়ার বিভিন্ন সুবিধা

কবুতরের ব্যবসা আমাদের জীবনে আর্থিক ও বিনোদনমূলক উভয় দিক থেকে বেশ কিছু সুযোগ সুবিধা দিতে পারে। এই ব্যবসার বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য সুযোগ সুবিধা নিচে উল্লেখ করা হলো-

বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান ইত্যাদি বিভিন্ন দেশের দরিদ্র ও অভাবী মানুষদের জন্য কবুতরের ফার্ম করাটা উপার্জন করার একটি উত্তম উপায় হয়ে উঠতে পারে। এর সাথে আরও দেখে নিতে পারেন পশুপাখি লালন পালন করতে যা জানা থাকা দরকার।

 

কবুতর সাধারণত জোড়ায় জোড়ায় পালন করা হয়। পুরুষ এবং স্ত্রী কবুতরের একটি জোড়া সাধারণত তাদের জীবদ্দশার প্রায় পুরোটা সময়ই একসাথে কাটিয়ে দেয়। এছাড়াও একেকটি কবুতর প্রায় ১২ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত বাঁচে। পুরুষ ও স্ত্রী উভয় কবুতর একসাথেই খড়কুটো সংগ্রহ করে এবং তাদের পরিবার গঠনের উদ্দেশ্যে ছোট খাটো একটি বাসা তৈরি করে নেয়। স্ত্রী কবুতরের বয়স যখন ৫ থেকে ৬ মাসের মত, তখন থেকেই তারা ডিম পাড়া শুরু করে। প্রত্যেক বার একটি জোড়া ২টি করে ডিম পারে এবং প্রায় ৬ থেকে ৮ বছর বয়স পর্যন্ত নিয়মিত ভাবে ডিম দেয়ার ক্ষমতা রাখে।

পুরুষ ও স্ত্রী উভয় কবুতরই পালা করে ডিমে তা দেয় এবং বাচ্চা ফোটানোর চেষ্টা করে। স্বাভাবিকভাবে ডিম থেকে বাচ্চা ফোটাতে তাদের ১৮ থেকে ২০ দিন পর্যন্ত সময় লাগে। ডিম থেকে বাচ্চা ফোটার ২ দিন আগে মাতা ও পিতা উভয় কবুতরের পেটের ভেতরে একটি থলিতে শস্যদুগ্ধ বা ক্রপ মিল্ক উৎপাদিত হয়, যা তারা তাদের বাচ্চাদের ৪ দিন বয়স পর্যন্ত খাইয়ে থাকে। স্ত্রী কবুতরেরা মুখের মধ্যে গুড়ো করা অর্ধতরল খাবার দশ দিন পর্যন্ত মুখের সাহায্যে তাদের বাচ্চাদের খাইয়ে থাকে। এর পর তাদের বাচ্চারা নিজে থেকেই সরবরাহকৃত খাবার খাওয়া শুরু করে দেয়। ওদের বয়স যখন ২৬ দিন পূর্ণ হয়, তখন ওরা পূর্ণবয়ষ্ক কবুতরে পরিণত হয়ে যায়।

কবুতরের জনপ্রিয় জাতসমূহ

সারা বিশ্বে প্রায় তিনশ এর মত কবুতরের জাত খুঁজে পাওয়া যায়। বাংলাদেশে সর্বাধিক প্রচলিত দু’টি প্রধান উদ্দেশ্যে পালিত কবুতরের জাতগুলো নিম্নে দেয়া হলো:

সাধারণত কবুতর পালনের বা ফার্ম করার প্রধান উদ্দেশ্য হলো মাংস উৎপাদন। বাচ্চা কবুতর বা স্কোয়াবেরকচি মাংস পূর্ণবয়স্ক কবুতরগুলোর তুলনায় যথেষ্ট নরম এবং সুস্বাদু হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষই কবুতরের সৌন্দর্যকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকেন এবং পোষ মানানোর জন্য কবুতর কিনে থাকেন।

আপনার কবুতরের জন্য বাসা বা খোপ

কবুতর পালা কিংবা ফার্ম দেয়ার ব্যাপারে তাদের ঘর তৈরি করাটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ। আপনার কবুতরগুলোর জন্য ঘর তৈরি করার আগে নিম্নে উল্লেখিত বিষয়গুলো অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে:

বাসা তৈরির ধরণের সাথে দামের সম্পর্ক

বাংলাদেশে কবুতরের ব্যাপারে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে যে এদের দাম মৌসুম এবং আবহাওয়া ও পরিবেশের উপর নির্ভর করে নিয়মিত পরিবর্তিত হয়। আপনি যদি বাংলাদেশের গ্রামীন অঞ্চলগুলোতে আপনার কবুতর গুলো রেখে লালন পালনের কথা ভেবে থাকেন, তাহলে আপনার এটা জেনে নেয়া ভালো যে গ্রামাঞ্চলে এদের দাম বর্ষা ও শীতকালে সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। কেননা ঐসব এলাকায় বেশির ভাগ মানুষ কবুতরের বাসা ভূমির সমতলে রেখে তৈরি করেন ও মাটিতে রেখেই কবুতর পালেন। তাদের কবুতর গুলো ঠান্ডা ও ভেজা মাটিতে চলাফেরা করে থাকে এবং ঘরে সেই ভেজা ঠান্ডা পা নিয়ে প্রবেশ করার কারণে তাদের ডিমগুলো সহজেই নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়াও শীত ও বর্ষা কালে প্রাপ্তবয়ষ্ক কবুতর গুলো খুব সহজে চুরি হয়ে যায় অথবা রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে ও অধিক হারে মারা যায়।

অন্যদিকে শহরে কবুতর গুলোর দাম সবচেয়ে বেশি বেড়ে যায় গ্রীষ্ম কালে। কেননা শহরের বেশির ভাগ মানুষ তাদের কবুতর গুলো হারিয়ে ফেলা বা চুরি হওয়ার ভয়ে নিজেদের বদ্ধ ঘরে ছোট আকারের খাঁচায় রেখে পালতে চান। কিন্তু গরম ও স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ায় থাকার কারণে পাখিগুলো সহজে অসুস্থ হয়ে পরে ও মারা যায়। অতএব আপনি কোথায় এবং কোন অবস্থায় রেখে আপনার কবুতর গুলো ফার্ম করে পালার পরিকল্পনা করছেন, সেই ব্যাপারটি এই ব্যবসায় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সেজন্য সব সময়ই ভূমির থেকে যথেষ্ট উঁচু কোন যায়গায় ওদের জন্য বাসা বা খোপ তৈরি করাটা অনেক বেশি নিরাপদ। সব সময় ওদের বাসা গুলো বড় আকারের ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখুন, এছাড়াও ওদেরকে রুক্ষ ও কঠোর আবহাওয়ায় সরাসরি বৃষ্টির পানি অথবা ঠান্ডা বাতাস থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করুন।

কবুতরের খাবার

সাধারণ ভাবে কবুতর গম, ভুট্টা, ধান, চাল, কলাই, শুঁটি, ছোলা এবং সরিষা দানা বা বীজ ইত্যাদি খেয়ে থাকে। ঘরের সামনেই ওদের খাবার কোন পাত্রে রাখুন কিংবা আপনার ছাদ বা উঠানে নিয়মিত সেগুলো ছিটিয়ে দিন। এভাবে ওরা নিজেরাই খাবার সংগ্রহ করতে পারে ও খেয়ে নিতে পারে। স্বাস্থ্যকর গঠন, ভালো স্বাস্থ্য এবং যথাযথ উৎপাদন ক্ষমতার জন্য আপনার উচিত আপনার কবুতরদের বিভিন্ন রকম খাবারের একটি পরিমিত মিশ্রণ তৈরি করে খাওয়ানো। এছাড়াও আপনি চাইলে ওদেরকে নিয়ন্ত্রিত পরিমানে মুরগীর খাবার খাইয়ে দেখতে পারেন, কিন্তু কবুতরের পুষ্টিগত চাহিদা মুরগীর তুলনায় অনেক বেশি। কবুতরের খাবারের মিশ্রণে অন্তত ১৫-১৬% প্রোটিন থাকা উচিত।

প্রতিটি কবুতর দিনে ৩৫ থেকে ৫০ গ্রাম পরিমাণ দানাদার খাবার খেতে পারে। বাচ্চা কবুতর দ্রুত বড় করা এবং পরিণত কবুতরগুলোর সঠিক পুষ্টি নিশ্চিত করার জন্য আপনি ওদেরকে নিয়মিত স্বাভাবিক খাবারে পাশাপাশি ঝিনুকের খোলস, চুনাপাথর, হাড়ের গুড়া, লবণ, গ্রিট মিশ্রণ, মিনারেল মিশ্রণ ইত্যাদি খাওয়াতে পারেন। এ সব কিছুর পাশাপাশি মাঝে মাঝে যদি ওরা পছন্দ করে তাহলে নিয়ম করে ওদের শাক সবজি খাইয়ে দেখতে পারেন। নিয়ন্ত্রিত ব্যালেন্সড কবুতরের খাবারের একটি মিশ্রণে উপাদানের নাম ও পরিমাণ নিম্নে উল্লেখ করা হলো:

খাবার মিশ্রণের উপাদান পরিমাণ (কেজি)
ভাঙা গমভাঙা ভুট্টা

সরিষা

ভাঙা ছোলা

সয়াবিন টুকরো

চাল ও তুষ

লবণ

২.৮ কেজি২.২ কেজি

১.০ কেজি

১.০ কেজি

০.৮ কেজি

১.৮ কেজি

০.৪ কেজি

মোট ১০ কেজি

বাচ্চা কবুতরের খাবার

বাচ্চা কবুতর বা স্কোয়াবের জন্য ৫ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত কোন বিশেষ খাবার দেয়ার প্রয়োজন হয় না। তাদের পিতা মাতার পেটের ভেতর উৎপাদিত ক্রপ মিল্ক বা শস্যদুগ্ধ খেয়েই তারা প্রয়োজনীয় সব রকম পুষ্টি গ্রহণ করতে পারে। এই দুধকে কবুতরের দুধও বলা হয়ে থাকে। স্ত্রী ও পুরুষ উভয় কবুতরই তাদের পেটের মধ্যে প্রক্রিয়াজাত করা উপকরণের সংমিশ্রণ বাচ্চাদের খাইয়ে থাকে প্রায় ১০ দিন পর্যন্ত। এর পর বাচ্চাগুলো যথেষ্ট বলবান হয়ে উঠে এবং উড়তে শিখে। তখন থেকে শুরু করে তারা তাদের নিজেদের জন্য খাবারের মিশ্রণ নিজেরাই সংগ্রহ করে নিতে পারে ও খেতে পারে। সব সময় শুধু খেয়াল করে পরিষ্কার খাবার এবং বিশুদ্ধ পানি ওদের বাসার আশে পাশে কোথাও রাখবেন, তাহলেই যথেষ্ট।

পানি

কবুতর গুলোর বাসার কাছাকাছি একটি বড় আকারের পাত্রে পরিষ্কার পানি ভরে রাখুন। কবুতর ও তাদের বাচ্চারা এই পাত্র থেকে পানি পান করে ও প্রয়োজনে গোসলও সেরে নিতে পারে। নিয়মিত ভাবে এই পানির পাত্রটি পরিষ্কার করুন। সব সময় যথাযথ পরিমানে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করার চেষ্টা করুন।

ডিম উৎপাদন

সাধারণত একটি পুরুষ ও একটি স্ত্রী কবুতর তাদের সমস্ত জীবন জোড়া বেঁধে কাটিয়ে দেয়। তাদের ডিম পাড়ার সময় হলে তারা কাছাকাছি ঘুরে ফিরে খড়কুটো সংগ্রহ করে এবং তাদের খোপের মধ্যে ছোট একটী বাসা তৈরি করে নেয়। স্ত্রী কবুতর ৫ থেকে ৬ মাস বয়স হলেই ডিম পাড়া শুরু করে দেয়। এর পর থেকে তারা প্রতি মাসে একবার দু’টো করে ডিম দিতে পারে। পুরুষ এবং স্ত্রী উভয় কবুতরই তাদের ডিমে পালা বদল করে তাদেয় ও বাচ্চা ফোটানোর চেষ্টা করে। এভাবে কবুতরদের ডিম থেকে বাচ্চা ফুটতে প্রায় ১৮ থেকে ২০ দিনের মত সময় লাগে। মাঝে মাঝে আপনাকে ওদের জন্য কৃত্রিম বাসা তৈরি করে দেয়ার প্রয়োজন মনে হতে পারে, তাই করুন। এছাড়াও মাঝে মাঝে কিছু কবুতর তাদের ডিমে তা দিতে বা ফোটাতে অনীহা করে ও বাইরে ঘোরাঘুরি করতে থাকে। এমতাবস্থায় আপনাকে সেই ডিম গুলো অন্য কবুতর জোড়ার কাছে তা দেয়া ও পালন করার জন্য দিয়ে দিতে হবে। ডিম খাওয়ার চেয়ে স্কোয়াব উৎপাদন অধিক পরিমানে লাভজনক, যেহেতু ডিমের আকৃতি অনেক ছোট হয়ে থাকে।

রোগ বালাই

অন্য যেকোন খামারের পাখির তুলনায় কবুতরের মধ্যে অসুখ বিসুখে পড়ার সম্ভাবনা অনেক কম। কিন্তু মাঝে মাঝে ছোট খাটো কিছু রোগ ওদের স্বাস্থ্যের ব্যাপক ক্ষতি করে ফেলতে পারে এবং ছড়িয়ে দলের অন্য সুস্থ কবুতর গুলোকেও সহজে আক্রান্ত করে ফেলতে পারে। কবুতরের নানা রকম রোগ বালাই হতে পারে, যেমন- টিবি, প্যারাটাইফয়েড, কলেরা, পক্স, রানীক্ষেত, ইনফ্লুয়েঞ্জা ইত্যাদি। তাছাড়াও ওরা বিভিন্ন রকম উকুন ও পরজীবি অথবা বিভিন্ন স্বাস্থ্যহানিকর রোগে আক্রান্ত হতে পারে। কবুতরদের এরকম প্রাণঘাতী রোগ বালাই থেকে দূরে রাখার জন্য আপনি কিছু প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা বা পন্থা আগে থেকেই অবলম্বন করতে পারেন। যেমন:

Exit mobile version