Tuesday, April 29

গল্প : বিধবার ছেলের ঈদ

ফারুক আহম্মেদ জীবন : ফাহিম, শাহিন, তুহিন, মৌ, আর জুঁই একসাথে খেলছিলো ওরা সব। হঠাৎ, তুহিন বললো…এই শাহিন তোর আব্বা-মা ঈদের নতুন জামাকাপড় কিনে দেছে তোর? শাহিন বললো…হুম কিনে দেছে। তোরও কি কিনে দেছে? তুহিন বললো..হুম দেছে। তারপর বললো…মৌ, জুঁই তুরা কিনেছিস?

মৌ, জুঁই বললো…হুম আমার আব্বু আম্মু তো তোদের কেনার আগেই কিনে দেছে। 

তুহিন হেসে বললো…ও তাই খুব ভালো। তারপর ফাহিমের দিকে তাকিয়ে বললো…ফাহিম তোর কিনে দেছে জামাকাপড়..? ফাহিম কি বলবে! মন মরা ভাবে মুখটা নেড়ে বললো…না…। তারপর মুখে হাসি টেনে বললো…আম্মু বলেছে ঈদের আগে কিনে দিবে। তারপর…

ছয় বছরের ছেলে ছোট্ট ফাহিম দৌড়াতে দৌড়াতে ছুটে ওর মায়ের কাছে এলো। ওর মা রহিমা তখন পরের বাসায় ঝিয়ের কাজ করতে যাওয়ার জন্য। ঢাকার মালিবাগ রেললাইনের বস্তির ছোট্ট একটা ঘর থেকে বেরুচ্ছে। পায়রার খোপের মতো ছোট-ছোট সারিবদ্ধ বস্তির ঘর গুলো। ওরা মা, ছেলে, ঐ বস্তির ছোট্ট একটা ঘরটিতে থাকে। ফাহিম এসেই কাঁদতে কাঁদতে ওর মা, রহিমার হাত ধরে বললো..ও মা, মা… সবাই ঈদের নতুন জামা, প্যান্ট,জুতা, টুপি কিনছে। আমার কখন কিনে দিবে মা? ও মা, মা…বলো না…আমরা কখন যাবো মার্কেটে নতুন জামা-কাপড় কিনতে? ঈদ যে এসে গেলো মা..৷ সেমাই চিনি কিনবে না..?

বারবার হাত ধরে ঝাঁকি দিচ্ছে আর কেঁদে কেঁদে 

বলতে লাগলো ফাহিম। চোখের জলে ফাহিমের ওভাবে কান্না করতে দেখে বিধবা রহিমার মাতৃ

হৃদয়টা ডুকরে কেঁদে উঠলো।চোখ দুটো তার ভরে গেলো জলে। রহিমা ছলছল নয়নে আসমানের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো।

হয়তোবা…

সে মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে বললো..প্রভু কেনো তুমি

অকালে আমার স্বামীটাকে আত্মঘাতি করোনায় কেড়ে নিলে? কেনো

আমার ছেলেটাকে তুমি পিতৃহীন এতিম করলে? কেনো আমাদের এতো অভাবি গরীব করলে? যে ছেলেকে ঈদের জন্য এখনো একটা নতুন জামা কিনে দিতে পারলাম না।

তারপর শাড়ির আঁচলে সে দু,চোখের জল মুছে। একটু উবু হয়ে বসে ছেলে ফাহিমকে বুকে টেনে ওর চোখের জল মুছে কান্না জড়িত ধরা গলায় বললো..যাবো বাবা. যাবো..। চিন্তা করিসনে এখনো তো ঈদের দু, তিন দিন বাকি আছে। দেখি, এর মধ্যে কাজের টাকাটা পেলেই কিনে দেবো। তখন ফাহিম বললো…জানো মা…..

মহল্লার আমার খেলার সাথী যারা তুহিন, শাহিন, মৌ, জুঁই ওরা সকলেই ঈদের জামা, প্যান্ট, জুতা কিনেছে। রহিমা বুকভরা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললো…ওদের সবার যে আব্বা বেঁচে আছে বাবা ফাহিম। ওরা ইনকাম করে। আজ যদি তোর বাবা-ও বেঁচে…গলা ধরে এলো। আর কথা বলতে পারলো না৷ ফাহিমকে বুকে জড়িয়ে অঝোরে  কাঁদতে লাগলো রহিমা। ফাহিম ওর মা,র কান্না দেখে। ওর ছোট্ট দুটো কচি হাত দিয়ে ওর মায়ের চোখের জল মুছে দিতে দিতে বললো…তুমি আর কেঁদো না মা, আর কেঁদো না। থাক মা..আমার কোনো নতুন জামা লাগবে না। এ কথা শুনে রহিমা ফাহিমের কপালে মুখে স্নেহের চুম্বন দিয়ে বললো…আমার লক্ষ্মী সোনা ছেলে একটা।

এমন সময় বস্তির অন্য একটি মহিলা আকাশের বউ এসে বললো…. এই ফাহিমের মা….ফাহিমের মা.. ও, যাক তুই দেখছি বাড়ি আছিস! আমি তো সংবাদ-টা শুনেই তোর কাছে ছুটে এসেছি। শুনে রহিমা বললো…কি সংবাদ আপা? তখন আকাশের বউ সুখ তারা বললো….এই আজ ফিতরা দিচ্ছে দৌলত খান। দেরি করলে কিন্তু পাওয়া যাবে না চল…এখুনি যেতে হবে। দৌলত খান প্রতিবছর ঈদের আগে ফিতরা দেয় গরীব-দের মাঝে। খুব দানশীল দয়ালু লোক। এলাকার

মানুষও তাকে বেশ ভালোবাসে ভক্তি শ্রদ্ধা করে।

শুনে রহিমা বললো…কিন্তু আপা আমাকে যে কাজে যেতে হবে। আজ আমার মাসের টাকা দেওয়ার কথা। আকাশের বউ বললো…তাহলে তাড়াতাড়ি আসিস কিন্তু কেমন…। রহিমা বললো..

আচ্ছা ঠিক আছে আপা। আকাশের বউ সুখতারা

চলে গেলো। রহিমা ফাহিমকে বললো…বাবা ফাহিম তুই খেলতে যা…। আমি কাজের থেকে এসে তোকে নিয়ে মার্কেটে জামাকাপড় কিনতে

যাবো। ফাহিম বললো…আচ্ছা ঠিক আছে মা।

তারপর খেলতে চলে গেলো ফাহিম।

রহিমা.কাজ করে বস্তির পাশেই এক ধনী লোকের

বাড়িতে। তাদের বাড়ির গেট খুলে ভিতরে যেতেই

বাড়ির মালিকের বউ বললো…এতো দেরি হলো

কেনো রহিমা? সামনে ঈদ।বাড়িটা একটু পরিস্কার 

পরিচ্ছন্ন করতে হবে।ঈদের দিন বিভিন্ন মেহমানরা আসবে বাড়িতে বুঝলি? রহিমা বললো চিন্তা করবেন না খালা মণি, আমি সবকিছু করে দিচ্ছি।মালিকের বউ বললো আচ্ছা ঠিক আছে একটু

তাড়াতাড়ি কর। রহিমা সারাদিন কাজ করলো..।

কাজ শেষে চলে আসার সময়…রহিমা বললো…

খালা মণি, আমার মাসের কাজের টাকাটা যদি দিতেন।আমার ছেলেটার জন্য একটু কেনাকাটা করতাম। মালিকের বউ বললো…এতো টাকা টাকা করিস কেনো? ঈদ কি পার হয়ে গেছে? যে

কিনতে পারবি-নে? যা- ঈদের আগের দিন নিস।

কাচুমাচু ভাবে কান্না জড়িত কন্ঠে রহিমা বললো.

খালা মণি, আমি আমার ছেলেটাকে বলে এসেছি

আজ ফিরে ওকে নিয়ে জামাকাপড় কিনে দেবো।

তাই বলছিলাম..যদি….টাকাটা…শুনে মালিকের বউ মার মার শব্দে বললো…এই যা-তো, যা। আর

কানের কাছে ঘানর-ঘানর করিসনে। হুম..যত্তসব।

গরীবের আবার ঈদ। রহিমা আর কোনো কথা বলতে পারলো না…। শাড়ির আঁচল মুখে চেঁপে

কাঁদতে কাঁদতে গেট দিয়ে বেরিয়ে এলো। রহিমা

চলে আসতেই মালিক ওর বউকে জিজ্ঞাসা করলো কি ব্যাপার! কাজের মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে ওভাবে চলে গেলো কেনো? মালিকের বউ

বললো…আর বলো না। টাকা টাকা করে পাগল

করে দিচ্ছে। নানান রকম ছুতো দেখাচ্ছে। কনে

ছেলের ঈদের জামা কিনবে আরো কতো কি…। শুনে, মালিক বললো…যাহোক কাজটা তুমি ভালো করোনি। গরীব মানুষ স্বামীটাও মারা গেছে। টাকাতো দিয়ে দিলে পারতে। তারপর মালিক বেরিয়ে গেলো অফিসের কাজে। রহিমা সন্ধ্যার সময় বাড়ি ফিরে ফিতরা আনতে গেলো দৌলত মিয়ার বাড়ি। 

কিন্তু ঐ যে, কথায় আছে না…

অভাগী যেদিকে তাকায় সেদিক শুকিয়ে যায়।

তেমনটাই হয়েছে পোড়াকপালি বিধবা রহিমার বেলায়।

রহিমা যখন দৌলত খানের বাড়িতে পৌঁছালো ততক্ষণে ফিতরার টাকা দেওয়া শেষ হয়ে গেছে।

রহিমা গেটের দারোয়ানের কাছে জিজ্ঞাসা করতে সে বললো… ফিতরা দেওয়া যে শেষ হয়ে গেছে। সন্ধ্যার আগে আসেননি কেনো? 

কি বলবে রহিমা? দু, চোখ জলে ছলছল করে উঠলো রহিমার 

ওর যে, একূল ওকূল দু,কূলেই গেলো। আশাহীন মনে নিরাশার ছাপ এখন রহিমার সারা চোখে মুখে। অত্যন্ত ভারাক্রান্ত ভাঙ্গা মন নিয়ে বাসায় ফিরলো রহিমা সন্ধ্যা ঘোরে।

মাকে আসতে দেখে ফাহিম, ও মা, মা তুমি এসেছ বলেই দৌড়ে এলো ওর মায়ের কাছে। ফাহিমকে ধরে রহিম বললো…আমি পারলাম নারে বাবা।

ঈদে তোকে নতুন জামা প্যান্ট, টুপি কিনে দিতে। তারপর হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো…।

সেসময় পেছন থেকে এক ভদ্রলোক বলে উঠলো

কে বলেছ তুমি পারোনি রহিমা? রহিমা ঘাড় ফিরিয়ে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে সে যে বাড়ি কাজ করে সেই বাড়ির মালিক রহমান। রহমানের

দুই হাতে অনেক বাজার-সদাই। নতুন কাপড়

-চোপড়ের প্যাকেটও আছে।

রহিমা বলে উঠলো খালু জান আপনি। তারপর 

দ্রুত ঘর থেকে বসার জন্য চেয়ার এনে দিলো।

রহমান বসতে বসতে বললো…হুম আমি। তুমি ওভাবে আমার বাড়ি থেকে কাঁদতে কাঁদতে চলে আসার পর আমি সব শুনেছি।তুমি আমার মেয়ের মতো মা। তোমার খালা তোমার সাথে অন্যায় করেছে। তুমি তাকে ক্ষমা করে দাও মা। এই নাও

এতে তোমার শাড়ি আর তোমার ছেলের জন্য ঈদের নতুন জামা, প্যান্ট, টুপি, জুতা আর সেমাই চিনি কিছু বাজার-সদাই আছে। রহিমা বললো…

কিন্তু খালুজান…। রহমান বললো আর কোনো কিন্তু নয় মা, গরীবের চোখে জল ঝরিয়ে কি ঈদ আনন্দ করা যায় মা?  নাও ধরো মা। সেসময় রহমানের স্ত্রী এসে বললো তুমি ঠিক বলেছ স্বর্ণার

আব্বু। রহমান বললো…তুমি? স্বার্ণার মা রত্না বললো… হুম আমি। আসলে রহিমার সাথে অমন ব্যবহার করে আমি নিজেই কষ্ট পেয়েছি। তাই…

কিন্তু এসে দেখি তুমি আমার আগেই এখানে। নে..

মা রহিমা, তোর খালুর হাত থেকে প্যাকেট গুলো নে রহিমা রহমানের হাত থেকে প্যাকেট গুলো নিলো। সেসময় পিছন থেকে দৌলত খান বললো.

আসলে কথায় আছে না…

 যার কেউ থাকেনা তার আল্লাহ থাকে। রহিমা দৌলত খানকে দেখে বললো…চাচাজান আপনি?

দৌলত খান বললো…হুম আমি মা, দারোয়ানের

মুখে শুনলাম তুমি কাঁদতে কাঁদতে চলে এসেছ। তাই না এসে আর থাকতে পারলাম না। তারপর

সে কিছু টাকা দিয়ে বললো…এই নাও মা, ঈদে

মাংস কিনে তোমার ছেলে আর তুমি পেট ভরে খেও কেমন।

রহিমা কাঁদছে। দৌলত খান বললো কাঁদছো কেনো মা রহিমা? রহিমা বললো এটা দুঃখের নয়

চাচাজান খুশির কান্না। এই অভাগীর প্রতি আপনার দয়া দেখে। তারপর বললো…আল্লাহ আপনাদের সবাইকে যেনো ভালো করেন। আমার এতিম ছেলের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ আপনাদের এর প্রতিদান দিবেন। রহমান বললো..কি ভাই ফাহিম তুমি খুশি তো? ফাহিম নতুন জামাকাপড় হাতে নিয়ে হেসে বললো…হুম খুব খুশি। আপনারা সকলে অনেক

ভালো। তাহলে থাকো ফাহিম আমরা আসি বলে..

সকলে চলে গেলো বিদায় নিয়ে। তার দু,দিন পর নতুন জামা-কাপড় পরে সেমাই, মিষ্টি, মাংস, ভাত খেয়ে বেশ হাসি-খুশি   আনন্দের সাথে ঈদ কাটলো বিধবা রহিমা আর তার ছোট্ট ছেলে ফাহিমের।

২৭/৩/২০২৫

নারাংগালী ঝিকরগাছা যশোর বাংলাদেশ। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!