Sunday, June 4
Shadow

ধ্রুব নীলের পরাবাস্তব হরর গল্প : টোপ 

ধ্রুব নীলের আধিভৌতিক পরাবাস্তব হরর গল্প টোপ 

ধ্রুব নীলের হরর গল্প

‘আপনারে একটা জিনিস দেখাব। ভয়ানক জিনিস।’
ধীরে, গুছিয়ে ও তাগাদা চাপা দেওয়ার কৃত্রিম চেষ্টা করে কথাটা বলল লোকটা। মুখে চওড়া হাসি টেনে বোঝানোর চেষ্টা করছে, কথাটা শুনে যেন গ্রামে বেড়াতে আসা খ্যাতনামা অভিনেতা অরিন্দম চক্রবর্তী তাকে পাগল না ভেবে বসে। যদিও এমনটা ভাবার বিশেষ কারণ ছিল না এবং লোকটার গায়ের ছেঁড়া চাদর ও উঁচু-নিচু হয়ে থাকা প্যান্ট দেখে যে তাকে উদ্ভটই ভাবতে হবে, এমন কথা নেই।
‘জি দেখব।’
লোকটা আরও বিনয়ী হওয়ার চেষ্টা করল এবং এ কাজে চওড়া কৃত্রিম হাসিই যেন একমাত্র সম্বল। সে চাইলে চাদরটা আরও শক্ত করে জড়িয়ে, হাত ঘষাঘষি করে মাথা নিচু করে এবং অকারণে পাখির ডাকের মতো শব্দ করে থুথু ফেলে পরিবেশ পাল্টে দিতে পারে মুহূর্তে। কিন্তু অরিন্দম চক্রবর্তীর কথার কোনে লুকিয়ে থাকা শ্লেষটা ধরতে পারল না। কোথায় কখন আসতে হবে, তা না জেনেই ‘যাবে’ বলেছে অরিন্দম। অবশ্য কোথায় আসতে হবে সেটা না জানিয়ে লোকটা নড়বে না।
অরিন্দম মন দিল তার বড়শিতে। মনে হলো, নিজেকে এক মুহূর্তের জন্য মাছের জায়গায় কল্পনা করে দেখা যাক না।
‘আপনার মাতাল প্রেম সিনেমাটা আমি দেখসি।’
অরিন্দম কল্পনায় সবে টোপটা দেখেছিল। অবশ্য মাছের মগজ সেটাকে টোপ হিসেবে দেখবে না। দেখবে প্রতিদিনকার খাবার হিসেবে। যেটা তার চা-ই। হোক না তাতে মৃত্যু। কিংবা মৃত্যু জেনেও এগিয়ে যেতে হবে টোপের দিকে।
‘কী যেন বলছিলেন? মাতাল প্রেম? ওহ। হ্যাঁ। স্রেফ টাকার জন্য কাজটা করেছি। ওতে কোনো কাহিনি নেই। সব ছাইপাশ।’
‘আপনার ডায়ালগগুলা আমার মনে ধরসে। মরার আগে প্রেমিকারে বলতেছিলেন, আমি তোমারে ভালোবাসার চাইতেও ভালোবাসি।’
অরিন্দম হাসল। সরাসরি লোকটার দিকে তাকিয়ে নয়, চোখ ফাতনার দিকে। সামান্য নড়ল কি। কল্পনার জগত ঝেড়েমুছে বলল,
‘চিত্রনাট্য যে লিখেছে ওই ব্যাটা নির্ঘাৎ কারও উক্তি মেরে দিয়েছে বুঝলেন। ডায়ালগটা ছিল এমন, আমরা এমন প্রেমে মজেছিলাম যা প্রেমের চেয়েও বেশি।’
‘ঠিক ঠিক। আমার বিষয়টাও অনেকটা এই রকম।’
অরিন্দম শ্বাস ছেড়ে নিজেকে বোঝাল, লোকটা সহজে যাচ্ছে না। গ্রামে থাকা ছেঁড়া চাদর গায়ে ভরদুপুরে ঘুরে বেড়ানো লোকগুলোর বোধহয় কোনো কাজ থাকে না, এমনটা ভেবে অরিন্দম ইশারায় তাকে বসতে বলল। লোকটা বসল না। তার সংকোচ কেটে গেল এবং স্বাভাবিক উত্তেজিত স্বরে বলল, ‘আপনি যেটা সিনেমায় বলেছেন, আমি সেটা করে দেখাইসি। আমি আমার বউকে প্রেমের চাইতেও বেশি ভালোবাসি। সেটার প্রমাণ আছে আমার কাছে। আপনি চাইলে সেটা দেখতে পারেন।’
লোকটার কণ্ঠের ওঠা-নামা কিংবা বসন্তের শুরুতে আচমকা এক ঝলক মন বিষণ্ন করে দেওয়ার মতো শীতল বাতাস অথবা ভরদুপুরের গোলমেলে নিস্তব্ধতা; কোনো একটা কারণে অরিন্দম এবার তার কৃত্রিমতা ঝেড়ে মুখ খানকিটা হা করে তাকাল।
‘কী দেখাইবেন?’
‘আমার বউয়ের কবর।’ এরপর উপযুক্ত শব্দ কিংবা বাক্যের অভাবে লোকটা কিছুক্ষণ শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকল নড়তে থাকা ফাতনার দিকে। সেই দৃষ্টিতে নেই টোপ গেলা মাছের জন্য মায়া। আছে কেবল একরাশ শূন্যতা, বিষণ্নতা।
শব্দটি শুনেই অরিন্দমের মস্তিষ্কের ডিফেন্স মেকানিজম মুহূর্তে সক্রিয় হয়ে উঠল। মগজ সতর্কবার্তা দিল, নিজেকে বাঁচাতে হবে। সাঁতার জানা সত্ত্বেও পুকুরের কাছাকাছি থাকার কারণে অরিন্দম নিজেকে অনিরাপদ মনে করল এবং ঠিক ওই মুহূর্তেই বড়শিতে টান অনুভব করার পর নিজেকে মাছের জায়গায় আবার কল্পনা করে বসল। এসব চিন্তাভাবনা দ্রুতই ঘটল এবং সেকেন্ডের মধ্যে আবার নিজেকে সামলে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল এবং আড়মোড়া ভাঙল।
লোকটা অরিন্দমের দিকে সরাসরি তাকাচ্ছে না। কারণ সে বুঝতে পেরেছে, খাপছাড়া কিছু কথা বলে অভিনেতাকে সে ইতোমধ্যেই রাগিয়ে দিয়েছে বা ভয় পাইয়ে দিয়েছে। অরিন্দম যে এক ফাঁকে তার চাদরের তলায় চকচকে কিছু উঁকি দিচ্ছে কিনা, সেটা পরখ করেছে, সেটাও চোখ এড়াল না লোকটার। তাই এবার সে নিজেকে আরও গুছিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে বলল-
‘এবার দেখবেন আসল প্রেমের ভেলকি। সিনেমার নকল প্রেম না।’
মাছের টানে ভেসে যাওয়া বড়শিটা দেখে অরিন্দম খানিকটা স্বস্তি পেল। টোপ গেলা মাছের মতো তার দম আটকে আসছিল।
‘কখন.. কোথায় যেতে হবে?’
‘দিনে দুপুরে না। রাইতে আওন লাগবো। গভীর রাইতে।’
অরিন্দম বুঝল লোকটার মতলব ভিন্ন। যে কিনা তাকে সস্তা ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করছে। অবশ্য পাগলও হতে পারে। গভীর রাতে গ্রামের গোরস্থানে গিয়ে অরিন্দমের মতো তারকা অভিনেতা স্বেচ্ছায় অপহৃত হতে চাইবে, এমনটা ভাববে কেন লোকটা। আবার যদি সে মতলববাজ না হয়, তবে হয়তো কোনো সস্তা জাদু দেখিয়ে অরিন্দমকে চমকে দেওয়ার চেষ্টা করবে এবং এরপর গড়গড় করে পরিবারের কারও অসুস্থতার বয়ান করে টাকা-পয়সা চাইবে।
‘আপনি ডরাইতেসেন?’
‘জি না। এখন ভয় পাচ্ছি না। তবে গভীর রাতে আপনার সঙ্গে কোথাও যাওয়ার মতো বোকামি আমি করব না।’
লোকটা সহজে ধরাশায়ী হবে ভাবেনি হয়তো। অস্থির দেখাল কিছুটা। অস্বস্তিতে পড়ল। চাইলেও হাসতে পারছে না। অহেতুক বিনয়টাও দেখাতে পারছে না। যেন বলতে চাইছে- ইচ্ছা হলে আসেন, না হলে মিস করবেন। কিন্তু সেটা বলার আগেই… এক ঝলক হাওয়া এসে নাড়িয়ে দিল দুজনকে। লোকটার চাদর পড়ে যেতেই চমকে উঠল অরিন্দম। এক হাত নেই লোকটার। গোড়া থেকেই নেই। দেখে আচমকা মনে হবে একটা অদৃশ্য হাত ঝুলছে ওই কাটা অংশ থেকে। এক হাতে চাদর পেঁচিয়ে নেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করল লোকটা। তারপর আশা ছেড়ে দিয়ে সেটাকে এক দলা পাকিয়ে তড়িঘড়ি বলল-
‘দেখতে চাইলে রাত বারোটার পরে এই ঘাটে আসবেন। সাথে টর্চ আনবেন। আপনি তো আবার শহরের মানুষ।’
আবারও কথার ফাঁদ ছোড়ার চেষ্টা। অরিন্দমকে শহুরে মানব বলে খেপিয়ে তুললেই যেন সে রাজি হয়ে যাবে।
রাতের আহার ও আতিথ্যের আতিশয্য; কিছুই অরিন্দমের মনযোগ সরাতে পারল না। এমনকি ঢাকায় থাকা প্রেয়সীর সঙ্গে দুয়েকবার ফোনে আলাপ করেও লোকটার কাটা কিন্তু অদৃশ্য হাতটা ফেরাতে পারল না মানসপট থেকে। সত্যি বলতে কি, অরিন্দম লোকটার চেহারা ভুলে গেছে এরই মধ্যে। শুধু মনে আচ্ছে অনেক দিনের জট পাকানো কোঁকড়া চুল, গালভর্তি দাঁড়ি-গোঁফ আর বয়সটা পঞ্চাশ হবে হয়তো।
অরিন্দমের মনের তোলপাড় ধরা পড়ল না বাড়ির লোকজনের চোখে। তাই অরিন্দম অবচেতনে বুঝতে পারল, তাকে যেতেই হবে মধ্যরাতে, কাউকে জানানো চলবে না।
কয়েকবার মাথায় এলো বিক্ষিপ্ত প্রশ্নগুলো, লোকটা তাকেই কেন নিয়ে যেতে চায় গোরস্থানে? গ্রামের অন্য কাউকে সে কি একই কথা বলেছে? নাকি শহর থেকে বেড়াতে এসেছে বলে অরিন্দমকে সে নিরাপদ ভাবছে। কেন ভাববে?

ধ্রুব নীলের আধিভৌতিক পরাবাস্তব হরর গল্প টোপ 

বাড়ির সীমানা পেরোতে সময় লাগল না। যেন কতবার এভাবে মধ্যরাতে বাগানটাকে পাশ কাটিয়ে মেঠোপথে টর্চ হাতে হেঁটে বেড়িয়েছে অরিন্দম। প্রথমে নিজেকে বলল, সে রাতে খাওয়ার পর গ্রাম ঘুরে দেখবে। বসন্তের বাতাস গায়ে মাখবে। অবচেতনে যে লোকটার কথামতোই সে চলতে শুরু করেছে, সেটা টের পেলেও আপাতত নিজের কাছে গোপন রাখল বিষয়টা।
টর্চের আলোয় চকচকে শেয়ালের চোখ। লাইটার জাতীয় কিছু আনা উচিত ছিল? শেয়ালেরা কীসে ভয় পায়?
‘আগুন। আহ আগুন।’
বিড় বিড় করে এমন আরও অহেতুক শব্দ ও আগের মুখস্থ করা সংলাপ আওড়ে এগিয়ে চলল অরিন্দম। পুকুর ঘাটটা এখন অচেনা। সারাদিন টোপ মুখে ঘুরে বেড়ানো মাছটা কি অন্ধকার পুকুরে সাঁতরে বেড়াচ্ছে? ‘ওহ.., ওটার জায়গায় নিজেকে কল্পনা করতে গিয়ে মুখ ফুটে অস্ফূট শব্দ। শিউরে উঠল অরিন্দম। দ্রুত সরে এলো ভাবনা থেকে।
মৃদু বাতাস বয়ে আনছে অচেনা ঘ্রাণ। হাসনাহেনার অনেকগুলো জাত আছে কিনা, প্রশ্নটার উত্তর জানা নেই। পুকুরের ওপারে জংলায় অনেক ফুল। দিনে সেভাবে চোখে পড়েনি। এখন ঘাটে বসে টর্চ জ¦ালিয়ে দেখছে।
যেন কেটে গেল কয়েক যুগ। অরিন্দমের চোখ পুকুরে। টর্চ নিভিয়ে রেখেছে। রাতের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যাওয়ার খেলা চলছে মনের ভেতর। তারপর বাতাসে কিছু ওড়ার শব্দ। সচকিত হেঁটে আসার সঙ্গে শুকনো পাতা মাড়ানো। তাকাল না অরিন্দম, যতক্ষণ না সে শুনল-
‘চলেন।’
লোকটার গায়ে এখন চাদর নেই। যেখানে তার একটি পরিপূর্ণ হাত থাকার কথা, শরীরের সেই স্থান দিয়ে হালকা চাঁদের আলো এসে পড়ল অরিন্দমের গায়ে। এরপর অনেকক্ষণের জন্য চাঁদ ঢাকা পড়ল মেঘের আড়ালে।
‘ঠিক আছে। চলুন।’
নিশুতি রাতে মগজের নিরাপত্তা কৌশলও ঘুমিয়ে পড়ে? আর তবে ফেরার উপায় নেই? এখন লোকটাই ঠিক করে দেবে অরিন্দমের গন্তব্য? যদিও দুজনই জানে তারা যাচ্ছে পুরোনো শ্যাওলা পড়া ভাঙাচোরা নামফলকওয়ালা এক গোরস্থানে।
ওই যে শেয়াল। একটার লেজ কামড়ে আছে আরেকটা। ওরাও জানে মধ্যরাতে দুই আগন্তুকের গন্তব্য?
‘বাতাস আসতেসে। দক্ষিণা বাতাস। ধরে রাখেন শক্ত করে।’
অরিন্দম কীসের সাথে নিজেকে ধরে রাখবে? বাতাস আসছে বটে। হু হু করে কানের পাশ দিয়ে যাচ্ছে আর ঠিক যেন হাসছে। হা হা হা হাশশশ। লোকটার শার্টের একটা হাতা নেই। তা না হলে বাতাসে সেটা অস্বাভাবিক দোল খেত। দৃশ্যটা বাস্তবে না ঘটলে, কল্পনায় তা ঠিকই দেখছে অরিন্দম।
পথে আর কথা হলো না। লোকটা তার সঙ্গীর দিকে তাকাচ্ছেও না। তাকালেই যেন অরিন্দম ভয় পেয়ে ফিরতি পথ ধরবে। অরিন্দম কি চাইলেই ফিরতে পারবে? পথ চিনবে? বনজুঁইয়ের জংলা, বেতের ঝোপ আর ডোবানালার পাড়ে থাকা আচমকা গজিয়ে ওঠা জোনাকি চত্বর পেরিয়ে কোন সুদূরে তারা চলল সেটা কারোরই বোধহয় জানার কথা নয়। মাটির সোঁদা গন্ধ নাকে এসে শব্দটা আবার মনে করিয়ে দিল অরিন্দমকে… কবর। শ্মশানঘাটে অনেক গিয়েছে। তবে গোর তার কাছে আতঙ্কের নাম। সম্ভবত শুধু এই মুহূর্তগুলোর জন্যই আতঙ্কের। ঠিক যেমন টোপ গেলার পরমুহূর্তে…।
অরিন্দম জোর করে মাছ সংক্রান্ত ভাবনা তাড়াল এই ভেবে যে, স্বেচ্ছায় বিপদে জড়ালে জীবনের আসল স্বাদ পাওয়া যায় না। তাই বলে জীবনের চরম তৃপ্তিময় সেই স্বাদ মৃত্যুতেই লুকিয়ে? অরিন্দম বুঝতে পারল রাতে খানিকটা যে মদ পান করেছে, সেটার ঘোর এখনো লেগে আছে।
লোকটা সামনে, অরিন্দম পেছনে। পিছলে পড়ে টর্চ পড়ে গেল একটা পানিভর্তি গর্তে। বারকয়েক ঝাঁকি দিয়ে বুঝল কাজ হবে না। ওটা ফেলেই এগিয়ে চলল।

ধ্রুব নীলের আধিভৌতিক পরাবাস্তব হরর গল্প টোপ 

সামনে একটা বড় টিলা। নাহ, চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারল জায়গাটা খাড়া হয়ে উঁচু একটা সমতল জঙ্গলে উঠেছে। ঘুরপথে উপরে উঠতে গেলে খাল পার হতে হবে। তাই দুই মানুষের সমান যে ঢালটা দাঁড়িয়ে আছে সামনে সেটা বেয়েই ওপারে যেতে হবে দুই অভিযাত্রিককে।
‘ঢাল পিছলা। ঝোপটোপের গোড়া ধইরা রাখবেন। পা পিছলাইলেও গোড়া ছাড়বেন না।’
ঝোপঝাড়ের গোড়া চেপে মাঝামাঝি উঠল অরিন্দম। নিঃশ^াস দূরত্বে থাকা এবড়োখেবড়ো মাটির দেয়ালটা আঠার মতো তাকে আটকে রাখতে চাচ্ছে। সেই দেয়াল থেকে খসে খসে পড়ছে অনেক দিনের পুরোনো মাটি। ভেতর থেকে একটা কিছু বেরিয়ে আসার সময় যেমনটা হয়। চোখের সামনেই মাটি ফুঁড়ে সাদা ওটা কী… পা পিছলে গেল অরিন্দমের। গড়িয়ে পড়ল নিচের নালায়। পড়েই রইল। এক হাতে তাকে ধরে টেনে তোলার উপায় নেই লোকটার। তার সেই ইচ্ছেও নেই বোধহয়। একরাশ বিরক্ত নিয়ে দেখছে অরিন্দমের উবু হয়ে পড়ে থাকার দৃশ্য।
বাতাস বেড়ে চলেছে। ঈষৎ ভেজা মাটির গন্ধ সড়াৎ করে নাকে ঢুকতেই অরিন্দমের মনে হলো মৃত্যুর শীতলতা তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। ছিপের অদৃশ্য সুতোয় জড়িয়ে যাচ্ছে গা। বুকে চেপে ধরে আছে একটা আঁকশি।

ধ্রুব নীলের আধিভৌতিক পরাবাস্তব হরর গল্প টোপ 

‘উঠেন। চলেন।’
অরিন্দমের শার্ট আটকে গেছে। হুকের মতো একটা কিছু। জীবিত হুক। বুকের কাছে হাত দিয়ে দেখল বড়শির চেয়ে খানিকটা চওড়া। তবে স্পর্শে মনে হলো ভঙ্গুর। বস্তুটা নড়ে উঠতেই শিউরে উঠে ছেড়ে দিল অরিন্দম। তবে নিজেকে ছাড়াতে পারল না শতচেষ্টাতেও। লোকটাও একহাতে টানতে টানতে হয়রান। অরিন্দমের মনে পড়ল ডেইজির কথা। শহরের নরম ঘুম-বিছানাটার কথা। আর কি তবে ফেরা হবে না প্রেমিকার কাছে।
‘কীসে আটকাইছেন? ঝামেলা হইল দেখি।’
‘ঝামেলা হবে কেন! কীসের ঝামেলা!’
আচমকা বাতাসের শব্দ দপ করে নিভে গেল যেন। ধীরে ধীরে উবে গেল জাগতিক সব শব্দ। আক্ষরিক অর্থেই নিস্তব্ধ সব। কানের কাছে বাজতে থাকা ঝিঁ ঝিঁ পোকারাও থমথমে। গাছের পাতাও নড়ছে না কার জানি ভয়ে। নিজের হৃদস্পন্দন শুনতে পেল অরিন্দম। কানের পাশ দিয়ে শিরা বেয়ে রক্ত গড়িয়ে চলার শব্দটাও। নালার চিকন পানির ঝিরির শব্দ বাড়ি খাচ্ছে বিশাল স্রোতের মতো। ঠিক এ সময়ই শার্টের কাছে মট মট শব্দ করে আটকে থাকা হুকটার শব্দটাও শুনলো পরিষ্কার। মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা একটা কিছু অরিন্দমকে আরও টেনে নিতে চাইছে ভেতরের দিকে।
‘সরেন তো। দেখি। ওহ! তাইলে এই বিষয়।’
‘কী! কী ওটা! কী বিষয়!’
‘ডরাইয়েন না। আপনারে মরণের শিকলে ধরসে। টান দিয়া নিজের কাছে নিতে চায় ওরা।’
‘কারা!’
অরিন্দম টের পেল এই প্রথম ভয়ে তার গলা কাঁপছে। এখন আর লোকটার কাছে নিজেকে সাহসী প্রমাণ করারও তাগাদা বোধ করল না।
‘টেনে তোলো আমাকে! কী বিষয়! কে টেনে নিয়ে যেতে চায়!’
‘এইখানে পুরানা কব্বর অনেক। কোনো একটা লাশের আঙুলে আপনের শার্ট খামচাইয়া ধরসে। তেমন কিছু না। আমারে মাঝে মইদ্যে টানাটানি করে। নিতে পারে না।’
‘টেনে তোলো! টেনে তোলো! টেনে তোলো!’ অরিন্দম বুঝতে পারল, তার মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না। চিৎকারটা বাজছে মাথার ভেতর।
মরণফাঁস ছুটল অনন্তকাল পর। এরপর অদৃশ্য শক্তিতে ভর করে হুড়মুড় করে অরিন্দম উঠে এলো উঁচু জায়গাটায়। দাঁতরাঙা ফুলগুলো ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল তাকে। কাকমারি আর তেঁতুল কড়ই গাছের ঝোপ পেরোতেই ক্ষত টের পেল পায়ে। রক্তের ফোঁটা মুহূর্তে শুষে নিচ্ছে মাটি। এক হাত না থাকা লোকটার ওপরও ধকল গেছে বেশ। অরিন্দমের নাক থেকে বোঁটকা গন্ধটা যায়নি তখনো। হড় হড় করে বমি করল। বিরক্ত হলেও কিছু বলল না লোকটা।

ধ্রুব নীলের আধিভৌতিক পরাবাস্তব হরর গল্প টোপ 

‘চলুন এবার। আর কতদূর।’
‘ওই তো সামনে।’
এরপর আরও কয়েকটা অনন্তকাল হাঁটল দুজন। বাতাসের বেগ বেড়েছে। চাঁদের আলো একবার আসছে, আবার নিভছে। এরপর অনেকক্ষণ আর দেখা নেই। ঝিঁঝিঁর ডাক, সরীসৃপের সরসর হেঁটে চলা; এসব অনুসরণ করে এগুলো দুজন।
সামনে একটা ঘর। গোরস্থানের ওপরই। এর মাঝে কত অচেনা সমাধি মাড়িয়ে এলো দুজন। মাঝে কয়েকবার পায়ে কিছু একটা পেঁচিয়ে ধরলেও না তাকিয়ে ঝাড়া দিয়ে বেরিয়ে এসেছে অরিন্দম। দূরের ঘরটায় মিটমিটে হারিকেনের আলো। সেটাই ঠিক করে দিল গন্তব্য।
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই অরিন্দমের মনে পড়ল তাদের অভিযানের লক্ষ্যের কথা।
‘আমাদের একটা কবর দেখার কথা ছিল।’
‘জি, আমরা এসেছি। কবরেই এসেছি। এই ঘরটাই কবর। বিছানায় বসেন। মাঝে পা দিয়েন না। ওই যে দেখতাসেন, মাটি সরাইলেই আমার বউ…।’
‘ওহ।’
একপাশে একটা কলসি দেখলেও পানের ইচ্ছে হলো না অরিন্দমের। গলায় এক পুকুর তৃষ্ণা।
লোকটা এক হাতে টুকটাক কাজ করে যাচ্ছে। মনোযোগ দিতে গিয়েও পারল না অরিন্দম। তার চোখ মেঝেতে। খোঁড়াখুঁড়ির দাগ স্পষ্ট। গভীর নয়। এক হাত দিয়ে লোকটা আর কতই বা খুঁড়বে।
এরপর হারিকেনটা মাঝে রেখে লোকটা কোদাল দিয়ে মাটি সরাতে লাগলো। অরিন্দমের মনে হলো মাটি যতই সরছে ততই আবার ফিরে আসছে বিভীষিকাময় সেই নীরবতা। একটু একটু করে চুপ হচ্ছে পৃথিবীটা। খানিক পর আবার সে শুনতে পাবে নিজের ঘাড় ঘোরানোর ম্যাড়ম্যাড়ে শব্দটা। নড়লেই কটমট করে উঠবে শরীরের প্রতিটি হাড়।
মাটি সরে গেল। ফুটে উঠল কাঠের পাটাতনের অবয়ব। চোখের ভুল না হলে পাটাতন কিংবা হাতে বানানো কফিনের ডালাটা তির তির করে কাঁপতে শুরু করল। কম্পনের গতি বেড়ে চলেছে প্রতি সেকেন্ডে। এরপর শুরু হলো ঝাঁকি। সরে গেল লোকটা। এক হাতে কোদাল ধরে ভারসাম্য রাখল নিজের। পড়ে গেলেই যেন মৃত্যু নিশ্চিত।
‘কী! কী ওখানে! বলুন আমাকে! কী রেখেছেন ওখানে! কী বেরিয়ে আসতে চাইছে!’
লোকটা কাতর চোখে তাকাল। এবার বুঝি সে অসহায়। হাল ছেড়ে দিতে চাইছে অরিন্দমের হাতে। ইশারায় কাঠের বাকশোটা দেখিয়ে বলল-
‘বিন্তি! এটাই বিন্তির কবর।’
‘না!’
অরিন্দম ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। ভীতিকর নীরবতা কান দুটোকে যেন কয়েক মণ ভারী করে তুলেছে। একটু পর দারুণ এক টানে আবার ঢুকল বিভীষিকাময় ঘরটায়।
‘বসেন অরিন্দম সাহেব। কাহিনিটা শোনেন।’
অরিন্দম ছুটে গিয়ে মাটির কলসি থেকে ঢক ঢক করে পানি গিলল। তৃষ্ণা গেল না তবু। কাঠের পাটাতনটা এখন শান্ত। কেউ সেখান থেকে উন্মাদের মতো বের হতে চাইছে না কিছু।
অরিন্দম বিছানায় বসল। ধাতস্ত হওয়ার ভাণ করল।
‘অনেক অসুখ ছিল বিন্তির। ডাক্তার কইল বাঁচবো না। আমি তো বিশ^াস করি নাই। নিম গাছের ডাইল আইনা রাখতাম তার বিছানার তলে। পুরান গোরস্থানের মাটি, কালি পেঁচার রক্ত, আরও কত কী। এক তান্ত্রিক আইলো একদিন। কইল, আমি চাইলে বিন্তিরে আজীবন বাঁচাইয়া রাখতে পারুম। কুনোদিন মরবো না। কুনোদিনও না।’
‘তারপর? তান্ত্রিক বিনিময়ে কী নিল?’
‘কোনো টাকা-পয়সা নেয় নাই। কিচ্ছু না। সে আমারে একটা মন্ত্র আর কিছু জিনিস শিখাইয়া দিয়া চইলা গেল। তারে আমি আর দেখি নাই। চিকুনচাকুন মুখওয়ালা তান্ত্রিক। বড়ই তাজ্জব লোক। তবে খুউব জানে।’
কপাটহীন জানালার ফাঁক দিয়ে আগের সেই খেপা বাতাস ছুটে এসে পুরোনো ধুলোর মতো উড়িয়ে নিয়ে গেল অরিন্দমের সঞ্চিত সাহস। ভাওতাবাজি বলে তান্ত্রিকের কথা সে উড়িয়ে দিতে পারল না। কারণ লোকটার স্ত্রীর অমরত্বের বিনিময়ে তান্ত্রিক নিয়ে গেছে শুধু একরাশ বিশ্বাস।
‘তান্ত্রিকের কথামতো সব করলাম।’
‘কী সেটা?’
লোকটা কিছু বলল না। অদৃশ্য কাটা হাতের দিকে এক পলক তাকিয়ে ঝট করে আবার অন্যদিকে চোখ ফেরাল। এই মুহূর্তেই অরিন্দমের মগজের অলিগলিতে ভিড় জমাল বীভৎস সব দৃশ্য।
‘তারপর বিন্তিরে আমি কবর দিলাম।’
‘মরেই গেল?’
‘না।’
‘মানে!’
‘যেটা হওনের ছিল, সেটাই।’
‘আমি কিছুই ভাবছি না! মাথা কাজ করছে না।’
‘বিন্তি তখনও পুরা মরে নাই। তবে আল্লাহর কসম ভাইজান, আমি জানি দুনিয়ার আর কোনো ডাক্তার, কোনো ওষুধ তারে বাঁচাইতে পারবো না।’
‘তান্ত্রিক এমনটা বলেছে?’
মাথা নাড়ল লোকটা।
বৈশাখ শুরুর আগেই বাতাসের শিকল ছিঁড়ে গেছে। খানিক দম নিয়ে নিয়ে ছুটছে পথহারা দানবের মতো। আশপাশের ঘুমিয়ে থাকা এটা সেটা জেগে উঠছে বাতাসের ধাক্কায়। কটমট করে উঠল একটা বাঁশের কাঠামো। দানব শিলকড়ইটাও তাতে সায় দিল। তবে ঘরটা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। প্রকৃতির এই উন্মত্ততার মাঝে তাকে পাহারা দিতে হবে একটা কবর। আধো নিকষ আধো আলোর এই খেপা বাতাসের রাতে অরিন্দমের নিজের কানে প্রশ্নটা শোনাল বেঢপ। কারণ উত্তরটা ততক্ষণে প্রকৃতির জানা হয়ে গেছে।
‘বিন্তিকে জ্যান্ত কবর দিলেন?’
‘নাহ!’
ভেতরের আর্তনাদ হয়ে ভেসে এলো কথাটা। লোকটার কণ্ঠনালী বেয়ে আরও কয়েকবার ‘না না’ শোনার পর সেটা পক্ষান্তরে ‘হ্যাঁ’ হয়ে গেল। তারপর বাতাসের সঙ্গে যুদ্ধ করে যে কথাগুলো শোনা গেল,
‘বিন্তির অনেক খিদা। আমি বান্ধা পড়লাম তার প্রেমের জালে। বিন্তির অনেক খিদা। অনেক। আমি তারে অনেক ভালোবাসি। না খাইলে সে বাঁচবে না। সে বাইর হইয়া পড়বে। তখন বিপদ। মহা বিপদ। আমিই তার ভরসা।’
আগের সেই ভীতিকর নীরবতা নেমে এলে শেষের দিকে শব্দগুলো শুনতে পেত অরিন্দম। অগত্যা কৌতুহল আবারও এক বিন্দুতে ফিরে এলো।
‘বিন্তি! বিন্তি কি তবে…।’
‘ওই তো। একটু বাদে উইঠা আসবে। কিন্তু.. কিন্তু…।’
অরিন্দমের মনে হলো এতদিন তার নিজের হয়ে থাকা অঙ্গগুলো এখন আর তার নেই। নিজেকে নির্ভার মনে হওয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে যেন। খসে পড়ছে হাত, পা। শরীরটাই যেন যত ভয়ের গোড়া। শরীর নেই তো ভয় কীসের। নিজে অশরীরি হয়ে গেলে আর ভয় নেই, ভয় নেই। মনের সঙ্গে শুরু হলো এক আধিভৌতিক যুদ্ধ। তির তির করে ফের কাঁপতে শুরু করল কফিনের ডালা। এরপর শুরু হলো ঝাঁকি। বাকশোটার ডালা উড়ে যাবে যেকোনো মুহূর্তে।
‘কিন্তু কী!’
‘আমি আর বিন্তিরে খাইতে দিতে পারুম না।’
‘বিন্তি কী.. কী খায়!’
‘অনেক খিদা। সে আরও চায়।’
জ্যান্ত বাকশোটার ডালা কি লোকটা খুলে দেবে না? ওই ডালা ভেঙে গেলে আবার নিজের মরে যাওয়া স্ত্রীকে আটকাবে কী করে?
অরিন্দম বুঝতে পারল পুকুরের বড়শি গেলা মাছটা মরে যাচ্ছে। ওটা তাকে এক ধরনের সংকেত দিচ্ছিল ক্রমাগত। সম্ভবত মানুষ আর মাছে মিল আছে বলেই। সর্বনাশা কৌতুহল যে একটা মস্ত বড় টোপ, এটা বুঝতে পেরেও টোপ গিলেছে অরিন্দম।
লোকটা একছুটে বেরিয়ে গেল। বাইরে থেকে ঠুকনো দরজাটার খিল লাগিয়ে দিয়ে গেছে। অরিন্দম এখন তার টোপ। একটু পর কি অরিন্দম মাছ হয়ে যাবে? ঝড়ো বাতাস শেষ হলে পরে লোকটা ধীরে ধীরে গুটিয়ে আনবে ছিপের দড়ি? মেঝেতে আবার শুইয়ে রাখবে নিজের প্রেয়সীকে? এরপর নিশ্চয়ই আবার অপেক্ষা করবে, কখন লাগবে খিদে, কখন আবার জাগবে প্রিয়তমা।
ধাক্কা দিয়ে দরজার শক্তি পরীক্ষার ইচ্ছে নেই অরিন্দমের। শরীর আর মনের সমস্ত বাঁধন আলগা হয়ে গেছে। বাতাসের তোড়ে চাটাই দিয়ে বানানো ঘরটার দেয়াল এতটুকু না কাঁপলেও মেঝেতে মাটির গর্তে থাকা কাঠের বাকশোটার ডালাটা খুলে গেল। অবধারিতভাবে বেরিয়ে এলো শে^তশুভ্র একটা হাত। এরপর বাকশের দেয়ালে ভর না দিয়েই শূন্যে ভেসে এলো সম্পূর্ণ নির্বিকার মুখখানা। অরিন্দমের দিকে তাকিয়েও যেন তাকায়নি। শবের দৃষ্টি আরও বহুদূরে। শবই তো! তবে মরদেহখানার দৃষ্টিতে আছে অমোচনীয় খুদা।
‘না! না! আমাকে না! প্লিজ!’
প্রচণ্ড বাতাসে রক্তাক্ত অথচ দারুণ ফ্যাকাসে সেই মুখ দিয়ে বের হওয়া আর্তচিৎকার অরিন্দমের কান পর্যন্ত এলো না।
পুরো ঘর জেগে উঠেছে। প্রেতসাধকের ছুড়ে দেওয়া মন্ত্র পাঠ হচ্ছে বাতাসে। অরিন্দমের কানের কাছে অচেনা শব্দগুলো হিস হিস করে জানান দিচ্ছে, সে… যাকে মরতেই হবে।
বাতাসের শব্দ কিংবা ফ্যাকাসে দেহ…মানে যতটুকু অক্ষত থাকলে ওটাকে দেহ বলা যায়, ওটার মুখ দিয়েই বের হচ্ছে অচেনা শব্দগুলো। অরিন্দম সেই অচেনা শব্দের ঘেরাটোপে বন্দি হচ্ছে ক্রমশ। অগণিত হুক হয়ে যেগুলো আঁকড়ে ধরছে তার সারা শরীর। অরিন্দমের মনে হলো তার দুই হাত খসে পড়েছে একটু আগে। কিংবা যে হাত দুটো তার শরীরে জুড়ে আছে, সে দুটোকে আর নিজের বলে দাবি করা যাচ্ছে না।

ধ্রুব নীলের আধিভৌতিক পরাবাস্তব হরর গল্প টোপ 

‘কে তুমি! আমাকে না! প্লিজ। আমাকে যেতে দাও।’
অরিন্দমের অস্ফূট কথাগুলো নিজের কানেই এলো না। বাতাসের ঘূর্ণিতে পেঁচিয়ে উঠে যেতে লাগল শূন্যে। নির্বিকার অথচ ক্ষত-বিক্ষত মুখটা এক সময় মায়াবি ছিল কি? এখন রক্তশূন্য, চামড়া লেগে আছে অস্থির সঙ্গে, কোটরে থাকা চোখ জোড়া এখন আর কাউকে দেখে না। অন্য কোনোদিকে তাকিয়ে সেগুলো ইশারায় কাকে যেন ডাকছে।
হিসস হিসসসসস। শব্দটা এতটাই অসহনীয় যে অরিন্দমের চকিতে মনে হলো মৃত্যুর চেয়ে শান্তির কিছু হতে পারে না। মগজটা বারবার সিগনাল দিচ্ছে- মৃত্যু ভয়াবহ নয়, মৃত্যু হলো ভয়াবহতার সমাপ্তি। চূড়ান্ত সমাধান। ওই তো… ক্ষুধার্ত বিন্তি.. এ বিন্তি নয়। এ অস্তিত্বের কোনো নাম হতে পারে না। এর ক্ষুধা কখনই মিটবে না। অরিন্দম নিজেকে সঁপে দিতে চাইল এই ভেবে যে, মৃত্যু ছাড়া আপাতত তার এই অপার্থিব ভীতি থেকে মুক্তি নেই।
হঠাৎ…! দরজা খুলে ঢুকল লোকটা। জড়িয়ে ধরল মেঝে বরাবর দাঁড়িয়ে থাকা আধা লাশ, আধা জীবন্ত অস্তিত্বটাকে।
‘বিন্তি! বিন্তিরে! আমারে খা! আমারে খা! একটা হাত খাইছিস, পুরাটা খা! আমি আর পারি না! তুই আমারে নিয়া মর! শান্তির মরণ দে!’
হিহসসস হিহহহসসসসস।
ইশারায় অরিন্দমকে দেখাল দেহটা। অরিন্দমের মগজ এতক্ষণ একটা কিছু সংকেতের অপেক্ষায় ছিল। পাশের কোদালটা তুলে সজোরে বাড়ি দিল লোকটার মাথায়। ফিনকি দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। হিসহিসিয়ে উঠল দেহটা। লোকটার মাথা ফেটে বের হওয়া রক্ত এসে মুখে লাগতেই বদলে গেল চাহনি। বুভুক্ষের মতো, যেন অনেক দিন পানি খায়নি এমন করে লোকটার রক্ত চুষে নিতে লাগল সেই ডাকিনি।
তারপর একসময় শান্ত হলো মরদেহটা। বাতাসও কমে এলো। এরপর লোকটাকে মানে বেঁচে থাকতে যে ছিল বিন্তির স্বামী, তাকে জড়িয়ে ধরেই আবার নিজের বিছানা, অর্থাৎ কাঠের কফিনে চলে গেল। যেভাবে শব্দ করে খুলেছিল, সেভাবেই লেগে গেল ডালা।
ঘেরাটোপ থেকে মুক্তির স্বাদ মিলতেই অরিন্দমের শরীরে ভর করল শক্তি। পাগলের মতো পাশে সরিয়ে রাখা মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে লাগল বাকশের দরজা। এরপর দিগি¦দিক হারিয়ে ছুটল গোরস্থানের ভেতর। কত যে আঁকশির মতো আঙুল মাটি ফুঁড়ে পেঁচিয়ে ধরতে চাইল। এখন আর কিছুতেই ভয় নেই তার। ছুটতে ছুটতে আবার সেই খাড়া ঢাল। যথারীতি ঝিরিতে আছড়ে পড়ল পা পিছল। এবার একটি নয়, শত শত আঙুলের বড়শি গেঁথে ফেলল, ঘিরে ফেলল। সবকটা মিলে মাটিতে টেনে নিতে লাগল অরিন্দমকে। শত চেষ্টাতেও চিৎকারটুকু করার শক্তি হলো না গলায়। ক্রমশ আটকে আসছে দম। বাড়ছে অন্ধকার। মাথায় একটি কথাই বাজছিল তার, ‘ওহ মাছ! ওহ টোপ গেলা মাছ!’

ধ্রুব নীলের আধিভৌতিক পরাবাস্তব হরর গল্প টোপ 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!

error: Content is protected !!