পশ্চিমে মাথা ঠুকে মরার দুরারোগ্য ব্যাধি

দ্রাবিড় সৈকত

অতীতের নিয়ন্ত্রণ যাদের কাছে থাকে, ভবিষ্যতের নির্মাণও তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় রূপায়িত হয়। আমাদের শিল্পকলার অতীত পুরোপুরি পশ্চিমের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পরিকল্পিত ভৃত্য বানানোর শিক্ষায় বুঁদ হয়ে আছেন আমাদের শিক্ষিতসমাজ। তাই অতীতের নিয়ন্ত্রণ, অতীতের প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে আমাদের ধারণা মূলত প্রভুদের শিখিয়ে দেওয়া এবং তাদের স্বার্থে নির্মিত অতীত। নিম্নবর্গের ইতিহাস-তাত্ত্বিক রণজিৎ গুহ বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন এভাবে—Education in history was thus designed as a servant’s education-an education to conform undeviatingly to the master’s gaze in regarding the past. It served the project of imperial dominance by annexing the past in order to preempt its use by the subject people as a site on which to assert their own identity. (Guha 1988: 21)

আমরা আমাদের শিল্পকলা বা ইতিহাস সম্পর্কে যা জানি; যতটুকু ধারণ করি, ঘৃণা করি, অবজ্ঞা করি, পাঠ করি তার সবই পশ্চিমা প্রভুদের পরিকল্পিত ছকের ভেতরে থেকেই করি। আমাদের শিল্পকলার বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ তাদের স্বীকৃতি-অস্বীকৃতির মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। আমাদের শিল্পকলার মান, সম্মান, নান্দনিকতা, ভালো, মন্দ, সুন্দর, কুৎসিত সবকিছু তারাই বর্ণনা করে সিদ্ধান্ত দেন, আমরা শুধু তাদের স্থানীয় বাস্তবায়নকর্মী। আমাদের যে কোনো শিল্পতত্ত্ব, নন্দনতত্ত্ব, সৌন্দর্যতত্ত্ব বিষয়ক একটি বইয়ের পাতা উল্টালে দেখা যাবে, সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে পশ্চিমা তাত্ত্বিকদের বিভিন্ন মতামত। কোথাও হয়তো প্রাসঙ্গিকভাবে দেশীয় কিছু বিশেষজ্ঞের মতামত থাকে কিন্তু সেসব এতই ক্ষীণস্বরের যে, তাদের না থাকাই আরেকটু সম্মানজনক হতে পারত। কিন্তু পশ্চিমের কোনো তাত্ত্বিকের বই খুললে আমরা একই রকম শব্দবিন্যাস বা তত্ত্ববিন্যাস দেখতে পাব না।

তার অর্থ একটাই, সেটি হলো আমাদের অতীতের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পশ্চিমের হাতে। এখানে একটি ক্লিশে তর্ক উত্থাপিত হতে পারে যে, যার যোগ্যতা থাকে সেই তো নিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জন করে, এটি একেবারেই মানুষ সভ্য হয়ে ওঠার পূর্ববর্তী ধারণা; অসভ্য জন্তু পর্যায়ের জন্য প্রযোজ্য যুক্তি। জানোয়ার আর মানুষে পার্থক্য হলো মানুষ সম্মিলিতভাবে একে অন্যের কাজে লাগে এবং সবার প্রয়োজন পূরণ হয়। পশুদেরও একটি পর্যায় পর্যন্ত এমন সহযোগিতার নজির আছে, তবে সেটি অনেক বড় আকারে হয় না।

মানুষের রয়েছে একটি অসাধারণ কল্পনাপ্রবণ মস্তিষ্ক। জানোয়ারকুলের জেনেটিক লিপিতে যতটুকু থাকে একে আর বাড়ানো তাদের সম্ভব হয় না। কিন্তু মানুষ সভ্যতা তৈরি করেছে, অতীতের সব অভিজ্ঞতা সে নানা মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে প্রবাহিত রাখার ব্যবস্থা করেছে, পরবর্তী প্রজন্ম শূন্য থেকে শুরু না করে পূর্ববর্তী প্রজন্মের যেখানে শেষ সেখান থেকে শুরু করে। তাই শক্তি ও ক্ষমতার নির্বিচার ব্যবহার মানুষের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বরং শক্তির নিয়ন্ত্রিত, প্রয়োজনীয় ও কল্যাণকর ব্যবহারই সভ্য মানুষের বৈশিষ্ট্য।

আমাদের শিল্পকলার নিয়ন্ত্রণ হয়তো পশ্চিম ছিনিয়ে নিয়েছে অথবা আমরা তুলে দিয়েছি তাদের হাতে। বাস্তবতা হলো, নিয়ন্ত্রণ আমরা হারিয়ে বসে আছি। এ দেশের ইতিহাসকে স্পষ্ট করে তোলার, আলোকিত করে তোলার দায়িত্ব স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন অনেক ভারততত্ত্ববিদ। তবে দুঃখের বিষয় তারাও পশ্চিমের অবজ্ঞার চোখ দিয়েই তাকে পুনর্নির্মাণ করেছেন। ফলে যা নির্মিত হয়েছে তা বরং অস্পষ্ট থেকে গেলেই আরও বেশি মঙ্গল হতে পারত। কেননা প্রাচ্যবিদ্যার বিশারদরা এবং তাদের অনুসারী স্থানীয় বিদ্বানমহল ইতিহাসের নামে স্থানীয় ইতিহাসের সর্বত্র কালিমা লেপন করে পুরো ব্যাপারটাকেই কুৎসিত করে তুলেছেন। সেখান থেকে স্বাভাবিক জলে স্নাত হওয়া বা পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়া এখন জটিলতম বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

দৃশ্যশিল্পের ভাষা বিশ্বজনীন হওয়া সত্ত্বেও স্থানীয় সংস্কৃতি, জীবন-দর্শন ইত্যাদি নানাবিধ কারণে এর রয়েছে বৈচিত্র্যপূর্ণ অভিব্যক্তি। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী নানা তত্ত্ব আমাদের শিখিয়েছে শিল্পকলাকে অবশ্যই পশ্চিমা আদর্শের মান বিচারের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। আমরা জানি এ পুরোনো কৌশল বেশ কার্যকর। এ কৌশল কাজে লাগানোর পদ্ধতি দুটি : ১. দেশীয় শিল্পকলাকে বিভিন্ন উদ্ভট তত্ত্ব-প্রমাণ হাজির করে নিকৃষ্ট হিসেবে প্রতিপাদন করা। ২. এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিল্পীদের সুবিধাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া।

অর্থাৎ মানসিক ও আর্থিক দুই দিক থেকেই চাপে রেখে কার্যোদ্ধার। এই কাজে ইংরেজ প্রশাসনের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় অতি তৎপর ছিলেন ভারতে আসা ইউরোপীয় অধিকাংশ শিল্পী, তাত্ত্বিক, বোদ্ধা, সমালোচক ও তথাকথিত বিশেষজ্ঞমহল। ব্রিটিশ শিল্পী, ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতাত্ত্বিক হ্যাভেলের পরে কলকাতা আর্ট স্কুলে অধ্যক্ষ নিয়োজিত হন পারসি ব্রাউন (১৮৭২-১৯৫৫), যার নেতৃত্বে ফাইন আর্ট বিভাগকে দ্বিখণ্ডিত করে ফাইন আর্ট বা পাশ্চাত্য রীতির শিল্প এবং ভারতীয় রীতির শিল্পকলা বিভাগ প্রবর্তন করা হয়। পারসি ব্রাউন ভারতীয় চিত্রকলার ভোক্তা সম্পর্কে বিভ্রান্ত্রিকর সিদ্ধান্তে উপনীত হন : Western painting, like Western music, is communal, it is produced with the intention of giving pleasure to a number of people gathered together. Indian painting, with the important exception of the Buddhist frescoes, is individual-miniature painting that can only be enjoyed by one or two persons at a time. In its music, in its painting, and even in its religious ritual, India is largely individualistic.. (Brown 1918: 7)

ব্যাপারগুলো হাস্যকর হতে পারত, কেননা তারা আধুনিকতার নামে যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের প্রশংসা করেন সেই একই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে এখানে নিন্দা করেন। আধুনিকতার মেরুদণ্ড হিসেবে চিহ্নিত যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ সেটি এ দেশের ক্ষেত্রে হয়ে গেল পশ্চাৎপদতার মাপকাঠি! কিন্তু ব্রাউন নিন্দা করতে গিয়েও বিষয়টিতে ভুল করেছেন; কেননা এ দেশের সামাজিকতাকে তিনি একেবারেই পড়তে পারেননি। পুরো দেশকেই তিনি ব্যক্তিবাদী বলে যা বলতে চাইলেন তার সঙ্গে এ সমাজের বাস্তবতার কোনো সম্পর্ক নেই। আবার একই আধুনিকতা পাঠ করে প্রাচ্যের আনন্দ কুমারস্বামী বলছেন বিপরীত কথা—‘The modern world, with its glorification of personality, produces works of genius and works of mediocrity following the peculiarities of individual artists : in India, the virtue or defect of any work is the virtue or defect of the race in that age.’ (Coomaraswmy1923: v)

পারসি ব্রাউন নিন্দা করছেন শিল্পকলা প্রায় ব্যক্তিগত বিষয় হওয়ার দোষে আর কুমারস্বামী নিন্দা করছেন সামাজিক হওয়ার দোষে। আসলে এখানে দৃষ্টিভঙ্গি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়; গুরুত্বপূর্ণ হলো নিন্দা করা। বাংলায় প্রচলিত একটি প্রবাদ আছে ‘যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা’, তো এখানে শিল্পের বৈশিষ্ট্য নয়, তার নিন্দাকে যুক্তিযুক্তভাবে পাঠকের মনে গেঁথে দেওয়াই কর্ম, যা দক্ষতার সঙ্গে সম্পাদন করেছেন ‘The Industrial Arts of India (1888)’ গ্রন্থের লেখক কোম্পানির কর্মকর্তা স্যার বার্ডউড, তিনি বলেন, ‘the life and arts of India, as in a lesser degree of the East generally, are still the life and arts of antiquity.’ (Birdwood 1880: 128), ভারতের জীবন ও শিল্প এখনো পশ্চাৎপদ। ফাইন আর্ট বলে এখানে কিছু নেই।

১৮৬৪ ইংল্যান্ডের রয়াল একাডেমি মেম্বার, ধ্রুপদি ভাস্কর্যের পণ্ডিত, প্রফেসর ওয়েস্টমেকট তার বিখ্যাত ‘Handbook of Sculpture Ancient and Modern’ গ্রন্থে ভারতীয় ভাস্কর্য সম্পর্কে মন্তব্য করেন : there is no temptation to dwell at length on the sculpture of hindustan. it affords no assistance in tracing the history of art, and its debased quality deprives it of all interest as a phase of fine art, the point of view from which it would have to be considered. […] They usually consist of monstrous combinations of human and brute forms, repulsive form their ugliness and the outrageous defiance of rule and even possibility (Westmacott 1864: 50-51).

একটি দেশের সার্বিক শিল্পকলা নিয়ে এমন জঘন্য ধরনের একপেশে কথা বলার যে অপরাধ, সেটি কোনোভাবেই হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। অথচ আমরা তাদের সাদরে গ্রহণ করেছি এবং তাদের বাহবা দিয়েছি। এমন বিভিন্ন পাশ্চাত্য পণ্ডিতের প্রতিধ্বনি আমরা শুনতে পাই স্থানীয় শিক্ষিতমহলের শিল্প বিচার পদ্ধতিতে। পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের আলোচনাকে মানদণ্ড ধরে এবং তাদের সিদ্ধান্তের প্রতি পূর্ণ আস্থা রেখেই স্থানীয় অনুসারীরা এ দেশের শিল্পকলাকে মূল্যায়ন অব্যাহত রেখেছেন।

এভাবেই পশ্চিমা লেখকদের সিদ্ধান্তের প্রভাবে আমরা নিজেদের ক্রমাগত হারিয়ে ফেলতে থাকি। বিবেকানন্দ তার ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’ গ্রন্থে বলেছিলেন, ভারতীয়রা ইউরোপের তুলনায় ছবি আঁকা ও মূর্তিকলায় চিরকালই অপটু এবং ইউরোপের শিল্প এক বিরাট ব্যাপার (শোভন সোম অনিল আচার্য ১৯৮৬ : ৭)। এভাবে সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তিবর্গের আত্ম-অবজ্ঞামূলক মন্তব্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ভারতীয় শিল্পের পরম্পরাহীনতা ও ইউরোপের তুলনায় নিকৃষ্ট এমন প্রচারকেই ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তুলেছে।

পশ্চিমের কোনো দার্শনিক-তাত্ত্বিকই এ দেশের প্রকৃত কল্যাণ চায়নি। তারা নিজেদের সুবিধা বৃদ্ধির জন্য সব ধরনের জঘন্য পদ্ধতির আশ্রয় নিয়েছেন, এসবের পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত এখন বেশ সহজলভ্য। সমস্যা হলো স্থানীয় শিল্পতাত্ত্বিকরা পশ্চিমের সঙ্গে আপাত আলাদা স্বরে কথা বললেও আদতে কোনো দ্বিমত করেননি। কুমারস্বামী ভারতীয় শিল্পের সঙ্গে আধুনিক বিশ্ব শিল্পের তুলনা করে ভারতীয় শিল্প সম্পর্কে তার নিজস্ব মতামত প্রকাশ করলেন, কিন্তু তিনি বিশ্ব শিল্পের আধুনিক সময়কে চিহ্নিত করলেন ভারতের কোনো সময়কাল উল্লেখ না করে।

এটি যথার্থ অবিবেচকের পরিচয়, কেননা ভারতীয় শিল্প বলতে যদি আমরা গুপ্ত যুগের শিল্পের কথা বুঝি, তাহলে সেই সময়ে আজকের ইউরোপীয় আধুনিক পৃথিবীর শিল্পকলার অবস্থান সম্পর্কে যদি বলা হতো, তাহলে কিছুটা সুবিচার হতো। তিনি তা না করে পুরো ভারতীয় শিল্পকে একটানে ইউরোপীয় আধুনিক পর্বের শিল্পের সামনে ফেলে দিয়ে তাকে পরাজিত বলে রায় দিয়ে দিলেন। বাংলা ভাষায় প্রথম শিল্পসমালোচনা গ্রন্থের লেখক শ্যামাচরণ শ্রীমানীকে তাই তপতি গুহ-ঠাকুরতাদের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়।

এমন উদাহরণ ভূরি ভূরি। পশ্চিমা জ্ঞানের প্রবল স্রোতে আমাদের বিদ্বানমহল ভেসে গিয়ে জাতীয় পরিচিতি রচনার প্রয়াসকে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করায়ও তৎপর রয়েছেন সমানভাবে। অনেকেই হালকাচালে ভাবতে অভ্যস্ত যে, ভারতীয় শিল্পচেতনা অনেক বেশি অবাস্তব, আধ্যাত্মিক, অপার্থিব বিষয়াবলির মিশ্রণে সৃজিত। তুলনায় পশ্চিমের শিল্পচেতনা অনেক বেশি বাস্তবমুখী, জাগতিক এবং প্রকৃতি অনুসারী। কিন্তু সময়ের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে ইউরোপীয় গির্জা প্যাগোডায় যেসব কাহিনি চিত্রিত হয়েছে, সেসব কি কোনো পার্থিব বিষয়ের চিত্রায়ণ? পক্ষান্তরে ভারতীয় শাস্ত্রীয় নিয়মানুসারে আমরা দেখতে পাই একজন চিত্রশিল্পীর সাধনা অবশ্যই বাস্তবানুগ এবং যথাযথ হতে হবে। যাকে তাকে এখানে চিত্রশিল্পী বলার অবকাশ নেই, কেননা চিত্রশিল্পী হিসেবে সেই বিবেচিত হওয়ার যোগ্যতা বর্ণিত আছে বিষ্ণুধর্মোত্তরে, ‘He who paints waves, flames, smoke and streamers fluttering in the air, according to the movement of the wind, should be considered a great painter.’ (Kramrisch 1928 : 61)

শিল্পকর্ম এবং শিল্পী হয়ে ওঠা উভয়ই এখানে সাধনা ও অধ্যয়নের অংশ। শিল্প বিষয়ে পৃথিবী এগিয়েছে বহুদূর। জানা ইতিহাসের অন্তত আড়াই হাজার বছর ধরে চলে আসছে শিল্পবিষয়ক নানা তর্ক-বিতর্ক এবং কখনো এটি শেষ হয়ে যাবে এমনটি ভাবারও কোনো সুযোগ নেই। শিল্প সম্পর্কে শেষ কথা বলারও তাই উপায় নেই। এ বিষয়ে শেষ কথা বলবে সময়। তাই শিল্পালোচনা হওয়া দরকার এর প্রয়োগ ক্ষেত্র বিষয়ে, অর্থাৎ শিল্প কোন কাজে লাগে? কেন শিল্প তৈরি হয়? শিল্পের গন্তব্য কোথায়? শিল্প কারা রচনা করে?

এমন প্রশ্নসমূহের উত্তর খোঁজাই সম্ভবত বুদ্ধিমত্তার কাজ। কেননা এসব বিষয়ের ওপর ভিত্তি করেই শিল্প তার গতিপথ পাল্টায়। পশ্চিম নিজেদের ক্ষেত্রে যে বিষয়কে মহান হিসেবে ঘোষণা করছে, একই বিষয়ে প্রাচ্যের ক্ষেত্রে বলছে দূষণ। জায়গাভেদে ব্যাখ্যা পাল্টে দেওয়ার স্ববিরোধিতাকে আমরা প্রহসন ছাড়া আর কীইবা বলতে পারি! এমন উদ্ভট কথাবার্তা বলা লোকজনকেই আমরা বিশাল পণ্ডিত মনে করে অনুসরণ করে ধন্য হই! লোকশিল্প, লোকজ্ঞান, লোকবিজ্ঞান, লোকচিকিৎসা ইত্যাদি নানা ধরনের ফোকলোর আবিষ্কার করে তাদের জন্য মায়াকান্নাও জুড়তে দেখা যায় পশ্চিমের পণ্ডিতদের। এভাবে কেন্দ্রবহির্ভূত প্রান্তীয় এলাকায় কিছু কারিগর মহান হয়ে ওঠে। যাদের শিল্প নেই, আছে কেন্দ্রের আদলে শিল্প হয়ে ওঠার ব্যর্থ প্রচেষ্টা। কিছু কারিগরকে প্রশংসা করে এ কথাই বোঝানো হয় যে, তোমরা আরও উন্নতি করতে চাইলে বা শিল্পী হতে চাইলে আমাদের অনুসরণ করো। পরিস্থিতির এমন দোদুল্যমানতায় বুদ্ধিমান সরাসরি অনুকারী হয়ে ওঠে, কিছু বোকাসোকা লোক দেশীয় ঐতিহ্যের নামে মৃত প্রথা-পদ্ধতিকে জাগিয়ে তোলার প্রাণপণ চেষ্টায় রত হয়।

এ সুযোগে স্থানীয় শিল্প, তার সম্পর্কিত সবকিছু চিরতরে হারিয়ে যায়। আমাদের হয়েছে তাই, পশ্চিমা সংজ্ঞায় আমাদের শিল্প এবং শিল্পী নেই, যা আমরা মেনে নিয়েছি, আছে কিছু কারিগর যাদের নিয়ে আমরা গৌরববোধ করার চেষ্টা করি কিন্তু সেখানে আর অন্তরের সাড়া পাওয়া যায় না। পশ্চিমা পণ্ডিত তাদের মতো ব্যাখ্যা দেবেন, নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রকল্পকে আরও সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর চেষ্টা করবেন, এটাই তাদের জন্য স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক হলো স্থানীয় শিক্ষিত মানুষের মতামত, তারা কীভাবে অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে পশ্চিমের তাচ্ছিল্য ও অবজ্ঞায়পূর্ণ মতামতকে সঠিক মনে করলেন? এর সহজ উত্তর থাকতে পারে ক্ষমতাবানের সঙ্গে অক্ষমের আচরণের ব্যাখ্যায়। কিন্তু এখানে অক্ষম বা ক্ষমতাহীন কোনো কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে না, সরাসরি তার মতকেই নিজের মতে বদলে নিচ্ছে; কেন নিচ্ছে? এর সঠিক উত্তর দেওয়ার জন্য নিশ্চিতভাবেই ব্যাপক মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ দরকার। তবে এর ফলাফল সম্পর্কে আমরা জানি, সেই ফলাফলের খেসারত আমাদের দিতে হচ্ছে জীবনযাপনের প্রতি পদে পদে।

storiesসাহিত্যসাহিত্য সমালোচনা