Site icon Mati News

রোমান্স গল্প : উপভোগ

রোমান্স গল্প : উপভোগ

লিখেছেন মৌমতিা শকিদার লাবনী

সুপ্রভার মনে হলো তার উপমাগুলো বাক্সে পুরে তালা লাগিয়ে দেয়ার দিন এসে গেছে। এ যুগে নাকি এসব অচল। রুজুর ভাষায় এ নাকি সেকেলে গন্ধ ছড়ায়। রঞ্জিতকে রুজু ডাকে সুপ্রভা। এই রুজুই তার কবিতার সমঝদার। মাপ মতো প্রশংসা সমালোচনা দুটোই করে। তবে ইদানীং রুজু সবকিছুতে কেমন যেন আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। কবিতা-গদ্য সবই এড়িয়ে চলছে।

সুপ্রভা বিজ্ঞানের ছাত্রী। তার সবকিছুতেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে যুক্তি আসবেই। রঞ্জিতকে সে মাঝে মাঝে বোঝানোর চেষ্টা করে, কবিতায় কাল ব্যাপারটা অন্যরকম। সুপ্রভার কাছে কবিতার সংজ্ঞা হলো, কালকে আলগোছে একপাশে সরিয়ে পরিচ্ছন্ন কিছু অনুভূতি। রঞ্জিত আবার এসব শুনতে পছন্দ করে না। ভ্রূ কুঁচকে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। আজও যেমনটি আছে।

সুপ্রভা বলল, এই যে তুমি এখনকার ভিজুয়াল প্রডাকশানগুলোকে অতিমাত্রায় মেলোড্রামাটিক বলছ, এটা ভুল। রঞ্জিত রিকশাওয়ালার পিঠে মৃদু স্পর্শ করে বলে, আস্তে চালান, সামনে স্পিডব্রেকার। সামনে যাই থাকুক তাতে সুপ্রভার মাথা ব্যাথা নেই। সে বলেই যাচ্ছে, ‘দুই হাজার কোটি বছর আগের কথা ভেবে দেখ, কী ছিল? দুচার রকম গ্যাস, সেই গ্যাসের তৈরি তারা সূর্য। আর এখন? সৌরজগত, পৃথিবী, চাঁদ.. আবার সেই চাঁদকে প্রিয়ার মুখের সঙ্গে মেলানোর মতো কবি-সাহিত্যিকও ঝটপট গজিয়ে গেলো। প্রকৃতির চেয়ে বড় মেলোড্রামাটিক কিছু আছে আর! এই যে আমি তুমি রিকশায়, এটাও এক রকম অতিরঞ্জিত। কী দরকার ছিল বল!’ রঞ্জিত এবার কথা বলার পয়েন্ট খুঁজে পায়। ‘হ্যাঁ সুপু ঠিকই বলেছ, যথার্থ, অতিরঞ্জিত, ভালোই’। ‘সব কিছুতে বেঁকে বস কেন!’ সুপ্রভা ভ্রƒ কোঁচকায়। রঞ্জিত তা খেয়াল করে না। দুজন দুদিকে চেয়ে থাকে। কিন্তু সুপ্রভা বেশিক্ষণ চুপ থাকতে পারে না। অল্প কিছু সময়ের জন্য রঞ্জিতকে কাছে পায়। বাকি সময় ছেলেটার কাজের শেষ নেই। কিছুদিন নাটকের পেছনে তো আবার সিনেমা। পড়াশোনা লাটে উঠেছে অনেক আগে। কাজ নিয়ে রঞ্জিতের সঙ্গে কথা বলে সুপ্রভা তাই স্বস্তি বোধ করে না। কিন্তু আর কীইবা বলে! কবিতা শুনিয়ে আর কদিন! আলগোছে রঞ্জিতের হাতের উপর হাত রাখে সুপ্রভা। কিছুটা চমকে ওঠে রঞ্জিত। ব্যাপারটা সুপ্রভা বেশ উপভোগ করে।

– রুজু

– কী?

রঞ্জিতের কণ্ঠ বেশ শান্ত। মনের সঙ্গে তার গলার স্কেল কখনো পাল্টায় না।

– কেমন আছ?

– ভালো, কেন?

– এমনি, কিছু না।

সুপ্রভা হাত সরিয়ে নিঃশব্দে হেসে সামনে তাকায়। রঞ্জিতের দৃষ্টিও সামনে। তবে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত।

 

সাদার উপর হাল্কা নীল ফুল। এ শাড়িটায় সুপ্রভাকে বেশ সরল দেখায়। আয়নায় শুধু চুলটা ঠিকাছে কিনা দেখে। ড্রইং রুমে এক তরুণ সাংবাদিক অপেক্ষা করছে। বেচারা রেকর্ডার আনলেও ক্যাসেট আনতে ভুলে গেছে। অবশ্য সুপ্রভার হাতে অঢেল সময়। ধীরেসুস্থে লেখার যথেষ্ট সময় পাওয়া যাবে। সুপ্রভার তৈরি হওয়ার ফাঁকে কিছু বলে নেয়া যাক। সে এখন প্রতিষ্ঠিত কবি। সবকটা পত্রিকা থেকেই কবিতার জন্য ফোন আসে। হয়তো সহজ সরলতার মাঝেও দুর্বোধ্য ঠেকে বলে তার কবিতার এতো কদর। তার ব্যাংকার স্বামী একজন শখের ফটোগ্রাফারও। কম্বিনেশনটা অদ্ভুত। সুপ্রভার পছন্দেই বিয়ে হয়েছে। আর রঞ্জিত? তার সঙ্গে সবচে ভালো মেলানো যাবে প্লুটোর সঙ্গে। সমঝোতার মাধ্যমেই সুপ্রভার জীবন হতে সে বিদায় নিয়েছে। কিন্তু কক্ষপথ থেকে হারিয়ে যায়নি। এখনো সেই ডকুড্রামা, অ্যাডফার্মে খেটে বেড়ায়। তেমন একটা পরিচিতি পায়নি। আবার অখ্যাতও নয়। বিয়ে করেনি। তাই যখন তখন কাজের সময় তৈরি হয়ে যায়।

সুপ্রভার ইন্টারভিউ শেষ হয়। হাঁফ ছেড়ে বাঁচে সে। মনে মনে ধন্যবাদ দেয় সাংবাদিককে। প্রথম প্রেম সংক্রান্ত বিব্রতকর প্রশ্নটা না করার জন্য। হয়তো তরুণ বলেই জিজ্ঞেস করার সাহস পায়নি।

 

 

সুপ্রভার স্বামী আড্ডা থেকে ফিরেছেন। যথারীতি আজও তার হাতে গোটা দশেক পত্রিকা। ছুটির দিনে একসঙ্গে সবগুলো পত্রিকায় তার স্ত্রীর কবিতা ছাপা হয়। কবিতা খুব একটা বোঝেন না। তারপরও বন্ধুদের দেখানোর জন্য তিনি নিজেই আবৃত্তি করে শোনান। এ নিয়ে সুপ্রভা বেশ রাগ দেখিয়েও সুবিধে করতে পারেনি। আজও নিশ্চয়ই সবাইকে শুনিয়ে এসেছে। সবাই কি আর অতো কবিতা পছন্দ করে! এ জিনিসটাই বোঝানো গেলো না তাকে। তবে সুপ্রভা ব্যাপারটা এক অর্থে উপভোগও করে।

‘পত্রিকাগুলো দয়া করে জায়গামতো রেখো, টেবিলে ছিটিয়ে রেখো না।’ সুপ্রভার স্বামী দেবব্রত চক্রবর্তী। তিনি কখনোই পত্রিকা ছিটিয়ে রাখেন না। বিশেষ করে শুক্রবারের পত্রিকাগুলোর কপালে যত্মআত্তি একটু বেশিই জোটে। আস্ত পত্রিকাই তিনি তুলে রাখেন। সুপ্রভা সব জেনেও এ কথা বলবে। আসলে এ বলাটাও সে বেশ উপভোগ করে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কথা কাটাকাটি হয় কিনা এ প্রশ্নটা এদের বেলায় অবান্তর। দেবব্রত যথেষ্ট মনযোগী শ্রোতা আর সুপ্রভাও গুছিয়ে কথা বলে। এভাবে বছরখানেক চললে তাদের সংসারটাকে অনায়াসে গ্রহের মর্যাদা দেয়া যায়। কক্ষপথ থেকে কখনো চুল পরিমাণ সরবে না। অন্যদিকে আবেগময় দুটো প্রাণতো আছেই।

 

প্রতিথযশা একটি দৈনিকের আয়োজনে কবিতা পাঠের আসরে কী করে যেন সুপ্রভার সঙ্গে রঞ্জিতের দেখা হয়ে গেল। মাঝে কয়েকবার রাস্তায় শুধু চোখাচোখি হয়েছিল। এখন একেবারে সামনাসামনি। সুপ্রভাই প্রথম বলে।

– কেমন আছ রুজু?

রঞ্জিত কেমন যেন দ্বিধাগ্রস্ত। রুজু সম্বোধনের জন্য নয়। সুপ্রভাকে সে মনে মনে খুঁজছিল। সে কারণেই তাৎক্ষণিকভাবে উত্তরটা দিতে পারে না। মৃদু হাসে। মাথা ঝাঁকায়। সুপ্রভাও হাসে। সেই হাসিতেও দুর্বোধ্য সরলতা। রঞ্জিত হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে উঠে।

– হ্যাঁ, এই তো! তারপর, এদিকে হঠাৎ?

সুপ্রভা উত্তর দেয় না। রঞ্জিত আবার বলল, অনেকদিন পর তাই না? সুপ্রভা সম্মতিসূচক মাথা ঝাঁকায়। রঞ্জিতের বিব্রতবোধ বুঝতে সে কিছুটা দেরি করেছে। তবে কথা বলায় তার একটুও দ্বিধা নেই।

– কী করছো এখন?

– কিছু না। ভাবছি আগে বিয়ে করবো, তারপর সব কাজ।

– বেশ তো, তাই কর।

– তোমার জলবালিকাটা বেশ ভালো হয়েছে।

সুপ্রভা শব্দ করে হাসে। রঞ্জিত কেমন যেন বোকা বোকা চোখে সুপ্রভার হাসি দেখে।

– তুমি আগের মতোই আছ রঞ্জিত। ঠিকমতো না পড়েই বল কিনা ভালো।

রঞ্জিতের ভেতরটা অতি ক্ষুদ্র সময়ের জন্য পুলকিত হয়। মুহূর্তে মনে পড়ে যার সঙ্গে দেখা করতে সে এখানে এসেছে সে যে কোনো মুহূর্তে অফিস ছেড়ে বের হয়ে যেতে পারে। কিন্তু মন থেকে খুব একটা তাড়া অনুভব করছে না। সুপ্রভার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, শোনো, আমি কিন্তু পড়ি, সত্যিই পড়ি!

তাই! সুপ্রভার চোখে অস্পষ্ট কৌতুক। প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, চলো চা খাই। অনেকদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা খাওয়া হয়নি। সুপ্রভার সাংসারিক বিষয়ে প্রশ্ন করতে রঞ্জিতের ইচ্ছে করলো না। সময় বড্ড কম। এ সময় অহেতুক কোনো আলাপ নয়।

প্রসঙ্গক্রমে সুপ্রভা তার স্বামীর প্রসঙ্গ টেনে আনলো।

– বাচ্চা নেয়ার সিদ্ধান্তটা ও আমার উপর ছেড়ে দিয়েছে। ক্যামেরা পাগল মানুষ। সংসার নিয়েও তার ভাবার সময় নেই।

রঞ্জিতের মনে হলো, এ মুহূর্তে তার কিছুটা হলেও ঈর্ষা অনুভব হওয়ার কথা। নাটকের পেছনে দৌড়ে জীবনটাই হয়তো তার কাছে নাটকের মতো হয়ে গেছে। তাই হয়তো সুপ্রভার কথাটা নিছক একটা ডায়ালগের মতোই মনে হয়েছে।

– তুমিও কি ব্যস্ত?

– নাহ্, এই যে দেখছো না!

– হুঁ

দ্রæত শেষ হয়ে আসে চা-পর্ব। রঞ্জিতের মনে হলো, এর বেশিক্ষণ থাকাটা উচিৎ হবে না। সুপ্রভা তাকে বিদায় জানাবে, এটা সে কেন যেন মেনে নিতে পারছে না। তাই সে-ই আগে বলল, বিয়ের পর তোমাকে একদিন বাসায় নিয়ে যাব। আমার বৌকে নিয়ে একটা কবিতা লিখে দিয়ে আসবে। সুপ্রভা বালিকার মতো দ্রুত উপর-নিচ মাথা ঝাঁকায়। রঞ্জিত চলে যায়। রঞ্জিতের হুট করে চলে যাওয়াটাও বেশ উপভোগ করে সুপ্রভা।

 

দেবব্রতকে এখন আর পত্রিকা যত্ন করে তুলে রাখতে হয় না। সুপ্রভার একটা ঢাউস সাইজের বই বেরিয়েছে। বইয়ের গোটা দশেক কপি শোকেসে সাজিয়ে রেখেছেন। নিকট বা দুঃসম্পর্কের যেই আসুক না কেন, একটা কপি ধরিয়ে দেবেন। সুপ্রভা এ জন্য প্রায়ই বলে, তোমার মতো ক্রেতার খোঁজ পেলে প্রকাশকরা দরজায় লাইন দেবে। দেবব্রত তার স্বভাবসুলভ হাসি হাসেন। মূলত, এ হাসিটার জন্যই সুপ্রভা কথাটা বলে।

বিচ্ছেদের পর রঞ্জিত সুপ্রভার ছাপা হওয়া কোনো কবিতা পড়েনি। কবিতা এখন আর তার ভালই লাগে না। তবে দৈনিকের পাতায় সুপ্রভার নাম সে আগ্রহভরেই খোঁজে। সেই নামের দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়েও থাকে। আর রাতে যেটুকু অবসর মেলে, তখন পুরনো ডায়রিটা বের করে। ডায়রির ভেতর অনেকগুলো টুকরো কাগজ। প্রতিটিতে সুপ্রভার হাতে লেখা কবিতা। রঞ্জিত কখনো পড়ে, কখনো শুধুই হাত বুলোয়। কবিতাগুলো বড় বেশি সরল, তবে দুর্বোধ্য নয়। এখনকার চেয়ে অনেক কাঁচা হাতে লেখা। মিনিট দশেক পর ডায়রিটা কাপড়ে মুড়িয়ে ড্রয়ারের ভেতর গুঁজে রাখে রঞ্জিত। স্মৃতিকাতরতা নয়, ব্যাপারটা সে বেশ উপভোগ করে।

 

 

গল্পটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।

Exit mobile version