ই-পাসপোর্ট যুগে ঢুকছে বাংলাদেশ

ই-পাসপোর্ট যুগে ঢুকছে বাংলাদেশ

বিশ্বের ১১৮টি দেশে চালু রয়েছে ই-পাসপোর্ট বা ইলেকট্রনিক পাসপোর্ট। ওই দেশগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশও প্রবেশ করতে যাচ্ছে ই-পাসপোর্ট যুগে। নিরাপত্তা চিহ্ন হিসেবে ই-পাসপোর্টে থাকবে চোখের মণির ছবি ও আঙুলের ছাপ। আর এর পাতায় থাকা চিপসে সংরক্ষিত থাকবে পাসপোর্টধারীর সব তথ্য। ফলে পরিচয় গোপন করা সম্ভব হবে না।

অন্যদিকে দেশের ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে বর্তমানে প্রায় দুই কোটি মানুষ মেশিন রিডেবল পাসপোর্টের (এমআরপি) মালিক। প্রতিদিন গড়ে ২০ হাজার মানুষ পাসপোর্টের জন্য আবেদন করছে। সময়মতো পাসপোর্ট দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে পাসপোর্ট অফিসগুলো। এর কারণ, প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাব। পাসপোর্ট অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগ দিলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কমবে। ২০১০ সালে মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) চালু হওয়ার সময় যেসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার হচ্ছিল সেগুলো দিয়েই এখনো কাজ চলছে। এসব যন্ত্রের অধিকাংশ বিকল। এক যন্ত্রের পার্টস অন্য যন্ত্রে বসিয়ে জোড়াতালি দিয়ে চালানো হচ্ছে কাজ।

এসব নিয়েই আজ শনিবার শুরু হচ্ছে পাসপোর্ট সেবা সপ্তাহ। চলবে ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এ উপলক্ষে প্রতিটি পাসপোর্ট অফিসে সেবার মান বাড়ানোর চেষ্টা চালানো হচ্ছে। তবে কর্মকর্তারা দাবি জানিয়েছেন ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট ক্যাডার নামের বিসিএস ক্যাডার পদ সৃষ্টির।

ই-পাসপোর্ট : স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০১৬ সালে এমআরপির পাশাপাশি ই-পাসপোর্ট চালুর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। একই সময় পাসপোর্টের মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত অনুুযায়ী যে দিন থেকে ই-পাসপোর্ট চালু হবে সেদিন থেকে এমআরপি পাসপোর্ট রিনিউ করতে গেলে ই-পাসপোর্ট করতে হবে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, কানাডাসহ ১১৮টি দেশে ই-পাসপোর্ট চালু আছে। বর্তমানে সাধারণ ও জরুরি পাসপোর্ট করতে যথাক্রমে তিন হাজার ও ছয় হাজার টাকা ফি দিতে হয়। মেয়াদ পাঁচ বছর। ই-পাসপোর্ট সম্পর্কে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রসচিব (সুরক্ষা সেবা বিভাগ) ফরিদ উদ্দিন আহম্মদ চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী ই-পাসপোর্টের কার্যক্রম দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে।’

পাসপোর্ট অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানান, জার্মান সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। জার্মানির প্রযুক্তি নিয়ে জিটুজির মাধ্যমে বাংলাদেশে ই-পাসপোর্ট করা হবে। ই-পাসপোর্ট শুরু হলে সেবার মান আরো বাড়বে। এতে জালিয়াতি রোধ করা সম্ভব হবে। এর জন্য বিমান, স্থল ও নৌবন্দরে ই-গেট স্থাপন করা হবে। ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট পেরিয়ে যাওয়া ই-পাসপোর্টধারী ব্যক্তি লাইনে না দাঁড়িয়েই স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইমিগ্রেশন শেষ করতে পারবেন। এতে সময় ও ভোগান্তি কমবে।

যেভাবে পাসপোর্ট করবেন : দেশে ৭১টি পাসপোর্ট অফিস রয়েছে। প্রতিদিন এসব অফিসে প্রায় ২০ হাজার নতুন পাসপোর্ট ও নবায়নের আবেদন জমা পড়ে। এর মধ্যে ঢাকার আগারগাঁও, যাত্রাবাড়ী, উত্তরা ও কেরানীগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসে জমা পড়ে গড়ে চার হাজার আবেদন। সাধারণ পাসপোর্টের জন্য ফি জমা দিতে হয় তিন হাজার ৪৫০ টাকা এবং জরুরি পাসপোর্টের জন্য দিতে হয় ছয় হাজার ৯০০ টাকা। পাসপোর্ট অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত এক কোটি ৯৬ লাখ সাত হাজার ৬৬৬টি মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) ও ছয় লাখ ২৬০টি মেশিন রিডেবল ভিসা (এমআরভি) মুদ্রণ করা হয়েছে।

মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট বা এমআরপি হচ্ছে এমন একটি পাসপোর্ট যাতে আবেদনকারীর ব্যক্তিগত তথ্য জলছাপের মাধ্যমে ছবির নিচে লুকায়িত থাকে। একই সঙ্গে এতে থাকে একটি ‘মেশিন রিডেবল জোন (MRZ)’, যা পাসপোর্ট বহনকারীর ব্যক্তিগত তথ্য বিবরণী ধারণ করে। এমআরজেড লাইনে লুকায়িত তথ্য শুধু নির্দিষ্ট মেশিনের মাধ্যমে পড়া যায়।

পাসপোর্ট অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, এমআরপির নির্ধারিত ফরম পূরণ করে ব্যাংকে পাসপোর্টের নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে ব্যাংক ভাউচার আবেদন ফরমের সঙ্গে যুক্ত করে আবেদন করতে হয়। সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাষিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার স্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারী, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবী, সরকারি চাকরিজীবীদের নির্ভরশীল স্বামী-স্ত্রী এবং তাঁদের ১৫ বছরের কম বয়সের সন্তানদের জন্য একটি ফরম ও অন্যদের ক্ষেত্রে নতুন পাসপোর্টের জন্য দুই কপি ফরম পূরণ করে জমা দিতে হয়। জাতীয় পরিচয়পত্র অথবা জন্ম নিবন্ধন সনদ এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক টেকনিক্যাল সনদসমূহের (যেমন—ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ড্রাইভার ইত্যাদি) সত্যায়িত ফটোকপি জমা দিতে হয়। ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিটি বিভাগীয়/আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে মুক্তিযোদ্ধা, বয়স্ক নাগরিক, অসুস্থ ব্যক্তি ও প্রতিবন্ধী নাগরিকদের জন্য আলাদা কাউন্টারে আবেদন করার ব্যবস্থা রয়েছে।

পাসপোর্ট সহজে পেতে যা করা প্রয়োজন : খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাসপোর্ট করতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হয় এসবির রিপোর্ট পেতে। কাউকে জরুরি বিদেশে যেতে হলেও এসবির রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত পাসপোর্ট করা যায় না।

পাসপোর্ট অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী এসবির রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত পাসপোর্ট করে দেওয়া সম্ভব নয়। এসবির রিপোর্ট পেতে বাড়তি টাকা গুনতে হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। গত বুধবার দুপুরে আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে কথা হয় আহসান নামে মিরপুরের এক বাসিন্দার সঙ্গে। তিনি পাসপোর্ট নিয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন। পাসপোর্ট কিভাবে করলেন জানতে চাইলে তিনি জানান, এসবির রিপোর্টের জন্য এক হাজার টাকা দিতে হয়েছে তাঁকে।

পাসপোর্ট অদিপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানান, দেশের সব নাগরিকের স্মার্টকার্ড হয়ে গেলে এসবির রিপোর্ট ছাড়াও পাসপোর্ট হতে পারে। যদি সেটি হয় তাহলে পাসপোর্ট পেতে সময় কম লাগবে।

মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পাসপোর্টের জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে এসবির রিপোর্টের প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। যাঁদের ন্যাশনাল আইডি কার্ড রয়েছে তাঁরা আবেদন করলে পাসপোর্ট পাওয়ার অধিকার রাখেন। এ ক্ষেত্রে পাসপোর্ট অফিস একটি কপি অনলাইনে এসবির কাছে পাঠিয়ে দিতে পারেন। যদি ওই ব্যক্তি অভিযুক্ত না হন তাহলে সঙ্গে সঙ্গে এসবির পক্ষ থেকে জানিয়ে দিলে পাসপোর্টের ভেরিফিকেশন-সংক্রান্ত জটিলতা এড়ানো সম্ভব।

 

সূত্র : কালের কণ্ঠ

 

খবর