বৌদ্ধ সংখ্যাগুরু বার্মায় সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর চালানো নির্মম হত্যা-ধর্ষণ-নিপীড়ন-অগ্নিসংযোগের খবর আর কোনোমতেই কেউ চেপে রাখতে পারছেন না। প্রতিবেশি দেশটির রাখাইনসহ অন্যান্য রাজ্যে প্রতিদিন সেনাবাহিনীসহ সাধারণ বার্মিজদের পৈশাচিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন রোহিঙ্গারা।
গত কয়েক মাস ধরে সেখানে নরক গুলজার করে রেখেছে মিয়ানমার তথা বার্মিজ আর্মি। তাদের সঙ্গে যোগ দিযেছে দেশটির সংখ্যাগুরু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী নাগরিকদের একটি অংশও।
সর্বশেষ গত ত ৯ অক্টোবর মায়ানমারের রাখাইন সীমান্ত চৌকিতে কথিত হামলার জের ধরে রোহিঙ্গা দমন অভিযান শুরু করে দেশটির সেনাবাহিনী। সেদিনই মুসলিম অধ্যুষিত রাখাইন প্রদেশের গ্রামগুলোতে কমপক্ষে ৬৯ জনকে হত্যার কথা স্বীকার করে খোদ দেশটির সেনাবাহিনী (ধারণা করা যায় প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি)। নৃশংসতার পর্যায় এমন পর্যন্ত পৌঁছায় যে শিশুদের ধরে জ্বলন্ত আগুনে নিক্ষেপ করার মতো পৈশাচিক ঘটনাও ঘটে।
এখন চলছে হত্যা, অগ্নিসংযোগসহ গণধর্ষণের মতো জঘন্য অমানবিক কর্ম। সম্প্রতি এমনি দুই বোনের কথা জানিয়েছে ভারতীয় পত্রিকা নবভারত টাইমস।
মিয়ানমারের রাখাইনের উদাং গ্রাম থেকে বাংলাদেশের টেকনাফে পালিয়ে আসা ২০ বছর বয়সী রোহিঙ্গা তরুণী হাবিবা (সংবাদে নিজের নাম প্রকাশে সম্মত) ও তার ছোট বোনকে মিয়ানমার সেনারা কয়েকদিন ধরে লাগাতার গণ ধর্ষণ করেছে। এসময় ওই বিভীষিকা থেকে বাঁচতে তাদের আর্তচিৎকার শুধু বাতাসে মিলিয়েছে। দয়ামায়া-করুণা কিছুই জাগেনি ধর্ষক সেনাদের মনে।
বর্তমানে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে একটি আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থঅনরত হাবিবা জানান, সৈনিকর তাদের দুবোনকে বিছানার সঙ্গে বেঁধে রাখে। এরপর লাগাতার গণধর্ষণ করে।
দুই সহোদরার ওপর ভয়াবহ ঘৃণ্য ওই নির্যাতন তাদের নিজ বাড়িতে করা হয়। পরে ওই বাড়ি জ্বালিয়ে দেয় ধর্ষক মিয়ানমারি সেনারা।
সংবাদ সংস্থা এএফপি’র বরাতে এনডিটিভি জানায়, হাবিবাদের পিতাসহ গ্রামের অনেক পুরুষকে হত্যা করে অত্যাচারী সৈন্যরা এবং গ্রামের অধিকাংশ বাড়ি-ঘরই জ্বালিয়ে দেয়। এছাড়া গ্রামের আরও তরুণীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায় হিংস্র সৈন্যরা।
টাইমস অব ইন্য়িা জানায়, সৈনিকরা এসময় যারা বেঁচে ছিল তাদের হুমকি দেয়- এরপর এলাকায় তাদের দেখলে হত্যা করা হবে।
নির্যাতীত এই দুউ বোনের সঙ্গে বার্মা ছেড়ে পালিয়ে বাংলাদশে আসা তাদের সহোদর ভাই হাশিমউল্লা বলেন, এখানে (বাংলাদেশে) ক্ষুধার কষ্টে পড়লেও অন্তত কেউ আমাদের ওপর নির্যাতন চালাতে বা হত্যা করতে তো আসছে না।
হিন্দি পত্রিকা নবভারত টাইমস জানায়, রাখাইন রাজ্যের বাসিন্দা রোহিঙ্গাদের ওপর এর আগে অনেকবার ভয়াবহ হিংসাত্মক কর্মকাণ্ড করেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। এবারও ইসলামি কট্টরপন্তিদের বিরুদ্ধে অভিযানের নামে সেখানে ভয়াবহ বর্বরতা চালাচ্ছে। নবভারত টাইমস আরও বলে- জাতিসংঘের এক কর্মকর্তা তো এমন অভিযোগ করেছেন যে মিয়ানমার তার দেশের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের নির্মূল করতে অভিযান চালাচ্ছে।
কোথায় গণতন্দ্রের মানসকন্যা!
প্রসঙ্গত, গণতন্ত্রের কথিত মানসকন্যা এবং শান্তিতে নোবেলজয়ী অং সান সু কির দল কিন্তু এখন দেশটির ক্ষমতায়। তিনিই এখন বতর্মান মিয়ানমারের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। সেনাশাসনের অধীনে দেশটিতে এ ধরনের অমানবিক ঘটনা অনেক ঘটেছে যাতে ধিক্কার জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মহল। কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য, মানবাধিকারের আন্দোলনে দীর্ঘ প্রায় প্রায় দেড়যুগ গৃহবন্দিত্বসহ নানাবিধ দমন-পীড়নের শিকার সু কির অধীন বার্মায় এখন এসব ঘটছে? বার্মার জাতির পিতা অং সানের কন্যার অধীনে চলছে এই পৈচাশিক চণ্ডালবৃত্তি- এটাই বিশ্ব বিবেক মানতে পারছে না।
বাংলাদেশে বার্মিজ রোহিঙ্গা: অতীত ও বর্তমান
গত শতাব্দীর আশির দশকে বার্মা তথা মিয়ানমারে সংখ্যালঘু মুসলিমদের জাতিগত নিপীড়নের শিকার হওয়ার ঘটনা আন্তর্জাতিক মিডিয়ার শিরোনাম হতে শুরু করে। বার্মিজ সেনাদের হামলা-নির্যাতন থেকে বাঁচতে মুসলিম রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ শুরু করে। এর ধারবাহিকতায় গত তিন দশক ধরে ৫ লাখের বেশি রোহিঙ্গা আছে বাংলাদেশে। ধনী বা উন্নত দেশ না হয়েও বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যার বলি রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে- নিজের দেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর চাপে সৃষ্ট নানান সমস্যাও মেনে নিচ্ছে বাংলাদেশ গত প্রায় চার দশক ধরে। কিন্তু বারবার আহ্বান সত্ত্বেও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেওয়ার কোনো উদ্যোগ নেয়নি সদ্য সাবেক সেনা সরকার এবং বর্তমানে নোবেল শান্তিজয়ী অং সান সুকির সরকার।
গত ৯ অক্টোবর মিয়ানমারের তিনটি সীমান্ত পোস্টে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদীদের’ হামলায় ৯ সীমান্ত পুলিশের মৃত্যুর পর রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত জেলাগুলোতে দেশটির সেনাবাহিনী অভিযানের নামে তাণ্ডব শুরু করে। প্রসঙ্গত, মিয়ানমারের অনেকগুলো রাজ্যেই জাতিগত দাঙ্গা এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের ধারাবাহিকতা রয়েছে।
যাহোক, গত অক্টোবরের ওই অভিযানে শতাধিক মানুষের প্রাণ হারানোর খবর দেয় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম। এছাড়া রাখাইন অঞ্চলে সহস্রাধিক বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে- এমন খবর দিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
এ অবস্থায় বাংলাদেশ সীমান্তে ফের রোহিঙ্গাদের ঢল নামায় ‘উদ্বেগ’ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় বিদেশি দূতাবাসের কূটনৈতিকদের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনেও বিষয়টি তুলে ধরেন।
প্রসঙ্গত, সরকার ২০১২ সালে সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে আসতে চাওয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে দেওয়ার পর এবারও একই অবস্থান নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।
দমন অভিযানের মুখে পালাতে থাকা রোহিঙ্গাদের নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা ঠেকাতে সীমান্তে বাড়তি বিজিবিকে বিশেষ সতর্ক অবস্থঅনে রাখা হয়েছে। তবে তা সত্ত্বেও গত কয়েকদিনে কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গা নারী-শিশু ও পুরুষ বাংলাদেশে চলে আসতে সক্ষম হয়। খুবই মানবিক পরিস্থিতির বিবেচনায় তাদের বাধা দেয়নি বলে জানায় বিজিবি।
তাদের মুখে জানা যাচ্ছে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর রোহিঙ্গা নির্যাতনের নির্মম ঘটনাগুলো।