বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে সাগরপথে মানবপাচারের ভয়ংকর রূপ উন্মোচন হওয়ার পর মধ্য ভূমধ্যসাগরপথে ইউরোপে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ওপর পাচারকারীদের এমন নির্যাতনের তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। গত শুক্রবার এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরেছে নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটন ও জেনেভাভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা উইমেন্স রিফিউজি কাউন্সিল (ডাব্লিউআরসি)। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মধ্যভূমধ্যসাগরপথে ইউরোপে আশ্রয়প্রার্থী প্রায় সব নারী, পুরুষ ও শিশুই যৌন নিপীড়নের শিকার।
মধ্যভূমধ্যসাগরপথে অবৈধভাবে ইউরোপে যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে আছে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাংলাদেশি। জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) এ বছরের প্রথম দুই মাসের হিসাব মতে ৫৭ জন বাংলাদেশি মধ্যভূমধ্যসাগরপথে অবৈধভাবে ইউরোপে পৌঁছেছে। উৎস-দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সেখানে শীর্ষে আছে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) হিসাব অনুযায়ী, ২০১৬ সালে সাগরপথে অবৈধভাবে ইতালিতে গেছে আট হাজার ১৩১ জন বাংলাদেশি। ২০১৭ ও ২০১৮ সালেও ওই পথে বাংলাদেশিদের ইতালি যাওয়া অব্যাহত ছিল।
ডাব্লিউআরসির “মোর দ্যান ওয়ান মিলিয়ন পেইনস : সেক্সুয়াল ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট ম্যান অ্যান্ড বয়েজ অন দ্য সেন্ট্রাল মেডিটেরিয়ান রুট টু ইতালি” (দশ লাখেরও বেশি যন্ত্রণা : মধ্যভূমধ্যসাগর দিয়ে ইতালির পথে ছেলে শিশু ও পুরুষদের ওপর যৌন সহিংসতা) শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ডিসেম্বর মাসে ইতালির সরকার নতুন একটি আইন প্রণয়ন করে। এর আওতায় মানবিক কারণে সুরক্ষার জন্য ‘রেসিডেন্সি পারমিট’ (বসবাসের অনুমতি) দেওয়ার ব্যবস্থা বিলোপ করা হয়েছে। এ কারণে ২০২০ সালের মধ্যে ইতালিতে প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার শরণার্থী ও অভিবাসী ঘরবাড়ি হারাতে পারে।
ডাব্লিউআরসির প্রতিবেদনে যৌন সহিংসতা এবং যৌন বা শ্রম নিপীড়নের শিকার ব্যক্তিদের সামাজিক সুরক্ষার আওতায় এখনো ইতালিতে বসবাসের অনুমতি পাওয়ার সম্ভাবনার পাশাপাশি ‘যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়া অনেক পুরুষের’ আশ্রয় না পাওয়ার আশঙ্কার কথা উল্লেখ আছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মুখ্য তথ্যদাতাদের একজন জানিয়েছেন, বাংলাদেশি এক তরুণ নতুন আইন প্রণয়নের কথা জেনে ‘আত্মহত্যার’ চেষ্টা করেন।
আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ার পথগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর হিসেবে বিবেচিত মধ্যভূমধ্যসাগর। ইউএনএইচসিআরের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ওই পথ দিয়ে ছয় লাখ ৪৮ হাজার ১১৭ জন ইতালি পৌঁছতে পেরেছে। ওই পাঁচ বছরে ওই পথে যাত্রার সময় নিহত ও নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তির সংখ্যা অন্তত ১৪ হাজার ৭৬৮ জন।
সাগরপথে অবৈধভাবে ইউরোপে পৌঁছে ইতালির বিভিন্ন শহরে অবস্থানকারী উল্লেখযোগ্যসংখ্যক অভিবাসনপ্রত্যাশী ও তাদের দেখভালকারী বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে ডাব্লিউআরসি ওই প্রতিবেদন তৈরি করলেও নীতিগত কারণে তাদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করেনি। কিছু ক্ষেত্রে ছদ্মনাম ব্যবহার করেছে। ‘মালিক’ ছদ্মনাম দেওয়া ঘানার এক ব্যক্তি বলেছেন, ‘আমাদের মনে অনেক কষ্ট। দশ লাখেরও বেশি কষ্ট। সব কিছু বলা কঠিন।’ তিনি দাবি করেন, লিবিয়া পর্যন্ত যাওয়া, লিবিয়া থেকে ইতালি এবং ইতালিতে অবস্থানকালেও তিনি যৌন নিপীড়নের শিকার হন।
একজন স্বাস্থ্যকর্মী ‘পল’ নামে আইভরি কোস্টের এক অভিবাসনপ্রত্যাশীর বন্ধুর আলজেরিয়া-লিবিয়া সীমান্তে যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি জানান, বন্দুকধারীরা পলের বন্ধুকে অন্যত্র নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর যখন সে ফিরে আসে তখন তার চোখ ছলছল করছিল। পলের বন্ধুকে তারা লাঠি দিয়ে পেটায়নি, কিন্তু পায়ুপথে নিপীড়ন চালিয়েছে।
প্রতিবেদনে বেশ কিছু জবানবন্দিতে অভিবাসনপ্রত্যাশী পুরুষদের বিকৃত যৌনচারের শিকার হওয়ার তথ্য আছে। প্রতিবেদনটিতে সাতটি মুখ্য পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়েছে। প্রথমত নারী, পুরুষ, ছেলেশিশু, কন্যাশিশু নির্বিশেষে প্রায় সবাই মধ্যভূমধ্যসাগরপথে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে। সংঘাতকালীন যৌন সহিংসতা এবং পরিবারের মধ্যে যৌন নিপীড়নের কারণে অনেক শরণার্থী ও অভিবাসনপ্রত্যাশী পুরুষ ও বালক নিজ দেশ ছেড়ে ইউরোপের উদ্দেশে পাড়ি জমিয়েছিল। ইতালি যাওয়ার পথে সীমান্তে ও তল্লাশি চৌকিগুলোতে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী তাদের আটক করেছে এবং যৌন নিপীড়ন চালিয়েছে।
দ্বিতীয় পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, লিবিয়ায় নারী ও পুরুষ শরণার্থী ও অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ওপর যৌন সহিংসতা হয়েছে। এমনকি সরকারি বন্দিশিবির ও কারাগারগুলোও যৌন সহিংসতার অন্যতম কেন্দ্র। লিবিয়ায় সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো রাস্তায় তল্লাশি চৌকিতে থামিয়ে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের শ্রমদাস হতে বাধ্য করে। এ ছাড়া বিভিন্ন গোষ্ঠী সেখানে বাসা-বাড়িতে শ্রমদাসত্ব ও যৌন সহিংসতার আখড়া বানিয়েছে। চাঁদা দিতে বাধ্য করতে, বিনোদনের জন্য ও শাস্তি হিসেবে সেখানে যৌন নিপীড়ন চালানো হয়।
তৃতীয় পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, অভিবাসনপ্রত্যাশী পুরুষ ও বালকদের লিবিয়ায় সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন বন্দিশিবির ও মরুভূমিতে নারী ও কন্যাশিশুদের ওপর ধর্ষণ ও অন্যান্য যৌন সহিংসতা দেখতে বাধ্য করা হতো। অনেকেই বলেছে, বন্দি পুরুষদের দিয়ে বন্দি নারীদের, এমনকি অনেক সময় নিজের পরিবারের নারীদের ধর্ষণ করানো হতো। আবার নারীদেরও অভিবাসনপ্রত্যাশী পুরুষ ও বালকদের ওপর যৌন সহিংসতা চালাতে বাধ্য করা হতো। আর এসব সহিংসতা চলত প্রকাশ্যে। আরো অপমান করার জন্য নিপীড়নের সেই ঘটনাগুলো ভিডিওতে ধারণ করা হতো। কখনো কখনো সেগুলো করা হতো অভিবাসনপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের জন্য।
চতুর্থ পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ইতালিতে অভিবাসনপ্রত্যাশী ও শরণার্থী বেশ কিছু বালক ও কিশোর যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে। তথ্যদাতারা জানিয়েছে, যৌন নিপীড়নের শিকার নারী ও পুরুষের প্রকৃত সংখ্যা ধারণার চেয়ে বেশি হতে পারে।
পঞ্চম পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, নারী ও পুরুষ উভয় শ্রেণির অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ওপর যৌন সহিংসতার প্রভাব রয়েছে। এটি কাটাতে ভালো মানের চিকিৎসা ও সহযোগিতা প্রয়োজন।
ষষ্ঠ পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ইতালিতে কিছু শহরে যৌন সহিংসতার শিকার নারী ও পুরুষদের জন্য সেবার ব্যবস্থা থাকলেও সার্বিকভাবে অনেক স্থানেই যৌন সহিংসতার শিকার হওয়া পুরুষ ও বালকদের সহায়তার তেমন ব্যবস্থা নেই।
সপ্তম পর্যবেক্ষণে যৌন সহিংসতার শিকার হওয়া অভিবাসনপ্রত্যাশী নারী ও পুরুষদের সেবা পেতে বাধাগুলো তুলে ধরা হয়েছে।
এসব বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও এর সদস্য রাষ্ট্রসহ সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ডাব্লিউআরসি।
অবৈধভাবে ইউরোপে যাওয়া এবং বৈধভাবে গিয়ে পরে অবৈধ হয়ে পড়া বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনতে ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ও ইইউ একটি চুক্তি সই করেছে। এর আওতায় ইউরোপে বৈধভাবে থাকার অধিকার নেই এমন বাংলাদেশিদের পরিচয় যাচাইসাপেক্ষে ফিরিয়ে আনা শুরু হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও অবৈধভাবে ইউরোপ যাওয়া বন্ধ হয়নি।
লিবিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শেখ সেকান্দার আলী গতকাল শনিবার দুপুরে টেলিফোনে কালের কণ্ঠকে বলেন, কোনো বাংলাদেশি বিপদে পড়েছে এমন খবর পাওয়া মাত্রই দূতাবাস তার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। লিবিয়ায় এখন একক কোনো সরকার নেই। বিভিন্ন অংশ মিলিশিয়া বাহিনীগুলোর নিয়ন্ত্রণে। লিবিয়া অনেক বড় একটি দেশ এবং এর উপদূতাবাসকর্মীদের ত্রিপোলির বাইরে যেতেও সরকারের অনুমতি ও নিরাপত্তা নিতে হয়। এ কারণে পরিস্থিতি বেশ জটিল।
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লিবিয়ায় সংঘাত শুরু হওয়ার সময় সেখানে প্রায় ৬০ হাজার বাংলাদেশি কর্মী ছিল। তাদের কয়েক হাজার দেশে ফিরে এলেও অনেকেই অবৈধভাবে সাগরপথে ইউরোপে পাড়ি জমিয়েছে। অনেকেই পাচারকারীচক্রের হাতে পড়েছে। কত জন ইউরোপ পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছে আর কত জন সাগরে ডুবে মরেছে সে-সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।
ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকার লিবিয়ায় শ্রমিক যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পরও আন্তদেশীয় মানবপাচারচক্র ইউরোপে পাঠানোর নাম করে শ্রমিকদের নানা পথ ঘুরিয়ে লিবিয়া নিয়ে যায়। ওই চক্রের কয়েকজন এ দেশেও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছে।
https://www.youtube.com/watch?v=r0t64gzuqtg