Site icon Mati News

রোমান্টিক উপন্যাস (ফ্যান্টাসি থ্রিলার) ”কৃ” (পর্ব-৪)

রোমান্টিক উপন্যাস ফ্যান্টাসি থ্রিলার উপন্যাস- কৃ

রোমান্টিক উপন্যাস (ফ্যান্টাসি থ্রিলার) ”কৃ” (পর্ব-৪)

আমার বাসাটা পাঁচ তলায়। বারান্দা ছাড়িয়ে যেতেই কলজেটা ছ্যাঁৎ করে উঠল ক্ষণিকের জন্য। এক-দুই তলা হলে এতটা ভয় পেতাম না। আঁকড়ে ধরলাম কৃকে। কানের কাছে মৃদু হাসির শব্দ।

‘আস্তে! হাড় ভাঙবে!’

আমি জানি কৃ ব্যথা পায়নি। আমাকে অভয় দেওয়ার চেষ্টা করলো কেবল। কিছু সময় লাগল ধাতস্ত হতে। ধীরে ধীরে চোখ মেললাম। পায়ের নিচে অপরিচিত শহর। ছাদের পর ছাদ। জনমানবশূন্য। সব দূরে সরে যাচ্ছে ক্রমশ। প্রচণ্ড বাতাস। কৃর চুল এসে বাড়ি খাচ্ছে আমার মুখে। আমার প্রচণ্ড ভয় পাওয়া উচিত। কিছুটা পাচ্ছিও। তবে কৃর ভেতর থেকে ছুটে আসা অনুভূতির কণাগুলো দলা পাকিয়ে আমার ভয়টাকে সরিয়ে দিচ্ছে।

‘ভয় পাচ্ছো? আবার নামিয়ে দিয়ে আসবো? বউয়ের পাশে গিয়ে ঘুমাবে?’

বিদ্রুপ গায়ে মাখলাম না। ভ্রƒ কুঁচকে তাকালাম কৃর দিকে। তারপর চিৎকার করে বললাম, ‘প্রশ্নই আসে না! আরো উপরে নিয়ে চল, শহর ছেড়ে বাইরে নিয়ে যাও। তোমার সঙ্গে মধ্যরাতে নদী দেখবো!’

ঠিকরে উঠল কৃর চোখ। যেন এমন কিছুই শোনার অপেক্ষাতেই ছিল। ওর বুকে মাথা গুঁজে দিতেই আবার পেঁজা তুলোর মতো হয়ে গেলাম। ঘুম জড়িয়ে আসলো চোখে।

ঘুমের ভেতরেই টের পাচ্ছি সব। কখনো মাটি ঘেঁষে, কখনো অনেক উঁচুতে। শোঁ শোঁ শব্দে বাতাস প্রতিবাদ জানাচ্ছে কানে। কিন্তু কে শোনে ওই দুর্বল বাতাসের কথা!

ঘুম ভাঙতেই টের পেলাম শরীরের নিচে ঘাস। শার্টটা ভিজে গেছে শিশিরে। আশপাশে কোনো শব্দ নেই। প্রকৃতির একটা রহস্য বুঝি জেনে গেলাম। গভীর রাতে সে নিজেও মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে পড়ে।

‘কতদূর এলাম?

‘উঠলে?’

‘হুঁ?’

নাহ স্বপ্ন নয়। ওই তো কৃ।

রোমান্টিক উপন্যাস (ফ্যান্টাসি থ্রিলার) ”কৃ” (পর্ব-৪)

‘কয়টা বাজে?’

‘শূন্যটা বাজে! ঘড়িই সব কিছু! এত কষ্ট করে নিয়ে আসলাম, এখন উনার টাইম জানার দরকার!’

‘কোথায় আমরা?’

‘আমার মাথায়!’

কৃর নকল রাগ পাত্তা দিলাম না। হাতঘড়িতে চোখ গেল অভ্যাসবশত। রাত দুইটা। চোখ ডলে উঠে বসে চারপাশে তাকালাম। ঘুম আধাআধি হয়েছে। এখনো রেশ কাটেনি। কৃর চোখে ঘুম নেই।

‘না! আমরা ঘুমাই না! আমরা বাতাসে ভেসে বেড়াই! আর বাদুড়ের হাড্ডি দিয়ে ব্রেকফাস্ট করি! এবার হলো!’

আহত দৃষ্টিতে তাকালাম। মনের কথা পড়ে ফেলাটা দেখলাম বড়ই ঝামেলার। আমার তরল দৃষ্টি সহজে তাকে কাবু করতে পারবে বলে মনে হলো না।

‘আর যাই করো, আমাকে এই অচেনা বিলের পাড়ে রেখে চলে যেও না আবার। কাল সকালে অফিস।’

‘তোমাকে আমি দিনের বেলায় অফিসে রেখে আসবো! একদম যেভাবে তুলে এনেছি, সেভাবে! সবার সামনে।’

‘ভয়াবহ ঘটনা ঘটে যাবে। আমেরিকা থেকে লোক আসবে তোমাকে ধরে নিতে। বলবে, তুমি হলে সুপারম্যানের বোন সুপারগার্ল। আর সুপারগার্ল হলো আমেরিকান নাগরিক।’

‘চলে যাব আমেরিকায়! তোমার কী!’

নদী থেকে আসা ঠাণ্ডা বাতাসে আবার শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে। কৃর দিকে তাকালাম। ও আমার মন পড়া বন্ধ করে দিয়েছে। ও যখন মাথার ভেতর ঢোকে তখন টের পাই। মগজের ভেতর শিরশিরে একটা অনুভূতি হয়।

হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে বসলাম কৃর ঠিক পাশে। এবার আর হাত নয়, সরাসরি কোমর জড়িয়ে ধরে বসলাম। আমি কখনো এভাবে কারো সঙ্গে বসেছি বলে মনে পড়লো না।

কৃও ধরলো একইভাবে। আমি আলতো করে মাথাটা রেখে দিলাম তার কাঁধে। সঙ্গে সঙ্গে চুল ধরে ঝাঁকি দিয়ে আমার মাথাটা সোজা করে দিল কৃ।

‘ঘুমানো চলবে না!’

‘কই নাহ…।’

আমি মাথা নিচু করে ঘাস দেখছি। আধেক চাঁদের আলোয় বিলের মাঝে একটা নৌকাও দেখতে পেলাম এক ঝলক। একটা পাখি উড়ে যাচ্ছে দূরে। তারার আলোয় নদীর শেষ প্রান্তের খানিকটা দেখা যাচ্ছে। তারপর আবার একরাশ অন্ধকার। পাখিটা ওই অন্ধকারের দিকে যাচ্ছে। যেন সেখানে তার মধ্যরাতের অফিস ধরতে হবে।

কৃর নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। কোন ভাবনায় ডুবে আছে কে জানে। চারদিকে ঘোর লাগা নীরবতা। এভাবে কোনো বিলের পাড়ে রাত দুটোয় প্রেমিক-প্রেমিকা বসে ছিল কিনা, নাহ.. হয়ত বসেছে। আমিই সেই তালিকায় ছিলাম না এতদিন।

ঘাড়ের কাছে কৃর বাম হাতের স্পর্শ পেলাম। আমার মাথাটাকে চেপে ধরলো নিজের কাঁধে। আহা.. এবার নিজেই তা হলে অপরাধবোধে ভুগছে তা হলে। বুঝুক মজা। আমি মাথা তুলে নিলাম। সঙ্গে সঙ্গে কড়া চোখে তাকাল কৃ। এ আগুনে দৃষ্টি উপেক্ষা করার সাহস হলো না।

‘ভুলে যাচ্ছো কেন বার বার? আমি তোমার মতো মিনমিনে স্বভাবের মানুষ না। মেজাজ গরম হলে মাঝনদীতে চুবিয়ে আসতে পারি।’

একবার ইচ্ছে হলো বিলের পানিতে নেমে পড়ি। কিংবা কৃকে বলি বিলের ওপর দিয়ে উড়িয়ে নিয়ে যেতে।

‘আমি তোমার রাইড শেয়ারিং হেলিকপ্টার না! যখন বলবে বান্দা হাজির!’

‘তুমি মানুষের মতো কথা বলছো কেন কৃ। তুমি হবে ভয়ংকর! তুমি হবে কালবৈশাখী!’

বলতে বলতে আমার বিড়ালস্বভাব জেগে উঠল। মাথাটাকে কাঁধ থেকে নামিয়ে এবার আলগোছে ছেড়ে দিলাম কৃর কোলে। এবার আরাম করে ঘুম দেওয়ার পালা। কিন্তু তড়াক করে লাফিয়ে উঠতে হলো অচেনা খসখসে একটা মধ্যবয়সী পুরুষের কণ্ঠ শুনে।

‘ওমমমা! সাহেব বিবি দেহি রাইত বিরাতে প্রেমলীলা শুরু করবার লাগছেন!’

একজন নয়। তিনজন। পেছনের দুজনের হাতে চকচকে রাম দা। তারা কৃর দিকেই তাকিয়ে আছে। আমিও ভ্রƒ কুঁচকে তাকালাম তার দিকে। আর যাই হোক, উড়ে তো পালাতে পারবো। কিন্তু ভয় পাচ্ছি অন্য কারণে। আমার সূক্ষ্ম সন্দেহ কৃর মেজাজ গরম করা নিয়ে। মেজাজ বেশি চড়ে গেলেই বিপত্তি। মাথা ঘুরিয়ে লোকগুলোর দিকে তাকাল ও। বেশ রিনঝিন টাইপের কণ্ঠে বলল।

‘তোমরা এত রাতে? বিল দেখতে এসেছো নাকি।’

‘ছেমরি দেহি আবার তুমি তুমি করে। আদব লেহাজ শেখা হয় নাই। আসো তোমারে আদব লেহাজ শেখাই।’

আমি উঠে দাঁড়াতে যাব, তার আগে হাত ধরে থামিয়ে দিল কৃ। তিনজনের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আপনারা ডাকাত হোন আর যাই হোন, চলে যান। আমি কিন্তু সাংবাদিক। এখন কিছু ঘটলে দেখবেন বিরাট ঘটনা ঘটে যাবে। পরে ধরাও পড়বেন।’

রাম দা হাতে একজন কৃর দিকে এগিয়ে আসছিল। আমার কথা শুনে একটু থমকে গেল। কিন্তু তাতে কাজ হলো না। দাঁত কেলিয়ে হাসল ডাকাত নেতা।

‘খুউব বালা। তুমি খবর লও, আর আমরা খবর বানাই। ওই, সাহেবরে কাগজ কলম দে। আমরা কী কী করি না করি, সেটা লিখবো! হে হে।’

কৃ চোখ মুখ শক্ত করে বিলের দিকে তাকিয়ে আছে তো আছেই। নড়াচড়ার জো নেই। ও কি আমার কাপুরুষতা দেখে বিরক্ত? নাকি অপেক্ষা করছে আমি আমার প্রচণ্ড গরম হয়ে থাকা মেজাজটা দিয়ে কী করি সেটা দেখার জন্য। আমার ধারণা পরেরটাই সঠিক।

ভাব ধরলাম খুব ভয় পেয়েছি। ধীরে ধীরে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। রাম দা হাতে যে লোকটা কৃর দিকে এগিয়ে এসেছিল ও খানিকটা হ্যাংলা। তার পেছনে মেঠো পথ। সে পথে কেউ নেই। আমি চোখ বড় বড় করে শূন্য পথে তাকালাম। যেন বড়সড় এক দানব আছে সেখানে। লোকটাও পেছনে তাকাল। একটাই সুযোগ। হ্যাঁচকা টানে তার হাত থেকে রাম দা কেড়ে নিলাম। ভড়কে গিয়ে পিছু হটতে গিয়ে লোকটা পড়ে গেল দলনেতার গায়ে। দলনেতাও ক্ষণিকের জন্য ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল। সময়কে আবার সেকেন্ডে মাপতে বসে গেলাম। আধা সেকেন্ডের মধ্যে দলনেতা গোছের লোকটার গলা বরাবর রাম দার কোপ বসিয়ে দিলাম। গলা থেকে ছিটকে আসা রক্ত আমার শার্টটাকে ভিজিয়ে দিল মুহূর্তে। পেছনের তিন নম্বর ডাকাতটা ভাবার জন্য সময় নিল কয়েক সেকেন্ড। আমি এগিয়ে যাব যাব করছি, এমন সময় পেছনে হ্যাঁচকা টান। আমাকে নিয়ে আবার শূন্যে ভাসল কৃ। হাত দিয়ে কেড়ে নিল রাম দা। ছুড়ে ফেলে দিল বিলে। এরপর উড়াল দিয়ে সত্যি সত্যি নিয়ে গেল বিলের মাঝে। পানিতে ভিজে চুপচুপে হয়ে গেলাম। বুঝতে পারলাম গায়ে লেগে থাকা রক্ত ধুয়ে দিতেই এ কাজ করলো। পাড়ে দাঁড়ানো দুই ডাকাতকে দেখলাম দৌড়াচ্ছে পাগলের মতো।

‘এখন যে ঠাণ্ডা লাগছে! একটু আস্তে উড়বে কিন্তু।’

কৃ একটা কথাও বললো না। তার চোখে মুখে নিদারুণ ব্যথার ছাপ। কোনো কারণে ভয়ানক কষ্ট পাচ্ছে মেয়েটা। অনেক কষ্টে চোখের পানি আটকে রেখেছে যেন। আমার দিকে তাকাল একবার। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে কী যেন বলল। মাঝে একবার শুধু ‘স্যরি’ বলতে শুনলাম। সে আমাকে স্যরি বলবে কেন? প্রশ্নের উত্তর নিয়ে ভাবার আগেই মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল। রকেটের মতো ছুটছে কৃ। এত গতিতে ছোটার জন্য আলাদা ট্রেনিং লাগে। আমার মনে হচ্ছে পেট আর মাথা এক হয়ে যাবে একটু পর।

থামল কৃ। নিজেকে আবিষ্কার করলাম বারান্দায়। গ্রিলের ওপাশে শূন্যে ভাসছে কৃ। তাকে এখন সত্যি সত্যি ডানাহীন পরীর মতো দেখাচ্ছে। সমস্যা হলো পরীটা কাঁদছে। এরপর যা বলল তাতেই বুঝতে পারলাম তার কষ্টের কারণ।

‘আমার কারণে তোমার এত বাজে একটা অভিজ্ঞতা হলো। তোমার কাছে আর আসবো না। আমি আসলেই ঝামেলা বাড়বে। অনেক ক্ষতি হতে পারে তোমার।’

‘কী বাজে বকছো! ঝামেলা ছাড়া জীবন চাই কে বলল! কী ভয়ানক বাজে ধারণা আমার প্রতি তোমার!’

‘সব চাইলেই হয় না। আমি শুধু শুধু.. উফফ কী ভালোই না ছিলে তুমি! এখন আমার কারণে হত্যাও করতে হলো তোমাকে।’

‘আমি এখন ভালো আছি কৃ! আর ওই ব্যাটাকে আরো দুটো কোপ বসিয়ে আসতে মন চাইছে।’

‘তুমি ভালো থেকো তুষার। আমি চললাম।’

আমি কিছু বলতে যাব, তার আগেই গলা ধরে গেল। প্রচণ্ড অভিমানে ভেতরে চলে এলাম। কৃ চলে গেলে যাক!

আবার বারান্দায় এলাম। আমার অভিমান ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু বারান্দায় আসার পর অভিমান কমলো না, বরং বেড়ে গেল। শূন্য বারান্দা। শূন্য আকাশ। ছাদের পর ছাদ। কোথাও নেই কৃ।

Exit mobile version