আমরা প্রবাসী । জন্মদাত্রী মা আমাদের কাছে নেই। জন্মভূমির মাটির স্পর্শও আমরা পাই না। আমাদের দিনগুলো-রাতগুলো কাটে পরিশ্রমে, পরিবার আর স্বজনের চিন্তায়। আমরা সব কষ্ট হাসিমুখে সয়ে বেঁচে থাকি। মা যখন মুঠোফোনে জানতে চান, কেমন আছি? মলিন মুখ নিয়েও তখন বলি, ‘ভালো আছি মা। কত সুযোগ-সুবিধা এখানে!’ ছোট ভাইবোনের কত আবদার। কারো বিদেশি চকলেট চাই, কারো বিদেশি পারফিউম। কারো একটা মুঠোফোন, কত কত চাহিদা। আমরা নিজেরা একবেলা কম খেয়েও প্রিয়জনদের আবদারগুলো পূরণ করতে চাই। মৌমাছির মতো তিলে তিলে জমানো টাকা দেশে পাঠাই। রেমিট্যান্স বাড়ে, আমাদের পরিবার-পরিজন সচ্ছল থাকে।
আমরা প্রবাসে থাকি বলেই উপলব্ধি করি দেশের মমত্ত্ব কতটুকু। উপলব্ধি করি মায়ের মতো দেশও কত প্রিয়। দেশের অর্থনীতির চাকা সচল করতে আমরা দিন-রাত খেটে যাই। আমাদের পরিশ্রমে বাংলাদেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়। আমরা প্রবাসীরাই ব্যাংকিং চ্যানেলে ২০১৫ সালে এক হাজার ৫৩১ কোটি মার্কিন ডলার ও ২০১৬ সালে এক হাজার ৩৬১ কোটি মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছি। প্রিয় বাংলাদেশ যখন অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হয়, তখন আমাদের ভালো লাগে। যখন আমরা নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু করতে পারি, তখন গর্বে ঘামে ভেজা এ বুক ভরে ওঠে। বাংলাদেশি হিসেবে আমরা গর্ববোধ করি, আনন্দিত হই।
আমাদের ঈদ, পূজা, উদযাপন বলতে তেমন কিছু থাকে না। পরিবার-পরিজন ছাড়া কি আর আনন্দ হয়। তা ছাড়া হয়তো এসব দিনে প্রবাসে ছুটি নেই। ছুটি থাকলেও একা একা মন টানে না। বুক ফেটে কাঁদতে ইচ্ছে করে। নিজেদের এতিম আর নিঃসঙ্গ মনে হয়। প্রবাসী ছাড়া এই বেদনাটুকু আর কেউ উপলব্ধি করতে পারবেন না। এটিও যে আত্মত্যাগ, তাই অনেকে সেটি বুঝতে পারেন না, বোঝার চেষ্টাও করেন না। আবার এমনও হয়, প্রবাসের মাটিতেই আমরা অনেকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ি। আমাদের স্বপ্নগুলো অবাস্তবায়িত হয়ে থাকে। আমাদের নিথর লাশটা দেশে ফেরে। ২০১৩ সালে তিন হাজার ৭৬ জন, ২০১৪ সালে তিন হাজার ৩৩৫, ২০১৫ সালে তিন হাজার ৩০৭, ২০১৬ সালে তিন হাজার ৪৮১ প্রবাসীর জীবনপ্রদীপ প্রবাসেই নিভে যায়। প্রবাসে থাকলে ভাবি, কবে ছুটি পাব, কবে টাকা জমাব, কবে দেশে যাব। ছুটি মিললেও আর্থিক সামর্থ্য হয়ে ওঠে না। দুই বছর, তিন বছর, চার বছর পর হয়তো আমরা দু-তিন মাসের জন্য দেশে ফিরি। এই ফেরাই আমাদের ঈদের আনন্দ, স্বর্গীয় সুখ বলে মনে হয়। মনে হয়, পরিবারের সঙ্গে থাকার মতো সুখ আর নেই। অথচ পরিবারের সঙ্গে দিন কাটানোর মতো সৌভাগ্য তো আমাদের নেই। অতিথি পাখির মতো স্বদেশে আমরা অতিথি হয়ে যাই।
শ্রম, ঘাম, জীবন, যৌবন দিয়ে প্রবাসীরা দেশ ও স্বজনের জন্য কাজ করে। অথচ প্রবাসীরা যেন তাঁদের প্রাপ্য সম্মান পাচ্ছেন না। কোথাও যেন একটা বাধা আছে। কোথাও যেন আমাদের ছোট করে দেখার মানসিকতা এখনো রয়ে গেছে। সে জন্য আমাদের কত রকমের কথা শুনতে হয়। দূতাবাস, বিমানবন্দর থেকে শুরু করে কত স্থানেই না প্রবাসীদের হয়রানি হতে হয়। পাসপোর্ট, ভিসার কথা না হয় বাদ থাকল। আবার অনেকের ‘মূর্খ’, ‘অশিক্ষিত’, ‘বর্বর’ গালি শুনতে হয়। কেউ কেউ বলেন, আমরা কামলা, জুতো পালিশ করি। আমাদের সত্যিই তখন প্রতিবাদের ভাষা থাকে না। আমাদের দেশের মানুষই যখন আমাদের ছোট করে দেখে, অবজ্ঞা করে, তখন বুকটা চৌচির হয়ে যায়। মনে হয়, আমরা হয়তো এখনো মানুষ হইনি। শ্রমিকই রয়ে গেছি। অথচ আমরা কারো না কারো ভাই, কারো সন্তান। আমাদের শ্রমে আমাদের পরিবার সুখে থাকে। আমাদের দেশ উন্নতির দিকে এগিয়ে যায়। এটি কি আমাদের অর্জন নয়? প্রবাসীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন বদলানো উচিত। ব্যক্তি থেকে শুরু করে রাষ্ট্র—সব ক্ষেত্রেই প্রবাসীদের দুঃখ, কষ্ট, শ্রম, আত্মত্যাগকে উপলব্ধি করা উচিত। রাষ্ট্র থেকে প্রবাসীদের জন্যে সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো যায় কি না, সেটিও দেখা দরকার। প্রবাসীদের জন্যে দূতাবাসগুলোর কার্যক্রম আরো প্রসারিত করা প্রয়োজন। আমরা এ বিষয়ে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছি। আর দেশবাসীর কাছে অনুরোধ, আপনারা প্রবাসীদের নিয়ে একটু মানবিকভাবে ভাবুন। প্রবাসীরা ভালো থাকলেই দেশ ও মানুষ ভালো থাকবে।
লেখক : সৌদিপ্রবাসী।