বক্ষব্যাধি হাসপাতালের সাবেক পরিচালক ডা. মো. রাশিদুল হাসান বললেন, শ্বাসতন্ত্রের জটিল রোগ সিওপিডি
শ্বাসনালির প্রদাহজনিত রোগ সিওপিডি একবার কারো হলে তাকে ধীরে ধীরে অবনতির দিকে নিয়ে যায়, দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসকষ্ট বাড়ায়, এমনকি মৃত্যুও ঘটায়। পুরোপুরি নিরাময়যোগ্য রোগ না হলেও সঠিক চিকিৎসায় সিওপিডির উপসর্গ প্রশমিত করাসহ অসুখের গতি কিছুটা হ্রাস করা যায়। লিখেছেন জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক পরিচালক, ইনজিনিয়াস হেলথকেয়ার লিমিটেডের (পালমোফিট) চেয়ারম্যান
অধ্যাপক ডা. মো. রাশিদুল হাসান
ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ বা সিওপিডি হচ্ছে গুচ্ছ রোগ, যা ক্রনিক ব্রংকাইটিস, এমফাইসিমা ও ক্রনিক অ্যাজমা—এই তিনটির যেকোনো একটি, দুটি বা তিনটির সহাবস্থান। একসঙ্গে একে সিওপিডি বলে। এর ফলে শ্বাসনালির ভেতরের গ্রন্থিগুলো মাত্রাতিরিক্ত শ্লেষ্মা তৈরি করে শ্বাসনালি সংকুচিত করে ফেলে। কখনো কখনো ফুসফুসের ভেতর থেকে বাতাস শ্বাসের সঙ্গে নির্গত হতে পারে না বলে ফুসফুস বেলুনের মতো বড় হয়ে ধীরে ধীরে কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
সারা বিশ্বে সিওপিডি রোগীর সংখ্যা বাড়ছেই। যুক্তরাষ্ট্রে এক কোটি ২০ লাখ লোক এই অসুখে ভুগছে। বাংলাদেশে সিওপিডি রোগীর সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও এখানে বায়ুদূষণ অনেক বেশি এবং ধূমপান একটি বড় নেশা, তাই সিওপিডিতে কী পরিমাণ লোক ভুগছে তা সহজেই অনুমেয়।
কারণ
সারা বিশ্বে সিওপিডির রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলছে। যারা ধোঁয়ার মধ্যে কাজ করে, বিশেষ করে নারীদের এই রোগের ঝুঁকি বেশি। ৩৫ শতাংশ সিওপিডি হয় নারীদের। ধূমপানের সঙ্গে এই অসুখ যুক্ত। বিশেষ করে অ্যাজমার রোগী, যারা ধূমপান করে, তাদের সিওপিডি হওয়ার আশঙ্কা বেশি। দেখা গেছে, যাদের সিওপিডি হয়, তাদের অনেকেই ধূমপান করে বা একসময় করত। পরোক্ষ ধূমপায়ীদেরও ৫ শতাংশের সিওপিডি হতে পারে।
এসব কারণ ছাড়া বায়ুদূষণ, ধুলাবালি, ধোঁয়া ইত্যাদি ফুসফুসে মারাত্মক প্রদাহের সৃষ্টি করে সিওপিডি তৈরি করে। ধোঁয়া বলতে শুধু ধূমপান বা শিল্প-কারখানার ধোঁয়া নয়; বরং বাড়ির চুলার ধোঁয়াকে বোঝায়, যা নারীদের ভীষণ ক্ষতি করে। মূলত ধূমপান, চুলার ধোঁয়া বা ধুলাযুক্ত পরিবেশে অনেক দিন কাজ করার ফলে সিওপিডি হয়। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বংশগত কারণও দায়ী বলে জানা গেছে।
লক্ষণ
♦ বুকে টান টান লাগা, কাশির সঙ্গে কফ, নিঃশ্বাসে শাঁ শাঁ শব্দ, দম ফুরিয়ে যাওয়া, বুক হালকা লাগা ইত্যাদি অনুভব।
♦ মারাত্মক শ্বাসকষ্ট হওয়া। এটি গর্ভাবস্থায় বেশি হয়।
♦ প্রায়ই শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ।
♦ শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়া বা কাজের শক্তি কমে যাওয়া।
♦ কোনো কারণ ছাড়াই ওজন কমে যাওয়া।
♦ অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা, জীবন সম্পর্কে হতাশা, আত্মবিশ্বাস হারানো ইত্যাদির মতো মানসিক সমস্যার মুখোমুখি হওয়া।
চিকিৎসা
যথাযথ চিকিৎসার মাধ্যমে সিওপিডি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এ জন্য চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী নিয়মিত ওষুধের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে অক্সিজেন অথবা শ্বাস-প্রশ্বাস চালানো মেশিন (BIPAP) ব্যবহার করতে হবে। ধূমপান বন্ধ করতে হবে। ইচ্ছা করলে ধূমপায়ী রোগীরা নিকোটিন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপিও নিতে পারে।
ফুসফুসের পুনর্বাসন কার্যক্রম : ফুসফুসের কার্যক্ষমতা ফিরিয়ে আনতে সিওপিডি সম্পর্কে অবহিতকরণ, নিয়মিত ব্যায়াম, স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদিই ফুসফুসের পুনর্বাসন কার্যক্রম। যাঁরা বহুদিন ধরে ফুসফুসের সমস্যায় ভুগছেন, ফুসফুসের শক্তি কমে যাওয়ায় যাঁরা শারীরিক অক্ষমতার শিকার, সর্বোচ্চ চিকিৎসা নিয়েও জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে যাঁদের, তাঁদের জন্য এই পুনর্বাসন কার্যক্রম। তবে স্মৃতিহীনতায় ভোগা রোগী, হার্টের তীব্র সমস্যা বা ব্যায়ামে অপারগ রোগীদের এই কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না।
গোল্ড নির্দেশনা অনুযায়ী যাঁদের উপসর্গ যত বেশি, ফুসফুসের এই পুনর্বাসন কার্যক্রম গ্রহণ করলে তাঁরা তত বেশি উপকৃত হবেন। কখনো কখনো হঠাৎ বেড়ে যাওয়া অসুখের চিকিৎসার পরও পুনর্বাসন প্রয়োজন হতে পারে। এই কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রথমেই রোগীর শারীরিক, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, ব্যায়াম করার ক্ষমতা ইত্যাদি বিচার করা হয় ও উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
ফুসফুসের এ পুনর্বাসন কার্যক্রম কমপক্ষে ছয় সপ্তাহ ধরে করাতে হয়, যাতে রোগ সম্পর্কে ধারণা দেওয়া, বিভিন্ন ধরনের ব্যায়াম শেখানো যেমন—শরীরের মাংসপেশি নমনীয় ও প্রসারিত করার ব্যায়াম, কাঁধের ব্যায়াম, পায়ের ব্যায়াম, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাংসপেশির শক্তি বাড়ানোর ব্যায়াম ইত্যাদি করা যায়। এ ছাড়া রোগীকে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ, ইনহেলারের সঠিক ব্যবহার, মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন, বিকল্প জীবিকা সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়। এই প্রক্রিয়ায় সিওপিডি রোগীরা তুলনামূলক আগের চেয়ে ভালো জীবন যাপন করতে পারে। তবে স্থায়ীভাবে উপকার পেতে হলে এ অভ্যাসগুলো ধরে রাখতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
আরো পড়ুন : আমায় লোভীও বলতে পারেন: বুবলী
ভয়াবহতা
সিওপিডির ফলে বহু লোক কর্মক্ষমতা হারায়, অনেকে মারাও যায়। বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর চতুর্থ বৃহত্তম কারণ সিওপিডি। ক্যান্সারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় ফুসফুসের ক্যান্সারে।
সিওপিডি শুরু হয় ধীরে ধীরে। কিন্তু বাড়তে বাড়তে এমন অবস্থায় পৌঁছে যে একপর্যায়ে হাঁটাচলা করাও কঠিন হয়ে পড়ে। তবে এটি মধ্যবয়সে বা বৃদ্ধ অবস্থায় ধরা পড়ে। ফুসফুসের ক্ষতি একবার হয়ে গেলে সেটি সারানো সম্ভব নয়। চিকিৎসায় উপসর্গ কিছুটা প্রশমিত রাখা যায় এবং অসুখের গতি একটু হ্রাস করা যায়।
অ্যাজমা নয় কিন্তু!
সিওপিডিকে অনেকে অ্যাজমা বলে ভুল করে থাকেন। তবে সিওপিডি আর অ্যাজমা এক রোগ নয়। অ্যাজমা যেকোনো বয়সে তথা শিশু থেকে শুরু করে একেবারে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত হতে পারে। সিওপিডি সাধারণত ৪০ বছরের পর হয়। অ্যাজমা মাঝেমধ্যে হয়, আবার ভালো হয়ে যায়। কিন্তু সিওপিডি হলে ধীরে ধীরে মারাত্মক শ্বাসকষ্টের দিকে চলে যায়। ধুলাবালি, খাবার, ঠাণ্ডা লাগা ইত্যাদি অ্যাজমার কিছু কারণ থাকে। যেকোনো সংক্রমণ সিওপিডি বাড়িয়ে দিতে পারে।
প্রতিরোধে করণীয়
♦ সিওপিডির ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জানিয়ে মানুষকে সচেতন করা।
♦ ধূমপান না করা।
♦ ধোঁয়ামুক্ত কাজের পরিবেশ তৈরি করা। বিশেষ করে নারীদের জন্য ধোঁয়ামুক্ত ও পরিবেশবান্ধব চুলার ব্যবস্থা করা।
♦ নিয়মিত ইনফ্লুয়েঞ্জা ও নিউমোনিয়ার ভ্যাকসিন নেওয়া, এতে মৃত্যুহার ৫০ শতাংশ কমে।
♦ কখনো ইনফেকশনের কারণে কফের পরিমাণ বেড়ে গেলে বা কফের রং পরিবর্তন হলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া।
♦ ডায়াবেটিস, হার্টের সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপ, দুশ্চিন্তা, হতাশা, ঘুমের সমস্যা, এসিডিটি ইত্যাদির যথাযথ চিকিৎসা করা।
https://www.youtube.com/watch?v=Geg0SPadJxM