মেরিটাইম ইউনিভার্সিটিতে ১১ বছরেও হয়নি স্থায়ী ক্যাম্পাস

তৌফিকুল ইসলাম আশিক

দেশের ৩৭তম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি । এটি বাংলাদেশের প্রথম, দক্ষিণ এশিয়ায় ৩য় এবং বিশ্বের ১২তম মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়। ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১ বছর পূর্ণ হলো ২৬ অক্টোবর। ১১ বছরের অগ্রযাত্রায় পূর্ণতা ও অপূর্ণতা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি।

বঙ্গবন্ধুর নামে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে “বাংলাদেশ মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি” করার দাবি শিক্ষার্থীদের। ইতোমধ্যে মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি সহ শেখ পরিবারের নামে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নাম পরিবর্তনের জন্য সরকারি উদ্যোগে কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুতেই মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির প্রথম উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন রিয়ার অ্যাডমিরাল এএসএম বাতেন। এছাড়া কমোডর খন্দকার তৌফিকুজ্জামানকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম রেজিস্ট্রার এবং কমোডর এএনএ রেজাউল হককে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ট্রেজারার হিসেবে নিয়োগ দেয়। ১১ বছর পরে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে সম্প্রতি দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন রিয়ার এডমিরাল আশরাফুল হক চৌধুরী। রেজিস্ট্রার হিসেবে কর্মরত আছেন কমোডর মো: মনির উদ্দিন মল্লিক।

দেশের ব্লু ইকোনমির সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে ২০১৩ সালে একটি মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ নেয় সরকার। জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি বিল-২০১৩ পাস হলে রাষ্ট্রপতি ২০১৩ সালের ২৬ অক্টোবর বিলটিতে সম্মতি দেন। মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি রাজধানী ঢাকার মিরপুর-১২ নম্বরের পল্লবীতে অবস্থিত। মিরপুরে বিশ্ববিদ্যালয়টির ২টি অস্থায়ী ক্যাম্পাস রয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রামের বাকলিয়ার হামিদচরে ১০৬.৬ একর জমিতে বিশ্ববিদ্যালয়টির স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণাধীন রয়েছে।

২০১৬ সালের ডিসেম্বরে শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য প্রথম ভর্তি পরীক্ষা নেয় মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি। মেরিটাইম ইউনিভার্সিটিতে বর্তমানে মেরিটাইম গভর্ন্যান্স এন্ড পলিসি, শিপিং এ্যাডমিনিস্ট্রেশন, আর্থ এন্ড ওশান সায়েন্স এবং ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি অনুষদের অধীনে ৫ স্নাতক প্রোগ্রাম চলমান রয়েছে। এই চারটি ফ্যাকাল্টিতে প্রতিবছর মোট ২০০ জন শিক্ষার্থী স্নাতক ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়। এছাড়াও মোট ৭টি অনুষদের অধিনে ৩৮টি বিভাগ রয়েছে। এগুলোর স্নাতকোত্তর প্রোগ্রাম চালু রয়েছে এবং কিছু বিভাগের কার্যক্রম স্থায়ী ক্যাম্পাসে চালু হবে বলে আশাবাদী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি ব্যাচেলর অব মেরিন সায়েন্সও চালু রয়েছে মেরিন ক্যাডেটদের জন্য। এর বাইরে কিছু অতিরিক্ত বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিও দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে প্রায় ১০০০ এর অধিক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করছে। 

বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষার্থীদের জন্য দুইটি ছাত্র হল, একটি ছাত্রী হল, একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও ক্যাফেটেরিয়া রয়েছে। হল দুইটি মিরপুর ডিওএইচএসে অবস্থিত। আবাসিক হল দুইটিতে অত্যাধুনিক সকল প্রকারের সুযোগ-সুবিধা বিদ্যমান। তবে ভাড়া নেয়া ভবন হওয়ায় অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যাল়গুলোর চেয়ে হলের ভাড়া অনেক বেশী। 

বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে অনেকগুলো সক্রিয় ক্লাব ও সংগঠন রয়েছে। এর মধ্যে সায়েন্স ক্লাব, কালচারাল ক্লাব, হাইকিং ক্লাব, বিজনেস অ্যান্ড ক্যারিয়ার ক্লাব, স্পোর্টস ক্লাব, ফটোগ্রাফিক ক্লাব, সাংবাদিক সমিতি, স্টুডেন্টস প্ল্যাটফর্ম, ডিবেটিং সোসাইটি, ল এন্ড মুট কোর্ট ক্লাব, হাল্ট প্রাইজ, বন্ধু সভা, রক্তদানের সংগঠন “রক্ত”, ইয়ুথ ম্যাপার্স, পাঠকবন্ধু অন্যতম। বিশেষায়িত পড়াশোনার পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রমকে প্রসারিত করছে এসব ক্লাব ও সংগঠন। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও বিভিন্ন অর্জন রয়েছে ক্লাব ও সংগঠনগুলোর।

রাজনীতিবিহীন এই ক্যাম্পাসের পরিবেশ শান্ত হলেও স্থায়ী ক্যাম্পাসের অভাবে শিক্ষার্থীরা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়। পর্যাপ্ত ক্লাসরুম না থাকা, সহশিক্ষা কার্যক্রমের জন্য পর্যাপ্ত জায়গার অভাব, গবেষণা ও ল্যাব কার্যক্রমের জন্য অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভরতা, অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় সেমিস্টার ফি অনেক বেশী, পর্যাপ্ত ও দক্ষ শিক্ষকের অভাবসহ নানাবিধ সমস্যা। এসব সমস্যা ছাপিয়েও ১১ বছরে বিশ্ববিদ্যালয় অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর বিভিন্ন ব্যাচ পড়ালেখা শেষ করে স্বাক্ষর রাখছে দেশের বিভিন্ন মেরিটাইম খাতে। তবে এক্ষেত্রেও রয়েছে বিভিন্ন ধরনের প্রতিন্ধকতা। মেরিটাইম খাতের বিষয়ভিত্তিক পর্যাপ্ত কাজের সুযোগ থাকলেও, নেই নিয়োগ পরীক্ষায় বিষয়ভিত্তিক পরীক্ষার ব্যবস্থা। উদাহরনস্বরুপ দেশের বিভিন্ন বন্দর, মেরিটাইম সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ পরীক্ষায় এখনো পুরোনো সিলেবাসে পরীক্ষা হয়। শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা এসব সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের নিয়োগে মেরিটাইম সংশ্লিষ্ট সিলেবাসে পরীক্ষা হলে মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা সুযোগ পাবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঠিক পদক্ষেপের মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠানে দক্ষতার সাথে অবদান রাখতে পারবে মেরিটাইম গ্র্যাজুয়েটরা। 

২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও ১১ বছরেও স্থায়ী ক্যাম্পাসের মুখ দেখেনি মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি। ২০২৩ সাল পর্যন্তও ছিলো শুধু বালুকাময় একটি প্রান্তর। বালু ভরাটে দীর্ঘদিন সময় লাগা ও ভবন নির্মাণের জন্য উপযোগী হতে সময় লাগায় এতদিন স্থায়ী ক্যাম্পাসের ভবন নির্মাণ শুরু হয়নি বলে বলে আসছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ২০২৪ সালে বিভিন্ন স্থাপনার টেন্ডার সম্পন্ন হয়ে নির্মাণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সদ্য প্রাক্তন উপাচার্য রিয়ার এডমিরাল মোহাম্মদ মুসা স্বল্প সময়ের মধ্যে স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য দ্রুততার সাথে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন যা স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ কাজকে এগিয়ে নিয়েছে বলে সকলের ধারণা। বর্তমান উপাচার্য রিয়ার এডমিরাল আশরাফুল হক চৌধুরী দায়িত্বভার গ্রহণ করার পরেই স্থায়ী ক্যাম্পাস পরিদর্শন করেছেন। তিনিও দ্রুততার সাথে স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণের ব্যাপারে বদ্ধ পরিকর বলে জানিয়েছেন। নিয়মিত স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ কার্যক্রম পরিদর্শন ও অগ্রগতি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে জানানো হবে বলে জানান তিনি। সর্বসাকুল্যে ২০২৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয় স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তর করা সম্ভব বলে সকলে আশাবাদী। এছাড়াও শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতে সেমিস্টার ফি কমানো সহ অন্যান্য দাবি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আগ্রহের সাথে কাজ করছে বলে জানিয়েছেন উপাচার্য। 

স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ শেষে, বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামে স্থানান্তর করা হলে একটি আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় হবে বলে আশাবাদী শিক্ষক, শিক্ষার্থী, মেরিটাইম সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। দেশের সুনীল অর্থনীতি অর্জনে ব্যাপক ভূমিকরা রাখবে দেশের বিশেষায়িত এ বিশ্ববিদ্যালয়।

ক্যাম্পাস