রহিম রানা: বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্প এক সময় কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির প্রাণভোমরা হিসেবে বিবেচিত হতো। ডিম ও ব্রয়লার উৎপাদনের দ্রুত সম্প্রসারণ শুধু পুষ্টিহীনতা কমাতেই ভূমিকা রাখেনি—এটি লাখো মানুষের জীবিকা, নারীর আর্থিক অন্তর্ভুক্তি এবং গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা সচল রাখতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু আজ সেই খাত একটি নীরব বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বাজারব্যবস্থার অস্থিরতা, অসাধু চক্রের দৌরাত্ম্য, কন্ট্রাক্ট গ্রোয়িংয়ের একতরফা আধিপত্য, অনিয়ন্ত্রিত আমদানি, ফিড–বাচ্চার লাগামহীন দাম বৃদ্ধি—এসব সমস্যার সম্মিলিত অভিঘাতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন প্রান্তিক খামারিরা; যারা এই শিল্পের প্রকৃত ভিত্তি।
বিভিন্ন অঞ্চলে এখন যে চিত্র দেখা যাচ্ছে তা উদ্বেগজনক। ফার্মগেটে মুরগির দাম কমে গেলেও খুচরা বাজারে দাম অপরিবর্তিত বা বেশি। অর্থাৎ খামারি লোকসান গুনছেন, ভোক্তা অতিরিক্ত দাম দিচ্ছেন—আর লাভে আছে অদৃশ্য মধ্যস্বত্বভোগী চক্র। এই অস্বাভাবিক মূল্যবৈষম্য শুধু বাজারব্যবস্থার দুর্বলতাই প্রকাশ করছে না, বরং কৃষিভিত্তিক একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত সুপরিকল্পিত নীতি ও নিয়ন্ত্রণের অভাবে কীভাবে ভেঙে পড়তে পারে তার এক ভয়াবহ সতর্কবার্তা দিচ্ছে।
সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো—সমন্বিত বাজার ব্যবস্থাপনার অভাব। প্যারেন্টস্টক আমদানি থেকে DOC উৎপাদন, ফিডমিল থেকে হ্যাচারি—সবখানে কোনো সুস্পষ্ট উৎপাদন পরিকল্পনা নেই। ফলে কোনো মাসে অতিরিক্ত বাচ্চা, কোনো মাসে ঘাটতি; আবার কখনো কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে কিছু চক্র বাজারকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। বাজারে চাহিদার তুলনায় হঠাৎ করে অতিরিক্ত মুরগির সরবরাহ হলে দাম ধসে পড়ে; আবার যখন সরবরাহ কমে যায় তখন ভোক্তা উচ্চমূল্য দিতে বাধ্য হন। এই অস্থিরতার দায় প্রান্তিক খামারি বা ভোক্তার নয়; দায় রাষ্ট্রের নীতি ও নজরদারির দুর্বলতার।
কন্ট্রাক্ট গ্রোয়িং মডেল নিয়েও নতুন করে ভাবতে হবে। এটি বিশ্বে প্রচলিত ও কার্যকর একটি মডেল হলেও বাংলাদেশে এর ব্যবহার অনেকটাই একতরফা। কোম্পানি লাভে থাকলে সুবিধা শুধু তাদের—কিন্তু লোকসানে গেলে পুরো দায় চাপানো হয় খামারির ওপর। বিপদের সময় ভাগাভাগির কোনো ব্যবস্থা নেই। খামারিরা চুক্তিগতভাবে এমনভাবে বাঁধা থাকেন যে প্রকৃত স্বাধীনতা কখনোই পান না। আর সবচেয়ে দুঃখজনক হলো—কন্ট্রাক্ট গ্রোয়িংয়ের মুরগি যখন কমদামে বাজারে আসে, তখন স্বাভাবিক খামারিদের উৎপাদিত মুরগির দাম মুহূর্তেই পড়ে যায়। এটি শুধু বাজারের স্বাভাবিক প্রতিযোগিতা ভঙ্গ করে না; বরং সাধারণ খামারিকে উৎপাদন থেকে সরিয়ে দেওয়ার একটি অঘোষিত পদ্ধতিতেও রূপ নেয়। দীর্ঘমেয়াদে এটি পুরো খাতকে কিছু বৃহৎ কোম্পানির ওপর নির্ভরশীল করে ফেলবে—যা বাজারের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক।
এখন প্রশ্ন—রাষ্ট্র কি চুপচাপ বসে থাকবে? নাকি এখনই শক্ত উদ্যোগ নেবে?
প্রথমত, পোল্ট্রি খাতে ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে হবে। খামারির উৎপাদন খরচের নিচে বিক্রি হলে সরাসরি ভর্তুকি বা ক্ষতিপূরণ—এমন একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা চালু করা উচিত। দ্বিতীয়ত, বাচ্চা ও ফিড উৎপাদনে কঠোর মূল্য মনিটরিং, অনিয়ন্ত্রিত আমদানি নিয়ন্ত্রণ এবং বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। জেলা–উপজেলা পর্যায়ে বাজার মনিটরিং সেল গঠন করা জরুরি। তৃতীয়ত, পোল্ট্রি সেক্টরের প্রতিটি উপখাতে ডাটা বাধ্যতামূলক করতে হবে—কত DOC উৎপাদন হচ্ছে, কোথায় অতিরিক্ত, কোথায় ঘাটতি—এসব তথ্য ছাড়া একটি স্থিতিশীল বাজার কখনো সম্ভব নয়। চতুর্থত, কন্ট্রাক্ট গ্রোয়িং–এ সরকারের উপস্থিতি বা তদারকি বাধ্যতামূলক করতে হবে যাতে চুক্তির স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয়।
সবচেয়ে বড় কথা, প্রান্তিক খামারি টিকিয়ে রাখার মতো পরিবেশ সৃষ্টি করা রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব। তারা শুধু উদ্যোক্তা নন—তারা খাদ্যনিরাপত্তার যোদ্ধা, গ্রামীণ অর্থনীতির প্রাণ, নিম্নবিত্ত–মধ্যবিত্তের পুষ্টির উৎস। তাদের ধস মানে গ্রামীণ অর্থনীতির ধস, বাজারের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ, আর ভোক্তার জন্য দীর্ঘমেয়াদে ভয়াবহ মূল্যবৃদ্ধি।
বাংলাদেশ এখনো সময়ের অনেক আগেই অবস্থান করছে। প্রয়োজন শুধু সুস্পষ্ট নীতিমালা, কঠোর বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং প্রান্তিক খামারিকে বাঁচানোর মানবিক সিদ্ধান্ত। পোল্ট্রি খাতকে রক্ষার দায়িত্ব শুধু সরকারের নয়—এটি একটি জাতীয় দায়িত্ব; কেননা এই শিল্প ধসে পড়লে দেশের খাদ্যব্যবস্থা, অর্থনীতি ও গ্রামীণ জীবনের স্থিতি একসঙ্গে বিপন্ন হবে।