শানতোং প্রদেশের পাহাড়ঘেরা ইইয়ুয়ান জেলার ছোট্ট একটি গ্রাম হৌচিয়াকুয়ানচুয়াং। দুপুরে এ গ্রামের এক ছোট্ট কমিউনিটি ক্যান্টিনে ভিড় জমে বয়স্ক মানুষদের। মেনুতে থাকে মাংস দিয়ে বাঁধাকপি ও সেমাই, আলুভাজা, বাজরার খিচুড়ি আর নরম পাউরুটি। পরিবেশন করেন লাল জ্যাকেট পরা স্বেচ্ছাসেবীরা। জনপ্রতি খরচ মাত্র ১ ইউয়ান। বাংলাদেশি টাকায় ২০ টাকারও কম।
চীনের অনেক বয়স্কই এখন একা থাকেন। রান্না, দৈনন্দিন যত্ন আর চিকিৎসা—সবই কষ্টকর তাদের কাছে। তবে এ ধরনের ক্যান্টিন এখন তাদের জন্য শুধু খাবারের জায়গা নয়, হয়ে উঠেছে হাসি-আনন্দ আর প্রাণবন্ত এক আড্ডাখানা। সেইসঙ্গে গ্রামের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন ও মানুষের উন্নয়নকে ঘিরে যে চীনের যে শাসনব্যবস্থা, সেটার এক অনুকরণীয় উদাহরণও তৈরি করেছে।
জেলাটির জনসংখ্যা ৫ লাখ ১৫ হাজারের মতো। এর মধ্যে ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সীদের হার ২৬ শতাংশ—জাতীয় গড়ের চেয়ে অনেক বেশি। গ্রামের দিকে এই হার আরও বেশি, প্রায় ৩৩.৭ শতাংশ। ইইয়ুয়ান জেলার ২৩০টি ‘ইইয়ুয়ানহং’ কেন্দ্র বানানো হয়েছে এই প্রবীণদের জন্য।
২০২১ সালে চালু হয় ‘ইইয়ুয়ানহং’ মডেল—বৃদ্ধদের যত্নআত্তিতে এক অভিনব উদ্যোগ। প্রতিটি গ্রামে তৈরি হয়েছে ছোট ছোট যত্নকেন্দ্র, চিকিৎসা। খাবার আর কেনাকাটার সুবিধা আছে এখানে।
৮৭ বছরের হৌ সিয়ানহুয়া উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বললেন, ‘এখন প্রতিদিন গরম খাবার পাই। দাঁতও আর কষ্ট পায় না! সবকিছু নরম আর হালকা মশলায় রান্না করা।’
তিনি আরও যোগ করলেন, ‘যুবক বয়সে দিনভর মাঠে কাজ করতাম। ভাবতেই পারিনি, একদিন এমন শান্তিতে খেতে পারব।’
হৌচিয়াকুয়ানচুয়াং গ্রামের এই ক্যান্টিনে এখন প্রতিদিন ৭০-৮০ জন বৃদ্ধ খেতে আসেন।
গ্রামের পার্টি সেক্রেটারি চুয়াং বেনচেন জানালেন, ‘জেলা, উপজেলা আর গ্রাম—তিন পক্ষ মিলে অর্থ দিচ্ছে, তাই খাবারের দাম কম রাখা যাচ্ছে।’
গ্রামের ফান্ড আসে মূলত ৩৩ হেক্টরের আপেল বাগান থেকে। অনেক বৃদ্ধই জমির কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। তারা তাদের জমির অধিকারও গ্রাম সমবায়কে দিয়ে দিয়েছেন। এখন সমবায় সেই জমিতে নতুন জাতের আপেল গাছ লাগিয়ে ভালো আয় করছে। সেই টাকাতেই চলে বয়স্ক সেবাকেন্দ্রের যাবতীয় খরচ।
ইইয়ুয়ানের বলতে গেলে ৯৯ শতাংশই পাহাড়ি এলাকা। কৃষিই এখানকার মূল আয়ের উৎস—আপেল, পিচ আর চেরি ফলে এখানে।
চুয়াংয়ের মতে, তারা এখন কৃষকদের জমিও বাঁচাচ্ছেন আবার বৃদ্ধদের জীবনও।
এভাবে ২৩০টি কেন্দ্র আর ১৬৮টি খাদ্য কেন্দ্র বদলে দিচ্ছে ইইয়ুয়ানের চালচিত্র আর ভাবমূর্তি।
জেলার পার্টি সেক্রেটারি চাং থাও বললেন, ‘গ্রামের মানুষদের জিজ্ঞাসা থেকেই এই প্রকল্পের জন্ম। তারা জানতে চান, যখন বৃদ্ধরা দুই-তিন দিন ধরে একই খাবার খান, তখন কী করবেন? যখন কৃষকের বয়স হয়ে যায়, কে তার বাগান দেখবে? একা বৃদ্ধ কেউ বাজার বা হাসপাতালে যাবেন কীভাবে?’
এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই কর্মকর্তারা ঘরে ঘরে ঘুরে আট দফা জরিপ চালান। দেখা গেল—মূল সমস্যা চারটি—খাবার, চিকিৎসা, পরিচ্ছন্নতা আর কেনাকাটা।
এরপর শুরু হয় রূপান্তরের কাজ। খালি পড়ে থাকা ভবন, পুরনো হলঘর, পরিত্যক্ত জমি—সবকিছু বদলে ফেলা হয় জীবনযাপন কেন্দ্রে।
লংচিইয়ু গ্রামে তৈরি হয়েছে ক্যান্টিন, গোসলখানা, ক্লিনিক, হেয়ার সেলুন, আর অবসর কেন্দ্র। ৬৬ বছরের তোং চিইউন খুশি হয়ে বললেন, ‘আগে শহরে গিয়ে চুল কাটাতে হতো। এখন দরজা খুললেই সেলুন।’
প্রতি সপ্তাহে চীনা ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসা হাসপাতালের ডাক্তাররা নিখরচায় আকুপাংচার করান, রক্তচাপও মাপেন।
ইহেতৌ গ্রামের ক্যান্টিনের স্টোররুমে সারি সারি চাল, ময়দা আর টাটকা সবজি। সব খাবার আসে জেলার কেন্দ্রীয় সরবরাহ কেন্দ্র থেকে। ক্যান্টিন কর্মীরা মোবাইলেই অর্ডার দেন। রাতভর চলে সরবরাহের কাজ। প্রতিটি আইটেমের ওপর প্রাপকের নাম, পণ্যের বিবরণ, পরিমাণ এবং বাছাইয়ের তারিখ লেবেল করা থাকে। খুব দ্রুত কর্মীরা বুঝে যান, কোন প্যাকেট কোথায় যাবে এবং দাম কত হবে। সকাল ৭টার মধ্যে সব খাবার চলে যায় শহরের কেন্দ্রীয় রান্নাঘরে।
কাউন্টি সরকার-সমর্থিত একটি উদ্যোগ, শানতোং লুচোং ফুড সাপ্লাই চেইন এখন খাবার সরবরাহের দায়িত্বে আছে। ব্যবস্থাটি নিশ্চিত করে যে রান্নার চূড়ান্ত পর্যায়েও যেন কোনো জটিলতা না থাকে। তারা গ্রামের ক্যান্টিনগুলোয় একদম ধুয়ে পরিষ্কার করা সবজিগুলোই পাঠান, যেন সেখানে নিয়েই রান্না শুরু করে দেওয়া যায়। এতে খাদ্যের মান বজায় তো থাকেই, সেই সঙ্গে শ্রমও কমে আসে অনেকটা।
এ প্রক্রিয়া আবার কৃষক, প্রক্রিয়াজাত কারখানা আর বৃদ্ধ যত্নকেন্দ্র—সবকিছুকে এক সুতোয় বেঁধেছে। এর মাধ্যমে তৈরি হয়েছে শতাধিক চাকরি। এখন এই খাবার শুধু বৃদ্ধদের জন্য নয়—উদ্বৃত্ত খাবার আবার বিক্রি হচ্ছে বিদ্যালয়, অফিস, এমনকি স্থানীয় বাজারেও।
জেলা, উপজেলা আর গ্রামের যৌথ ভর্তুকিতে এখানকার খাবারের ৮০ শতাংশ খরচই মেটানো যায়। তবে এই ভর্তুকি কোনো অনুদান নয়—এটা এক ধরনের ‘স্মার্ট ইকোসিস্টেম’। এ প্রক্রিয়ায় প্রতিটি গ্রাম গড়ে তুলেছে নিজস্ব আয়ের উৎস—‘এক গ্রাম, এক শিল্প’ নীতি।
এখানে কোনো পক্ষ সরাসরি কাউকে কোনো অনুদান দেয় না। বরং এখানে এমন এক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে যেখানে প্রতিটি গ্রাম নিজের অর্থনীতিকে ব্যবহার করেই বৃদ্ধদের সেবা দেয়।
শুইমেতৌহেনান গ্রাম বেছে নিয়েছে পাহাড়ি, অনুর্বর জমি। তারা বেছে নিয়েছে সৌরবিদ্যুৎও।
২০১৬ সালে বিনিয়োগ করে গড়ে তুলেছে সোলার প্রজেক্ট, এখন বছরে সেখানে ৫ লাখ ২০ হাজার ইউয়ান।
তোংকান গ্রামেও ছোট ছোট জমিগুলোকে এক করে তৈরি করা হয়েছে সুবিশাল আঙ্গুর বাগান।
আগে বৃদ্ধরা আলাদা আলাদা প্লটে কষ্ট করতেন, এখন সব জমি একসঙ্গে করে চাষ—বছরে আয় হচ্ছে ১ লাখ ২০ হাজার ইউয়ান।
মজার ব্যাপারটা হলো এসব গ্রামের বৃদ্ধরাই এসব পরিবর্তনের নায়ক। ইহেনান গ্রামের বৃদ্ধা চাং সিয়াংমেই আর লিউ ওয়েনমেই প্রথমে এ উদ্যোগ নিয়ে চিন্তায় ছিলেন। পরে নিজেরাই উৎসাহ দেন সবাইকে।
তাদের সমর্থনে গড়ে ওঠে ১৩ হেক্টরের কিউই ফলের বাগান—যার মুনাফা দিয়ে চলে বৃদ্ধ সেবা কেন্দ্র।
এখন বৃদ্ধারা একসঙ্গে থাকেন, প্রতিদিন ক্যান্টিনে খাওয়াদাওয়া করেন, গল্প করেন, হাসেন।
পুরো জেলায় এমন ১,৩০৮টি শিল্প প্রকল্প চলছে। ৪৪৬টি গ্রামই বছরে ১ লাখ ইউয়ানের বেশি আয় করছে। অর্ধেক গ্রাম ছাড়িয়ে গেছে ২ লাখ ইউয়ান।
এই বছর ১,২২০ জন এমন ‘গ্রামীণ সিইও’ প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তারা ৪০০ হেক্টর জমি একত্র করেছেন, ৪৫টি কৃষি প্রকল্প চালু করেছেন, আর আয় করেছেন ৩০ লাখ ইউয়ান।
এটা শুধু একটি ভবনে গুটিকয়েক মানুষের পাশাপাশি থাকার গল্প নয়, বরং এটি চীনের মানুষকেন্দ্রিক এমন এক শাসনব্যবস্থার উদাহরণ—যেখানে প্রতিটি নীতির শেকড়েই আছে মানুষের কল্যাণ।
সূত্র: সিএমজি