চীনের বিস্ময় সুপারঅ্যাপ উইচ্যাট

বেইজিংয়ের ব্যস্ত বিকেল। দোকানের সামনে সারি। কাঁচাবাজারে চলছে দরদাম। এমন সময় একজনের ইচ্ছে হলো একটি মাত্র আপেল কেনার। কিন্তু পকেটে নেই খুচরো টাকা। ক্রেডিট কার্ড? সেটাও ধরুন নেই। ফোন বের করে একটি কিউআর কোড স্ক্যান করতেই ঝটপট হয়ে গেল পেমেন্ট। ক্রেতা খুশি মনে নিয়ে গেলেন আপেল। দোকানিকে দিতে হলো না কোনো ছাড়।

আবার ধরুন চীনের সাজানো গোছানো সড়কের পাশে সারি করে রাখা সাইকেল। চালাতে গেলে গুনতে হবে ভাড়া। কিন্তু এসব সাইকেলের নেই কোনো পাহারাদার বা ব্যবস্থাপনা স্টেশন। সাইকেলে প্রিন্ট করা আছে শুধু একটি কিউআর কোড। ওটা স্ক্যান করতেই টাকা কাটা গেল একাউন্ট থেকে। খুলে গেল সাইকেলের তালা। 

এভাবেই নিরবে এক প্রাযুক্তিক বিপ্লব ঘটে গেলো চীনে। যে বিপ্লবের পেছনে আছে ছোট্ট একটি নাম—উইচ্যাট। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত স্বয়ংসম্পূর্ণ সুপারঅ্যাপ এটি। চীনের তৈরি অ্যাপটি বার্তা আদান-প্রদান, অডিও-ভিডিও কল থেকে শুরু করে যাবতীয় পেমেন্ট ব্যবস্থায় এনে দিল জাদুকরি পরিবর্তন।

কিভাবে যাত্রা শুরু করল উইচ্যাট?

২০১১ সালে যখন চীনা প্রতিষ্ঠান টেনসেন্ট তার নতুন মেসেজিং অ্যাপ উইচ্যাট বাজারে আনে, তখন অবশ্য এটি নেহায়েত একটি মেসেজিং অ্যাপই ছিল। কেউ ভাবতেও পারেনি এই উইচ্যাটই একদিন চীনের অর্থনীতির হৃদস্পন্দনে রূপ নেবে। শুরুতে ওটা ছিল বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলা, ছবি ভাগাভাগি করার আর গ্রুপ চ্যাটের চীনা মাধ্যম। যেখানে যাবতীয় তথ্য থাকে সুরক্ষিত। কিন্তু এ প্রযুক্তির পেছনের মানুষগুলো—বিশেষ করে টেনসেন্ট -এর কর্ণধার পনি মা চেয়েছিলেন এর চেয়েও বেশি কিছু।

চলছিল পরীক্ষা-নিরীক্ষা। ভাবনায় এলো যদি কথোপকথনের মাঝে টাকার লেনদেনও করা যায়? যদি বন্ধুকে বার্তা পাঠানোর মতো সহজ হয় দোকানের বিল মেটানো? যদি এক অ্যাপ দিয়েই হয়ে যায় সব—মেসেজিং, পেমেন্ট, বুকিং, কেনাকাটা?

এই ভাবনাতেই ২০১৩ সালের আগস্টে উইচ্যাট পে’র জন্ম।

প্রথমদিকে বাছাই করা কিছু ব্যবহারকারী পাচ্ছিলেন টাকা পাঠানোর সুযোগ। কেউ আবার মোবাইল রিচার্জ বা অনলাইনে পণ্য কেনার পেমেন্ট করছিলেন উইচ্যাটে।

উইচ্যাট চীনে ওয়েইসিন নামে পরিচিত। টেনসেন্ট কোম্পানির তৈরি একটি মাল্টিপারপাস সুপার অ্যাপটিতে রয়েছে: ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং, সোশ্যাল মিডিয়া ফিড, ফাইল ট্রান্সফার এবং নানা ধরনের ফাইন্যান্সিয়াল ফিচার। চীনা অর্থনীতিতে তাই উইচ্যাটকে সমীহ করে বলা হয় ‘সুইস আর্মি নাইফ অ্যাপ’ নামে। আর এতসব সুবিধার কারণেই ২০১৮ সালে উইচ্যাটের ব্যবহারকারী ছাড়িয়ে যায় ১০০ কোটি। আর এখন সক্রিয় ব্যবহারকারী প্রায় ১১৩ কোটি ৩০ লাখ।

এর পেমেন্ট পদ্ধতি প্রধানত কিউআর কোড ভিত্তিক। আবার এক একাউন্ট থেকে আরেক একাউন্টে সরাসরি অর্থ প্রদানের ব্যবস্থাও আছে। এ ছাড়া চীনে উপহার দেওয়ার ‘হোং পাও’ বা ‘লাল খাম’ ঐতিহ্যকে ডিজিটাল ফরম্যাটে নিয়ে এসেছে উইচ্যাট।

কারা ব্যবহার করতে পারবেন উইচ্যাট বা উইচ্যাট পে? বার্তা আদান প্রদানের উইচ্যাটের ব্যবহার বিশ্বের অনেক দেশেই প্রচলিত। তবে পেমেন্ট সংক্রান্ত ফিচার ব্যবহার করতে চীনা ব্যাংকিং শনাক্তকরণ ব্যবস্থার ভেতর দিয়ে যেতে হবে ব্যবহারকারীকে। আবার আন্তর্জাতিক ভ্রমণকারীদের জন্য ভিসা, মাস্টারকার্ড সাপোর্টও রয়েছে এতে। মোট ২৬ ধরনের মুদ্রায় লেনদেন করা যায় এতে।

উইচ্যাট চীনের পেমেন্ট ইকোসিস্টেমে সুবিশাল ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। বিশেষ করে উইচ্যাট পে ইতিমধ্যেই চীনকে বানিয়ে তুলেছে ক্যাশলেস তথা প্রায় নগদবিহীন সমাজে। বাজার, ট্যাক্সি, রাস্তার পাশে থাকা বৈদ্যুতিক মোটরসাইকেলেও এখন কিআর কোডের ছড়াছড়ি। উইচ্যাট পে বা ওয়েইসিন পে মিনি প্রোগ্রাম ব্যবহার করে হোটেল বুক করা, ভিসার আবেদন, খাবার অর্ডারসহ প্রায় সবকিছু করা যায়।

২০১৬ সালে যখন উইচ্যাট ব্যবহারকারীদের জন্য একটি নতুন সার্ভিস চার্জ চালু করা হয় — তখন ব্যবহারকারীরা তাদের উইচ্যাট ওয়ালেট থেকে ডেবিট কার্ডে টাকা স্থানান্তর করতেন, এর জন্য চার্জ প্রযোজ্য হতো। পরে এই ট্রান্সফার ফিচারে সার্ভিস চার্জ নেওয়া বন্ধ করে প্রতিষ্ঠানটি।

২০১৮-২০২০ সালের মধ্যে উইচ্যাট পে-এর ব্যবহারকারী ১০০ কোটি ছাড়িয়ে যায়। যার ফলে ২০২০ সালে উইচ্যাট পেতেই লেনদেন হয় প্রায় ১৩ ট্রিলিয়ন ডলার।

২০২১-২০২৫ সালে উইচ্যাট-এর ব্যবহারকারী ১২০ কোটি ছাড়ায় এবং আশা করা হচ্ছে ২০২৫ সালের শেষের দিকে এর লেনদেন ছাড়াবে ২০ ট্রিলিয়ন ডলার।

উইচ্যাট নিয়ে আরও কিছু তথ্য জানা যাক এবার

  • চীনে উইচ্যাট ছাড়া একদিনও চলে না। দিনে দেশটিতে উইচ্যাটে পাঠানো হচ্ছে সাড়ে চার হাজার কোটিরও বেশি মেসেজ। উইচ্যাট পে’র ৮০ কোটি ব্যবহারকারীর লেনদেনকে বাদ রেখেই এই হিসাব করা হয়েছে!
  • চীনের অফিসিয়াল যাবতীয় যোগাযোগে এখন ৮০ ভাগ ক্ষেত্রেই উইচ্যাট ব্যবহৃত হচ্ছে।
  • বিশ্বসেরা সোশাল মিডিয়া প্লাটফর্মের তালিকায় উইচ্যাট এখন ৫ নম্বরে। উইচ্যাটের চেয়ে এগিয়ে আছে ফেসবুক, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুক মেসেঞ্জার।
  • চীনের বয়স্কদেরও লেনদেনের পছন্দের মাধ্যম উইচ্যাট পে। জরিপে অংশ নেওয়া পঞ্চাশোধ্র্ব প্রায় ৯৯ শতাংশ চীনা জানিয়েছে উইচ্যাট ব্যবহারে তাদের কোনো সমস্যা হয় না।
  • উইচ্যাটের যাবতীয় তথ্য থাকে চীনের মূল ভূখণ্ডে। বাইরের কোনো সার্ভারে এর তথ্য সংরক্ষিত থাকে না। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রসহ আরও কিছু দেশ উইচ্যাটকে কিছুটা বাঁকা চোখে দেখে। অবশ্য এরপরও প্রায় ২ কোটি ২০ লাখ আমেরিকান উইচ্যাট ডাউনলোড করেছে।
  • ব্যবহারকারীর অবস্থান ও ধরন বুঝে উইচ্যাটের তিনটি বিজনেস একাউন্ট আছে। বিদেশি কোম্পানিগুলো শুধু উইচ্যাট সাবসক্রিপশন একাউন্ট ব্যবহার করতে পারে। এ ছাড়া আছে পরিষেবা অ্যাকাউন্ট এবং এন্টারপ্রাইজ অ্যাকাউন্ট।

২০১৭ সালে উইচ্যাট চালু করে “মিনি প্রোগ্রাম” নামে একটি নতুন ফিচার চালু করে। এটি হলো অ্যাপের ভেতরে ছোট অ্যাপ—যাতে ব্যবসায়ীরা নিজেদের প্রয়োজনে অ্যাপ সাজিয়ে নিতে পারেন।

২০১৮ সালের জানুয়ারিতে উইচ্যাট জানায়, তারা ৫ লাখ ৮০ হাজার মিনি প্রোগ্রাম তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া উইচ্যাট গেমস—বিশেষ করে ‘জাম্প জাম্প’ গেমটি মাত্র তিন দিনে ৪০ কোটি খেলোয়াড় এবং দুই সপ্তাহে ১০ কোটির বেশি সক্রিয় ব্যবহারকারী পেয়েছে।

এ ছাড়াও ২০২০ সাল থেকে উইচ্যাটে যুক্ত হয়েছে ভিডিও প্লাটফর্ম উইচ্যাট চ্যানেল। ২০১৬ সালে টেনসেন্ট একটি উইচ্যাট আউট সার্ভিস চালু করে, যার মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা বিশ্বজুড়ে মোবাইল ও ল্যান্ডলাইন নম্বরে কল করতে পারেন।

২০১৭ সালে চালু হয় উইচ্যাট অ্যাপের নিউজ ফিড ও সার্চ অপশন। এমনকি চীনের আদালতগুলো উইচ্যাটের মাধ্যমে মামলা করা, প্রমাণ দাখিল ও রায় শোনা—এসবের সুযোগ দেয়। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩০ লাখ ব্যক্তি উইচ্যাট ব্যবহার করে আদালতের কার্যক্রমে অংশ নিয়েছিল।

উইচ্যাট এখন শুধু একটি অ্যাপ নয়—এটি চীনের ডিজিটাল জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ব্যবসা, বিনোদন, আর্থিক লেনদেন থেকে শুরু করে সবই এখন ঘুরে বেড়ায় এই সুপার অ্যাপের চারপাশে। সময়ের সাথে সাথে উইচ্যাট হয়ে উঠেছে প্রযুক্তি ও জীবনের মিলনস্থল।

সূত্র: সিএমজি

chinamade in chinawechat