ভারতীয় ডাক্তার কোয়ারকানাথ এস. কোটনিসকে চীনারা যে কারণে ভুলবে না

ছাই ইউয়ে (মুক্তা), সংবাদকর্মী, চায়না মিডিয়া গ্রুপ

৮৭ বছর আগে তরুণ ভারতীয় ডাক্তার কোয়ারকানাথ এস. কোটনিস আহতদের চিকিত্সাসেবা দিতে তথা জীবন বাঁচাতে, নিজের পরিবার ও স্বদেশ ছেড়ে, চীনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন। ধোঁয়া ও গুলির শব্দের মাঝেই তিনি অসংখ্য চীনা সৈন্য ও বেসামরিক নাগরিককে চিকিত্সাসেবা দিয়েছেন। পাশাপাশি, বিপুলসংখ্যক চীনা চিকিত্সাকর্মীকে প্রশিক্ষণও দিয়েছেন। কিন্তু অতিরিক্ত কাজের কারণে তিনি নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মাত্র ৩২ বছর বয়সে মারা যান।


‘জাপানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে চীনা জনগণের প্রতিরোধযুদ্ধের সময় চীনকে সহায়তাদানকারী ভারতীয় চিকিত্সকদলের কাজ ছিল গভীরভাবে মর্মস্পর্শী। তাঁদের অসামান্য প্রতিনিধি, ডাক্তার কোটনিস চীনের মাটিতে শান্তিতে শায়িত আছেন ও চীনা জনগণ সর্বদা তাঁর অবদানকে স্মরণ করবে।’ ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে, চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পি, ভারতীয় বিশ্ব বিষয়ক পরিষদে তার বক্তৃতায় এ কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছিলেন।


৮০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ডাক্তার কোটনিসের আন্তর্জাতিকতাবাদী চেতনা সময় ও স্থানকে ছাড়িয়ে গেছে ও সর্বদা প্রাসঙ্গিক আছে। হ্যপেই প্রদেশের রাজধানী শিচিয়াচুয়াংয়ে অবস্থিত ডাক্তার কোটনিস আবাসিক স্মৃতি যাদুঘরে একজন দর্শক একটি ছবির দিকে তাঁকিয়ে বলেন, ‘অপরিচিত ব্যক্তিদেরকে বাঁচাতে সে এতো দীর্ঘ পথ হেঁটে গেল! সে কেমন মানুষ!’ ১৯৩৮ সালে, ২৮ বছর বয়সী ডাক্তার কোটনিস জাপানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে চীনের প্রতিরোধযুদ্ধে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ও চার জন ভারতীয় ডাক্তার চীনে একটি চিকিত্সা-সহায়তা দল গঠন করেন। তখন তাঁরা একসাথে ছবিও তোলেন।


যখন কোটনিস ছংছিংয়ে পৌঁছান এবং ইয়ান’আনে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন, তখন বাড়ি থেকে একটি চিঠি তাঁর বাবার মৃত্যুর দুঃখজনক সংবাদ নিয়ে আসে। তাঁর সঙ্গীরা তাঁকে বাড়ি ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু ছংছিংয়ে জাপানি বোমা হামলা, তাঁর দৃঢ় সংকল্পকে আরও দৃঢ় করে তোলে। তিনি বলেন: ‘আমার পরিবার সত্যিই অনেক বড় দুর্ভাগ্যের সম্মুখীন হয়েছে, কিন্তু এখানে যারা কষ্ট পাচ্ছেন তাদের আমাকে আরও বেশি প্রয়োজন।’

ছাই ইউয়ে মুক্তা, সংবাদকর্মী, সিএমজি বাংলা


১৯৩৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে চিকিত্সা-সহায়তাদলটি হাজার হাজার মাইল ভ্রমণের পর ইয়ান’আনে পৌঁছায় এবং আহতদের চিকিত্সাসেবা দিতে শুরু করে। ‘সম্মুখ সারিতে একজনও আহত সৈনিককে না হারানোর’ প্রত্যয় নিয়ে তিনি গুলির আঘাতে আহতদের উদ্ধার করেছিলেন এবং তিন দিন ও রাত একটানা কাজ করেছিলেন।


কোটনিসের ভাগ্নী সুমঙ্গলা বোকা বলেন, যুদ্ধের আগুনে তাঁর ভাগ্য চীনা জনগণের ভাগ্যের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিল। দেশকে রক্ষা করার এবং জাতীয় ন্যায়বিচারের জন্য নিজেদের জীবন উত্সর্গ করার ক্ষেত্রে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব দ্বারা কোটনিস গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। ১৯৪২ সালে তিনি তাঁর সহকর্মীদের চিঠিতে লিখেছিলেন যে, অষ্টম রুট সেনাবাহিনীর সাথে তার মিথস্ক্রিয়া ‘আমার চরিত্র ও চিন্তাভাবনাকে ব্যাপকভাবে বদলে দিয়েছে’। একই বছর, তিনি চীনা কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন। ১৯৪২ সালের ৯ ডিসেম্বর হ্যেপেই প্রদেশের থাং জেলায় অসুস্থতার কারণে ডাক্তার কোটনিস মারা যান।


তার মৃত্যুতে পুরো সেনাবাহিনী একজন সাহায্যকারী হাত হারায় এবং জাতি হারায় একজন প্রকৃত বন্ধুকে। কোটনিসের আন্তর্জাতিকতাবাদী চেতনা এমন কিছু যা আমাদের কখনই ভুলে যাওয়া উচিত নয়। চীনের মহান নেতা মাও সে তুং এ কথা বলেছিলেন।


২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে ডাক্তার কোটনিসের জীবিত আত্মীয় হিসেবে সুমঙ্গলা বোকা বেইজিংয়ে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং কর্তৃক প্রদত্ত ‘জাপানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে চীনা জনগণের প্রতিরোধযুদ্ধের ৭০তম বার্ষিকী’-র স্মারক পদক গ্রহণ করেন। তিনি বলেন, ‘সেই মুহূর্তে আমার মনে হয়েছিল যে, ডাক্তার কোটনিসের নাম জাতীয় সীমানা ও সময়কে অতিক্রম করেছে এবং আমার স্মৃতিতে গভীরভাবে খোদাই হয়ে গেছে।’ তিনি আরও বলেন, এই সম্মান ডাক্তার কোটনিসের কর্মকে স্মরণ করে এবং সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত করে।
সি চিন পিং বহুবার ডাক্তার কোটনিসের গল্প বলেছেন। সুমঙ্গলা বোকার আবেগের সাথে বলেন, ‘চীনে আসার পরই আমি সত্যিকার অর্থে বুঝতে পেরেছিলাম যে, ডাক্তার কোটনিসের প্রতি চীনা জনগণের গভীর ভালোবাসা কতোটা।’


বর্তমানে শিচিয়াচুয়াং কোটনিস মেডিকেল সেকেন্ডারি ভোকেশনাল স্কুলে, যখনই নতুন শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয়, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা ডাক্তার কোটনিসের মূর্তির সামনে পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে তার গল্প বলেন।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে সুমঙ্গলা বোকারের ছেলে মঙ্গেশ বোকার স্মারক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের জন্য শিচিয়াচুয়াং ও বেইজিংসহ চীনের বিভিন্ন স্থান ভ্রমণ করেন। তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী সংকটের সময়ে একে অপরকে সাহায্য করেছে, মূল্যবান আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার রেখে গেছে। আজকের বিশ্বের সকল দেশ ও জাতিগোষ্ঠীর উচিত আন্তর্জাতিকতার চেতনাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং বিশ্বের ঐক্য ও অগ্রগতিতে যৌথভাবে অবদান রাখা।’