চীনের সমুদ্রসীমায় যখন ভোরের আলো প্রথম ছড়িয়ে পড়ে, তখন নীল জলরাশির ওপর জেগে উঠতে শুরু করে সুবিশাল এক ছায়া। ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয় মহাকাব্যিক এক অস্তিত্ব। চীনের নবযুগের প্রতীক—ফুচিয়ান এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার।
সুবিশাল এই জাহাজ যেন এক চলমান দ্বীপ, যার বুক চিরে জেগে ওঠে উড়ে যাওয়ার দুর্দান্ত প্রত্যয়। পৃথিবীতে মাত্র দুটি দেশ তৈরি করতে পেরেছে এ ধরনের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার, যার একটি হলো—চীন।
ফুচিয়ান প্রদেশের নামেই নাম রাখা হয়েছে এই বিমানবাহী রণতরীর। এর আরেক নাম টাইপ ০০৩। বিমানবাহী নৌযানটি ২০২২ সালের ১৭ জুন চীনের স্টেট শিপবিল্ডিং কর্পোরেশন-এর চিয়াংনান শিপইয়ার্ডে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়। এরপর থেকে ৮০ হাজার টন ওজনের জাহাজটি নিয়ে শুরু হয় নানা পরীক্ষা ও মহড়া। অবশেষে ২০২৫ সালের ১২ নভেম্বর হাইনান প্রদেশের সানইয়া বন্দরে এক জমকালো অনুষ্ঠানে ফুচিয়ান রণতরীর হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে পতাকা হস্তান্তর করেন চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং।
ওই অনুষ্ঠানে চীনা নৌবাহিনীসহ নানা প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার প্রায় দুই হাজার কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। এমন জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানেই মূলত বোঝা যায়, এ ধরনের অত্যাধুনিক বিমানবাহী রণতরী একটি দেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার প্রশ্নে কতটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
ফুচিয়ান টাইপ শূন্য শূন্য তিন এর দুটি পূর্বসূরী আছে। একটি হলো সিএনএস লিয়াওনিং এবং আরেকটি সিএনএস শানতোং। ওই দুটো ক্যারিয়ার জাহাজে ফাইটার জেট উড্ডয়নের জন্য রয়েছে স্কি–জাম্প র্যাম্প। আর ফুচিয়ান চীনের প্রথম বিমানবাহী রণতরী যাতে ব্যবহার করা হয়েছে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ক্যাটাপল্ট লঞ্চ সিস্টেম। বিশ্বে এ সিস্টেম আর আছে কেবল যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীতে।
কী এই ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ক্যাটাপল্ট সিস্টেম, যার কারণে আন্তর্জাতিক মহলে এত কদর পাচ্ছে ফুচিয়ান? এ নিয়ে এবার জানা যাক সংক্ষেপে।
ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ক্যাটাপল্টকে ইংরেজিতে বলে ইমালস, যার পূর্ণরূপ হলো ইলেকট্রোম্যাগনেটিক এয়ারক্রাফট লঞ্চ সিস্টেম। প্রচলিত উচ্চতাপের বাষ্পের পরিবর্তে এখানে বিমানকে সজোরে নিক্ষেপ করতে ব্যবহার করা হয় বিদ্যুৎচুম্বকীয় শক্তি। আর এ শক্তি তৈরি করতে ব্যবহার করা হয় শক্তিশালী লিনিয়ার ইনডাকশন মোটর।
এই সিস্টেমটি বিমানবাহী রণতরীতে ব্যবহৃত হয় স্থির‑ডানা বা ফিক্সড উইং বিমানের উড্ডয়নের জন্য। এটি ইলেকট্রোম্যাগনেটিক এবং লোরেন্টজ ফোর্স নামের শক্তির সাহায্যে বিমানকে দ্রুত গতিশক্তি দেয় এবং এটি থাকলে ছোট রানওয়ে থেকেও ফাইটার জেট সহজে উড্ডয়ন করতে পারে।
ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ক্যাটাপল্ট বিদ্যুতের শক্তি ব্যবহার করে কাজ করে, তাই এটি স্টিম ক্যাটাপল্টের চাপে বাষ্প তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়ার চেয়ে অনেক দ্রুত। অর্থাৎ জরুরি পরিস্থিতিতে এই সিস্টেমে দ্রুত যুদ্ধবিমান টেকঅফ করতে পারবে। আবার বিদ্যুৎ ব্যবহার করার কারণে এতে তাপমাত্রার পরিবর্তন বা লিক হওয়ার কোনো ঝামেলা নেই।
অন্যদিকে বাষ্পীয় সিস্টেমগুলোয় বাষ্পের বিস্তার যত বেশি হয়, চাপ তত কমে যায় এবং তাপমাত্রার পরিবর্তনও সরাসরি বিমান উড্ডয়নের গতিতে প্রভাব ফেলে। ইলেকট্রোম্যাগনেটিক সিস্টেমে এসবের কোনো বালাই নেই।
আবার ইলেকট্রোম্যাগনেটিক গতিশক্তিটা হয় সুষম। বাষ্পনির্ভর ক্যাটাপল্টে যেটা ঘটে, তাতে প্রাথমিক সময় যুদ্ধবিমান খুব জোরে একটা ধাক্কা পায়। এতে বেশ ঝাঁকুনি অনুভূত হয়। ইলেকট্রোম্যাগনেটিক পদ্ধতিতে এমন কোনো ঝটকা লাগে না, তাই বিমান ও এর কাঠামোর ওপর চাপ অনেক কম পড়ে। এতে যুদ্ধবিমান নিরাপদ থাকে, দীর্ঘসময় ব্যবহারযোগ্য হয় এবং রক্ষণাবেক্ষণ খরচও কমে আসে।
বিদ্যুৎচুম্বকীয় ক্যাটাপল্টকে প্রয়োজন অনুযায়ী কনফিগার করা যায়। বিভিন্ন অংশে ভিন্ন শক্তি ব্যবহার করে, বিভিন্ন বিমান ও তাদের ওজন অনুযায়ী সবচেয়ে উপযোগী গতি তৈরি করা যায় এ সিস্টেমে।
ইলেকট্রোম্যাগনেটিক সিস্টেমের আকারও ছোট, ওজন কম। তাই এর নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ কম খরচে হয়। এই সিস্টেমে নতুন করে বারবার পানি গরম করার প্রয়োজন হয় না বলে শক্তি সাশ্রয় হয় এবং জটিল পাইপিং ব্যবস্থার প্রয়োজনও নেই। তাই রণতরীর জায়গাও অনেকটা বেঁচে যায়।
এই ফাঁকে জানিয়ে রাখি, চীনের বিমানবাহী রণতরীতে যাতে সর্বাধুনিক বিদ্যুৎচুম্বকীয় ক্যাটাপল্ট যুক্ত করা হয়, এমন নির্দেশ দিয়েছিলেন চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও দেশের সামরিক কশিমনের চেয়ারম্যান প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং।
ফুচিয়ান ক্যারিয়ার জাহাজে চীনের সর্বাধুনিক ফাইটার জেট জে-১৫টি, জে-১৫ স্টেলথ ফাইটার ও কেজে-৬০০ আর্লি ওয়ার্নিং এয়ারক্রাফট; এ তিনটিই উড়তে পারবে। এগুলো মূলত ফুচিয়ানের ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ক্যাটাপল্ট প্রযুক্তির উপযোগী করেই বানানো হয়েছিল।
যুদ্ধে নিজের দক্ষতার কথা জানান দিতে ফুচিয়ান বিমানবাহী রণতরীতে আছে বড় ফ্লাইট ডেক এবং সমান্তরাল বিমান উৎক্ষেপণ ও অবতরণ ব্যবস্থা। চীনের সামরিক বিশ্লেষক ওয়েই তোংসু জানালেন, ফুচিয়ানের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো এতে একই সময়ে বিমান উৎক্ষেপণ ও অবতরণ করতে সক্ষম। অর্থাৎ, একটি বিমান ক্যাটাপল্ট দিয়ে উড়ার সময় অন্যটি অবতরণ করতে পারে, কোনো বাধা সৃষ্টি হয় না।
এই ফুচিয়ান বিমানবাহী রণতরীতে জে-১৫টি ফাইটার। এর আরেক নাম ‘উড়ন্ত হাঙর’। ২০২৪ সালে চীনের এয়ারশোতে উন্মোচিত হয়েছিল এ ফাইটার জেট। আবার ফুচিয়ানে চীনের তৈরি উন্নত স্টিলথ মাল্টি-রোল ফাইটার জে-৩৫এ-এর একটি ক্যারিয়ার সংস্করণও উড়তে পারবে।
জে-৩৫ ফাইটারটি ফুচিয়ান ক্যাটাপল্টের মাধ্যমে টেকঅফ করতে পারবে সর্বোচ্চ ৩০ টন ওজন নিয়ে। বিমানটি অনায়াসে বহন করতে পারবে এয়ার-টু-এয়ার মিসাইল ও নিখুঁতভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার মতো অস্ত্র। সেইসঙ্গে শত্রুর যুদ্ধজাহাজ, ফাইটার জেট ও ভূমিতে থাকা এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমও ফাঁকি দিতে পারে এটি।
একটি বিমানবাহী জাহাজের নৌবহর আকাশ প্রতিরক্ষার জন্য একটি বড় এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। চীনের আগের দুটি সহ এখন মোট তিনটি রণতরী হলো। তাই এই নিয়ন্ত্রণ এলাকার ব্যাপ্তিও হবে বিশাল। এ ছাড়া কয়েকদিনের অপারেশনের পর একটি জাহাজের জন্য জ্বালানি ও গোলাবারুদ পুনরায় সরবরাহ করতে হয়। সরবরাহ ও সংযোজনের ওই সময়টায় দরকার হয় প্রতিরক্ষা। ফুচিয়ানের জন্য ‘রক্ষাকারী ছাতা’ হিসেবে কাজ করবে সিএনএস লিয়াওনিং ও সিএনএস শানতোং। তিন নম্বর জাহাজটি বহরে যুক্ত হওয়ায় এখন স্বাভাবিকভাবেই সমুদ্রযুদ্ধে বিরামহীন লড়াই চালিয়ে নেওয়ার সক্ষমতা বেড়ে গেল চীনের।
ফুচিয়ান রণতরী কেবল চীনের সামরিক শক্তিমত্তা নয়, দেশটির শিল্পখাতের সক্ষমতারও একটি বড় নজির। যুদ্ধবিমান বানানো থেকে শুরু করে সেই বিমানকে চটজলদি ওড়ানোর মতো ক্যারিয়ার জাহাজ; পুরো প্রক্রিয়াটাই এখন চীনের নখদর্পণে। আর এ বার্তা কিন্তু পৌঁছে গেছে বিশ্বের যাবতীয় বিনিয়োগকারী, উদ্যোক্তা ও অন্যান্য বড় অর্থনীতির কাছে।
ফুচিয়ান বিমানবাহী রণতরী যেন চীনের সমুদ্রে ভেসে থাকা এক প্রাযুক্তিক মহাগ্রন্থ। যে জাহাজের ডেকে আছে দুর্বার ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক শক্তিবলয়। যে শক্তি ফাইটার জেটগুলোকে ছুড়ে দেয় ভবিষ্যতের দিশা ঠিক করে দেওয়ার জন্য। ঢেউ কেটে এগিয়ে চলা এই বিশাল জাহাজ যেন জানিয়ে দেয়—দৃঢ় প্রত্যয় থাকলে উত্তাল সমুদ্রেও লেখা যায় শক্তি ও আত্মমর্যাদার আখ্যান।
সূত্র: সিএমজি বাংলা