হুজুর যখন বলছিলেন ‘হে আল্লাহ আমাদের সকলের মধ্যে হানাহানি বন্ধ করে দাও’ ঠিক তখনই প্রথম কোপটা মারা হয়। একদম দক্ষ হাতের নিপুন আঘাত। একজন বললো ‘শালার রগটা ভালোভাবে কাটে নাই, ঠিকমত বসা।’ এবার আর ভুল হলো না গলার আর চিবুকের সন্ধিস্থলে বসানো হলো আরেকটা কোপ। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল। এরপরও এলোপাথারি আরও কতগুলি কোপ মারা হল। রক্ত যখন ছিটকে গিয়ে সাত্তারের মুখে লাগল, সে একটা তৃপ্তির নিশ্বাস নিল। অস্ফুষ্ট ভাষায় বললো ‘শুয়োরের বাচ্চা শ্যাষ’। তখনও দেহটা কয়েকবার ঝাঁকি দেবার চেষ্টা করলো। নিষ্ফল প্রচেষ্টা। ৫/৬ জন তাগড়া জোয়ানের সাথে পেরে উঠলো না ১৮ বছরের তরুণ আলীম।
ভোর রাতে আজান হল আসসালাতু খাইরুম মিনান নাওম। মাহফিল শেষে লোকজন নামাজের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। বাচ্চা ছেলে মেয়েরা ঘুম জড়ানো চোখ নিয়ে বাড়ি ফিরছিল। হঠাৎ কেউ একজন চিৎকার করে বললো ‘খুন, খুন, খুন’। ভোরের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে শত শত লোক ছুটে গেল কবরস্থানের কাছে। দেখা গেলো রক্ত মাখা গুটিশুটি মারা একটা লাশ পড়ে আছে সেখানে। পুকুর পাড়ে। মানে পয়দা বাজার সংলগ্ন কবরস্থানের পুকুর পাড়ে। মুরুব্বি গোছের একজন বলল, “মনে হয় মাহফিল যখন চলছিল তখনই কাজটা হয়েছে।”
একটা বাচ্চা ছেলে বলল, “আরে এতো আলীম, পয়দা বাজারে সেলুনে কাজ করে।” এবার শোরগোল বেড়ে গেল। খানিক বাদেই খবর পেয়ে ছুটে আসলো আলীমের পরিবার পরিজন। বুক চাপড়ে কাঁদতে লাগল তার বড় ভাই মতিন। কিন্তু, কেন এই হত্যাকাণ্ড? কি এমন করেছিল আলীম? কারা ঘটালো এই ঘটনা কোন কিছুরই ইয়াত্ত্বা নেই। তারপর …
যথারীতি পাবনা সদর থানায় মামলা রুজু হল। মামলা নং- ৭৩ তাং- ২২/০২/২০১৮ ইং। কিন্তু, এফআইআরএ আসামির কোন নাম উঠল না। উঠবে ক্যামনে করে? কেউই তো জানে না, কি হয়েছিল সেদিন। দিব্যিই তো ছেলেটা বিকেল বেলা বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়েছিল। রাতে বাজার থেকে টুকিটাকি জিনিসও কিনেছিল। তাছাড়া বয়সই বা কি এমন হয়েছে তার যে শত্রু জন্মাবে। থাক সে কথা, এই মামলার তদন্ত করতে গিয়ে যে গলদঘর্ম হতে হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সদর সার্কেল মোঃ ইবনে মিজান ও ওসি সদর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে চিন্তায় পড়ে গেলেন। কেননা পাশেই বাৎসরিক ওয়াজ মাহফিল চলছিল। তবে কারা ঘটালো এমন নৃশংস ঘটনা। পুরো ঘটনা তারা পুলিশ সুপার জনাব জিহাদুল কবির পিপিএম স্যারকে জানালেন। সব শুনে স্যার বললেন, “বিচক্ষণ একজন আইও নিয়োগ করো। বাকিটা সময় আমরা তো সাথেই আছি।” স্যারের নির্দেশনা অনুযায়ী সদর থানার অন্যতম বিশ্বস্ত অফিসার এসআই আব্দুর রাজ্জাককে মামলার তদন্তভার দেওয়া হল। অত্যন্ত প্রাণ চঞ্চল পরিশ্রমী অফিসার এসআই আব্দুর রাজ্জাক। ‘না’ শব্দটা তার অভিধানে নেই। যেখানে অন্যরা ঝামেলা এড়াতে চাইছে সেখানে তিনি সাদরে গ্রহন করলেন মামলাটি।
দিনের পর দিন রাতের পর রাত পড়ে থাকলেন ঘটনাস্থল সংলগ্ন এলাকায়। লেগে থাকলে ফল আসবেই। আসতেই হবে। ২/১ দিন পরই জানতে পারলেন ঘটনার পর থেকে নিলয় (ছদ্ম নাম) নামে আলীমের এক বন্ধু পলাতক রয়েছে। লোক মুখে শোনা যায়, ঘটনার পর তার আচরন অস্বাভাবিক ছিল। ঘটনার ১৩ দিনের মাথায় ধরা পড়ল নিলয় (ছদ্ম নাম)। ১৪/১৫ বছরের কিশোর সে। আটকের পর সে জানায় ঘটনার দিন সন্ধ্যা বেলায় বাজারে ক্যারাম খেলছিল সে আর রজব। হঠাৎ গুটি পড়ে গেলে উঠাতে গিয়ে রজবের কোমর থেকে খসে পড়ে ধারালো টাঙ্গি। রজব খুব তাড়াতাড়ি করে আবার তা কোমড়ে গুঁজে নেয়। এর বেশি সে জানে না।
এবার শুরু হল রজবের খোঁজ। অনেক কাঠ খড় পোড়ানোর পর জানা গেল একজনের বাড়িতে গরুর দুধ দোয়ানের কাজ নিয়েছে সে। কৌশলে গ্রেফতার করা হল তাকে। ১৮/১৯ বছর বয়স হবে তার। পুলিশের সম্মুখে প্রথমে সে কিছুই বলতে চাইলো না। কিন্তু চৌকস অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মোঃ ইবনে মিজান, পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাঃ জালাল উদ্দিন, পুলিশ পরিদর্শক (অপঃ) মোঃ হাফিজুর রহমান, আর শ্যেন দৃষ্টির রাজ্জাকের উপর্যপুরি জেরার মুখে বেশিক্ষণ টিকতে পারলো না সে। মুখ খুলতে শুরু করলো, বেরিয়ে এল এক ভয়ঙ্কর তথ্য।
পয়দা বাজারে চায়ের দোকান সাত্তারের। বয়স অনুমান ৩৫/৩৬ হবে। পাশেই সেলুনে কাজ করতো আলীম। নাপিতের কাজ করলে কি হবে, সে শিক্ষিত। এইবার এইচএসসি পরীক্ষার্থী। সেই সাথে চেহারাটাও মাশাল্লাহ। ছেলেটা স্মার্টও কম না। এলাকায় প্লে-বয় হিসেবে তার খ্যাতি আছে। এদিকে মাঝে মাঝেই সাত্তারের অনুপস্থিতিতে দোকান চালায় তার বউ। বয়স ২৮/২৯ হবে। দুই সন্তানের মা হলেও এখনও অনেক তরুণীই তাকে হিংসে করে। পাশাপাশি দোকান হওয়ায় অল্পদিনেই অসম প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে আলীম ও রীবার। এক সময় তা শারীরিক সম্পর্ক পর্যন্ত গড়ায়। টের পেয়ে যায় সাত্তার। নিষেধ করে বউকে। কিন্তু, কোনো কাজ হয়নি। অবশেষে আলীমকেই শেষ করার ফন্দি আঁটে সে। টাকা দিয়ে বায়না করে এলাকার কিছু নকশালকে (তদন্তের স্বার্থে নাম গোপন রাখা হল)। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী বাৎসরিক ওয়াজ মাহফিলের দিন ডেকে আনা হয় আলীমকে। তারপর গল্প গুজব চলে অনেকক্ষণ। রাত ০১টা, ০১.৩০টার দিকে যখন মাইকের আওয়াজ ছাড়া কিছুই শোনা যাচ্ছিল না, পুরো এলাকাবাসী জিকির আসগারে মশগুল ছিল, ঠিক তখনই খতম করা হয় আলীমকে।
ঘটনা এতটুকুই। রজব বিজ্ঞ আদালতে ১৬৪ ধারায় দোষ স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দি দিয়েছে। তার সহযোগিদের নাম বলেছে। মজিবর নামে আরও একজন গ্রেপ্তার হয়েছে। বাকিদের গ্রেফতারের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। হয়ত একদিন মামলার চার্জশিট হবে। আসামিদের বিচার হবে। সাজা হবে। কিন্তু, মায়ের বুকে ফিরবে কি আলীম? কি জবাব দেবে রীবা তার সন্তানদের? সাত্তারের মনের কষ্ট কি কেউ বুঝবে কোনো দিন? সভ্য এই পৃথিবীর অসভ্য দংশনের শেষ কোথায় …
লেখক : আশীষ বিন হাসান , অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, বেড়া সার্কেল, পাবনা।
জিহাদুল কবির, এসপি পাবনা -এর ফেসবুক থেকে