ক্যাডার সার্ভিসের শিক্ষকদের মধ্যে অন্য ক্যাডারে যাওয়ার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। এরইমধ্যে নিজ ক্যাডার ছেড়ে অন্য চাকরিতে চলে গেছেন প্রায় কয়েকশ শিক্ষক। সম্প্রতি শিক্ষা ক্যাডারে চাকরি পেয়েও যোগ দান করেননি ৯৫ জন শিক্ষক ।
এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন—শিক্ষা ক্যাডারে ক্যারিয়ার নেই। পদোন্নতিসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও অপ্রতুল। কাজের চাপ বাড়ে ঠিকই তবে জনবল বাড়ে না। এ সব কারণেই শিক্ষা ক্যাডার ছেড়ে অন্য ক্যাডারকেই উপযুক্ত মনে করছেন শিক্ষকরা।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, অনুমতি না নিয়ে ৪১তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন ২৬ জন শিক্ষক। তাদের মধ্যে গণিত, বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক রয়েছেন।
অন্যদিকে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আদেশে আরও ২৬ জন কর্মকর্তাকে ৪১তম বিসিএস মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিতে ছাড়পত্র দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কারিগরি শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালককে এই নির্দেশ দেওয়া হয় গত ১৩ মার্চ।
আদেশে দেখা গেছে, এরমধ্যে রয়েছে গণিত, ইংরেজি, বিজ্ঞান, রসায়নের শিক্ষক। একজন বাংলার শিক্ষক।
গত বছর শিক্ষা ক্যাডারের আইসিটি বিষয়ের ২৫৫টি পদের বিপরীতে যোগদান করেছে মাত্র ১৬০ জন। অন্যরা যোগদান করেননি।
২০২১ সালে ৩২তম বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের এক কর্মকর্তা চার বছর চাকরির পর পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি নিয়েছেন। একইভাবে আনসার ক্যাডারের সহকারী পরিচালক পদে যোগদান করেছেন উদ্ভিদবিজ্ঞানের শিক্ষক। খুলনার সরকারি ব্রজলাল কলেজে মার্কেটিংয়ের এক শিক্ষক চার বছর চাকরির পর প্রশাসন ক্যাডারে চলে গেছেন। এভাবে গত কয়েক বছরে শতাধিক শিক্ষক পেশা বদল করেছেন।
শিক্ষা ক্যাডারের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, যেকোনও ক্যাডারের তুলনায় শিক্ষা ক্যাডারে কর্মরতরা বৈষম্যের শিকার হন বেশি। সরকারের একজন উপ-সচিব গাড়ি কেনার জন্য ঋণ পান এবং চালকসহ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আরও ৫০ হাজার টাকা পান। অথচ একজন অধ্যাপক পদমর্যাদার শিক্ষক গাড়ি কেনার জন্য কোনও ঋণ নিতে পারেন না। চতুর্থ গ্রেডের ওপরে যাওয়ার সুযোগ নেই। শিক্ষকদের সম্মানের চোখে দেখা হয় না। নানা কারণেই যখন অন্য পেশায় যাওয়ার কেউ সুযোগ পান তখন চলে যান।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) অধ্যাপক শাহেদুল খবির চৌধুরী বলেন, ‘প্রত্যেকেই কর্মজীবনে ভালো ক্যারিয়ারের চেষ্টা করেন। সঠিক সময়ে পদোন্নতিসহ অন্যান্য যেসব সুযোগ-সুবিধা একজন ডিজার্ভ করেন, কিন্তু যখন দেখেন এটি হচ্ছে না—তখন অন্য পেশায় চলে যান। শিক্ষা ক্যাডারে তেমন কোনও প্রশিক্ষণ নেই। একটি ফাউন্ডেশন ট্রেনিং হয়, তাও আংশিক। ছয় মাসের ট্রেনিং হওয়ার কথা, চার মাসের হয়। এসব নানা কারণে শিক্ষা ক্যাডারে এসে অনেকে হতাশার মধ্য দিয়ে যায়।’
তিনি আরও বলেন, শিক্ষা ক্যাডার সৃষ্টির পর থেকেই অনেক বঞ্চনা। সম্পূর্ণ বিধিভঙ্গ করে জাতীয়করণের মাধ্যমে ক্যাডারমেন্ট হওয়া, প্রকল্প থেকে ক্যাডারমেন্ট হওয়া, ১০ শতাংশ কোটার চিত্রের বিপরীতে যারা সরাসরি ক্যাডার হয়ে চাকরিতে রয়েছেন তাদের মধ্যে হতাশা দেখা যায়।
এসব কারণে শিক্ষা ক্যাডারের আবহ নষ্ট হচ্ছে। শিক্ষক স্বল্পতার কারণে অনেক বেশি কাজ করতে হয়।
তিনি আরও বলেন, কারিকুলামের পরিবর্তন হয়েছে, কোর্স বেড়েছে, কিন্তু শিক্ষক সংখ্যা কাম্য পর্যায়ে নেই। ফলে অনেক চাপ নিয়ে কাজ করতে হয়। তারা দেখছে—তার বড় ভাই বা বোনদের পদোন্নতি হচ্ছে না।
শিক্ষা ক্যাডারের সর্বোচ্চ পদোন্নতি পেয়ে চতুর্থ গ্রেড পর্যন্ত সবার যাওয়ার সুযোগ থাকলেও অন্যরা যেতে পারবেন না। কয়েকটি পদ থাকলেও তা দখল হয়ে যাচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর ও মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতরের বড় পদগুলোতে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা চলে আসছেন।
যেসব পদ আছে দিন দিন সেগুলোতেও অন্য ক্যাডারের লোক বসে যাচ্ছে। শিক্ষার পরিসর যেভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে, সেভাবে পদ বাড়েনি। ফলে অফিসগুলোতে কাজের চাপ বাড়লেও জনবলের ঘাটতি রয়েছে।
শিক্ষার সম্প্রসারণ করা হলেও জনবলের দিকে নজর নেই। অনেক শিক্ষক চাকরি ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন তাদের ক্যারিয়ারের প্রয়োজনে। আইসিটিতে ২৫৫টি পদের বিপরীতে যোগদান করেছে মাত্র ১৬০ জন। অন্যরা যোগদান করেননি। এরমধ্যে আবার হয়তো অনেকে চলে যাবেন।