অটিস্টিক শিশু : মা-বাবার জন্য কিছু পরামর্শ

অটিস্টিক শিশু সংসারে আসার পরে বাবা-মা সহ সবাই দিশেহারা হয়ে যান। আত্মীয়-স্বজন পাড়া-প্রতিবেশী অনুমান করে করে উল্টাপাল্টা কথা বলে বিভিন্নভাবে দোষারোপ করেন তাতে মা-বাবারা আরো ভড়কে যান। শিক্ষকদেরও ভালো ধারণা না থাকাইয় সঠিক পরামর্শ দিতে পারেন না। অনেক ডাক্তাররাও তাই। এ অবস্থায় মা-বাবারা চিন্তায় পড়ে যান কি করবেন কোন দিকে যাবেন।

 

যথাসম্ভব উচ্চাশা পরিহার করুন 

  • আপাতত অটিস্টিক শিশু কে জীবন চলার মতো ন্যূনতম স্কিল শেখানোর টার্গেট করুন।
  • অন্য স্বাভাবিক শিশুর সঙ্গে তুলনা করতে যাবেন না। তাই সংগীত, ছবি আঁকা এসব দিকে গুরুত্ব দিলে বরং কিছুটা আগাতে পারবে।
  • যেটুকু কাজ তাকে দিয়ে হতে পারে তাই তাকে দিয়ে করান।  সংসারের কাজগুলো শেখানোর চেষ্টা করুন।
  • মন থেকে অপরাধবোধ বা নেগেটিভ চিন্তা পরিত্যাগ করুন। বাস্তব পরিস্থিতি মেনে নিয়ে কিভাবে বর্তমান অবস্থায় শান্তিতে থাকা যায় তাই চিন্তা করুন। নিজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তুলুন।
  • বিশেষ স্কুল খুঁজে শিশুদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করুন। নরমাল স্কুলের ঝুঁকি না নেওয়াই ভালো। কারণ ওখানে আন্তরিক শিক্ষক, বন্ধু-বান্ধব পাওয়া মুশকিল হবে। ফলশ্রুতিতে শিশুটি বুলিংয়ের শিকার হবে।

 

বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিন

কোনো অলৌকিক ক্ষমতা বা দৈবশক্তির উপর ভর না করে অটিজমের মাত্রা জেনে তার জন্য বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, অটিজম এক্সপার্টদের পরামর্শ মতো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিন।

 

বাড়িতে যেভাবে অটিস্টিক শিশুদের যত্ন নিবেন

  • শিশুদের পছন্দ-অপছন্দ চাওয়া ভালোবাসা এসব জিনিসকে গুরুত্ব দিন। এই গুলোর তালিকা করে পরিবারের সব সদস্য এবং স্কুলে প্রশিক্ষকের সাথে এগুলো শেয়ার করুন।
  • কোনো কোনো বিষয়ে পুরস্কারে, তিরস্কারে সে কিভাবে রি-এক্ট করে? কি কি করতে পারে? কি কি করতে পারে না এসবেরও তালিকা করে পরিবারের সদস্য ও প্রশিক্ষক এর সাথে শেয়ার করুন।
  • যেসব কাজ সে ভালোভাবে করতে পারে বা আনন্দ পায় সেসব কাজে তাকে বেশি করে নিয়োগ করুন। কম্পিউটার, পড়া, ড্রইং, গান শোনাও এসব কাজের রুটিন করে দিন।
  • তাকে সামাজিক রিইনফোর্সমেন্ট দেওয়ার সুযোগ খুঁজতে থাকুন। কোনো কাজে তাকে প্রশংসা করার সুযোগ হাতছাড়া করবেন না। প্রতিটি সুন্দর আচরণের বা তাদের জন্য ধন্যবাদ দিন, প্রশংসা করুন।
  • শিশুর সারাদিনের কাজকে রুটিনের মধ্যে নিয়ে আসুন। পারতপক্ষে এর যাতে কোনো পরিবর্তন না হয়। সকালে ঘুম থেকে উঠে ব্রাশ করা থেকে শুরু করে রাতে ঘুমানো পর্যন্ত তার কাজের ধারাবাহিকতা ও স্থানের কোন পরিবর্তন না করে তাকে পরিচালনা করন।
  • অনিবার্য কারণে রুটিনে পরিবর্তন হলে প্রোএকটিভ হয়ে আগে ভাগে তা নিয়ে আলোচনা করুন। এ ক্ষেত্রে তাঁর আনন্দের আরো কোনো প্রোগ্রাম দিয়ে মিস হওয়া প্রোগ্রাম পূর্ণ করুন।
  • তার ভাই বোন, বন্ধুবান্ধব সবার সহযোগিতা আদায় করতে তাদের সাথে মত বিনিময় করুন। তারাই তাকে সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারে।
  • স্কুলের IEP তৈরিতে মত বিনিময় করুন। IEP অনুযায়ী প্রত্যেক দিন স্কুলে করা কাজের বাড়িতে প্র্যাক্টিস করান। স্কুল ও বাড়ি মিলিয়ে সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা প্রাক্টিস নিশ্চিত করুন।

 

নাম ধরে কথা বলবেন

  • নেগেটিভ কথা পরিহার করে পজিটিভভাবে বলুন।
  • লম্বা বাক্য দিয়ে কথা বলবেন না। ছোট ছোট বাক্য দিয়ে কথা বলুন, নাবিহা আসো, দিয়া পড় ইত্যাদি।

 

তার রুটিন অনুযায়ী মাঝে মাঝে পরের কাজ মনে করিয়ে দিন; নাস্তা শেষ হলে কাপড় পরা। শেষ করা কাজটি ক্রস করে রাখবেন।

তার নিজের কাজ নিজে করতে তাকে নিয়োজিত করুন। এসব কাজের রুটিন টিক করে রাখতে পারেন। যেমন ঘুমাবার আগে তার করণীয় লিখে দেয়ালে টাঙিয়ে রাখুনঃ

ক.  নিজের বেড পরিষ্কার করা

খ.  ময়লা কাপড় সরিয়ে রাখা

গ.  বইগুলো সেলফি রাখা

ঘ. স্কুলের নোটবুক ব্যাগে রাখা

ঙ. খেলনা গুলো খেলনা বক্সে রাখা

চ. ঘরের মেঝে পরিষ্কার করা

 

  • মিথ্যা বলা পরিহার করুন। তার সাথে বলা প্রতিশ্রুতি সময় মতো পালন করুন।
  • তার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলুন। কথা বলার সময়ে তার  সমান্তরালে থাকবেন এবং যেকোনো কিছুতেই যৌথ মনোযোগ দিন।
  • তার প্রিয় ব্যক্তি, বন্ধুর বাসায় আসা যাওয়া, তার সাথে কথা বলা ঘন ঘন করান।
  • তার সাথে শান্ত, রিলাক্স স্বরে কথা বলুন। উত্তেজিত হয়ে কথা বলবেন না।
  • তাকে টিজ করা বা  বোলিং থেকে রক্ষা করুন। এমন পরিবেশ থেকে  সরিয়ে রাখুন।

 

অটিস্টিক শিশু : সমস্যাগুলো কিভাবে মোকাবেলা করবেন

চোখের দিকে না তাকিয়ে কথা বলাঃ  সব সময় তার চোখের সমান্তরালে চোখ রেখে কথা বলুন। বাসার বিভিন্ন জিনিসের প্রতি ইশারা করে একসাথে তাকান। প্রয়োজনে পাশাপাশি বসে সামনে আয়না ধরে কথা বলুন।

 

অটিস্টিক শিশু ও টয়লেটের সমস্যাঃ এসব শিশুদের অনেকেরই টয়লেটের সমস্যা হয়। ঠিকমত বলতে পারে না, করতেও পারে না। টয়লেটে কিভাবে কাজ করতে হয় তার ফ্লো-চার্ট টয়লেটের দেয়ালে টানিয়ে রাখুন। সে অনুযায়ী প্র্যাকটিস করান। নির্দিষ্ট সময়ে টয়লেটে নিয়ে যান।  প্রয়োজনে ঘরে কাপড় খুলে গামছা বা তোয়ালে পরিয়ে টয়লেটে নিয়ে যান। দেয়ালে রাখা চার্ট অনুযায়ী তাকে কাজগুলো প্রম্পট দিয়ে দিয়ে শিখিয়ে দিন। এসব কাজে তাকে স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করুন।

 

ঘুমের সমস্যাঃ দৈহিক ও মানসিক পরিশ্রম না করাতে অনেক অটিস্টিক শিশু নিয়ম মত ঘুমায় না। সারারাত বকবক করে কাটিয়ে দিতে পারে। একটু ঘুমালেও তারপর জেগে উঠে বকবক শুরু করে দেয়।

 

যা করতে পারেনঃ

ক. প্রতিদিন সময়মতো ঘুমাতে নিয়ে যান।

খ. ছোট থাকতে পাশে নিয়ে ঘুমান।

গ. বড় হয়ে গেলে আলাদা বিছানা করে দেন। তবে প্রথম প্রথম তার সাথে আলাদা বিছানায় ঘুমান। মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়ান। হালকা আলো  বা হালকা সুরের গান কাজে লাগতে পারে। ঘুম আসলে পরে আস্তে আস্তে করে সরে আসুন।

প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। তবে ঘুমের ঔষধের দীর্ঘমেয়াদে কোন লাভ হয় না। অভ্যাস পরিবর্তন কাজে লাগে।

 

খাবার সমস্যাঃ অধিকাংশ অটিস্টিক  শিশুর খাবারের সমস্যা রয়েছে। তারা-

ক. তাদের পছন্দের একই ধরনের খাবার অনেকদিন খায়। নতুন কোন খাবার খেতে চায় না।

খ. অনেকে মুখে তুলে খায় না।

গ. অটিস্টিক শিশুদের অনেকেই গিলে খায়, চিবায় না।

ঘ. অনেকে বাড়ির সবার সাথে খেতে চায় না। একা একা খায়।

ঙ. কেউ আমিষ জাতীয় খাবার খেতে চায়, কেউ আলু বা অন্য শর্করা জাতীয় খাবার, কেউ ভাজাপোড়া জাতীয় খাবার, মিষ্টি, চকলেট পছন্দ করে। অথচ তাদের ডাক্তাররা ওজন বেড়ে যাওয়া, ক্যালোরি ক্ষয় না হওয়ায় এসব খাবার মানা করেন।

 

কী করবেন

ক. প্রতিদিন পছন্দের খাবার প্রথমে দিন। এরপর নতুন খাবার দিন। হয়তো ফেলে দিবে। তারপরও প্র্যাকটিস করান। মাছ মাংসের সাথে তরকারি পাক করে দিন, যাতে আস্তে আস্তে তরকারি খাবার অভ্যাস হয়।

খ. মুখে ভাত নিয়ে বসে থাকলে তার দিকে না তাকিয়ে অন্যদিকে মনোযোগ দিন। আস্তে আস্তে খেয়ে ফেলবে।

গ. অটিস্টিক শিশু নিজের হাতে খেতে না চাইলে প্রথমে চামচ দিয়ে খাওয়ান, আস্তে আস্তে তাকে হাত দিয়ে খাওয়ানোর অভ্যাস করেন। হাতের পেশি শক্ত করতে রাবারের মন্ড, আটার মণ্ড তাকে পাকাতে দিন। খাবার টেবিলে গ্লাসে পানি ঢালা, প্লেটে ভাত নেওয়া, তরকারি নেওয়া এসব তার হাত দিয়েই করান।

 

কাপড় ও জুতা পরা ও খোলা

এসব ক্ষেত্রে নিজে নিজে পুরোটা করে দিবেন না। প্রথমে বেশি প্রম্পট দিয়ে আস্তে আস্তে প্রম্পট সরিয়ে তাকে নিজে নিজে করতে দিন। একসাথে সব করতে না দিয়ে পার্ট পার্ট করে করতে দিন। আজ পায়ে জুতা ঢোকাতে দিন, জুতা ঢুকানো শিখলে মোজা পরা, তারপর ফিতা লাগানো এভাবে আগাতে পারেন। কাপড় পরার ক্ষেত্রেও তাই।

 

অটিস্টিক শিশুর আচরণগত সমস্যা

যেহেতু শিশুরা অন্য শিশুদের মত কথা বলে নিজেকে প্রকাশ করতে পারে না তাই তারা আচরণ দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করে তারা তাদের আচরণ দিয়েই কিছু না কিছু বলতে চায়। তাই সব আচরণকে পজিটিভ ভাবে গ্রহণ করতে হবে।

তার যেকোনো প্রকাশ ভঙ্গিকে বুঝে নিয়ে সে অনুযায়ী নরমাল শিশুদের মত তার কথাটাই জিজ্ঞেস করুন। পানি খাবে, বাথরুমে যাবে ইত্যাদি বলে তার চাহিদা পূরণ করুন।

ব্যায়ামের সামগ্রী বাসায় রাখতে হবে যাতে শিশুর উত্তেজিত অবস্থাকে ব্যায়াম দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

 

অটিস্টিক শিশু উত্তেজিত হলে কী করবেন

শিশু যদি উত্তেজিত হয়ে যায় তবে তার কারণ দূর করতে হবে। এ সময় শান্ত করনের জন্য যা করণীয়-

ক. শিশুর আবেগ বুঝতে তথ্য সংগ্রহ করুন।

খ. তারওপর চাপ প্রয়োগকারী আইটেম চিহ্নিত করুন।

গ. চাপ প্রয়োগ করে আইটেম গুলো কমিয়ে নিন। অপছন্দের বা জটিল কাজকে মডিফাই করুন। এ সময় নতুন কোন কাজ দেবেন না। সাপোর্ট বাড়িয়ে দিন এবং আপনার প্রত্যাশাকে কমিয়ে নিন।

ঘ. পরিবেশকে শিশুর কাছে আরও বোধগম্য করে তোলেন। কী ঘটছে সে যাতে তা ভালোভাবে অনুমান করতে পারে।

ঙ.  চাপ দানকারী উপাদান ও শিক্ষার মধ্যে সামঞ্জস্যতা বিধান করুন।

 

অটিস্টিক শিশুর বয়ঃসন্ধিক্ষণের সমস্যাঃ  নরমাল শিশুদের মত বয়ঃসন্ধিক্ষণে তারা তাদের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তাই এ সময়ে অধিক জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়।

ক. কাউকে জড়িয়ে ধরা প্রকাশ্যে চুমু খাওয়া, যৌন অঙ্গভঙ্গি করলে তার মনটাকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিন।

খ. তাদের থাকার ঘর নির্দিষ্ট করে দিন যাতে সে সেখানে নিজের মতো করে থাকতে পারে।

গ. মেয়েদের ক্ষেত্রে সংসারের কাজের চাপ ফেলে দিন যাতে সে অন্যদিকে ব্যস্ত থাকে।

 

মেনস্ট্রুয়েশনের সময় করণীয়

ক. এ সময় ঘরের বাইরে না যাওয়াই ভালো।

খ. ন্যাপকিন লাগানো ও চেঞ্জ করাতে অন্যের সাহায্যও নিন।

গ. মানসিক অবস্থায় পরিবর্তনে ধৈর্য ধরে মোকাবেলা করুন।

 

অটিজমঅটিস্টিক শিশু