এটুকু বললাম প্রসঙ্গত। কেন বললাম একটু পরই বুঝবেন। তো , আমরা তিন নারী দাড়িয়ে আছি। বনানীর জ্যাম আর ছাড়েই না। অনেক পুরুষও দাঁড়িয়ে আছেন আমাদের আশপাশে।
জ্যামে বাসে দাঁড়িয়ে থাকা বিরক্তিকর। এসময় সালোয়ার কামিজ পরিহিত মেয়েটি সাথের জিনস ফতুয়া পরিহিত মেয়েকে বলল , ওই দেখ বাসে কি লেখা ?
জিনস ফতুয়া পরিহিতা বলল , এ আর নতুন কি ? এই আমাদের সাধের বাংলা।
ওদিকে তাকিয়ে দেখি লেখা আছে জানালার একটু ওপরে বেশ বড় করে “ নারীদের জন্য ৭ সিট ও প্রতিবন্ধীদের জন্য ৩সিট। পিলিজ(বানান এভাবেই লেখা )কেউ বসবেন না।”
ওই নির্ধারিত স্থানে দেখা গেল মাত্র চারজন নারী বসা। অন্য সাতটি সিটেই সুস্থ স্বাভাবিক পুরুষ যাত্রী বসে আছেন। এদের মধ্যে একজন চেঁচালেন , ওই মাথার ওপরে ফ্যান নষ্ট ক্যান ? ভাড়া তিরিশ টাকার টা বিশটাকা দিমু।
হেলপার উত্তর দিলেন , জ্যাম আছে। না পোষাইলে নাইমা যান। তিরিশ টাকাই ভাড়া।
ওই যাত্রী বললেন ,চুপ। (একটা গালি )
হেলপার জবাবে বললেন , গালি দিয়েন না। দেখতে তো শিক্ষিতই লাগে। মাইয়া মাইনষের সিটে বইসা আছেন। মাইয়া মানুষ দাঁড়াইয়া আছে। আবার কথা কন।
ওই যাত্রীর পাশে বসা তরুণ যাত্রী যেন এই মূহূর্তটার জন্যই ছিলেন। তিনি বিগলিত হেসে বললেন , ওরা বসবেন না ওদের সিটে বসতে বললেও। এবার জিনস ফতুয়া পরিহিতা মেয়েটি বেশ স্মার্টলি জানতে চাইলেন , কেন বসব না ?
তরুণ যাত্রী বললেন ( মেয়েটির হাতের বই দেখিয়ে ) ওই যে সাতকাহন পড়েন। আপনারা দীপাবলী। আপনারা তো অবলা না।
একথা বলার পরই তরুণ যাত্রীর সাথে আরও কয়েক যাত্রী হাসিতে যোগ দিলেন।
জিনস ফতুয়া পরিহিতাও কম সাহসী নন। কথা জানেন। তিনি বললেন , ওদিকে তাকান , (জানালার ওপরের দিক ইঙ্গিত করে ) কি লেখা আছে ? প্রতিবন্ধী। আপনারা যারা এখানের সিট গুলোতে বসে আছেন তারা তো একেকজন প্রতিবন্ধী।
জ্যাম ছেড়েছে। বাস ছুটে চলেছে। কিন্তু ওইসব সিটে বসা পুরুষদের কলরব বেড়ে গেল। অন্য সিটে বসা পুরুষদের হাসি। যেন চলন্ত বায়োস্কোপ চলছে। ওই তরুণ যাত্রী একটু রেগে গিয়ে বললেন , কি করব না বসে ? দাড়িয়ে যদি থাকতাম আপনার পাশে না বসে তবে বলতেন আপনার শরীরে স্পর্শ করেছি।
পেছনের সিট থেকে এক বুড়োলোক বললেন , আজকালকার মেয়েরাও। এত চটাং চটাং কথা শিখেছে।
জিনস ফতুয়া পরিহিতা বললেন , মুরব্বী আপনার সমস্যা কি?
এসময় কেউ কেউ সবাইকে চুপ হতে বললেন। শান্ত হতে বললেন।
ততক্ষণে বাস বিশ্বরোডের স্টপেজে। যাত্রীরা নামছে, উঠছে। হঠাত সালোয়ার কামিজ পরিহিতা মেয়েটি চেঁচিয়ে উঠলেন , আমার মোবাইলটা ব্যাগ থেকে টেনে নেমে গেছে একটা লোক । ড্রাইভার গাড়ি থামান। আমি চিনব লোকটাকে। মুখ দেখেছি।
ড্রাইভার বললেন , থামাইয়া লাভ নাই আফা। ওরা টানা পার্টি। এতক্ষণে মিলাইয়া গেছে।
অন্য যাত্রীরাও যার যার মতো বলতে থাকল। কথাগুলো এমন :
১,গাড়ি থামাইয়েন না ড্রাইভার। জ্যামে আটকা ছিলাম।এইবার টানেন।
২, নিজের ব্যাগ সামলাতে পারেন না প্রাইভেট কারে চড়েন গিয়া।
৩, কয়েকটা দিন সেলফি তুলতে পারবেন না আপু। নতুন কিনা নিয়েন।
৪, এইরকম হইলে দীপাবলী হবেন কেমনে ( সেই তরুণ যাত্রীটা )
এবার জিনস ফতুয়া পরিহিতা সেই তরুণ যাত্রীকে উদ্দেশ্য করে বললেন , অাপনি একটা অসভ্য।
তরুণ যাত্রী পাল্টা বললেন, মুখ সামলে কথা বলেন।
জিনস ফতুয়া পরিহিতা বললেন , আপনি মানসিক প্রতিবন্ধী। ওই জন্য ওই সিটে বসে আছেন।
পেছনের যাত্রীদের মাঝে আবার শোরগোল , মেয়েগুলো মনে হয় ভাল ফ্যামিলির না। নাহলে রাস্তাঘাটে এমন তর্ক করে।
সালোয়ার কামিজ পরিহিতা বলল , কেন আপনাদের মা /বোন নেই ?
আমার মধ্যে তখন কি হোল কে জানে। সংরক্ষিত মহিলা ও প্রতিবন্ধীদের সিট থেকে সবাইকে উঠে দাড়াতে বললাম। সম্ভবত কন্ঠে দৃঢতা এমন ছিল যে এবং বাক্য উপস্থাপনায় কি ছিল জানি না তারা সবাই উঠে দাড়াল। ওই দুই তরুণী বসল সিটে। ওই তরুণ যাত্রীর চেহারায় একটা ভ্যাবাচ্যাকা ভাব। এয়ারপোর্টের স্টপেজে তখন বাস থেমেছে। যাত্রী নামারও নেই। উঠারও নেই । বাসে পিন-পতন নিরবতা যাত্রীদের মুখে।
স্টপেজ ছাড়তেই এক তরুণ এবার মুখ খুললেন , থ্যাংন্কস আপনাদের ( দুই নারীর উদ্দেশ্য )। এরপর আগে সিট দখল করে বসা এখন দাঁড়ানো যাত্রীদের দিকে তাকিয়ে বললেন , ভাই , মন খারাপ কইরেন না। এতগুলা মানুষের মধ্যে ওদের জন্য বরাদ্দ মাত্র সাত সিট। ঠাঠ্রাকে উপভোগ করেন।
বাস ততক্ষণে উত্তরা রাজলক্ষী স্টপেজের সামনে। আমিও দুই তরুণী নামলাম । পরিচিত হলাম পরষ্পরের সঙ্গে।
জিনস ফতুয়া পরিহিতা বললেন , আসলেই তো এত সিটের ভীড়ে মাত্র সাত সিট আমাদের দেওয়া হয় এটি তো মহা মশকরা।
সালোয়ার কামিজ পরিহিতার মন খারাপ । ফোনসেটের জন্য। তবু সে মিনমিনিয়ে বলল , এই পাওয়া যায় না। আর মশকরা। শরীরে হাত দেয়। টিপ্পনী কাটে। নো রাইটস উই হ্যাভ। এরপর তিনজন তিনদিকে মিলিয়ে গেলাম।