মানসিক রোগ কী
যুগে যুগে মানসিক রোগকে নানাভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। প্রাচীনকালে মানুষ মনোরোগকে কখনো জীন ভূতের আছর, কখনো অশুভ আত্মা, কখনো কালো বা দূষিত রক্তের প্রভাব মনে করেছে। যেসব রোগীর আচরণ উচ্ছৃঙ্খল হতো, তাদের ওপর অশুভ আত্মা প্রভাব রয়েছে এবং যাদের আচরণে ধর্মীয় ও গূঢ়ভাব প্রকাশ পেত তাদের ওপর শুভ আত্মা ভর করেছে বলে মনে করা হতো। চিকিৎসা হিসেবে মানসিক রোগীদের মাথার খুলিতে ছিদ্র করা হতো এবং মনে করা হতো অশুভ আত্মা এই ছিদ্র পথে বের হয়ে যাবে। প্রাচীনকালের এই ভুল ধারণা বর্তমানের ফোর জি যুগের অনেক মানুষ বিশ্বাস করে। এখনো মানসিক চিকিৎসার জন্য মানুষকে মানত করা বা ঝারফুকের ওপর নির্ভর করতে দেখা যায়। তবে সেই প্রাচীনযুগের মানুষ হয়েও হিপোক্র্যাটস মানসিক রোগের কারণ হিসেবে মস্তিস্কের আক্রান্ত হওয়াকে দায়ী করেছেন। হিপোক্র্যাটস অব কস ছিলেন প্রাচীন গ্রিসের এক চিকিৎসক। বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি না হওয়ায় সে সময় তিনি তাঁর মতকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি। সেটি না পারলেও তাঁর করা মানসিক রোগের তিনটি ধরন (ম্যানিয়া, বিষাদরোগ ও ব্যক্তিত্বের গোলযোগ) নিয়ে এখনো মানুষ চর্চা করে। শুধু তাই নয় তাঁর চিকিৎসা পদ্ধতির কিছু কিছু অংশ আরো বৈজ্ঞানিকভাবে এখন ব্যবহৃত হচ্ছে। মধ্যযুগে মনোরোগীদের ডাইনি বা পিশাচ মনে করে তাদের নির্মূল করার অভিযান চালানো হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে মানসিক রোগীদের ক্ষেত্রে মানবিক ও উদার দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠলেও চিকিৎসা পদ্ধতির কিছুটা কমতি থেকেই যাচ্ছিল। রোগীদের অন্ধকার কারাকক্ষে বা ‘উন্মাদাগারে’ কাটাতে হতো। কিছুদিন আগ পর্যন্ত আমাদের দেশের মানসিক হাসপাতালকে বলা হতো ‘পাগলাগারদ’।
মানসিক রোগের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েসন প্রকাশিত ডায়গনোস্টিক অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিক্যাল ম্যানুয়াল অব মেন্টাল ডিসওর্ডারসে। সংজ্ঞাটি সহজবোধ্য করে বললে বলা যায়, মানসিক রোগ হলো মানুষের এমন কতগুলো আবেগীয়, শারীরিক বা আচরণগত সমস্যার বা অস্বাভাবিকতার সমষ্টি, যা ব্যক্তিকে কষ্ট দেয় বা তাঁর সামাজিক ও দৈনন্দিন জীবনের কাজগুলোকে ব্যাহত করে।
আবার অন্যভাবে বলা যায়, ব্যক্তির চিন্তা, কাজ, প্রত্যক্ষণ ও অনুভূতি ঠিক যেভাবে হওয়ার কথা সেভাবে না হলে তাকে মানসিক রোগ বলা হয়। অর্থাৎ মানসিক রোগে ব্যক্তির চিন্তায়, বিশ্বাসে, আবেগে, প্রত্যক্ষণে ও কাজের মধ্যে বিশৃংখলা দেখা দেয়। এ ছাড়া শরীরে ব্যথাসহ আপাত নিউরোলজিক্যাল উপসর্গও মানসিক রোগে হতে পারে। রোগ ভেদে এগুলোর যেকোনো একটিতে বা সবগুলোর ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিতে পারে।
মানসিক রোগের কিছু উপসর্গ নিজের সাথে মিললেই সেটি মানসিক রোগ হবে না। যেমন কেউ কষ্ট পেলেই সেটি বিষণ্ণতা নয়। কোনো নিকটজন মারা গেলে বা দূরে চলে গেলে কষ্ট লাগা স্বাভাবিক; সেটিকে বিষণ্ণতা বলা যাবে না। মানুষের জীবনে স্বাভাবিক কারণে যে ভিন্ন আবেগ আসে সেটিই স্বাভাবিক। বরং মানসিকভাবে কাছের মানুষ চলে গেলে যদি একদম কষ্ট না লাগে তবে সেটিই অস্বাভাবিক। আবার যদি কেউ দীর্ঘদিন ধরে কষ্ট পেতেই থাকে এবং তাঁর কাজ কর্মের ক্ষতি হতে থাকে তবে তা মানসিক রোগের লক্ষণ হতে পারে। এখানে লক্ষণীয় হলো উপসর্গের কারণে ব্যক্তির সম্পর্কগত,সামাজিক ও নিজ কর্মের কোনো ক্ষতি না হলে সেটি মানসিক রোগের পর্যায়ে পড়বে না।
বিভিন্ন ধরনের মানসিক রোগ রয়েছে। প্রাপ্ত বয়স্কদের প্রধান প্রধান মানসিক রোগের মধ্যে রয়েছে সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার মুড ডিসওর্ডার, বিষণ্ণতা, দুঃশ্চিন্তা, অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসওর্ডার, বিভিন্ন ধরনের ফোবিয়া, সামাজিক ভীতি, প্যানিক ডিসওর্ডার, ডিসোসিয়েটিভ ডিসওর্ডার, কনভার্সন ডিসওর্ডার, হাইপোকন্ড্রিয়াসিস, পারসোনালিটি ডিসওর্ডার, ইমসোমনিয়া (ঘুমের সমস্যা), মাদকাসক্তি, সাইকোসেক্সুয়াল ডিসওর্ডার ইত্যাদি।
মানসিক রোগ ছাড়াও আরো কিছু কারণে মানসিক চিকিৎসা বা মানসিক স্বাস্থ্য সেবা নিতে হয়। যেমন : সম্পর্কগত সমস্যা (দাম্পত্য, সন্তান-পিতামাতা, সহদর), নির্যাতনের (মানসিক, শারীরিক ও যৌন) শিকার হলে, শিশু নিগ্রহের শিকার হলে, কোনো ট্রমাটিক ঘটনার মুখোমুখি হলে, কাজে বা পড়াশোনাতে ভালো করতে না পারলে ইত্যাদিসহ এমন সব বিষয় যা ব্যক্তিকে তীব্র মানসিক চাপের মধ্যে রাখে।
কেন মানসিক সমস্যার চিকিৎসা প্রয়োজন
মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি নিজে কষ্টে থাকার পাশাপাশি তার পরিবারও তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা ও কষ্টে থাকে। রাগ জিদ করা, তুচ্ছ ঘটনাকে জটিল করে দেখা, সন্দেহ করা ইত্যাদির কারণে প্রায়ই কাছের মানুষের সঙ্গে মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত রোগীর সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
মানসিক রোগ হলে ব্যক্তির লেখাপড়া ও পেশাগত কাজ করতে অসুবিধা হয়। যার কারণে ক্যারিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়। ব্যক্তি নিজেই শুধু আর্থিকভাবে দুর্দশার মধ্যে পড়ে না বরং তাঁর পরিবার এমনকি দেশের জিডিপির ওপর তার একটি প্রভাব পড়ে।
একটি নাগরিককে তৈরি করতে রাষ্ট্রকে অনেক অর্থ খরচ করতে হয়। সেই নাগরিকের কাছে রাষ্ট্রের প্রত্যাশাও থাকে। কিন্তু মানসিক রোগের কারণে তা না করতে পারলে কিংবা সে আত্মহত্যা করলে ব্যক্তি নিজে, তাঁর পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র সামগ্রিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই মানসিক রোগকে অবহেলা না করে, লুকিয়ে না রেখে, তথাকথিত লোকলজ্জার ভয় কাটিয়ে বৈজ্ঞানিকভাবে চিকিৎসা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
চিকিৎসা
মানসিক রোগ শারীরিক ও সামাজিক নানা কারণেই হতে পারে। এর চিকিৎসাও হতে হয় বায়ো-সাইকোস্যোসাল মডেল অনুযায়ী। অর্থাৎ মানসিক রোগের ক্ষেত্রে ওষুধ ও সাইকোথেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে ওষুধ ও সাইকোথেরাপির সমন্বিত চিকিৎসায় সবচেয়ে ভালো ফলাফল লাভ করা যায়। তবে কিছু রোগে ওষুধের ভূমিকা মুখ্য আবার কিছু রোগে সাইকোথেরাপি অত্যাবশ্যকীয়। তবে চিকিৎসা গ্রহণ করার জন্য সাইকিয়াট্রিস্ট বা ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের প্রশিক্ষণ সম্পর্কে ভালো করে জেনে নিতে হবে।
এ ছাড়া সমাজে ভালোভাবে পুনর্বাসনের জন্য স্যোসাল ওয়ার্কারের সহযোগিতার প্রয়োজন। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টটিউট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং সব বড় মেডিকেল কলেজে মনোরোগের চিকিৎসা পাওয়া যায়। এ ছাড়া ঢাকার মধ্যে ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতাল (মগবাজার), নাসিরুল্লাহ সাইকোথেরাপি ইউনিট (কলা ভবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) ও দর্পনসহ (গুলশান) বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সাইকোথেরাপি নেওয়া যায়। ঢাকার বাইরে রাজশাহীতে প্যাসিল্ক (পদ্মা আবাসিক, ভদ্রা) এ সাইকোথেরাপি পাওয়া যায়।
তানজির আহম্মদ তুষার : সহকারী অধ্যাপক, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।