সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশু থেকে শুরু করে একটু বড় বয়সের প্রায় সব শিশুই কোনো না কোনো ধরনের র্যাশ-এ প্রায় সময়ই আক্রান্ত হয়ে থাকে। কোনো শিশুর শরীরে র্যাশ খুব সাধারণভাবে আত্মপ্রকাশ করে কোনো সমস্যা সৃষ্টি না করেই চলে যায়, আবার কারও কারও শরীরে খুব জটিলতার সৃষ্টি করে। সাধারণত গরমের সময়ই এই র্যাশ বেশি হতে দেখা যায়। সব রকম র্যাশই যে ছোঁয়াচে তা কিন্তু নয়। যে সকল র্যাশ এলার্জি ধরনের সেগুলো থেকে কোনো ছোঁয়া লাগার ভয় থাকে না। আর যে সকল র্যাশ ভাইরাসজনিত কারণে হয় তা অবশ্যই ছোঁয়াচে শিশুর শরীরের এই র্যাশ বিভিন্ন রকমের হতে দেখা যায়। যেমন- নবজাতকের র্যাশ, ভাইরাস র্যাশ, ওষুধের প্রভাবে র্যাশ, অ্যাটপিক ডার্মাটাইটিস, আর্টিকেরিয়া ইত্যাদি। এ ছাড়াও আরও প্রচুর র্যাশ আছে যেগুলো সাধারণত দেখা যায় না। জন্মের পর পরই শিশুর শরীরে সাধারণত এক ধরনের লাল লাল ছোপ দেখা দেয়- সমস্ত গায়েই থাকে। কিছু সময় বা ২/১ দিন পর এই র্যাশ আপনা থেকেই কমে যায়। গর্ভাবস্থায় শিশু যে ধরনের তাপমাত্রায় থাকে, জন্মের পর সেই তাপমাত্রার পরিবর্তনের কারণে এই র্যাশ হয়ে থাকে। প্রচলিত ভাষায় এই র্যাশকে আমরা ‘মাসিপিসি’ বলে থাকি। গরমকালে কমবেশি প্রতিটি শিশুই ঘামাচিতে ভোগে। এই ঘামাচি বা ‘মিলিরিয়া’ গরম কমলেই কমে যায়। ঘামাচি হলে শিশুকে ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করানো, সুতির কাপড় পরানো উচিত। পাউডার যত কম ব্যবহার করা যায় ততই ভাল। কারণ স্বেদগ্রন্থির মূলে ঘাম জমে মুখ বন্ধ হয়ে ঘামাচির উৎপত্তি হয়, তার উপর পাউডার দিলে এ অবস্থায় আরও অসুবিধা হয়।
শিশু যদি বেশিক্ষণ ভেজা ন্যাপিতে শুয়ে বা বসে থাকে তবে ‘পোরয়ানাল ডারমাটাইটিস’ বা ‘ডায়াপার ডারমাটাইটিস’ নামে এক প্রকার র্যাশ হয়। এই র্যাশ সাধারণত নিতম্বে বা পায়ের খাঁজে হয়। লাল লাল এই র্যাশ আমরা ইচ্ছা করলেই Avoid করতে পারি, একটু সতর্কতা ও যত্নের মাধ্যমে। শিশুকে ভিজে কাপড়ে না রেখে।
শুকনো কাপড় পরিয়ে রাখলেই হয়। পায়খানা বা প্রস্রাব করার পর ঐ জায়গা পরিষ্কার করে, শুকনো কাপড় দিয়ে মুছে একটু লোশন বা পাউডার লাগিয়ে দিলে শিশু বেশ আরাম অনুভব করে আর র্যাশ হওয়া থেকে মুক্তি পায়। এই ধরনের র্যাশকে সবাই “ন্যাপির্যাশ” বলেই জানে।
শিশুদের অপরিচ্ছন্ন রাখার জন্য এক প্রকার র্যাশ যেটা মাথাতে কুঁচকিতে প্রথমে গুড়িগুড়িভাবে বেরোয়- সেটাকে বলে ‘সেবোরিয়া ডারমাটাইটিস’। যত্নের অভাবে এই ব্যাশ মুখে ও সমস্ত গায়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই শিশুদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে একটু সতর্কতা অবলম্বন করলেই আর এই র্যাশ হয় না। তবুও যদি একবার হয়ে যায় তবে মাথা, সমস্ত গা, হাত, পা স্যাভলন পানি দিয়ে পরিষ্কার করে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ‘অ্যান্টিবায়োটিক ক্রিম লাগানো উচিত।
কিছু কিছু র্যাশ আছে যেগুলো ভাইরাস এর কারণে হয়ে থাকে। যেমন- হাম, চিকেন ফক্স, হারপিস সিমপ্লেক্স’, ‘রোজিওলা ইনফেকশন’ ইত্যাদি। এই সকল র্যাশ এর সাথে জ্বর, মাথা ও গায়ে ব্যথা হতে পারে। এই ধরনের ভাইরাস র্যাশের চিকিৎসা নেই বললেই চলে। শুধু চিকিৎসকের পরামর্শে ব্যথার ঔষধ খাওয়া যায়। তবে এই র্যাশ আক্রান্ত শিশুদের Nursing বা সেবা যত্নই বেশি প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
আরও কিছু র্যাশ আছে যেগুলো বিভিন্ন প্রকার ঔষধের Side effect বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসাবে দেখা যায়। এগুলো সাধারণত বিভিন্ন প্রকার অ্যান্টিবায়োটিক (যেমন- পেনিসিলিন, ক্লোরামাইসেটিন, ট্রাইমিথেপ্রিম) গ্রহণের ফলে হয়ে থাকে। শিশু যদি ঐ সকল ঔষধ সহ্য করতে না পারে তবেই এই র্যাশ হয়ে থাকে। ঔষধ বন্ধ করে দিলেই র্যাশ আপনাআপনি কমে যায়।
মাঝে মাঝে আবার দেখা যায়, কোনো কোনো শিশুর গারের ত্বক জায়গায় জায়গায় ফুলে উঠছে এবং এই ফুলে ওঠা জায়গা থেকে রস গড়িয়ে পড়ছে, এই অবস্থাকে বলে “অ্যাটপিক ডার্মাটাইটিস’। কিছুদিন পরেই আবার এগুলো শুকিয়ে যায় ও আলগা হয়ে খসে পড়ে। এই র্যাশ-এর কোনো কারণ জানা যায়নি। শিশুর শরীরে র্যাশ-এর ফলে যাতে ‘সেকেন্ডারি ইনফেকশন’ না হয় সে জন্য অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত এবং প্রয়োজনে ‘ক্যালামাইন’ লাগানো ও ‘অ্যান্টি অ্যালার্জিক’ খাওয়া উচিত।
আরও এক প্রকার র্যাশ শিশুদের খুবই হতে দেখা যায় যেটাকে ‘আর্টিকেরিয়া” বলে। এই র্যাশ সমস্ত শরীরে, নানা মাপের হয়ে থাকে। কোনো কারণ ছাড়াই শিশুর শরীরে র্যাশ হয়ে থাকে। তবে অনেক সময় পোকামাকড় কামড়ালে, কোনো ওষুধ খাওয়ার ফলে, লতাপাতার সংস্পর্শে এলে শিশুর শরীরে র্যাশ হতে দেখা যায়। এই র্যাশ খুব চুলকানি হয়ে থাকে কিন্তু এর সাথে আর কোনো অসুবিধা যেমন জ্বর বা ব্যথা থাকে না। এই অবস্থাতেও চিকিৎসকের পরামর্শে প্রয়োজনীয় ওষুধ যেমন ‘অ্যান্টি অ্যালার্জিক’ ও ক্যালামাইন ব্যবহার করা উচিত।
শিশুর শরীরের যে কোনো জায়গায় র্যাশ হলে অবহেলা না করে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত। অনেকে চিকিৎসককে না দেখিয়ে নিজে নিজেই চিকিৎসা শুরু করেন- এটা কখনই ঠিক নয়। মনে রাখতে হবে, আমাদের একটু ভুলের জন্য শিশুর মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। তবে এই র্যাশ যাতে না হয় সে জন্য সর্বদা আমাদের সতর্ক থাকতে হবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
শিশুর শরীরে র্যাশ হলে কী করবেন?
১. শিশুর শরীরে র্যাশ দূর করতে শিশুকে সর্বদা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখতে হবে। প্রতিদিন গোসল করিয়ে পরিষ্কার সুতির কাপড় পরিয়ে রাখতে হবে। অনেক মায়ের ধারণা নবজাতক বা একটু বড় শিশুকে প্রতিদিন গোসল করালে ঠাণ্ডা লাগতে পারে। এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। নিয়মিত গোসল করালে শিশুর শরীরে খোস পাঁচড়া, চুলকানি যে সকল র্যাশ অপরিষ্কারজনিত কারণে হয়ে থাকে সে সকল হয় না বললেই চলে। যদি ঠাণ্ডা লাগার ভয় থাকে তবে কুসুম কুসুম গরম পানি দিয়ে গোসল করানো উচিত
২. শিশুকে সর্বদা স্বাস্থকর পরিবেশে রাখা উচিত। যেমন- শিশুর ঘরে যেন রোদ ঢুকতে পারে। শোয়ার জায়গা যেন পরিষ্কার ও খোলামেলা হয়।
৩. শিশুর পরনের কাপড়চোপড়, বিছানার চাদর, বালিশের কভার প্রতিদিন স্যাভলন পানি দিয়ে ধোয়া উচিত।
৪. শিশুর বাসন, গ্লাস সাবান দিয়ে পরিষ্কার করে ধুয়ে রাখা উচিত।
৫. ময়লা হাত বা অপরিষ্কার শরীরে শিশুকে কোলে নেয়া বা আদর করা উচিত নয়। এতে শিশুর শরীরে ময়লা সংক্রমিত হয়।
৬. শিশুর ঘরসহ সমস্ত বাড়িই প্রতিদিন ঝাড় দিয়ে মুছে পরিষ্কার রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, ছোট্ট শিশু সর্বত্রই ঘুরে বেড়াচ্ছে, খেলছে।