আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের ব্যস্ততা আর যান্ত্রিকতা আমাদের সামাজিক জীবন থেকে, পরিবার-পরিজন থেকে অনেক দূরে ঠেলে দিয়েছে। বাংলার চিরায়ত যৌথ পরিবারের ঐতিহ্য এখন কালের হালখাতার উৎসবের মতো অমলিন। ব্যস্ততার নামে আত্মকেন্দ্রিক একক একাকীত্ব পরিবারের খন্ডিত হতে হতে আজ পারিবারিক বন্ধনের সুতো ছিঁড়ে যাচ্ছে। কাােে সময় নেই, সবাই নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। চলছে..চলবে রীতিতে কোনমতে জীবন পাড়ি দেয়ার চেষ্টায় ত্রস্তব্যস্থ হয়ে ছুটিেছ আমরা সুখ নামর অচিনলোকে সন্ধানে। পরিণতি ভালো হচ্ছেনা। শেকড় ভুলে দূরে সরে থাকার পরিণতি ভালো হবারও কথা নয়।
লিখেছেন: ফয়জুন্নেসা মণি
জীবনটা চলছে এভাবেই। একক একাকী জীবনে সুখী হওয়ার মোহাচ্ছন্ন হয়ে সব শক্তি হারাচ্ছি আমরা। এভাবেই কি চলবে? নিশ্চয়ই নয়। আসুন ব্যস্ততম জীবনের মাঝেও ভালো কিছু কাজ, ভালো কিছু চিন্তার সুযোগ সন্ধান করি। চলুন চেষ্টা করি পারিবারিক বন্ধনগুলোকে নতুনভাবে সুঁতোয় গাঁথা যায় কিনা দেখি…। আসুন তৈরি করি ফ্যামিলি ট্রি। ‘ফ্যামিলি ট্রি’র ধারণাটা আসলে পারিবারিক সম্প্রীত সুরক্ষার একটা কারিগরি সূত্র। ফ্যামিলি ট্রি’র ধাপগুলো লক্ষ্য করলেই বোঝবেন এই প্রক্রিয়াটি পরিবারিক সম্পর্কোন্নয়ন ও পুনঃপ্রতিষ্ঠায় কতোটা সহযোগী হতে পারে। সোজা কথা, আপনার বংশ পরম্পরায় পূর্বপুরুষদের সম্পর্কে তথ্য যোগাড় করে তা লিপিবদ্ধ করাই হলো ‘ফ্যামিলি ট্রি’ তৈরির নিয়ম। পারিবারিক এঐতিহ্যেক ধারক হিসেবে ফ্যামিলি ট্রি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বাবা মা, দাদা-দাদু, নানা-নানুর কাছ থেকে জেনে নিন এবং সংগ্রহ করুন নিম্নোক্ত তথ্যগুলো
- তারা কোথায় জন্মেছেন এবং বড় হয়েছেন (শহর/গ্রাম, দেশ/জেলা/উপজেলা- স্থান ইত্যাদি)।
- আপনার দাদা-দাদি ও নানা-নানির জন্ম ও মৃত্যুর তারিখ। তাদের কোনো ছবি যদি পাওয়া যায়।
- বাবা-মায়ের বিয়ের স্থান, তারিখ, সময়। বিবাহের বিশেষ কোনো ঘটনা জানাগেলে, যেমন পরিচয়-পরিণয়।
- তাদের বাবা-মাকে কোথায় সমাধিস্থ করা হয়েছে (স্থান, সমাধিস্থলের নাম, শহর, দেশ)।
- প্রত্যেক পরিবারের নিজ্স্ব কিছু রীতি-রেওয়াজ বা ঐতিহ্য আছে। পারিবারিক ঐতিহ্যগুলো সম্পর্কে জানুন। আপনার পারিবারিক ঐতিহ্যচক্রে হয়তবা কেউ মুক্তিযোদ্ধা, কেউ সমাজ সেবক, কেউ দানবীর, কেউ আলেম বা বুজুর্গ ব্যক্তি, কেউবা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব অথবা চেয়ারম্যান বা বড় কোনো সামাজিক পরিচায়ক আছে তা হয়তো আপনার জানাই নাই।
- জেনে নিতে পারেন আপনার কোনো নিকটাত্মীয় আপনার আগে এ ধরনের (বংশানুক্রম সম্পর্কিত) উদ্যোগ নিয়েছেন কিনা। অথবা এমন কেউ কি আছেন যিনি অনেক বেশি পারিবারিক হিস্ট্রি সম্পর্কে জানেন। প্রয়োজনে তার দ্বারস্থ হোন।
- সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ আত্মীয়দের সম্পর্কে জানুন। একটা না একটা ক্লু তো পাবেনই।
- পরিবারটি সম্পর্কে তারা কি জানেন তা প্রশ্ন করে করে জানতে চেষ্টা করুন। আপনার উদ্দেশ্যটিও পরিষ্কার করুন।
- তাদের আত্মীয়দের কোথায় কোথায় সমাধিস্থ করা হয়েছে, কীভাবে, কী কারণে মৃত্যু হয়েছিলো জানতে পারেন।
- যার যার জানা জন্ম, মৃত্যু এবং বিবাহের দিন তারিখ, বিশেষ ঘটনা সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করুন।
- পরিবারের হিস্ট্রিতে বিশেষ কোনো ঘটনার ইতিহাস থাকলে তার প্রেক্ষাপট, পরিণতি বর্ণনায় শুনুন। নোট রাখুন প্রতিটি বিষয়ে। স্থান কাল পাত্র সম্পর্কে নোট রাখতে ভুলবেন না। রেফারেন্স হিসেবে যার কাছ থেকে জেনেছেন বা সংগ্রহ করেছেন তার নাম, সম্পর্ক, সময় উল্লেখ রাখুন।
- পারিবারিক পরিমন্ডলে কততম প্রজন্ম আপনি তা আগে জেনে নিন। সে হিসেবে আগের প্রজন্মের পূর্ব পুৃরুষদের তথ্যানুসন্ধান করলে সুবিধা হবে।
- জেনে নিন পূর্ব প্রজন্মের বংশধারা সম্পর্কে। ছক তৈরি করুন।
- জীবিত আত্মীয়দের কারা কোথায় আছেন জেনে নিন। ঠিকানা, ফোন নম্বর যোগার করুন।
- পর্যায়ক্রমিকভাবে তথ্য অনুসন্ধান করুন।
- আপনার পরিবারের বিশেষ কোনো পরিচয় সূত্র থাকলে তার সম্পর্কে অঅগে জানুন। তাদেও বংশ পরম্পরায় কেউ কেউ সবিস্তার তথ্য আপনাকে জানাতে পারবেন। যেমন- কেউ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন কিনা, কেউ জনপ্রতিনিধি ছিলেন কিনা, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কেউ জড়িত ছিলেন কিনা তা জানুন।
- বয়োজ্যেষ্ঠ আত্মীদের সাথে সাক্ষাতের সময় তাদের ছবি সংগ্রহ করুন।
- সাথে একটি ক্যামেরা রাখুন। যে ছবি আত্মীয়রা হাতছাড়া করতে চাইবেনা, তুলে নিন।
- পরিবারের অন্যদের আপনার কাজটি সম্পর্কে জানান, তাদের কাছে পুরোনো ছবি চাইতে পারেন।
- অন্যের গোপনীয়তা, রেকর্ড এবং মতামতের ব্যাপারে বিবেচকের মতো আচরণ করুন।
- যাই সংগ্রহ হবে সাজিয়ে রাখুন তথ্যে সারণীতে। ছবিগুলো যত্ন সহকারে সংরক্ষণ করুন। পারিবারিক হিস্ট্রিকেল এলবাম সাজান। এবার বাসায়/বাড়িতে যারাই বেড়াতে আসবে তাদেরকে দেখান- দেখুন তাদের চোখ কপালে উঠে কিনা। আবার এমনও হতে পারে যে তিনিও অঅপনাকে আরো কিছু তথ্য ও ছবি দিয়ে সহায়তা করতে পারছেন।
- এবার সংগৃহিত তথ্য সাজিয়ে তৈরি করুন ফ্যামিলি ট্রি। আপনি হয়ে উঠুন পরিবারের ইতিহাসবিদ। যদি পরিবার সম্পর্কেই কিছু জানলেন তো কি জানলেন। কি জানাবেন আপনার প্রজন্মকে!