ভারতীয় সিনেমায় সাহসী নায়িকারা

স্লিম-ট্রিম বা জিরো ফিগারের যুগ সেটা ছিল না। সে সময় বলিউডের নায়িকাদের সৌন্দর্য জয়দেব-কালিদাসদের বর্ণনার নিক্তিতে মাপা হত। স্ট্রেট চুল বা এক্কেবারে জিম করা মেদহীন ফিগার নয় বরং নারী সৌন্দর্যের অসীমতার সঙ্গে এক চাপা আবেদন- এমনভাবেই নায়িকাদের দেখা হত সে সময়। চোখে অপার মুগ্ধতা আর মনের মণিকোঠায় নারী সৌন্দর্যে বুঁদ হতে হতে ভেসে যেতেন তামাম সিনেমাপ্রেমী। শুধু পুরুষরাই যে এই দলে ছিলেন তেমনটা নয়, নারীরাও সমানভাবে এই সব নায়িকাদের রূপে-গুণে আর যৌন আবেদনে বুঁদে হয়ে থেকেছেন বছরের পর বছর। তবে নিজেদেরকে তারা এমনভাবেই উপস্থাপন করেছেন যা দেখে কেউই তাদের ‘অশ্লীল’ তকমা দিতে পারেনি। সত্তরের শেষে এবং আশির দশকের এই নায়িকাদের মধ্যে যেমন ছিলেন রেখা, তেমনি ছিলেন হেমা মালিনী থেকে মুনমুন সেন, পারভিন ববি, জিনাত আমানরা।

১. রেখা
বিখ্যাত সিনেমা পরিচালক বাবার অবাঞ্চিত সন্তান। নিদারুণ গরিবীতে ডুবে থাকা জীবনে পেট চালাতে ছোট্ট বেলাতেই নেমে পড়তে হয়েছিল সিনেমা আর থিয়েটারের চৌহদ্দিতে। কালো টানা চোখ-শরীর জুড়ে মাজা রং-এ যেন রবীন্দ্রনাথের বর্ণিত সার্থক কৃষ্ণকলি। এমন রূপের আগুন আর উষ্ণতার আবেদনে কে কাত হয়নি! মাত্র ১৪ বছরের রেখাকে দেখে এক বিখ্যাত বাঙালি নায়ক শ্যুটিং-এ নাকি নিজেকে ঠিক রাখতে পারেননি। সত্যি সত্যি রেখার ঠোঁঠে এক রক্তাক্ত চুম্বন উপহার দিয়েছিলেন। রেখা-র কাছে এটা উপহার ছিল না, কারণ পরবর্তীকালে তিনি নিজের বয়ানেই বলেছিলেন জোর করে তাঁকে চুম্বন করেছিলেন ওই বাঙালি নায়ক। সে দিন সেটের অন্য লোকেরা এসে বাধা না দিলে হয়তো ধর্ষণের শিকারও হতেন রেখা। এহেন রেখা যৌবনের পূর্ণ দিগন্তে যে তাবড় তাবড় লোকেদের মাথা ঘুরিয়ে দেবেন তাতে কেউ কোনো দিনই সন্দেহ প্রকাশ করেননি। শুধুমাত্র শাড়ি পরে রেখা যে যৌনতার আগুনে বলিউডকে পুড়িয় ছারখার করেছিলেন তা আজ পর্যন্ত কোনো নায়িকা পেরেছেন এমনটা বলার সাহস কেউ দেখান না। রেখার রূপের সৌন্দর্যের মাদকতা কোন মাত্রায় তার একটা নমুনা মিলেছিল ‘উৎসব’ ছবিতে। শূদ্রকের লেখা নাটকের সিনেমাটিক ভার্সানে রেখা অভিনয় করেছিলেন রাজনর্তকী বসন্তসেনার চরিত্রে।

২. মুনমুন সেন
বাংলা সিনেমায় নায়িকাদের সাহসী দৃশ্যে একটা-সময় প্রচুর রাখ-ঢাক করা হত। অভিনেত্রীদের সাহসী দৃশ্যের চরিত্রায়ণে দাপট দেখাতে হয় মিস শেফালি বা প্রেমা নারায়ণদের তলব পড়ত। কিন্তু, কোনো নায়িকা যে নিজের পোশাক অকপটে ক্যামেরার সামনে খুলে ফেলতে পারেন তা বাংলা ছবির দর্শকদের দেখিয়েছিলেন মুনমুন সেন। বলতে গেলে মুনমুন সেনের হাত ধরেই বাংলা ছবির নায়িকারা সাহসী দৃশ্যে যেন পুরোপুরি সাবালকত্ব প্রাপ্ত হয়েছিলেন। বাংলা থেকে হিন্দি সিনেমা- সবেতেই রূপের আবেদনে এক শ্রেণির দর্শককে কাত করেছিলেন মুনমুন। প্রায় দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারতীয় চলচ্চিত্রে এক বিশাল ফ্যান বেস তৈরি করে ফেলেছিলেন তিনি। অভিনয়-সৌন্দর্য আর উষ্ণতার আবেদনে তাই আজও ভারতীয় চলচ্চিত্রে নায়িকাদের তালিকায় উপরের দিকেই পাকাপাকি স্থান করে নিয়েছেন মুনমুন।

৩. সারিকা
দিল্লিতে পরিবারকে পরিত্যক্ত করে বাবা যখন চলে গিয়েছিলেন সারিকা তখন একদম ছোট্ট। কিন্তু, ওই ছোট্ট বয়সেই পরিবারের প্রয়োজনে নেমে পরতে হয়েছিল অভিনয়ে। মাত্র চার বছর বয়সে অভিনয় জগতে আবির্ভাব ঘটেছিল সারিকার। গায়ে রাজপুত রক্ত। অভিনেতা কমল হাসানকে বিয়ে করার আগে সারিকার পদবী ছিল ঠাকুর। ছোট্ট থেকেই ওয়েস্টার্ন লুক-এর জন্য পরিচালকদের নজরে পড়ে গিয়েছিলেন সারিকা। সংসারের অভাব তাঁকে কোনও দিনই স্কুলের গণ্ডীতে পৌঁছতে দেয়নি। কিন্তু হাল ছাড়েননি সারিকা। লড়াই চালিয়ে ভারতীয় চলচ্চিত্রে নিজের জায়গা পাকা করেছিলেন। সারিকার অভিনয়ে যেমন একটা দিক ছিল তাঁর ওয়েস্টার্ন লুক, অন্যদিকে ছিল সাহসী দৃশ্যে অভিনয় করার মতো মানসিকতা। আর ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে সারিকার কাছে এই ধরনের চরিত্রেই অভিনয় করার অফার আসত। ভয় পেতে জানতেন না সারিকা। খুল্লাম-খুল্লা শয্যা দৃশ্য থেকে স্বল্প-পোশাকেও অন্যমাত্রায় নিয়ে যেতেন তাঁর অভিনয়। তাই ভারতীয় চলচ্চিত্রের হিন্দি-সহ অন্যান্য ভাষার ছবিতে সবসময়ই অভিনয়রের সঙ্গে সঙ্গে সারিকার রূপও গুরুত্ব পেয়েছিল। বাংলা ছবিতেও তাঁর অভিনয় এবং রূপ প্রশংসিত হয়েছিল।

৪. নীনা গুপ্ত
সত্তর দশকের শেষে ভারতীয় সিনেমায় এমন এক ঝাঁক তরুণ-তরুণীর আবির্ভাব ঘটেছিল যাঁদের রক্তে ছিল শুধুই অভিনয়। আর এই অভিনয়কে এঁরা রূপ-সৌন্দর্য বা কনজারভেটিভ মাইন্ড-সেটে বাঁধতে রাজি ছিলেন না। এঁদের যুক্তি ছিল শুধু অভিনয়। আর এই অভিনয়ের চরিত্রের প্রয়োজনে দরকার পড়লে নিজের শরীরকেও উন্মুক্ত করে দাও। এই তরুণ-তরুণীদের দলেই ছিলেন নীনা গুপ্তা-র মতো একজন মেয়ে। অভিনয়ের স্বচ্ছতা এবং স্তস্ফূর্তার সঙ্গে সঙ্গে নীনার অন্যতম গুণ ছিল সাহসীকতা। চরিত্রের প্রয়োজনে নিজের শরীরকে উন্মুক্ত করতে এতটুকু দ্বিধা করতেন না। তাঁর এই নিয়ম ভাঙার খেলা একটা সময় বলিউডে বিপুলভাবে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।

৫. হেমা মালিনী
দক্ষিণ ভারতের এক সংরক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে। হেমা মালিনীর সিনেমায় নামা নিয়ে তাই পারিবারিক ঝামেলাও কম হয়নি। দুধে-আলতা গায়ের রঙে গ্ল্যামারের স্বর্গীয় বিচরণ। এমন ড্রিম গার্লকেই তো মানুষ স্বপ্নে দেখতে চায়। কিন্তু, রাখঢাক-সৌন্দর্যের মুক্তি ঘটলে চোখও যে ঝলসে যেতে পারে তাও প্রমাণ করে দিয়েছিলেন হেমা। বেশকিছু ছবিতে তাঁর সাহসী দৃশ্যে অভিনয়ের যে কয় ছটাক প্রমাণ মেলে তাতেও হেমা যেন আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন।

৬. শর্মিলা ঠাকুর
বিকিনি পরে সমুদ্রের উপর দিয়ে স্কি করছেন নায়িকা! এখনকার সময়ে এমন দৃশ্যে চোখ সওয়া। কিন্তু, তিন দশক পিছিয়ে গেলে এমন দৃশ্যে চারিদিকে গেল-গেল রব পড়ে যেত। তেমনই এক ঘটনা ঘটেছিল ‘অ্যান ইভিনিং ইন প্যারিস’ ছবিতে। শর্মিলা ঠাকুর ও স্বামী কাপুর অভিনীত এই ছবি রীতিমতো বিতর্ক তৈরি করেছিল। ছবিতে শর্মিলা বিকিনি পরে সমুদ্রের উপরে স্কি করেছিলেন-এই নিয়ে উঠেছিল গেল-গেল রব। সৌন্দর্য আর অভিনয় দক্ষতায় নিজেকে ভারতীয় চলচ্চিত্রের এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন শর্মিলা। কিন্তু, তাঁর রূপের উন্মুক্ত আহ্বান যে মাথা ঘুরিয়ে দিতে পারে তা যারা প্রত্যক্ষ করেছেন তারাই জানেন। ‘আরাধনা’ ছবিতে ‘রূপ-তেরা মস্তানা’ গান থেকে টু-পিসে ফোটো শ্যুট- রূপের জ্বলন্ত আগুনে উষ্ণতার আঁচকে যেন বাড়িয়ে দিয়েছিলেন শর্মিলা। তাঁর টু-পিস ফোটো শ্যুট এতটাই সে সময় হইচই ফেলেছিল যে দেশজুড়ে মৌলবাদীরা হুঙ্কার দিয়েছিলেন। এমনকি, বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনও তাঁদের প্রচ্ছদে শর্মিলার সেই ছবিকে স্থান দিয়েছিল। মার্কিন এই পত্রিকা সেই সংখ্যায় শর্মিলাকে নিয়ে কভার স্টোরিও করেছিল।

৭. জিনাত আমান
রূপের যৌনতার গনগনে আগুনে যিনি ভারতীয় সিনেমাপ্রেমীদের বুঁদ করে দিয়েছিলেন তিনি হলেন জিনাত আমন। নিটোল শরীরে উর্তুঙ্গ কটিদেশ, গভীর গ্রীবা, ঠোঁঠের আনচানে এক অন্য মাদকতা- যেন নেশা ধরিয়ে দিতেন জীনাত। সত্যম শিবম সুন্দর ছবিতে যে কামনার আগুন তিনি জ্বেলেছিলেন, তা দিয়ে প্রায় দেড় দশক ধরে বজায় রেখেছিলেন। জীনাতের রূপের সেই মাদকতায় আজও নস্টালজিক হয়ে পড়েন বহু মানুষ।

৮. পারভিন ববি
অভিনয় দক্ষতায় হয়তো তাঁর নাম কোনওদিনই শর্মিলা, হেমামালিনীদের কাছে-পিঠে আসেনি। কিন্তু, একটা সময় বলিউড সুন্দরীদের তালিকায় রীতিমতো প্রথম কয়েক জনের মধ্যেই ছিলেন পরভিন ববি। তাঁর ফিগারে ঢলঢলে গৃহস্থ মেয়ের ছাপ ছিল না। বরং তাঁর ছিল আলট্রা-মড-এর সৌন্দর্য। যার স্ট্রেট চুল, ক্লিভেজ শো-করা হাঁটু পর্যন্ত স্কার্টে রূপের ডানায় চারিদিকে নেমে আসত মায়াবী আবেদন।

৯. ডিম্পল
সত্তর দশকের শুরুতে যখন ‘ববি’ মুক্তি পেয়েছিল তখন ডিম্পলের বয়স ছিল মাত্র ষোল বছর। বিকিনির সাজ কেমন হত? ডিম্পল-এর মধ্যে দিয়েই যেন প্রথম বিকিনির আগুন ঝরানো গ্ল্যামার-এর সন্ধান পেয়েছিলেন ভারতীয় চলচ্চিত্র প্রেমীরা। প্রথম ছবিতে রূপের উষ্ণতার এক অন্য আবেদন তৈরি করেছিলেন ডিম্পল। যা তাঁর অভিনয়ের ট্যাগ লাইন হয়ে গিয়েছে। অভিনয়ের নিক্তিতে ডিম্পল বরাবরই ভারতী সিনেমার বন্দিত হবেন অভিনয়+সৌন্দর্য+গ্ল্যামার+যৌনতা-র জন্য। তাঁর অভিনীত চরিত্রের এই চার গুণ বারবারই নজর টেনেছে সিনেমাপ্রেমীদের।

১০. পুনম ধিঁলো
আশির দশকের আরও এক নায়িকা পুনম ধিঁলো। নিটোল সৌন্দর্যের আবরণে যার উষ্ণতার বিচ্ছুরণ ঘটেছে একাধিক সিনেমায়। মন্দাকিনী ‘রাম তেরি গঙ্গা ম্যায়লি’ ছবিতে নতুন মুখের খোঁজে ছিলন রাজ কাপুর। আচমকাই স্টুডিও-র রোজ কাজ খুঁজতে আসা একস্ট্রাদের দলে একটি মেয়ের প্রতি নজর পড়ে তাঁর। এরপরেরটা ছিল ইতিহাস। ‘রাম তেরি গঙ্গা ম্যায়লি’-তে এমনকিছু বিতর্কিত ও সাহসী দৃশ্য ছিল যার জন্য সে সময় বহু প্রতিষ্ঠিত নায়িকাই কাজ করতে রাজি ছিলেন না। রাজ কাপুর-এর মনে আরো একটা চিন্তা ছিল যে কোনো প্রতিষ্ঠিত নায়িকাকে নিলে আড়ালে চলে যেতে পারেন তাঁর ছোট ছেলে তথা ছবির নায়ক রাজীব কাপুর। তাই নতুন মানানসই নতুন নায়িকা খুঁজে পাওয়াটাও দরকার ছিল। ‘রাম তেরি গঙ্গা ম্যায়লি’-র নায়িকা মন্দাকিনী কিন্তু আখেরে রাজীব কাপুরকে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন। মন্দাকিনীর অভিনয় সে সময় যতটা আলোচনায় ছিল তাঁর থেকেও বেশি চর্চিত হয়েছিল ঝর্ণার জলে ফিনফিনে শাড়িতে তাঁর স্নানের দৃশ্য। এমন সাহসী স্নানের দৃশ্য এর আগে কখনও ভারতীয় সিনেমায় শ্যুট করা হয়নি বলেও দাবি করেছিলেন চলচ্চিত্র বোদ্ধারা। এই একটা ছবির দৌলতেই প্রায় দেড় দশক ধরে বলিউডে টিকে ছিলেন মন্দাকিনী।