দৃঢ়তা আর সাহস, গোয়েন্দাগিরি পেশায় নাম করতে হলে এই দু’টি গুণ তোমার মধ্যে থাকতে হবেই হবে। এই কাজে প্রচণ্ড পরিমাণে যুক্তিযুক্ত চিন্তাভাবনার প্রয়োজন হয়, তথ্যপ্রমাণ জোগাড় করা ও সেগুলো যাচাই করার মতো ধৈর্য, মনে-মনে সমস্যা সমাধানে দক্ষতা— নিত্যিদিন প্রয়োজন পড়ে এসবেরও। যার জন্য আবার দরকার অখণ্ড মনোযোগ, স্বচ্ছ বোঝাপড়া, যুক্তি দিয়ে নিরপেক্ষ চিন্তা করার ক্ষমতা এবং ফাইনালি, অসম্ভব ভাল টাইম ম্যানেজমেন্ট।
আর কী-কী চাই?
লোকজনের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে তুমি কতটা দড়, তার উপরও নির্ভর করে, এই পেশায় তোমার ভবিষ্যত কতটা ভাল হতে পারে। মৌখিকভাবে হোক বা লিখিত, লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে তোমাকে হবেই। অনেকসময়ই যেচে কথা বলতে হবে। ক্লায়েন্ট নিজে তাঁর সমস্যার কথা যেটুকু যা বললেন, তার বাইরেও খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে তোমাকে বের করে নিতে হবে প্রয়োজনীয় সমস্ত তথ্য। তারপর সন্দেহভাজন সব্বার সঙ্গে এক-এক করে, ঠান্ডা মাথায় কথা বলার ব্যাপার তো আছেই। সেই করতে গিয়ে মাথা গরম করে ফেললেও মুশকিল, আবার বাড়াবাড়ি রকমের সহানুভূতি দেখাতে গিয়ে আসল কথাটা বের করে নিতে না পারলেও পুরো আয়োজনটাই মাটি! চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে বলতে গেলে, সততা, শৃঙ্খলা, একাগ্রতা আর দায়িত্ববোধের পাশাপাশি শারীরিকভাবে ফিট হওয়াটাও এই পেশায় আসতে এবং টিকে থাকতে হলে প্রয়োজন।
কাজটা কেমন?
গোয়েন্দা এবং অপরাধ-বিষয়ক তদন্তকারীরা সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করে অপরাধীকে খুঁজে বের করেন। আইনভঙ্গ নানারকমের হতে পারে। খুন, জখম, রাহাজানি, ব্যক্তিগত আক্রোশ, প্রতারণা, এই বিভিন্ন ধরনের ক্ষেত্রে আইন কোথায় ভাঙা হচ্ছে, আইনত তার কী প্রতিকার হতে পারে, সমস্তটা সম্পর্কেই একজন গোয়েন্দাকে ওয়াকিবহাল থাকতে হয়। গোয়েন্দারা লোকাল, স্টেট কিংবা ফেডের্যাল এজেন্সির হয়েও কাজ করতে পারেন, আবার প্রাইভেটলিও কাজ করতে পারেন। ছিঁচকে চুরি থেকে শুরু করে ড্রাগ পাচার, অপহরণ, হত্যা কিংবা গণহত্যা, অপরাধ যেমনই হোক না কেন, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে গোয়েন্দারা তার তদন্তে ব্যবহার করেন কম্পিউটারের পাশাপাশি নানা আধুনিক যন্ত্রাদি। গোয়েন্দাগিরির কাজে খুব জরুরি হল প্রমাণ জোগাড় করা। তার জন্য ভুক্তভোগী ও সন্দেহভাজন, দু’পক্ষের সঙ্গেই কথা বলতে হয়, অপরাধস্থল খুঁটিয়ে দেখে খুঁজে বের করতে হয় ক্লু। স্বাভাবিকভাবেই প্রমাণ যত পোক্ত হবে, অপরাধীর শনাক্তকরণ ও তাকে দোষী সাব্যস্ত করাও হয়ে উঠবে ততটাই সহজ।
কীরকম-কীরকম হয়?
ডিটেকটিভ এবং ক্রিমিন্যাল ইনভেস্টিগেটরদের মধ্যেও নানা ভাগ থাকে। পুলিশের গোয়েন্দারা যেমন দুঁদে অপরাধীদের উপর অনেকসময়ই লুকিয়ে নজর রাখেন। কখনও সরাসরি নিজেরাই, কখনও আবার বিশ্বস্ত খোচড়দের মাধ্যমে। এদেরকেই বলা হয় সাদা পোশাকের তদন্তকারী। অনেক গোয়েন্দাই আবার ডিটেকটিভ এজেন্সি কিংবা আলাদা-আলাদা ক্লায়েন্টের জন্য আলাদাভাবে কাজ করেন।
এই পেশায় সাধারণত অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসারদের ভিড়ই বেশি দেখা যায়। তা বলে ডিটেকটিভ এজেন্সিগুলো যে নতুন ছেলে-মেয়েদেরও ট্রেনিং দিয়ে কাজে নেয় না, এমনটা নয়। যিনি গোয়েন্দা, তিনি এক্স-পুলিশ অফিসারই হোন, কিংবা আনকোরা নতুন কেউ, যেহেতু পুলিশ ফোর্সের সঙ্গে তার প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই, তাই কাউকে অ্যারেস্ট করার ক্ষমতা সাধারণত এঁদের থাকে না। কোর্ট ট্রায়াল ও প্রসিডিংয়ের জন্য তথ্য জোগাড় করার উদ্দেশ্যে, কিংবা আর্থিক প্রতারণা বা ইনসিয়োরেন্স ক্লেম সংক্রান্ত বিষয়ে অনুসন্ধানের কাজে অনেকসময় উকিল কিংবা বিভিন্ন ফার্মও গোয়েন্দাদের কাজে লাগায়। নিখোঁজ বা অপহৃত মানুষদের খুঁজতেও দ্বারস্থ হতে হয় গোয়েন্দাদেরই।
কীভাবে এগোবে?
একজন পেশাদার গোয়েন্দা বা ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেটরের জীবন সাধারণত শুরু হয় পুলিশ অফিসার ট্রেনিং দিয়ে। শিক্ষাগত যোগ্যতার ব্যাপারে প্রত্যেক ডিপার্টমেন্ট বা এজেন্সির নিজস্ব সামান্য কিছু দাবিদাওয়া থাকে। বেশিরভাগ এজেন্সিই চায় প্রার্থী যেন কমপক্ষে দু’বছর কলেজে লেখাপড়া করে তবেই এ পথ মাড়ায়। অনেক এজেন্সি আবার চায়, প্রার্থীর যেন ক্রিমিন্যাল জাস্টিস, ল’ বা পুলিশ সায়েন্সের মতো বিষয়ে ব্যাচেলর ডিগ্রি থাকে। পুলিশ ডিটেকটিভরা সাধারণত ছ’সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত ট্রেনিং পান। এই ট্রেনিং পিরিয়ডে তাঁদের পারফরমেন্সের উপর নির্ভর করে পার্মানেন্টলি কাজ দেওয়া হয়।
বেতন কীরকম?
এটা নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। অভিজ্ঞতা, এমপ্লয়ার, কাজের জায়গা এবং দায়িত্বের উপর নির্ভর করে গোয়েন্দাদের বেতন ভীষণরকম ভ্যারি করে। তুলনায় প্রাইভেট ডিটেকটিভরা একবার পসার জমিয়ে নিতে পারলে তাদের উপার্জন হতে পারে আকাশছোঁয়া।
যাঁরা প্রাইভেট ডিটেকটিভ নন, তাঁরা কাজের সূত্রে ছুটি তো পানই, সেইসঙ্গে জীবনবিমা ও স্বাস্থ্যবিমা, রিটায়ারমেন্ট ও পেনশন প্ল্যান, সবরকম সুবিধেই পেয়ে থাকেন। এই পেশায় যাঁরা আছেন, চিরকালই সমাজে সম্মান পেয়ে এসেছেন ভীষণরকম। তবে যেহেতু খুন-জখম-অপরাধ নিয়ে কারবার, তাই আঘাত পাওয়া এবং অবাঞ্ছিত দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার একটা আশঙ্কা এই পেশায় থেকে যায় সবসময়ই। অনেকসময়ই গোয়েন্দারা হুমকি পেয়ে থাকেন। তা বাদেও কাজের সূত্রে যে ধরনের ঘটনার তাঁরা মুখোমুখি হন, অনেকসময় অনেকদিনের জন্য তার একটা বিশ্রী এবং বিরক্তিকর ছাপ থেকে যায় মনে। একবার হাতে কোনও কেস নিলে তার সমাধান না হওয়া অবধি গোয়েন্দারা তা থেকে বেরতে পারেন না ইচ্ছে থাকলেও। তা সে উইকএন্ডই হোক কিংবা অন্য কোনও ছুটির দিন।
প্রতিযোগিতা কেমন?
প্রতিযোগিতার সেভাবে কোনও আশঙ্কা এই মুহূর্তে তো নেই। মানুষের সমাজ কোনওদিনই অপরাধমুক্ত থাকতে পারে না, যে কারণে অপরাধের রহস্যভেদ করতে পারেন যাঁরা, তাঁদের চাহিদাও থেকে যাবে চিরকাল। উপরন্তু ইন্টারনেটের বাড়বাড়ন্তের সঙ্গে-সঙ্গেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে অপরাধের ঘটনাও গিয়েছে বেড়ে। আস্তে-আস্তে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য সবটাই ইন্টারনেট সর্বস্ব হয়ে পড়ছে, সেইসঙ্গেই বাড়ছে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব গোয়েন্দার প্রয়োজন।
কাজের বাজার কেমন?
কেউ বলেন সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে আমাদের সমাজে অপরাধের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। কেউ আবার বলেন, অপরাধ হয়তো একইরকম ছিল, সংবাদমাধ্যমের তৎপরতা বেড়ে গিয়েছে বলেই এখন আরও বেশি-বেশি করে আমরা তার খবর পাই। ঘটনা যাই হোক না কেন, এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে এই দেশে প্রাইভেট ইনভেস্টিগেশন ও ডিটেকটিভ সার্ভিসের চাহিদা কিন্তু দিন-দিন বেড়েই চলেছে। সিকিয়োরিটি নিয়ে মানুষের উৎকণ্ঠা বাড়ছে ক্রমশই। ফলত দেশ জুড়ে ডিটেকটিভ এবং সিকিয়োরিটি এজেন্সিগুলো চলছে রমরমিয়ে। নানারকম ঝুঁকি আছে সত্যি, তা সত্ত্বেও বুদ্ধি খাটিয়ে একটা রহস্যের সমাধান করতে পারার যে তৃপ্তি, শুধু সেটুকুর লোভেই হাসতে-হাসতে চলে আসা যায় এই পেশায়। রিটায়ার্ড পুলিশরা তো আছেনই, পাশাপাশি এই আমাদের বয়সীদের কাছেও অপরাধের বিরুদ্ধে নিজের মতো করে লড়াই করার জন্য এর চেয়ে থ্রিলিং পেশা খুব কমই হতে পারে।