চোখ মেলতেই চোখ ধাঁধিয়ে গেল ছেলেটার। একরাশ সাদা। ধপধপে সাদা। যতদূর চোখ যায় ততদূর। মিশমিশে কালো থাকলেও যে কথা, সাদা থাকলেও ব্যাপারটা একই। কিছুই দেখা যাবে না। সময়ের গতিও বোঝা যাচ্ছে না। সেকেন্ড মানে কি? ভুলে গেছে ছেলেটা। এমনকি নিজের নামটাও। ডান হাতটা তুলে আনল চোখ বরাবর। নিজের অস্তিত্ব আছে বুঝতে পেরে আশ্বস্ত হলো কিছুটা।
‘গুড মর্নিং। ১.. ২.. ৩.. ৪…।’
এভাবে পনের পর্যন্ত গুনল স্পিকারে ভেসে আসা একটা কণ্ঠ। এরপরই চোখে উজ্জ্বল সাদা আলোটা সয়ে এলো। অবাক হলো ছেলেটা। ঠিক তার মতোই সাদা টিশার্ট আর সাদা প্যান্ট পরা কয়েকশ ছেলে দাঁড়িয়ে। হলরুমটার দেয়াল সম্ভবত কেউই দেখছে না। ছেলেটা দেখেই বুঝল বাকি ছেলেগুলো তারই বয়সী। অদ্ভুত ব্যাপারটা টের পেল বেশ কয়েক সেকেন্ড পর। সামনে থাকা বিভ্রান্ত ছেলেগুলোর চেহারা হুবহু একই রকম।
‘হ্যালো রতন।’
আবারও স্পিকারের গলা। কথাটা কাকে বলল লোকটা? রতন কে?
‘ওহ! আমিই তো রতন!’
গোটা হলরুমের সমস্ত ছেলে গুঞ্জন করে উঠল। আবার চুপ। রতনের কানে সবার নিঃশ^াসের শব্দটা শোনাচ্ছে হিস হিস করতে থাকা হাজারটা সাপের মতো। এক পা এগোলো। ধুপধাপ শব্দ। আরও অনেকেই তার মতো করে এক পা এগিয়েছে। পায়ে পায়ে সবাই সবার সামনে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কেউ যাচ্ছে না। সবাই যে যার জায়গাতেই আছে। রতনের মনে হলো সে এক পা আগানোর সঙ্গে সঙ্গে পেছনের মেঝেটাও তার সামনে চলে আসছে।
ছেলেরা সবাই হট্টগোল পাকাল। এ ওর দিকে তাকাল। ও তার দিকে তাকাল। ওরা সবাই ধরে নিয়েছিল যে, সে ছাড়া বাকি সবার চেহারা বুঝি এক। ভুলটা ভাঙতে বেশিক্ষণ লাগল না। হলরুমে সবার চেহারাই এক। রতনও ধরতে পারল বিষয়টা।
‘রতন তুমি নিরাপদে আছো। ভয় পেয়ো না। তুমি হারিয়ে যাবে না।’
লোকটা ভয় পেতে বারণ বলল কেন? ভয় পাওয়ার কারণ আছে?
রতন ভাবছে, লোকটা শুধু তাকে সম্বোধন করে কথা বলছে কেন? ঘরে তো আরও শয়ে শয়ে ছেলে আছে।
‘তোমাকেই বলছি। স্থির হও। এটা একটা সিম্যুলেশন। তুমি মেধাবী ছেলে। তুমি এটা বুঝতে পারবে। একটু পরই।’
রতন টের পাচ্ছে তার ভেতর চাপা অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে। বাকিরাও ইতস্তত আচরণ করছে। একটু পর আবার সবাই এলোমেলো পায়চারি শুরু করল। এমনটাই যেন স্বাভাবিক। ঠিক যেন ক্লাস পার্টি চলছে। সবাই যে যার মতো হেঁটে বেড়াচ্ছে। কেউ কারও সঙ্গে কথা বলছে না। রতন স্থির হলো। বাকিরাও স্থির।
‘রতন, তোমাকে এখন দেখতে পাচ্ছি না। তবে তোমাকে একটা কাজ দেব। তুমি কাজটা করলে পুরস্কার পাবে।’
‘কী পুরস্কার?’
একযোগে বলল সবাই।
অপরপ্রান্তে নীরবতা। পুরস্কারের বিষয়টা সম্ভবত মিথ্যে। লোকটা বানিয়ে কিছু একটা বলবে হয়তো।
‘রতন আমি কিউ-কম্পিউটার কৃবু। আমি আসলে তোমাকে পুরস্কার দিতে পারব না। ব্যাপারটা তোমাকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য বলেছি।’
রতনের মনে হলো তার একটা কিছু বলা উচিত। সে ভাবছে, সে কিছু বললে বাকিরাও কি একই কথা বলে উঠবে? বাকিদেরও কি মনের মধ্যে একটা কিছু বলার ইচ্ছে তৈরি হয়েছে?
‘আমি কোথায়?’
রতন বলল কথাটা। বাকিরা কথা বলেনি।
‘তুমি একটা সিম্যুলেশনে আছো। এই মুহূর্তে তোমার অবস্থান আমি জানি না। জানা সম্ভব নয়। আমি এটুকু বলতে পারি যে আমি নিশ্চিত তুমি এখানেই আছো।’
অনেকক্ষণ হলো কম্পিউটার কৃবু আর কথা বলছে না। মনে হলো সে আসলে জানে না রতন কোথায়। রতন কি জানে? রতন এদিক ওদিক তাকাল। এদিক-ওদিক বলতে কোন দিক সেটাও সে বুঝতে পারছে না। তার কাছে মনে হচ্ছে সব দিকই একই দিক।
সাদা হলরুমটায় দেয়াল নেই। দেয়ালগুলোকে মনে হলো অসীম দূরত্বে। রতনের মতো হলো সে আগেও এক অসীমের মাঝেই ছিল, এখনও আছে। পৃথিবী ছাড়িয়ে সৌরজগত, তারপর গ্যালাক্সি, তারপর গ্যালাক্সির গুচ্ছ, তারপর চেনা মহাবিশে^র শেষ সীমানা, তারপর স্থান-কাল বিহীন অপার এক শূন্যতার সমুদ্র। ঠিক যেন এই ঘরটার মতোই।
ছেলেরা সবাই জড়ো হতে লাগল। তারা ঠিক করল একজন আরেকজনের সঙ্গে কথা বলবে। এমনটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু দুটো ছেলে সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে হাত মেলাতেই রতন দেখল তার জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ এবং অদ্ভুত দৃশ্য। ছেলে দুটো হাত মেলাতেই এক হয়ে গেল। মানে দুম করে দুটো থেকে একটা ছেলে হয়ে গেল।
এরপর? এরপর সেই ছেলেটাও নিজেকে আবিষ্কার করল নতুন করে। যেন সে একটু আগে একজনই ছিল। রতন চমকে গেল। সেও কি এভাবে অন্যের মাঝে হারিয়ে যেতে পারে? ওর ঠিক সামনেই আরও তিনটা ছেলে কথা বলছিল। মুহূর্তেই তিনজন নেই হয়ে গেল। এভাবে একে একে সবকটা ছেলে মিলে যেতে যেতে শেষে রইল একজন। সে এবার তাকাল রতনের দিকে।
একরাশ আতঙ্ক চেপে ধরেছে রতনের মনে। ঠিক করেছে ওই ছেলের সঙ্গে কথাই বলবে না। ছেলেটা তার দিকে এগিয়ে আসতেই রতন ছুটে গেল এক দিকে। কোন দিকে? দিক তো সব একই রকম লাগছে। কখনও সামনে, কখনও পেছনে। রতনের মনে হলো সে যে ছেলেটার হাত থেকে বাঁচতে বিপরীত দিকে ছুটল, ছেলেটা আসলে সে দিকেই ছিল। মানে সাপ দেখে কেউ উল্টো দিকে ছুটতে গিয়ে আবার সেই সাপের মুখেই পড়ল, ব্যাপারটা এমন।
‘রতন, তোমার পায়ের নিচে মেঝেতে তাকাও। তুমি কি কোনো সংখ্যা দেখতে পাচ্ছো?’ স্পিকারে ভেসে এলো কৃবুর গলা।
‘শূন্য দশমিক শূন্য শূন্য সাত দুই নয়…।’
‘হয়েছে। এর মানে সিম্যুলেশন ঠিকঠাক আছে। তুমিও ঠিক আছো।’
‘আমি কোথায় আছি?’
‘এখানেই কোথাও। আমরা তা জানি না। তবে তুমি আছো।’
‘তোমরা কারা?’
‘আমি কৃবু। আ.. আমার সঙ্গে বিজ্ঞানী। ইয়ে.. তিনি তোমার নাম দিয়েছেন রতন।’
‘বাকিরা কারা?’
উত্তর দিল না কৃবু। মনে হলো সে রতনকে আর দ্বিধায় ফেলতে চায় না।
আচমকা ধাক্কা খেল রতন। সর্বশেষ যে ছেলেটা ছিল সে-ই ধাক্কাটা দিয়েছে। ধাক্কার পর দুজনই সরে গেল। ডান দিকে ঘাড় বাঁকিয়ে রতনকে দেখল ছেলেটা। রতনও তাকে দেখল বাম পাশে ঘাড় বাঁকা করে।
‘তোমার নাম রতন?’
‘হ্যাঁ, তুমি?’
‘আমি নতর।’
‘এ আবার কেমন নাম?’
‘তোমার নামটাও অদ্ভুত। আমার নামের উল্টো করলে রতন হয়।’
রতন মাথা চুলকানোর জন্য ডান হাত উপরে তুলল। সঙ্গে সঙ্গে নতর তুলল বাম হাত। রতনের মনে হলো সে একটা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে যা করছে নতরও হুবহু তা করছে। তবে উল্টোভাবে করছে। রতন বাম পা তুলে লাথি দেওয়ার ভঙ্গি করল, নতর তুলল ডান পা।
রতন দিল ছুট। ছুটতে ছুটতে নিজেকে আবিষ্কার করল শুরুর জায়গাতেই। মেঝেতে দেখল। আগের সেই সংখ্যাটাই- দশমিক শূন্য শূন্য সাত দুই…। সংখ্যাটার মানে কী?
বুঝিয়ে দিল কৃবু। ‘এটা একটা অনুপাত রতন। একটু আগে তোমার সঙ্গে যার ধাক্কা লাগল তার সঙ্গে তোমার একটা জোড়া বেঁধেছে। আর সংখ্যাটাকে ওই ধাক্কাধাক্কির শক্তি বলতে পারো। এটা ঠিক থাকলে সব ঠিক।’
রতন মাথামুণ্ডু কিছু না বুঝলেও এটা নিশ্চিত যে তাকে এই অদ্ভুত ঘর থেকে বের হতে হবে। ওদিকে নতরের দেখা পাচ্ছে না। কোথায় হারাল কে জানে। আচমকটা রতনের বাম হাত চলে গেল মাথায়। চুলকাতে লাগল। কেন একাজ করল? জানে না। আশপাশে আর কেউ নেই। ধপধপে সাদা এক মহাবিশে^ সে একা। নতর থাকলেও হতো। কথাবার্তা বলা যেত।
এমন সময় দেখল নতর আসছে তার দিকে। সে তার ডান হাত দিয়ে মাথা চুলকাচ্ছে।
‘ও, এই তবে ঘটনা। তুমি যা করবে আমি তার উল্টোটা করবো?’ বলল নতর।
‘আমিও একই ব্যাপার টের পাচ্ছি। তুমি বাম হাত দিয়ে মাথা চুলকাচ্ছো বলেই তো আমি ডান হাত দিয়ে মাথা চুলকাচ্ছি।’
ধন্ধে পড়ল রতন। তাদের মধ্যে কে আগে মাথা চুলকাতে শুরু করল ভেবে পেল না। সম্ভবত দুজন একসঙ্গেই।
‘এখান থেকে বের হতে হবে আমাকে।’
‘বিজ্ঞানীকে বলে দেখো। সে পারবে মনে হয়। আমরা একা একা বের হতে পারব না।’
‘আমরা মানে, আমি বের হতে চাই শুধু। তুমি আমার ছায়া। তুমি কেন বের হবে! তুমি আসল না। আমি আসল।’
‘হা হা হা।’
নতর হেসে উঠল। হাসিটা অসহ্য লাগলো রতনের। নতরও নিশ্চয়ই একই কথা ভাবছে। রতন চেঁচিয়ে বলল, ‘আমাকে এখান থেকে বের করো!’
অদৃশ্য স্পিকারে মৃদু ফিসফিস শুনলো রতন। কৃবু নামের কম্পিউটারটা কীসের হিসাব করছে এত? ওই বিজ্ঞানীই বা কে? রতনের মনে পড়ল সে অনেক বিজ্ঞানীকে চেনে। তার এও মনে পড়ছে যে সে নিজেও বিজ্ঞানীর চেয়ে কম জানে না। কী যেন একটা পরীক্ষার কথা মনে পড়ল তার। কে করছে সেই পরীক্ষা? পরীক্ষার ফল কী হবে? উত্তর পেল না।
‘দুঃখিত রতন। আমরা তোমাকে বের করতে পারব না। তোমার বের হওয়ার পথ তোমাকেই বের করতে হবে।’
কৃবুর কথায় মাথায় বাজ পড়ল রতনের। মেজাজটাও বিগড়ে গেল। মেঝের সংখ্যাটাই কি সব নষ্টের গোড়া? কৃবু তো বলল সংখ্যাটা ঠিক আছে মানে সব ঠিকঠাক। সব ঠিকঠাক থাকলে সে বের হতে পারবে না এই অদ্ভুত সাদা ঘর থেকে। সংখ্যাটা বদলে দিলে কেমন হয়?
‘না রতন তুমি তা করতে পারো না। আমি করতে দেব না। কারণ আমি নতর। আমি তোমার উল্টোটা করবো। এটাই আমার কাজ। প্রকৃতি এটাই ঠিক করে দিয়েছে। তুমি যেমন আমি তার উল্টোটা। আমরা দুজন থাকলে সব ব্যালেন্স থাকবে। সংখ্যাটাও বদলাতে পারবে না।’
‘তোমার ব্যালেন্সের নিকুচি করি আমি। আমি বের হবো!’
‘আমি তা হতে দেব না। তুমি যে কারণে বের হতে চাও আমি তার উল্টো কারণে বের হতে চাই না।’
‘আমাদের একজনকে বের হতে হবে। তা না হলে…।’
‘তা না হলে কী?’
‘তা না হলে আমরা দুজন শূন্য হয়ে যাব বুঝলে?’
শুরু হলো কুস্তি। রতন বনাম নতর। কেউ কারও সঙ্গে পেরে উঠছে না সহজে। আচমকা কুস্তি থামিয়ে রতন বলল, ‘আমি যা করবো তুমি তো তার উল্টোটাই করবে তাই না?’
‘হ্যাঁ।’
‘আর তা যদি করতে না পারো?’
‘তবে আমরা আর জোড় থাকব না। আমাদের একজন বের হয়ে যাব এই ঘর থেকে। কিন্তু সেটা তো হবে না। তুমি আমার সঙ্গে কখনই পেরে উঠবে না। আমিও পেরে উঠব না। আমাদের কুস্তি আজীবন চলতেই থাকবে।’
রতন মেঝেতে তাকাল। নতরের সঙ্গে পেরে উঠবে না বুঝতে পেরেছে। তবে বুদ্ধি একটা পেয়েছে। অদ্ভুত সেই সংখ্যাটার দিকে তাকাল। সংখ্যাটার শেষ অঙ্কটা হলো ৮। রতন জোরসে ঘষে সেটা মুছে লিখে দিল ৯। আর তাতেই ভীষণভাবে দুলে উঠল দেয়াল বিহীন সাদা ঘরটা। ভেঙেচুরে যেতে লাগল সব।
নতরের দিকে তাকিয়ে হাসল রতন। বলল, ‘আমাদের মধ্যে একজন জেগে উঠবে এখন।’
নতর বলল, ‘কে জেগে উঠবে? আমি না তুমি?’
রতন বলল, ‘আমি জানি না। তুমি যে ব্যালেন্সের কথা বলেছিলে, সেটা ভেঙে দিয়েছি। নতুন যে সংখ্যাটা তৈরি হলো তাতেই আমাদের একজন জেগে উঠবে।’
‘হুম। ঠিক!’
চোখ মেললেন বিজ্ঞানী সাইদুল করিম রতন। হাত বাড়িয়ে চশমাটা পরে নিলেন। কম্পিউটার কৃবুর রেকর্ড বলছে এক সেকেন্ডের দশ হাজার কোটি ভাগের এক ভাগ সময় তিনি সিম্যুলেশনে ছিলেন। কত ক্ষুদ্র সময়, অথচ মনে হলো অন্ততকাল। ওয়েভ ফাংশন নষ্ট হতেই ঘুম ভেঙেছে বিজ্ঞানী রতনের। উঠেই মাথা দুলিয়ে বলতে লাগলেন, ‘বুঝলিরে কৃবু! সব বুঝতে পেরেছি। একটা একরোখা কণার গোঁয়ার্তুমির কারণেই ঘটেছিল বিগ ব্যাং।’
(আমাদের আয় নেই বলে আমরা লেখকদের সম্মানি দিতে পারি না। তাই গল্পটি আপনার ভালো লেগে থাকলে লেখককে এক কাপ কফি খাওয়াতে পারেন। সেক্ষেত্রে বিকাশ করুন : 01976-324725)