শত্রুকে চেনা চাই : সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর কলাম

কোনো আন্দোলনেরই সাফল্যের একেবারে প্রথম শর্তটি হচ্ছে শত্রুকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করা। নারীমুক্তির প্রশ্নে পুঁজিবাদী সমাজ ও রাষ্ট্রকে মূল শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করতে আমরা যেন ভুল না করি। .. পড়ুন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর কলাম..

নাটকে-উপন্যাসে, প্রবচনে— কথোপকথনে, আমরা অনেক সময় উল্লেখ পাই যে, নারীর শত্রু নারী নিজে। এ ধারণার সামাজিক ভিত্তি আছে। সেটা হলো এই—মেয়েদের নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি দেখা যায়। শাশুড়ি ঘরের বউয়ের প্রতি বিরূপ আচরণ করে। ঘরের বউও শাশুড়িকে পছন্দ করে না। এখন অবশ্য পরিবারগুলো আর আগের মতো নেই; ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হয়ে গেছে, মেয়েরা কর্মক্ষেত্রে চলে এসেছে। কর্মক্ষেত্রে মেয়েরা একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে কথা বলে। বোনে-বোনে ঝগড়া হয়। কিন্তু এই যে ধারণা, মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু, সেটা অবশ্যই ভ্রান্ত। শুধু ভ্রান্ত নয়, ক্ষতিকরও। আরও যেটা আপত্তিকর সেটা হলো, আসল শত্রুকে আড়ালে রাখা। নির্মম সত্য হলো এই যে, মেয়েদের সঙ্গে শত্রুতা করে গোটা সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা। সমাজে যখন সামন্তবাদী ব্যবস্থা ছিল তখনো নারী ওই ব্যবস্থার দ্বারা নির্যাতিত হতো। এখন যখন পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় আমরা পৌঁছে গেছি, তখনো নারী নির্যাতিত হচ্ছে। শাশুড়ি ও গৃহবধূ উভয়ই ব্যবস্থার শিকার। কিন্তু বিক্ষোভ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে না নিয়ে চলে যাচ্ছে পরস্পরের বিরুদ্ধে।

পরিসংখ্যান বলে যে, শতকরা ৮০ জন মেয়ে নির্যাতিত হচ্ছে। এ নির্যাতন গৃহে, কর্মক্ষেত্রে, পথেঘাটে সর্বত্রই ঘটে। যেখানে সরাসরি নির্যাতন নেই সেখানেও বৈষম্য আছে। মেয়েরা এখন বিপুলসংখ্যায় কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত। তাদের উপস্থিতি সর্বত্রই লক্ষ করার মতো। কিন্তু তাদের বেতন ও মজুরির ব্যাপারে নারী-পুরুষের পার্থক্য বেশ স্পষ্ট। তদুপরি একজন কর্মনিযুক্ত মেয়েকে ঘরের সাংসারিক-পারিবারিক কাজ করতে হয়। পুরুষের তুলনায় এ কাজের পরিমাণ অধিক। কিন্তু এ গৃহকর্মকে যতই আদর্শায়িতই করা হোক না কেন, এটা ভয়ানকভাবে একঘেয়ে ও ক্লান্তিকর। কিন্তু এই যে প্রতিদিনের কাজ এর কোনো মূল্যায়ন করা হয় না। অধিক মূল্যায়নের তো প্রশ্নই ওঠে না। পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যায়নও নেই।

কেউ বলবে না যে বাংলাদেশের মানুষ এখন ভালো অবস্থায় আছে। কিন্তু এই খারাপ অবস্থার ভেতর মেয়েদের অবস্থা আরও খারাপ। এর কারণ নারী দুর্বল। আমাদের এই নিপীড়নমূলক সমাজের নিয়মই এই যে, প্রবল দুর্বলের ওপর অত্যাচার করবে। নারী মোটেই দুর্বল নয়। তাকে দুর্বল করে রাখা হয়। সন্তানের জন্মদান ও প্রতিপালনের ক্ষেত্রে মেয়েদের যে ভূমিকা তা পুরুষের পক্ষে সম্ভব নয়। সেবা ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে মেয়েরা সবসময় দক্ষতা প্রদর্শন করে আসছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে তারা পুরুষের সঙ্গে শুধু প্রতিযোগিতা করে তাই নয়, অনেক ক্ষেত্রে তারা পুরুষের চেয়ে ভালো ফল করে। অনেক কঠিন কাজ মেয়েরা করছে। তারা কারখানায় আছে, পোশাকশিল্পে মেয়েরাই অধিক। সামরিক বাহিনীতে, পুলিশ বাহিনীতে, প্রশাসনে, বিচার বিভাগে, গণমাধ্যমে তারা দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে। কিন্তু তাদের হয়রানির শিকার হতে হয় এবং সামাজিকভাবেও হেয় বিবেচনা করার দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। পুঁজিবাদী সমাজ নিজেকে গণতান্ত্রিক বলে দাবি করে। কিন্তু এ ব্যবস্থা পুরোপুরি পিতৃতান্ত্রিক। নারীকে সে যতটা পারে দুর্বল করে রাখতে চায়। এটাই তার স্বভাব।

এ দেশে মানুষের নিরাপত্তার ভীষণ অভাব। কিন্তু এর মধ্যে নারীরা বিশেষভাবে নিরাপত্তাহীনতাই ভোগে। প্রতারণা, যৌন হয়রানি, লাঞ্ছনা ইত্যাদি নিত্যকারের বাধা। পথেঘাটে বখাটে যুবকরা উৎপাত করে। নারী ধর্ষণ আগেও ছিল। কিন্তু এখন সেটা মাত্রায় অনেক বেড়েছে। গণধর্ষণ আমাদের দেশে অপরিচিত ছিল। সেটাও চলছে। মেয়েরা পাচার হয়ে যাচ্ছে। নারী নির্যাতনে এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যক্তিরাও অভিযুক্ত হচ্ছে। অসহায় মেয়েরা আত্মহত্যা করছে। ধর্মীয় মৌলবাদীরা নারীর মানবিক অধিকারগুলোকে স্বীকৃতি দিতে কুণ্ঠা প্রকাশ করে। যৌতুকের জন্য নিপীড়ন এখনো চলছে। মেয়েরা যে এখন হিজাব ও বোরকা পরিধান করছে, তার পেছনে একটা বড় কারণ নিরাপত্তাহীনতা। গোটা ব্যবস্থাটাই মেয়েদের দুর্বল করে রেখেছে। যদিও মেয়েরা যোগ্যতায়, কর্মদক্ষতায় অর্থনীতিতে অবদান রাখছে, কিন্তু সবকিছু সত্ত্বেও তাদের কোণঠাসা করে রাখা হচ্ছে।

আমাদের সমাজ বৈষম্যমূলক। এ সমাজে মেয়েরা দুই দফায় বৈষম্যের শিকার হয়। প্রথম বৈষম্য শ্রেণিগত, দ্বিতীয় বৈষম্য নারী-পুরুষের। নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র ঘরের মেয়েদের তো কথায়ই নেই। বিত্তবান পরিবারেও মেয়েদের প্রতি আচরণ বৈষম্যমূলক।

সব মিলিয়ে সত্য এই যে, সমাজ ও রাষ্ট্রই আসলে শত্রু। নারীমুক্তির আন্দোলন আসলে এ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন। এ ক্ষেত্রে সংস্কার, নতুন আইন প্রণয়ন, আইনের প্রয়োগ অনেক কিছুর কথাই ভাবা হয়। এদের উপযোগিতা অবশ্যই আছে। কিন্তু সংস্কারের মধ্য দিয়ে এ ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করা যাবে না। নির্মম বটে, তবে সত্য এই যে, সংস্কার ব্যবস্থাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে সাহায্য করে। আমরা অবশ্যই সংস্কার চাইব। কিন্তু এ সত্যকে ভুললে চলবে না যে, বৈষম্যমূলক ব্যবস্থাকে বদলাতে না পারলে নারীমুক্তি অসম্ভব। আন্দোলনের লক্ষ্যও তাই গোটা ব্যবস্থা পরিবর্তনের। এ ব্যবস্থা পরিবর্তনের স্বপ্ন আমরা দীর্ঘকাল দেখেছি, এখনো দেখছি। কিন্তু ব্যবস্থা বদলায়নি। অন্যায় ও অমানবিক এ ব্যবস্থার প্রকোপে বাংলাদেশের সমস্ত মানুষ আজ নিতান্ত দুর্দশাগ্রস্ত ও হতাশায় আক্রান্ত। এ ব্যবস্থাকে বদলানোর কাজটা শুধু মেয়েদের নয়। নারী-পুরুষ সবারই। নারীমুক্তি আন্দোলনকে সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখতে হবে। না দেখলে তা দূরদর্শী হবে না এবং লক্ষ্য অর্জনের দিকেও এগোতে পারবে না। আবারও বলি, সমাজ পরিবর্তনের দায়িত্ব নারী-পুরুষ সবারই এবং আন্দোলন ছাড়া পরিবর্তন সাধনের অন্য কোনো উপায় নেই।

যে কোনো আন্দোলনেরই সাফল্যের একেবারে প্রথম শর্তটি হচ্ছে শত্রুকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করা। নারীমুক্তির প্রশ্নে পুঁজিবাদী সমাজ ও রাষ্ট্রকে মূল শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করতে আমরা যেন ভুল না করি।

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

columnstoriesকলাম