‘এক চিলতে উষ্ণতার স্পর্শ ছড়িয়ে দেওয়া একজন জাহাজির গল্প’

পাবনার সরদার পাড়া নামক  ছোট্ট এলাকায় তাঁর জন্ম। কাকলি, বাসন্তী,  নির্মল প্রকৃতির সঙ্গে তাঁর শৈশব-কৈশোর কেটেছে। বর্ণচোরা, ধোঁয়াটে, প্রকৃতির রং তাকে খুব বিস্মিত করেছে। কখনো বা বাড়ির সাথের পুকুরের কোকনদ কখনো বা কৃষ্ণচূড়া তাকে স্নিগ্ধ স্মিথ হাস্যোজ্জ্বল বানিয়েছে। প্রকৃতিতে গুঞ্জন জীমূতমন্দ্র, যেমন  তাকে কলতান দিয়েছে মধুর। তেমনি জীবনের সঙ্গে জীবন যোগ করে মর্মর, নির্ঘোষ, ঐকতান ও ভাবুক করে তুলেছে। খুব কাছ থেকে দেখেছেন বাস্তবতা।  কখনো তাঁর এক পসলা স্বপ্নকে উথান হতে দিলেও পতন হতে দেয়নি। জাহাজির মতো ধড়ে প্রাণ এসেছে মানুষের দিকে হাত বাড়িয়ে।


মায়ের প্রেষণা থেকেই নিজের যা আছে তা নিয়ে অপরের পাশে থাকার আগ্রহ  থেকেই শুরু স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজের। যেকোনো সচেতনতামূলক ও মানবিক কাজে রয়েছে তাঁর বিশেষ ভূমিকা। পরিবেশ পরিস্থিতি  তাকে যেখানেই নিয়ে যাক সব সময়ই তিনি চান ভালোর সঙ্গে আলোর ফোয়ারা হয়ে থাকতে।


পাবনা জেলার প্রত্যন্ত এলাকায় অসহায় ও সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের নিয়ে তিনি গভীরভাবে ভাবতে শুরু করেন। কোমলমতি ফুটন্ত গোলাপ ফুলের মতো শিশুদের দিকে তাকিয়ে যিনি নিজের শৈশবের প্রতিচ্ছবি দেখতে পান।
ভূয়োদর্শী এই দীপ্তিমান তরুণ একজন জাহাজির মতো ছুটে যান যখন রক্তের প্রয়োজনে কেউ কাতরায়। একবার ক্যম্পাসে পান্ডুর চেহারা নিয়ে উস্কোখুস্কো চুল নিয়ে  এলোমেলো এক লোক হন্যি হয়ে তাঁর সন্তানের জন্য রক্তের খোঁজ করছিলো সেই জাহজি জানা মাত্র অপরিচিত লোকটির সঙ্গে গিয়ে নিজের রক্ত মিলে যাওয়াতে রক্ত দান করেন। এ পর্যন্ত ১১ বার যিনি রক্ত দিয়েছেন সময়ে অসময়ে রক্তদাতা খুঁজে দিয়েছেন বিপদগ্রস্ত রোগীদের। ধীরে ধীরে এই রক্ত যোদ্ধা জাহাজি নাবিক যেমন যাত্রীদের কাছে ভরসা যোগ্য হয়ে ওঠে,ঠিক তেমনিভাবে  তিনিও আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন সকলের কাছে। ভালোবাসা পায় বহু মানুষের বন্ধু মহল থেকে চারিপাশে।


বিপদগ্রস্তের স্থানে নিজেকে চিন্তা করেন, আজ যদি তাঁর এরকম সমস্যা হতো তাহলে তাঁর ও হয়তো রক্তগ্রহীতা হয়ে তড়িঘড়ি করে রক্তদাতা খুঁজতে হতো।


জাহাজি নামে পরিচিত হয়ে উঠা এই স্বেচ্ছাসেবকের প্রকৃত নাম মো.আরিফুজ্জামান। ‘আরিফ’বা জাহাজি নামেই এক নামেই যার পরিচিতি।  জন্ম পাবনার শালগাড়িয়া সরদার পাড়া। 

পড়াশোনা পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার ঈশ্বরদী  সরকারি কলেজের রসায়ন বিভাগে আর  ঈশ্বরী হওয়ার  সুবাদে গোটা পাবনা শহরের ও প্রত্যন্ত প্রতিকূল অঞ্চলের পরিস্থিতি পরিবেশ তাকে উদ্বিগ্ন করে ফেলে।শৈশব থেকেই মায়ের দেয়া মানবিক শিক্ষা তাকে প্রেষণা দেয়। গতানুগতিক পড়াশোনায় নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখতে পারেন নি আরিফ।

মানবতার টানেই মূলত কখনো দূরন্ত গতীতে প্রত্যন্ত এলাকায়  কখনো  এক চিলতে উষ্ণতার স্পর্শ  দিতে এগিয়ে গেছেন মহল্লায় কখনো বা প্রকৃতি পরিবেশ নিয়ে  কাজ করতে।

পরিবেশ প্রকৃতির হাহাকার খুব সূক্ষ্ণভাবে তাঁর মনে টানাপোড়েন সৃষ্টি করে।  কোমলমতি শিশুদের ভালোবাসা ও তাঁর টইটম্বুর।


তিনি তাঁর জীবনের সঙ্গে পথশিশুদের ঝরা পতার মতো দেখেছেন চান নি আর কেউ ঝড়ে পড়ুক। মহল্লার শেষ প্রান্তে এমন কিছু জনগোষ্ঠী আছে যাদের একবেলা অসুস্থতায় পড়ে রইলেই ভরাডুবি। তাই এ বিষয়গুলি আরিফের জিগমিষা থেকে জিজ্ঞাসার তৃষ্ণা বাড়িয়ে তোলে। তবে তাঁর একার পক্ষে এভাবে সম্ভব নয় কিভাবে সে শুরু করবেন যেখানে প্রাথমিকে মাত্র ২য় শ্রেণীতে পড়াকালীন জীবনের বটবৃক্ষ তাঁর পিতাকে হারান। বাবা মারা যাওয়ার পর মা সংগ্রাম করে দু’ সন্তানকে লালন পালন করতে শুরু করেন, হাল ধরেন। সে তখন বুঝতো না বাবা না থাকলে কি হয়!   ধীরে ধীরে যতই বড় হতে থাকেন শৈশব থেকে কৈশোরে পদার্পণ করতে তিনি উপলব্ধি করতে শুরু করলেন বাবা থাকাটা  অনেক দরকার।  সমাজের মানুষের ভয়াল থাবা থেকে পরিবারকে  আগলে রাখার জন্য হলেও দরকার।


এইসকল প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তিনি  বিচলিত হতেন সে সময় তাঁর মায়ের দোয়া অনুপ্রেরণা, মানুষের মতো মানুষ হতে চাওয়ার তীব্র সদিচ্ছা,  তাকে পরিশ্রমী ও বিনয়ী করে তোলে। প্রাথমিকে বৃত্তি প্রাপ্ত হয়ে মেধাবী এই শিক্ষার্থী, মাধ্যমিকে ভর্তি হয় নিম্ন মাধ্যমিকে পড়াকালীন সময় থেকেই নিজের পড়াশোনার টুকটাক খরচ নিজেই বহন করা শুরু করেন, উচ্চ মাধ্যমিকে পুরোদমে নিজের পড়াশোনার খরচ নিজেই বহন শুরু করেন। 

নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি শুরু কীরেন টিউশনি। তাঁর প্রবল ইচ্ছে তাঁর মতো কষ্ট বা সংগ্রামের কারণে কোনো শিশু আগামীতে ঝরে না পড়ুক এই সংকল্পকে কোমল পথকে এগিয়ে নেয়ার মাধ্যম হয় জাগো ফাউন্ডেশনের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ভিবিডি। ভিবিডি বা ‘ভলেন্টিয়ার ফর বাংলাদেশ ‘ এসডিজি বা টেকসই উন্নয়ণের লক্ষ্যে যা ভূমিকা পালন করে। তাঁদের এই প্ল্যটফর্মের লক্ষ্যমাত্রা আরিফের চেতনার পরিপূরক। তাই পাবনা জেলার ভিবিডির সঙ্গে আরিফ একাত্নতা প্রকাশ করে কাজ শুরু করেন ২০২১ থেকে। ভিবিডিতে ৫ই জুন ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবসে’ বৃক্ষরোপন ইভেন্টের মাধ্যেমে কাজ শুরু করেন। এরপর ভিবিডি পাবনা জেলার বেশ কয়েকটি ইভেন্ট ‘আসুন ব্লাড গ্রুপিং শিখি’


‘রেল লাইনে ঢিল ছোড়া ‘ও তাঁর আইন কানুন সম্পর্কে সচেতনতামূলক ইভেন্টে অংশগ্রহণ করেন। এরপর পাবলিক রিলেশনস্ অফিসার হিসেবে ভিবিডি পাবনা জেলার নেতৃত্বে আসেন।


পরের বছরই জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পান। এখন থেকে পর পর দুইবার শীত বস্ত্র বিতরণ মূলক ইভেন্ট ‘ এক চিলতে উষ্ণতার হাসি’ পাবনা ও ঈশ্বরদীতে সচেতনতামূলক ক্যম্পেইন’আপনার মাস্ক কোথায়?’ ‘সুপেয় পানির অধিকার এর মাধ্যেমে অসহায় পরিবারে নলকূপ স্থাপন, ‘ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতনতমূলক ক্যম্পেইন, সুচিকিৎসার অধিকার,  এর মাধ্যেমে অসুস্থ ব্যক্তিদের সাহায্য প্রদান, সিলেটে বন্যার্তদের জন্য অনুদান সংগ্রহ ঈদে অসহায় পরিবারের উপহার, ইয়াতিমদের ইফতার(রমজানের হাসি) সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের নতুন পোশাক, ‘শেয়ার কাইন্ডনেস ক্রিয়েট স্মাইল) এছাড়াও তুলনামূলক সুবিধা বঞ্চিত শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপকরণ বিতরণ ইত্যাদি।  জীবনে চড়াই উৎরাই পার করে মানুষ হলেও কঠিন পরিস্থিতিতে তাঁর ভেতরে সততার বীজ বুনে দিয়েছেন তাঁর মা এবং বাস্তবতা। তিনি জানান, “আমি যেমনভাবে লড়াই করেছি আর কোনো শিশু যেনো না করে এ সকল বিষয় আমার মনে নাড়া দিয়ে ‘ভলেন্টিয়ার’ হিসেবে গড়ে তুলেছে।”


এই জাহাজি তরুণ আরিফ জানান, “সমাজের প্রত্যেকটি মানুষ মানুষের জন্য একটু সহানুভূতিশীল হয়ে উঠুক সবাইকে সাহায্য করুক, তাহলে হয়তো আমাদের  দেশটাই পরিবর্তন হয়ে যাবে।”
এই সুদৃঢ় প্রত্যয়েই জাহাজি এগিয়ে চলেছে।

লেখা,
মোছা. জেরিন ফেরদৌস জবা
শিক্ষার্থী,
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ,
ঈশ্বরদী সরকারি কলেজ।

stories