গল্প : তৈয়ব আখন্দের মা

একটি সুপ্রতিষ্ঠিত বীমা কোম্পানির জন্য দিন রাত গ্রাহকের সন্ধান করলেও তৈয়ব আখন্দকে সহসা বীমার দালাল বলে মনে হয় না। পরিপাটি ফতুয়ার ওপর মাফলার জড়িয়ে আয়নায় নিজের গোলাকার মুখখানি দেখে তৈয়ব আখন্দের মনে নতুন ভাবনার উদয় হয়। তৈয়ব আখন্দ আসলে আয়নায় কোনোদিন নিজের চেহারা দেখেনি। হয় চুল দেখেছে না হয় শেভ করা গাল। আজ সেসবের কিছুই দেখলো না। কেবলই অভ্যাসবশত আয়না দেখা।

ফোনটা বেজে উঠতেই সেটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে চল্লিশে পা দেওয়া তৈয়ব আখন্দ। মায়ের ফোন। যথারীতি ফোন রিসিভ করে তৈয়ব আখন্দ বলে ‘আম্মা।’ তৈয়ব আখন্দের চেহারার পরিবর্তন ও হুঁ হাঁ বলার ধরন দেখে আমরা জানতে পারি যে ওপাশ থেকে বৃদ্ধা বলছেন, ‘ও তৈয়ব, রওনা দিসস? বেলা থাকিতে আইয়া পড়। দেরি হইয়া গেলে মুসিবত।’ তৈয়ব আখন্দ ‘আইতাসি, সবুর কর।’ বলে ফোনটা রেখে আবার আয়নায় নিজের দিকে তাকাল। ভাবছে অতীতের কথা। অতীত যে কোনদিন অতীত হয়ে গেল, সেটাই ভাবার বিষয়। সময় জিনিসটাকে তার কাছে বাইম মাছের মতো মনে হয়। কোন দিক দিয়া যে পিছলাইয়া যায়। তৈয়ব আখন্দ মনে মনে ভাবতে গিয়ে টের পায় দেরি হয়ে যাচ্ছে। বাইম মাছটা তার জন্য অপেক্ষা করছে না। পিছলেই যাচ্ছে।

সকালে বেশ সময় নিয়ে সুটকেস গুছিয়েছে। গ্রামে গেলে এবার কিছুদিন থাকবে। শীত পড়তে শুরু করেছে। শীত মানেই তো গ্রাম। গ্রামের কুয়াশা। কুয়াশার ওইপারে চুলার দুয়ারে মা। ট্রেনে ওঠার পর আবার ফোন আসে মায়ের।

‘টেরেনে উঠসিস বাপ? টেরেন কি জোরে চলে? ও বাপ।’

‘হ মা। টেরেন জোরে চলে। তুমি টেনশন কইর না। সময় থাকতে আইয়া পড়ুম।’

তৈয়ব আখন্দ এবার তার কম দামি মোবাইল ফোনটার দিকে তাকায়। মোবাইল ফোনটার সঙ্গে সে তার নিজের চেহারা সাদৃশ্য খুঁজে পায়। দুজনই কম দামি। কিন্তু দুটোতেই আশ্চর্য এক কোমলতা। ভেতরে বাইরে। তৈয়ব আখন্দ নিজেও জানে সে শান্তশিষ্ট প্রকৃতির। অকস্মাৎ কিছুতে প্রতিক্রিয়া দেখায় না। তার ঠিক সামনের আসনে এক মুরুব্বি মতোন মানুষ। মানুষটার পাশের সিটে সম্ভবত তার ছোট ছেলে। ছেলে একটু পর পর চিপস খেতে চায়। মুরুব্বি নিজে খানিক পর পর জানালা দিয়ে পানের পিক ফেলে ছেলেকে বলেন, বাবা কালেমায়ে শাহাদাত শুনাইয়া দাও, তাইলে চিপস চকলেট দুইটাই পাইবা। ছেলে মুখস্থ করা কালেমা পড়ে, ‘আশ্হাদু আল-লা-ইলা-হা…।’ কালেমা শুনে তৈয়ব আখন্দের বাবার কথা মনে পড়ে। বাবা যখন মারা যায় তখন ছোট চাচা জোরে জোরে এই কালেমা পড়েছিল। তৈয়ব আখন্দের বয়স তখন নয় কি দশ। কবর দেওয়ার পর ঝুম বৃষ্টি। এখনও বাইরে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে। কাঁপুনি দেওয়া শীত আসার আগে এমন বৃষ্টি হয় নাকি।

‘ও বাপধন, কদ্দূর আইলি? টেরেন কি থাইমা রইসে?’

‘না আম্মা, টেরেন চলতেছে। টেরেন কি আর থাইমা থাকে। তুমি যে কী কও।’

ছেলেটা কালেমা পড়া শেষ করে তৈয়ব আখন্দের দিকে তাকিয়ে থাকে। চিপস চকলেটের আবদার করে না সহসা। ছেলেটার নজর তৈয়বের কম দামি মোবাইল ফোনটার দিকে যায়। তৈয়ব আখন্দ যেটাকে শক্ত মুঠোয় আগলে রেখেছে।

বৃষ্টির কারণে বাইরের সব ঝাপসা। তাই ভেতরেই নজর দিল তৈয়ব আখন্দ। আশপাশ দেখলো খানিকক্ষণ। ট্রেনের শব্দ ছাপিয়ে গুন গুন একটা আওয়াজ শুনতে পেল। শব্দটা বগির ভেতর থেকেই আসছে। সম্ভবত তিন চার সিট পেছনে। মহিলার কান্নার শব্দ। আহা, কী না কী হয়েছে! তৈয়ব আখন্দের জানতে ইচ্ছে হলো খুব। কিন্তু উঠে গেল না।

‘ও তৈয়ব, তুই আমার ঝাল বাদাম আনতিছিস তো?’

‘হ আম্মা। দুই প্যাকেট লইসি। সুটকেসে আছে।’

‘হুরার মাইয়াডা যে লাল স্যান্ডেলের কথা কইসে।’

‘হ হ মনে আছে। ওই সব আগেই কিনা রাখসিলাম।’

‘বাপ, তোর কথা এমুন লাগে কেন, তোর ঠাণ্ডা লাগসে?’

‘শীত পড়সে তো। এইবার কি রস হইসে গাছে?’

‘শাআলমরে কইসিলাম গাছ ছাইনা দিয়া গেছে। তোর লাগি রস রাখসি দুই কলস। আরো তিনখান গাছ বাকি।’

‘আইচ্ছা, অহন রাখি। আর ফোন দিও না। দুই তিন ঘণ্টা লাগবো আইতে।’

‘টেরেনের ডাইবাররে তারাতারি চালাইতে ক। দেরি হইয়া গেলে মুসিবত।’

সামনের সিটে বসা ছেলেটা কী নিয়ে যেন খুব হাসছে। তার বাবার কানে কানে কী যেন বলল। বাবা ধমক দিতেই ছেলেটা চুপ হয়ে গেল। তৈয়ব আখন্দ এর কোনো অর্থ বুঝলো না। ছেলেটা কি তার ফোনটা ধরতে চায়? তা না হলে অমন করে তাকিয়ে আছে কেন? তৈয়ব আখন্দ একবার ভাবলো জিজ্ঞেস করবে। পরে ভাবলো থাক, আর অল্প কিছুক্ষণের পথই তো।

‘বাপ, আমি আইতে কইসি দেইখা কি তোর মন খারাফ হইছে? সত্য কইরা ক। মার লগে মিছা কবি না। গুনাহ হইবো।’

তৈয়ব আখন্দ ধার্মিক। সে গুনাহর ভয় করে। তারপরও খানিকটা মিথ্যে বলে ‘রাগ করসি। অনেক রাগ করসি। তুমি জানো না আমার কত কাম। একটা কাস্টমার পাইলে কত টেকা। আর না পাইলে তো বইয়া থাকতে হয়।’

‘ও বাপধন আমারে মাপ কইরা দে। তোরে আর আইতে কমু না।’

‘হইসে হইসে। এহন কও কী রানসো। তোমার ওই রাতা মুরগা কিন্তুক এইবার আমি খাইয়া যামু।’

ছেলেটা আবার তার বাবার কানে কানে কী যেন বলল। তৈয়ব আখন্দের সেটা খুব জানার আগ্রহ হয়। সে ইশারায় জানতে চায়। ছেলেটা ইশারায় তৈয়ব আখন্দের হাতে থাকা কম দামি মোবাইল ফোনটার দিকে ইঙ্গিত করে। তা দেখে তৈয়ব আখন্দ আরো শক্ত করে মোবাইলটা আঁকড়ে ধরে।

ট্রেন থেকে নেমে কিছু দূর হাঁটা পথ। তারপর জমাদার মোড় থেকে ভ্যান নিতে হয়। ভ্যানঅলারা কমবেশি সবাই তৈয়ব আখন্দের চেনা। পথ চেনাতে হয় না। উঠে পড়লেই হলো। বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে। ভ্যানঅলাদেরও তাড়া বেড়ে গেছে। তৈয়ব আখন্দ একটায় উঠে বসতেই চলতে শুরু করলো। শীতের কণকণে বাতাস ঝাপটা দিচ্ছে মুখে।

‘হ মা, ভ্যানে উঠসি। যে শীত পড়সে।’

‘জলদি কর। দেরি হইয়া গেল। মুসিবত। দুপরে তো খাস নাই। তোর তো খিদা লাগসে। আমিও তো না খাইয়া বইয়া রইসি।’

ভ্যানওয়ালা পেছনে তাকায়। তার শীত লাগে না। সে আরো জোরে প্যাডেল চালাতে থাকে। ভ্যানটাকে তৈয়ব আখন্দের কাছে বাইম মাছ মনে হয়। রাস্তায় পিছলে যাচ্ছে।

বাড়ির উঠোনে ভ্যান থামে। তৈয়ব আখন্দের সুটকেস নিতে এগিয়ে আসে বাড়ির কেউ একজন। সময় খুব কম। মুরুব্বি মতোন একজন তৈয়বকে ইশারা করলো। প্রথমে বোঝে নাই। পরে একজন তৈয়ব আখন্দের কানে কানে বলল কথাটা। তৈয়ব আখন্দ উঠোনের মাঝে রাখা খাটিয়ার কাছে দাঁড়ালো। মুরুব্বি মতোন লোকটা এবার খানিকটা জোর দিয়া বলল, ‘বাবা খাটিয়া কান্ধে লইতে অইব। মাগরেবের ওয়াক্তের আগেই দাফন করন লাগবো। লাশ এতক্ষণ বাইরে রাইখতে নাই। জলদি জলদি দেইখা লও। আশহাদু আল-লা-ইলা-হা…।’ তৈয়ব আখন্দ আরো শক্ত করে মোবাইল ফোনটা আঁকড়ে ধরে।

লিখেছেন: ধ্রুব নীল

 

ধ্রুব নীলের সব বই পাবেন রকমারিতে। ক্লিক করুন এখানে

 

storiesগল্পধ্রুব নীলমা