প্রেম মানে না নিয়ম। তবু হরেক নিয়মের বেড়াজালে রেখে তবেই করতে হয় প্রেমচর্চা। প্রেমকে বাড়তে দিতে হয়। শেকড় গজানোর মতো সময় দিতে হয়। তা না হলে লাগামহীন ঘোড়া আবার কার না কার ক্ষেতের ধান খেয়ে ফেলে তার নেই ঠিক নেই। পরে দেখা যাবে সাধের প্রেমটাই আটকে গেলো খোয়াড়ে।
প্রেম নিয়ে কত মাতামাতি। কত বছরের কত শত প্রেমের বিয়ে। সবাই সাচ্চা প্রেমিক? তা তো নয়। অন্তত নিজের মনের কাছে তো ধরা খেতেই হয়। অনেক দাম্পত্যেও তাই দেখা যায় প্রেমজনিত ফাটল, সেই ফার্স্ট ইয়ারের উন্মাদনা খুঁজে পাওয়ার লোভে প্রেমের ঘোড়া ছোটে ইতিউতি। তবু রবীন্দ্রনাথ সুখ পান না।
প্রেম নিয়ে খুব বেশি কচকচানিতে যাব না। প্রেম তো আর কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মতো জটিল বিষয় নয় যে একে একেবারে কেটেকুটে দেখতে হবে। গোটাকতক বোঝাপড়াই যথেষ্ট। তাতে করে উচ্ছ্বাসের সমীকরণ বেশ সরল হয়ে আসে।
দাম্পত্য প্রেমে দূরত্ব আসে। আসবেই। অবধারিত যেন। বিয়ের পর কেউ আর প্রবল প্রেমিক পুরুষ বা দিশেহারা অভিমানী প্রেমিকা থাকে না। হয়ে যায় বাবা, মা, দায়িত্ববান, সংসারের হাল ধরার নাবিক। তো, এতে প্রেমের উথাল-পাথাল আচরণে আসবে পরিবর্তন। এটাই তো স্বাভাবিক। এই নিয়ম আপনি না মানুন, আপনার সঙ্গীকে তো মানতে দিতে হবে। সঙ্গী কি তবে ভুল? মোটেও না। সঙ্গীর ভেতরও হয়তো একই হতাশা। দিন শেষে দুজনই হতাশ। কোথায় গেল আমাদের প্রেম? কেউ আর আগের মতো কেন আরেকজনকে ঠিক ওইভাবে অনুভব করতে পারছি না? আহারে। কত প্রশ্ন দুটো বুকে। কিন্তু মুখ তো ফোটে না। প্রশ্ন প্রশ্নই থেকে যায়।
পরিস্থিতি যদি এমন হয় যে, সংসার শুরু হতে না হতেই আপনার প্রতি আপনার সঙ্গীর আগের সেই পাগলামো খেপামো সব দুম করে গায়েব, তবে কুছ তো গড়বড় হ্যায়। এক্ষেত্রে আপনি যদি ধরেই নিন যে, সঙ্গী আপনাকে কোনোদিনই ভালোবাসেনি, তবে সেটাও একতরফা দোষারোপ। হয়তো একটা রঙিন সময় ছিল। একটা স্ফূলিঙ্গের মতো। উবেও গেছে যা। হতেও তো পারে। তো সেই স্ফূলিঙ্গ যতক্ষণ ছিল, ততক্ষণ ছিল বসন্ত। তারপর হুট করে গায়েব। দাম্পত্য প্রেম তো আর ব্যবসায়িক লাভক্ষতির চুক্তি নয়। সবসময় মনে উপচেপড়া বসন্ত থাকবে, তা তো নয়ই।
পাশ্চাত্যের জীবনাচার দেখে আমরা নাক সিঁটকে বলতাম না, ওদের আবার সংসার হয় নাকি! মিনিটে মিনিটে ডিভোর্স। কী একটা পাপী শব্দ যেন!
কোনো এক সময় আপনার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেউ বৃষ্টিতে ভিজেছে বলে এখনও তা করবে, সেটা তো ঠিক নয়, তা এতদিনে বুঝে গেছেন। হয়তো আবার এমনটা করবেও, কেউ কেউ। প্রেমকে আপনি কেনই বা আইনের বই ভাবছেন? বলুন তো? প্রেম তো পাঠ্যসূচিতে ছিল না। তবে ওটার আকার, গড়ন, সংবিধান এতসব আসে কেন? প্রেমে একবার হাবুডুবু খেলে তাকে জলে ডুবে মরতেই হবে, এমন কথা তো থাকতেই পারে না। এ জন্য কালে কালে এসেছে গালভরা অনেক ইংরেজি শব্দ, মনোগামি, পলিয়ামোরাস।
বাঙালির সিনেমা আর উপন্যাস পড়া প্রেম নিয়ে এই হলো বিপদ। তা না হলে পাশ্চাত্যের জীবনাচার দেখে আমরা নাক সিঁটকে বলতাম না, ওদের আবার সংসার হয় নাকি! মিনিটে মিনিটে ডিভোর্স। কী একটা পাপী শব্দ যেন! অথচ, নিজের মনের সঙ্গে প্রতিটা সেকেন্ডে লড়াই করে, মেনে নিতে নিতে সেই বাঙালি নারী ও পুরুষটি তো প্রেমের গোড়াতেই গলদ সবক নিয়ে বসে আছেন, সে ভুল কে ধরিয়ে দেবে!
মোটাদাগের কথাটা হলো, আমরা সত্যরে সহজভাবে নেই না। কখনই না। সত্য মানেই যেন যত অসুন্দরের আস্তানা। আপনার সঙ্গীকে ভালো লাগছে না? সঙ্গী আর আগের মতো অন্তরঙ্গ হতে চাইছে না? হলেও সেটা মনমতো হচ্ছে না? কিংবা আপনার ফ্যান্টাসির দুনিয়ায় সঙ্গীর কোনও ভূমিকাই নেই? এসবই সত্য। কারও না কারওর জন্য। হয়তো আপনার সত্য অন্য এক সময় বুঝতে পারবে আপনার সঙ্গী। কিন্তু ততদিনে আবার হয়তো আপনার আর কিছুই ভালো লাগছে না। হতেই তো পারে। তো, যা হতেই পারে, সেটাকে মেনে নিয়ে এগিয়ে যাওয়াই জীবন। এই মেনে নেওয়া আবার মানে কিন্তু হজম করা নয়। আমরা বাঙালি নারী-পুরুষেরা যে কাজটি বেশ ভালোই পারি। পশ্চিমারা সেটা পারে না তা নয়, তারা চায় না বলেই হজম করে না। এজন্যই তাদের ছাড়াছাড়ি হয়, আবার দাম্পত্য প্রেম হয়, নতুনের মতো। আবার সেই প্রজাপতির ডানায় চড়ে বেড়ানো। আবার সেই স্ফূলিঙ্গ। আর আমরা কিনা বসে বসে সত্যরে শাকচাপা দিতে দিতে, একসময় হয়ে যাই নিজের মনের ঘোরতোর শত্রু।
কী করবেন তাহলে? সুতো কেটেছে সেই কবে। এখন আটপাকে বাঁধা জীবনটাকেই বা কোন দিকে নিয়ে যাবেন। কিছুই করতে হবে না। জীবনকেই জিজ্ঞেস করুন, জীবন মহাশয় আপনি কোন বাঁকে বাঁকে যেতে চান। তারপর জীবনকে ছেড়ে দিন লাগামছাড়া ঘোড়ার মতো। জীবন আপনাকে টেনে নিয়ে যাবে, স্বাবলম্বী হতে শেখাবে, জীবনকে উপভোগ করতে শেখাবে।
জীবনের ঘোড়াটাকে এমন স্বাধীনতা পাইয়ে দিতে সবার আগে চাই খোলামেলা মন। ভারতের কোন এক গ্রামে একবার এক স্বামী তার স্ত্রীর সঙ্গে তার প্রেমিকের বিয়ের আয়োজন করেছিলেন ঘটা করে। খুব নিউজ হয়েছিল ও নিয়ে। পাড়ায় নিশ্চয়ই ঢিঢি পড়তে বসেছিল। কিন্তু সেটা আর হয়নি। সব সুন্দরভাবেই হয়েছে। কোনও জীবনে নেমে আসেনি মেঘের বলয়। স্বামী বুঝতে পেরেছিলেন স্ত্রী তাকে আর ভালোবাসছে না। তার মন পড়ে আছে আরেকজনের মনে। স্ত্রীও সেটা অকপটে বুঝিয়ে বললেন। তো স্বামীর মন খারাপ হয়েছিল কিনা- হতেই পারে, তবু তো জোর করে মানুষকে আটকে রাখা যায় না। তাতে তো সুখ বাড়ে না। স্বামীও তাই ছেড়ে দিলেন জীবনের ঘোড়া। স্ত্রীর সঙ্গে তার প্রেমিকের বিয়ের আয়োজনটা করে মূলত বাকিদের একটা মেসেজ দেন তিনি। দেখো, জীবন এমনই হওয়ার কথা। মনই ঈশ্বর।
আর যদি মনে করেন, এসব বলা সহজ, করা ততটাই কঠিন। তবে বলবো, কাউন্সেলিং নিন। দুজন। একসঙ্গেই। সব খুলে বলুন। কে কী চান সেটাও। চাওয়ার মধ্যে দ্বন্দ্ব আসবে, দ্বন্দ্বের সমাধানও আসবে। মাঝে শুধু কলহ, বিষণ্নতা কিংবা বিধ্বংসী কোনো পথ আসবে না। মনের গভীরে চোখ বড় করে তাকান। তখন ঠিকই বুঝবেন জীবন সুন্দর, প্রেম সুন্দর। প্রেম হলো বর্ণালী। তাতে অনেক রঙ। কারও ইচ্ছে হলে একটা মাত্র রঙের প্রলেপ নিয়েই সারাজীবন রঙিন করে কাটিয়ে দিতে পারে। আবার কেউ চায় প্রজাপতির ডানায় চড়ে সেই রঙ বিলিয়ে দিতে। আপনি যেমন আপনার মতো, আরেকজন তার মতো করে শিখে নিয়েছে ভালোবাসতে। সুতরাং, কথা বলুন। সত্যটা বলুন সঙ্গীকে। এটা আপনার অধিকার। মিথ্যে বলে সাময়িক সুখি করার চেয়ে সত্যের দমকা হাওয়ায় অন্যকে শৃঙ্খলমুক্ত করাটাই শ্রেয় নয় কি?