দূর পরবাস জাপান: সময়ের ডায়েরি

গ্রন্থের ‘কিছু কথা’র ভূমিকায় লেখক নিজেকে বলেছেন হাতুড়ে লেখক। এই বক্তব্যের গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন কোথাও খুঁজে পেলাম না ২৩২ পৃষ্ঠার বইটিতে। তবে তথ্যের সংকট ও বিন্যাস চিন্তা করলে এ দায় লেখকের ঘাড়ে বর্তায় বই কী! তথাপি আলোচ্য ‘দূর পরবাস জাপান’ গ্রন্থের রচয়িতা কাজী ইনসানুল হক কথায় ও লেখায় দুটোতেই পারদর্শী।

জাপানে লেখক, সাংবাদিক, সম্পাদক ও সংগঠক কাজী ইনসানুল হক অতিপরিচিত একটি নাম। বহু আগে থেকেই তিনি লেখালেখির সঙ্গে জড়িত। জাপানে প্রবাসী হওয়ার আগে তাঁর লেখার সঙ্গে আমি পরিচিত। রংপুর-কুড়িগ্রামের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, অবিভক্ত বাংলা ও সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের দীর্ঘ ৩৫ বছরের জনপ্রতিনিধি ‘টাইগার অব বেঙ্গল’ খ্যাত কাজী ইমদাদুল হকের সন্তানই হচ্ছেন কাজী ইনসানুল হক। তিনি কখনোই পিতৃপরিচয় দেন না, ফলে আমরা অনেকেই সেই তথ্যটি জানি না। এটা তার দ্বিতীয় গ্রন্থ। প্রথম গ্রন্থ ‘মেড ইন জাপান’ ২০০৭ সালে ঢাকার জাগৃতি প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। মূলত ‘যায়যায়দিন’ কাগজে লিখিত কলামের সংকলন সেটি। বইটি বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, আমারও সৌভাগ্য হয়েছিল আলোচনা করার।

এবারের গ্রন্থটিও বিভিন্ন ম্যাগাজিন ও পত্রিকায় প্রকাশিত নাতিদীর্ঘ মোট ৫২টি লেখার সংকলন। লেখাগুলোকে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে। যেমন; প্রেস, জাপান, বিবিধ, প্রবাসী, সায়োনারা জাপান, ট্রাভেল, প্রবাসে বাংলাদেশ, যত দূরে যাও এবং অন্যান্য, রম্য। ৫২টি লেখার মধ্যে বেশ কয়েকটি কৌতূহলোদ্দীপক নিঃসন্দেহে। যেমন, গ্রন্থের প্রথম লেখা ‘সাক্ষাৎকার: ড. হেনরি কিসিঞ্জার’। প্রাক্তন মার্কিন পররাষ্ট্রসচিব ধুরন্ধর কূটনীতিবিদ ড. হেনরি এ. কিসিঞ্জারের সঙ্গে লেখকের দেখা এবং সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকার গ্রহণ। নিঃসন্দেহে বিরল ঘটনা। টোকিওর ফরেন করেসপনডেন্টস ক্লাবের সদস্য হওয়ার বরাতে ক্লাবে সাক্ষাৎ ঘটে কিসিঞ্জারের জাপান ভ্রমণের সময়। লেখক তাঁকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আমেরিকার ভূমিকা কি ছিল এবং স্বাধীন বাংলাদেশকে কেন ‘বটমলেস বাস্কেট’ বলে মন্তব্য করেছিলেন তিনি—এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলেন। নিজের মতো করেই জবাব কিসিঞ্জার প্রদান করেছেন। লেখক শেষে তাঁকে বাংলাদেশ সম্পর্কে মন্তব্য কী জিজ্ঞেস করলে কিসিঞ্জার যা বলেন তা প্রণিধানযোগ্য—‘ভৌগোলিক কারণে অনেক প্রতিকূলতা দেশটির উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করেছে। আমি জাপানে আসি প্রথম ১৯৫১ সালে, আজ ৫৬ বছর পর যে জাপানকে দেখছি তা কিন্তু সম্ভব হয়েছে সঠিক নেতৃত্বের জন্যই। বাংলাদেশসহ অনেক দেশেই এই নেতৃত্বের সংকট আছে। হ্যাঁ তবে সামান্য হলেও বাংলাদেশ এগোচ্ছে। প্রতিবেশী ভারত, চীন তো অনেকটাই এগিয়েছে। এখন সময় এশিয়ার। আমি আশাবাদী। বাংলাদেশের সাফল্য কামনা করি।’ তথাপি অসন্তুষ্ট চিত্তে লেখার শেষে লেখক বলেছেন, ‘অমর ২১, আমাদের স্বাধীনতা দিবস, মহান বিজয় দিবস এলেই ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করে। হেনরি কিসিঞ্জারের প্রতি জানাই ধিক্কার, ঘৃণা এবং ঘৃণা।’ এবং এটাই একজন সচেতন দেশপ্রিয় বাঙালির সত্যি কথা, শেষ কথা।

প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা জাপানে এসেছিলেন। ফরেন প্রেসক্লাবে তাঁর ভাষণ শোনার সৌভাগ্য হয় গ্রন্থাকারের। এটাও পরম সৌভাগ্য না বলে উপায় নেই। যা সম্ভব হয়েছে ক্লাবের সদস্য হওয়ার কারণে। ‘ওবামা’র টোকিও ভাষণ’ একটি চমৎকার নাতিদীর্ঘ প্রতিবেদন যাতে বেশ কিছু অজানা তথ্য বর্তমান। পাঠকের ভালো লাগবে।
তৃতীয় লেখাটি তাৎপর্যপূর্ণ কিন্তু অসম্পূর্ণ ঠেকেছে। ‘রাষ্ট্রীয় আমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফর: প্রত্যাশার হিসাব-নিকাশ’ শিরোনামে লেখাটিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান সফরের (২০১৪) প্রাক্কালে লিখিত। জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের ভাববিনিময় সম্পর্ক শতবর্ষী পুরোনো। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে জাপান স্বাধীনতার পর থেকেই চাইছে বাংলাদেশ শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হোক এবং জাপানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করুক। বলা বাহুল্য, আওয়ামী লীগের কাছেই জাপানের এই প্রত্যাশা সবচেয়ে বেশি ঐতিহাসিক কারণে। শতবর্ষ পূর্ব থেকে বাংলার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ধারা যা জাপান পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছে স্বামী বিবেকানন্দ, বিপ্লবী রাসবিহারী বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কর্মতৎপরতার গুণে। জাপান আজও এই সম্পর্ককে গুরুত্বের চোখে দেখে কিন্তু আওয়ামী নেতৃবৃন্দ কখনোই তাকে গুরুত্ব দেয়নি। জাপানে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আজও সাধারণ মানুষের কাছে সুখকর নয়।
সাম্প্রতিক ভয়ংকর ৎসুনামি (সুনামি নয়) নিয়ে লেখকের তিনটি যথাক্রমে, ‘সুনামির পাঁচ বছর-এক’, ‘সুনামি উপদ্রুত উপকূলের নিঃসঙ্গ সারথি’ এবং ‘গামবারে নিপ্পন-অকৃতজ্ঞ নয় জাপানপ্রবাসীরা’ লেখা মর্মস্পর্শী। বাংলাদেশে বিশিষ্ট জাপানি নাগরিক ‘কুনিও হোশি’র নির্মম হত্যাকাণ্ড কাঁপিয়ে দিয়েছিল দুই দেশের সম্পর্ককে! ‘হোশি’র হত্যাকাণ্ডে জাপানপ্রবাসী আমরা বিব্রত’ নামক লেখাটি খুবই হৃদয়স্পর্শী। ‘টোকিওর বাংলাদেশ দূতাবাসে পরিচয়হীন এক দাতার দান’ শীর্ষক লেখাটি জানান দেয় যেসকল জাপানি নাগরিক বাংলাদেশকে জানেন ও বোঝেন তাঁদের পরম ভালোবাসার ঘটনা অতীতেও ঘটেছে। জাপানের সরকারি সাহায্য ছাড়াই অনেক জাপানি নাগরিক বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগে আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু এবারের বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। গুলশান ট্র্যাজেডির ঘটনায় নিদারুণ মর্মাহত জনৈক জাপানি নাগরিক জঙ্গি দমনের জন্য একটি খামে মোটা অঙ্কের টাকার সাহায্য প্রদান আমাদের মনকে ভারাক্রান্ত করে, দারুণ দুশ্চিন্তার বার্তা দিয়ে যায়।
‘নাগাসাকির শান্তি পার্কে বাংলাদেশের শান্তির ভাস্কর্য’ লেখাটি পড়ে উজ্জীবিত হয়েছিলাম কিন্তু বহুদূর পর্যন্ত এগিয়ে এসে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি এখনো। খুবই দুঃখজনক। স্বপ্ন পূরণ হয়নি একসময় নাগাসাকিতে বসবাসকারী ডা. আরিফা নাজনীনেরও। যেমন আশা পূরণ হয়নি জাপানপ্রবাসীদের, ‘বিমানের ঢাকা-টোকিও ফ্লাইট’ সরকার নানা নাটকই করে গেল শুধু!
‘জাপানের বিমানবন্দরে বাংলায় ‘স্বাগতম’ দেখতে চাই’ লেখাটি পড়ে আমারও একাধিকবার মনে হয়েছে এমনটি হলে কত আনন্দই না হতো! প্রবাসীরা চেষ্টা করলে হবে না কেন? ‘স্থানীয় নির্বাচন: জাপান-বাংলাদেশ’ শীর্ষক লেখায় লেখক কাজী ইনসান দুটি দেশের তুলনা করেছেন নির্বাচনভিত্তিক নিয়ম-শৃঙ্খলা-শিষ্টাচার নিয়ে। বাংলাদেশের সরকার ও নেতারা সচেষ্ট হলে এমন শৃঙ্খলা গড়ে তোলা কঠিন কিছু নয়। ‘বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী ও একজন ব্যান্ড তারকার বাংলা প্রীতি’ লেখাটি উৎসাহব্যঞ্জক। কিন্তু বইটির জাপানি ভাষায় অনুবাদ নিয়ে বাংলাদেশ দূতাবাস এবং জাপানি প্রকাশকের মধ্যে অর্থবিষয়ক কেলেঙ্কারির কথা শোনা যাচ্ছে। ঘটনা সত্যি হলে লজ্জাজনক। তা ছাড়া গ্রন্থটির মূল্য অত্যধিক চড়া। ৭০০০ ইয়েন নিশ্চয়ই সাধারণ জাপানিদের জন্য ব্যয়সাধ্য নয়! তাহলে বঙ্গবন্ধুর জীবনী জাপানিদের মধ্যে ছড়াবে কীভাবে?
‘কেমন আছ সবুজ পাতা’ লেখাটিতে উল্লিখিত মুহম্মদ জাফর ইকবাল রচিত গ্রন্থটির নাম ‘মেয়েটির নাম নারীনা’, কিন্তু এক জায়গায় মুদ্রিত আছে ‘মেয়েটির নাম নারিতা’, তবে লেখাটি মর্মস্পর্শী।
‘ঘরের পাশে যেন জয়নুল!’ লেখাটি হৃদয়কে আন্দোলিত করে। ইতাবাশি-ওয়ার্ডের তোকুমারুগাওকা কোওয়েন উদ্যানে রক্ষিত ‘মিনোরি নো দোওজোও’ অর্থাৎ শস্য গোলাজাত বিষয়ক পথ ভাস্কর্যটি প্রমাণ করে একদা এখানে কৃষিভিত্তিক মানুষের বসবাস ছিল। ভাস্কর্যটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের স্বনামধন্য শিল্পী জয়নুল আবেদীনকে স্মরণ করিয়ে দেয়। উল্লেখ্য, ষাটের দশকে জাপানে তাঁর শিল্পকর্মের একটি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
‘জাপানের এক পাখিওয়ালা’ প্রতিবেদনটি এই গ্রন্থের সবচে উজ্জ্বল ও কৌতূহল জাগানিয়া। জাপানপ্রবাসী অতি পরিচিত মুখ গোলাম মাসুম জিকো একজন তরুণ কবি, লেখক, সাংবাদিক, আলোকচিত্রী ও ব্যবসায়ী। তার মেয়ে ‘রাহিমা’ যখন শৈশবে কঠিন অসুখে পড়ে বাঁচার সম্ভাবনা ঢাকায় ও সিঙ্গাপুরের চিকিৎসায় প্রায় শূন্যে পৌঁছায় এবং শেষমেশ জাপানের চিকিৎসায় মেয়েটি সুস্থ হয়। সেই রাহিমার জন্মদিনে একটি পাখি কিনে দেওয়ার চিন্তাকে কেন্দ্র করে লিখিত প্রতিবেদনটি। পাখিটি বিক্রি করার পরও পাখিওয়ালার আন্তরিক টান হৃদয় খামচে ধরে আমাদের!
‘ঢাকা টু নাগোয়া: হুইল চেয়ারের চাকায় বিশ্বমানবতা’ শীর্ষক লেখাটি বিমুগ্ধকর ও আশাব্যঞ্জক। শারীরিক প্রতিবন্ধীদের বহির্বিশ্বের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ যতই বৃদ্ধি পাবে ততই মঙ্গলজনক। প্রতিবন্ধী সম্মেলনের আয়োজক জাপানের মানবিকতাকে স্বাগত জানাতেই হয়।
‘তোমরা এবং আমি, একই দেশের আমরা বাংলাদেশের’ লেখাটিতে ফরাসি তরুণী চিত্রশিল্পী জাসনাবোর্দাদের খবর তুলে ধরে একটি মহৎ কাজ করেছেন লেখক। জাসনার মা বাংলাদেশের এবং বাবা ফ্রান্সের। সুদূর জাপানে এসে তার এই চিত্র প্রদর্শনী কৌতূহলোদ্দীপক।
‘জাপানপ্রবাসী বাংলাদেশি এক শৌখিন মুদ্রা সংগ্রাহক’ নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর সংবাদ! হক মোহাম্মদ ইমদাদুল বহির্বিশ্বের বহু দেশের বিপুল মুদ্রা সংগ্রহ করে একটি জাদুঘর গড়ে তুলেছেন তার বাসায় এক বিরল ঘটনাই বটে।
‘টোকিওর প্রাণকেন্দ্র বাংলার পণ্য’ নাকি হবে ‘টোকিওর প্রাণকেন্দ্রে বাংলার পণ্য’? সে যা হোক, বাংলাদেশে তৈরি পণ্যসামগ্রীর প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন বহু বছর ধরে প্রবাসী এবং একদা লেখক ও সম্পাদক (মাসিক বাংলার মুখ) মুকুল মুস্তাফিজ। মুকুলের আরেকটি পরিচয় তিনি বিশিষ্ট কবি মোহন রায়হানের অনুজ। ব্যবসার পাশাপাশি এখানে দারুণ আড্ডাও হয়। ‘বাংলার পণ্য’ প্রতিষ্ঠানের প্রসঙ্গে আরেকটি প্রতিষ্ঠানের স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছে, মাচিয়া শহরের ‘দেশ’—অসাধারণ একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলেছিল প্রবাসী কবি ও সাংস্কৃতিককর্মী মোতালেব শাহ আইউব প্রিন্স। আমার যেমন, তেমনি এই গ্রন্থকারেরও বহু স্মৃতি আছে ‘দেশ’-এর সঙ্গে। কিন্তু বেশি দিন চলল না।
আরও যেসব লেখা গ্রন্থটিতে অন্তর্ভুক্ত সেগুলো হচ্ছে: ‘জাপানে বাংলাদেশের সবজি চাষ’, ‘আসির আহমেদের ‘জাপানকাহিনী”, ‘তন্ময়ের ঘরে ফেরা’, ‘প্রিয় বন্ধু বদরুলের সায়োনারা জাপান’, ‘বন্ধু কমলের জন্য হৃৎকাব্য’, ‘আসিগাকা ও তোচিগি কেন’, ‘বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মডেল রোলা: পাল্টে দিচ্ছে জাপানের পপ সংস্কৃতিকে’, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সাহায্যকারী জাপানি বন্ধুদের সম্মাননা ও সাহিত্য সভা’, ‘টোকিওতে সানন্দ বৈশাখী মেলা’, ‘উত্তরণের ২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্‌যাপন’, ‘স্বরলিপির ২২তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী: জমজমাট আনন্দঘন কনসার্ট’, ‘টোকিওতে নান্দনিক দুই প্রজন্মের মিলনমেলা’, জাপানের এপিএফএসের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্‌যাপন’, ‘৮ম কাহাল আর্ট ফেয়ার ২০১৬ জাপান-বাংলাদেশ যৌথ চিত্র প্রদর্শনী’, ‘শেখ আহমেদ জালালের স্বাধীনতা তথ্য সংগ্রহশালা’, ‘প্রয়াত ফখরুজ্জামান চৌধুরী যত দূরে যাও তুমি রবে আমাদের হৃদয়ে’, ‘বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি-প্রেমী অধ্যাপক কাযুও আজুমার মহাপ্রয়াণ: আমরা শোকাহত, লজ্জিতও…’, ‘দীপনের হত্যাকাণ্ড: আমরা হতবাক: শোকাহত’, ‘যেন পিতার সান্নিধ্যে’, ‘যত দূরে যাও: প্রয়াত বারী সিদ্দিকী স্মরণে’, ‘জাপানিদের ভিনদেশি জীবনসঙ্গী’, ‘স্বদেশে প্রবাসী’, ‘নিষ্ঠুর স্বদেশ জার্নি: প্রবাসের আত্মীয়রা’, ডক্টর কালী প্রদীপের স্বপ্নের ‘আইকনিক টাওয়ার’ আকাশচুম্বী উচ্চতায় বাংলাদেশ’ এবং ‘বাঁশ কথা’ (রম্য)।
এই ২৫টি লেখার মধ্যে কয়েকটি লেখা এতই গৌণ যে এগুলোর প্রয়োজন ছিল না। তবে কয়েকটি লেখা খুবই গুরুত্ববহ যেমন, ‘শেখ আহমেদ জালালের স্বাধীনতা তথ্য সংগ্রহশালা’, ‘প্রয়াত ফখরুজ্জামান চৌধুরী যত দূরে যাও তুমি রবে আমাদের হৃদয়ে’ এবং ‘বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি-প্রেমী অধ্যাপক কাযুও আজুমার মহাপ্রয়াণ: আমরা শোকাহত, লজ্জিতও…।’ কিছু লেখায় তথ্যের সংকট, ভুল তথ্য বা তথ্যের ভ্রান্ত বিদ্যমান। যেমন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সাহায্যকারী জাপানি বন্ধুদের সম্মাননা ও সাহিত্য সভা’য় জাপানের বিশিষ্ট সাংবাদিক, লেখক, গবেষক এবং রাজনৈতিক শিক্ষক তানাকা মাসাআকির প্রসঙ্গ আসতে পারত। তিনি হায়াকাওয়া তাকাশির সহযোগী ছিলেন, ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুকে আমন্ত্রণ জানাতে হায়াকাওয়ার নেতৃত্বে যে দুজন বিশিষ্ট জাপানি ঢাকায় যান তাঁরা হলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফুজিওয়ারা ইওয়াইচি এবং তানাকা মাসাআকি। নাম আসতে পারত অধ্যাপক ড. পেমা গিয়ালপো, সানকেইশিম্বুন পত্রিকার খ্যাতিমান সাংবাদিক তানাকা তাকেহিসাসহ আরও কারও কারও। তাঁরা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় জাপানে জনমত গঠনে অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন। ফখরুজ্জামান চৌধুরী বিষয়ক লেখাটি আরও তথ্যবহুল করা যেত। জাপান শীর্ষ রবীন্দ্রগবেষক প্রয়াত কাজুও আজুমার কর্মকাণ্ড এককথায় বিপুল ও বিশাল। তিনি দীনবন্ধু মিত্রের নাটক ‘নীল দর্পণ’ অনুবাদ করেছেন বলে জানা নেই! ‘ইন্দ্রধনু’ তাঁর একক অনুবাদ নয়। বিশ্বভারতীর অধ্যাপক ও রবীন্দ্রগবেষক অমিত্রসূদন ভট্টাচার্যের সঙ্গে যৌথভাবে নোবেল বিজয়ী জাপানি ঔপন্যাসিক কাওয়াবাতা ইয়াসুনারির বিখ্যাত উপন্যাস নিজি বাংলায় অনুবাদ করেন ইন্দ্রধনু নামে যা কলকাতার দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় ষাট দশকের দিকে।
‘দূর পরবাস জাপান’ গ্রন্থটি নিঃসন্দেহে আনন্দদায়ক কিন্তু তৃপ্তিদায়ক নয়। বইটি প্রকাশ উপলক্ষে নাতিদীর্ঘ লেখাগুলোকে সংশোধন, সংযোজন ও পরিমার্জন করে রচনা করলে অসামান্য গুরুত্বপূর্ণ একটি গ্রন্থ হতো বলে আমার বিশ্বাস। লেখক জানি না কেন সেদিকটি বিবেচনা করলেন না! প্রচ্ছদ, ছাপা ও বাঁধাই ভালো, তবে আগাগেড়া বইটিতে চরম অবহেলা জড়িয়ে রয়েছে, বানান ভুলের আধিক্য, দীর্ঘ শিরোনামগুলো সামঞ্জস্যহীন এবং আলোকচিত্রগুলোর অস্পষ্টতা গভীর পীড়াদায়ক।

প্রবীর বিকাশ সরকার: জাপানপ্রবাসী লেখক-গবেষক।