সায়েন্স ফিকশন গল্প : এখন কিংবা…

ধ্রুব নীলের সায়েন্স ফিকশন গল্প

ধ্রুব নীলের সায়েন্স ফিকশন গল্প : তৈয়ব আখন্দ ভুলোমনা। নিজেও জানেন বিষয়টা। অফিসের অর্ধেকটা পথ এসে তার মনে পড়লো তিনি মহাগুরুত্বপূর্ণ একটা ফাইল মেসে ফেলে এসেছেন।

রোজ হেঁটে অফিসে যান। কারণ তার ডায়াবেটিস। রোগটার সঙ্গে ভুলে যাওয়ার একটা সম্পর্ক আছে। প্রায়ই ডায়াবেটিসের কথা বলে পার পেয়ে যান। আজ সেই উপায় নেই। ফাইল না নিয়ে গেলে চাকরি থাকবে না। চাকরি গেলেও ফাইলটা অফিসে পৌঁছে দিতে হবে।
তৈয়ব ভাবছেন অফিসে গিয়ে আবার বাসায় চলে আসবেন, নাকি চট করে রিকশা নিয়ে ফিরে যাবেন। ভাবতে ভাবতে রমনা পার্কের পাশের ফুটপাতে দাঁড়ালেন। পানওয়ালার কাছ থেকে পান নিয়ে চিবুতে শুরু করলেন।
‘কী মশাই গাছের পাতায় এনার্জি আছে? বেশ বেশ।’
আগন্তুককে দেখে পাগল কিসিমের মনে হলো না। চেহারাটা অদ্ভুত। একবার এক রকম লাগছে। কখনও চওড়া চিবুক, কখনও গোলগাল তেলতেলে, আবার কখনও পুরনো আমলের মাস্তানদের মতো লম্বা চুল-জুলপি। ডায়াবেটিসে চোখও নষ্ট হয় জানেন, কিন্তু একবার একেক চেহারা দেখার কথা নয়।
‘মশাই, মনে হচ্ছে খুব টেনশনে আছেন।’
এখন সাধারণত কেউ মশাই সম্বোধন করে না। তবে লোকটার মুখে শুনতে খারাপ লাগছে না। পানের পিক ফেলে তৈয়ব আখন্দ কথা জুড়ে দিলেন অপরিচিত মধ্যবয়সী লোকটার সঙ্গে।
‘টেনশনে আছি ভাই। ফাইল ফেলে এসেছি। মহা গেঞ্জাম বাঁধবে অফিসে।’
‘ওহ। আমি কিন্তু মানুষের উপকার করে বেড়াই। কারণ মানুষের সঙ্গে খাতির জমাতে না পারলে আমরা এখানে কলোনি করতে পারবো না।’
‘কীসের কলোনি? ওয়াপদা কলোনি থেকে আসছেন?’
‘জি না। আমি এসেছি বিগিলানা গ্যালাক্সির সারিনা কলোনি থেকে।’
‘ওহ। পান খাইবেন? কাঁচা সুপারি দিয়া?’
‘জি খাওয়া যায়।’

ধ্রুব নীলের সায়েন্স ফিকশন গল্প : পোর্ট্রেট

‘তৈয়ব সাহেব আপনার সমস্যার সমাধান করে দিচ্ছি।’
‘কী সমস্যা?’
‘ওই যে ফাইল ফেলে এসেছেন।’
‘কোন ফাইল?’
লোকটা চিন্তায় পড়ে গেলো। কিছু বললো না। চোখ বুঁজে কী যেন বিড়বিড় করলো।
‘ওহ আচ্ছা। অফিসের ফাইল। ফাইলটা যে কই রেখেছি মনে নাই। ড্রয়ারে থাকার কথা।’
‘আপনার বাসার ঠিকানা দিন। আমি টাইম মেশিনে করে ঘণ্টাখানেক অতীতে গিয়ে আপনার ফাইল গোপনে আপনার ব্যাগে ঢুকিয়ে দিয়ে আসবো।’
‘সত্যি পারবেন? বাসার ঠিকানা নিয়া লাভ নাই অবশ্য। আমি একা মানুষ। বিয়ে করি নাই। ঘরে নেওয়ার মতো কিছু পাইবেন না। আপনার কি মোটরসাইকেল আছে? ফাইল এনে দিতে পারবেন? খুব উপকার হয়। নেন আরেকটা পান নেন। এবার এটা চাবাইয়া খান। আমার মুখে দেখেন। পান এভাবে চাবাইতে হয়।’
লোকটা আরেকটা পান নিয়ে যত্ন করে পকেটে রাখলো। তারপর পকেট থেকে একটা টর্চের মতো যন্ত্র বের করে সুইচ টেপাটেপি করলো। একটু পর দুম করে একরাশ আলো ঢেকে দিলো সব।
চা-পানের দোকান দেখে দাঁড়ালেন তৈয়ব। হেঁটে অফিসে যান বলে হাতে সময় নিয়ে বের হন। তাই আয়েশ করে একটা পান খাওয়াই যায়। পানের দোকানে বসে থাকা লোকটাকে দেখে তার মনে হলো তিনি তাকে আগেও দেখেছেন। অবিকল তার ছোটবেলার বন্ধু কাশেমের মতো। তবে কাশেম নয় নিশ্চিত। সে থাকে কানাডায়।
‘আপনার ফাইল ব্যাগে আছে।’
‘কীসের ফাইল?’ লোকটার কথায় পাগল মনে হলো না। তবে ভয়ও লাগলো না।
‘যেটা আপনি ভুল করে ফেলে এসেছিলেন।’
তৈয়ব জলদি ব্যাগের চেইন খুলে চেক করলেন। না, ফাইল ভুল করে ফেলে আসেননি। এ ফাইল ফেলে আসলে তার চাকরিই থাকার কথা না। লোকটা এমন ফাজলামো করলো কেন? ফাইলের কথাই বা জানলো কী করে?
‘আপনার কিছু মনে নেই?’
‘কী মনে নেই? আমার আবার ডায়াবেটিস, মনে থাকে কম। তবে ফাইল ফেলে আসবো এত বোকা না। চাকরির মায়া পাগলেরও আছে।’
‘ও। কিন্তু আমি যে অতীতে গিয়ে আপনার ফাইলটা ব্যাগে ঢুকিয়ে দিলাম।’
‘ফালতু কথা বলেন কেন। ফাইল ব্যাগেই ছিল। আর আমার কাছে ভাই টাকা-টুকা নাই। অন্য কোথাও ম্যাজিক দেখেন। ওমা! আপনার চেহারা দেখি এখন আবার আমার বড় খালুর মতো। আপনি থাকেন কই ভাই?
‘জি আমি বিগিলানা গ্যালাক্সির সারিনা কলোনি থেকে এসেছি। আমি হলাম এলিয়েন। ভিনগ্রহের অত্যন্ত বুদ্ধিমান প্রাণী। মানুষের সঙ্গে খাতির জমানোর চেষ্টা করছি।’
‘আপনি এলিয়েন মানুষ, তা বাংলাদেশে করেন কি। আপনি থাকবেন আমেরিকায়। পান খান? হায় হায়, মানিব্যাগ আনতে ভুলে গেছি। কী মুশকিল। এখন পানের দাম দিমু কেমনে।’
কথাটা শুনে লোকটাকে বেশ উৎফুল্ল মনে হলো।
‘আমার কাছে টাইম মেশিন আছে। অতীতে গিয়ে আপনার মানিব্যাগটা গোপনে আপনার টেবিলের ওপর রেখে আসতে পারি। বের হওয়ার সময় চোখে পড়বে। বাসার ঠিকানাটা দিন।’
তৈয়ব সাহেব আবার নির্বিকার চিত্তে তার মেসের ঠিকানা দিলেন। আবার সেই আলোর ঝলকানি।
পানের দোকান দেখে আবার এসে দাঁড়ালেন তৈয়ব আখন্দ। যথারীতি বেঞ্চে বসা লোকটাকে দেখে তার বাবার কথা মনে পড়ে গেলো। অবিকল তরুণ বয়সের আজগর আখন্দ বসে আছেন যেন।

ধ্রুব নীলের সায়েন্স ফিকশন গল্প  | একটি লম্বা সকাল

‘মানিব্যাগ পেয়েছেন?’
‘মানিব্যাগ কেউ ফেলে আসে নাকি!’ থমকে গেলেন তৈয়ব। তার মন বলছে তিনি মানিব্যাগ নিয়ে এলেও বড় কিছু একটা ভুলে গেছেন। কী ভুলে গেছেন সেটা মনে পড়ছে না। অস্বস্তিকর একটা ব্যাপার। মনে না আসা পর্যন্ত ভেতরটা খচখচ করতে থাকবে। তড়িঘড়ি ব্যাগ চেক করলেন, অফিসের গুরুত্বপূর্ণ ফাইলটা আছে। তাহলে কী নেই?
‘আমার মনে হয় আপনি টিফিন ক্যারিয়ার ফেলে এসেছেন। আগেরবার হাতে দেখেছিলাম।’
তারপর? আবার সব ঘটলো আগের মতো।
তৈয়ব আখন্দ এবার টিফিন ক্যারিয়ার সমেত দাঁড়ালেন পানওয়ালার সামনে। এবার বেঞ্চে বসে আছে এক তরুণী। তৈয়ব আখন্দ চোখ ফিরিয়ে নিতে গিয়েও পারলেন না। মুখ ফসকে বেরিয়ে গেলো, এ কী মিনু নাকি! পঁচিশ বছর আগে যে মেয়ের সঙ্গে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল, সে বসে আছে পানওয়ালার বেঞ্চে। তৈয়ব আখন্দের দিকে তাকিয়ে হাসছেও।
‘তৈয়ব সাহেব পান খাবো। পান দিন। কাঁচা সুপারি দেওয়া। আপনার মানিব্যাগ, ফাইল, টিফিন ক্যারিয়ার সব গুছিয়ে দিয়েছি।’
‘মিনু তুমি পান খাও?’
‘খাই। তবে গন্ধটা সহ্য হয় না।’
‘তুমি কোথায় থাকো?’
‘ওয়াপদা কলোনিতে।’
‘ওহ।’
‘এবার কিছু ভুলে যাননি তো?’
‘মনে হয়। জানি না। ডায়াবেটিস তো।’
এটা বলেই তৈয়ব হারিয়ে গেলেন সুদূর অতীতে। অনেক আগে একটা ভুল করেছিলেন। ডায়াবেটিস যত বেশিই হোক, ওই ঘটনা তার মনে আছে। মিনু তার সঙ্গে কলেজে পড়তো। কী গভীর প্রেম ছিল দুজনের। রাত জেগে চিঠিপত্র লিখতেন। ওই সময় মোবাইল টোবাইল ছিল না। কিন্তু তৈয়ব আখন্দ সাহসের পরীক্ষায় পাস করতে পারেননি। মিনু একদিন কেঁদে কেঁদে তাকে বলেছিল, বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছে। বলেছে বিয়ে না করলে গলা টিপে মারবে, তারপর তোমার নামে মামলা দেবে। মামলার কথা শুনে ঘাবড়ে যান তৈয়ব।
টগবগে তরুণ তৈয়ব যদি ওইদিন হাসিমুখে মিনুকে বলতো, চলো, পালিয়ে বিয়ে করি, তাহলে আজ আর তিনি চিরকুমার হয়ে অফিসে বসে তপস্যা করতে হতো না।
‘তৈয়ব সাহেব, আমার কাছে টাইম মেশিন আছে।’
‘বাহ ভালো তো। চায়না আজকাল সবই বানায় দেখি।’
আচমকা আবার সেই দুম করে আলোর ঝলকানি।
পঁচিশ বছর আগের এক সন্ধ্যা। তুমুল বৃষ্টি। কাকভেজা হয়ে মিনু এসেছে তৈয়ব আখন্দের বাসায়। তৈয়বের বোন সালমা তাড়াতাড়ি নিজের জামাকাপড় বের করে দিলো। তৈয়বদের বাসাভর্তি মেহমান। মিনু আসায় উৎসব উৎসব আমেজ লেগে গেছে। বড় খালা পান না পেয়ে চেঁচিয়ে বাসা মাথায় তুলছেন। একটু পর ভিসিআর-এ অমিতাভ বচ্চনের সিনেমা দেখার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন তৈয়বের বাবাকে।

অতিপ্রাকৃতিক সায়েন্স ফিকশন গল্প : পরীবিবির দোলনা

মিনুর কথা তৈয়বের বাসার মোটামুটি সবাই জানতো। মেয়েটার কাঁদো কাঁদো চেহারা হয়ে তৈয়বের মা হয়ে গেলেন মাদার তেরেসা। তিনি কোমল স্বরে বড় খালাকে শান্ত হতে বলছেন।
তৈয়ব তার বড় খালুর সঙ্গে কোনওমতে মিনুর পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে।
‘ও হলো আমার বন্ধু। মানে ক্লাসমেট। মানে বিপদে পড়ে এসেছে। ওর বাবা ওকে মেরে ফেলার জন্য খুঁজছে।’
‘না খালু। আমি এসেছি তৈয়বকে নিয়ে কাজী অফিসে যাবো। আমরা বিয়ে করবো। আজই।’
এটা শুনে হই হই করে এলেন তৈয়বের মা।
‘কাজী অফিসে কেন! আমার ভাই বেলালকে বললে ও পাঁচটা কাজী ডেকে আনবে। ওর আবার এলাকার ব্যাপক পাওয়ার। ওকে খবর পাঠাই। তোমার বাবা-মা কই।’
‘বাসায় বলে এসেছি আমি তালগাছের তলায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবো। বজ্রপাত হলে মারা যাব।’
তৈয়বের মা আরও বিগলিত হয়ে বললেন, ‘তোমার দেখি অনেক বুদ্ধি। আমার আর চিন্তা নেই। ছেলেটা আবার একটু ভুলোমনা হয়েছে।’
তৈয়ব আর মিনুর বিয়ে হয়েছে ঝুম বৃষ্টির মাঝে। দীর্ঘ সংসারে তাদের ঘরে দুই কন্যাসন্তানও এসেছে। ওরা এখন মেডিক্যালে আর বুয়েটে পড়ে। মিনু পানের গন্ধ সহ্য করতে পারে না বলে অভ্যাসটা ধরেও আবার ছাড়তে হয়েছিল তৈয়বকে। তবে রাস্তাঘাটের কনডেন্সড মিল্কের চা তার বড়ই পছন্দ।
অনেক দিন পর একদিন বিকালে জিগাতলার রাস্তার পাশের চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়ান তৈয়ব আখন্দ। দোকানের টুলে ছেঁড়াফাটা জোব্বা পরা একজনকে দেখে মনে হলো আগেও দেখেছেন তাকে। লোকটার ইশারা তাই এড়ানো গেলো না।
‘কী মশাই এবার কিছু ভুলে যাননি তো।’
‘কী ভুলবো?’
‘মনে করে দেখেন তো। মানিব্যাগ, টিফিন ক্যারিয়ার, বউ..।’
তৈয়ব বসলেন আয়েশ করে। চায়ের অর্ডার করলেন। লোকটার জন্যেও এক কাপ দিতে বললেন।
‘নেন চা খান।’
তৈয়ব নিজের কাপে চুমুক দিয়ে হারিয়ে গেলেন অতীতে। মিনু যখন তাকে বলেছিল তার বাবা বিয়ে মেনে নেবে না তখন এক ষণ্ডামার্কা লোক এসেছিল তৈয়ব আখন্দের সঙ্গে দেখা করতে। একটা বুদ্ধি বাতলে দিয়েছিল লোকটা। তৈয়বের তখন বয়স কম। যা বলেছিল তাতেই রাজি হয়ে গিয়েছিল।

ধ্রুব নীলের সায়েন্স ফিকশন গল্প : ত্রুটি

ওই দিনই বৃষ্টির মধ্যে মিনুদের বাড়ি গিয়েছিল লোকটা। মিনুর বাবাকে গিয়ে বলেছিল, আপনার মেয়েকে আমার পছন্দ হয়েছে। একে আমি বিয়ে করবোই। না হলে বিরাট গণ্ডগোল হবে। আমি কাজী আনতে গেলাম।
এরপরই বাসা থেকে পালায় মিনু। তৈয়বের সঙ্গে তার বিয়ের খবর পেয়ে অনেকটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে তার মা-বাবা।
চায়ে চুমুক দিতে থাকা লোকটাকে অবিকল সেই ষণ্ডাটার মতোই লাগছে। তবে চোখের ভুলও হতে পারে। একই চেহারার কত লোকই তো থাকে।
‘আজ আবার কিছু ভুলে যাননি তো?’
‘কী ভুলে যাব?’
তৈয়ব আখন্দ মানিব্যাগ বের করে চায়ের দাম দিয়ে টিফিন ক্যারিয়ার হাতে উঠলেন। উঠতেই তার মনে পড়লো, মিনুর জন্মদিনের কেকটা তিনি সোবহানবাগের একটা দোকানে ফেলে এসেছেন। দোকানটা অবশ্য বেশি দূরে নয়।
‘আমার কাছে টাইম মেশিন আছে, চাইলে…।’
‘আরে দূর কী যে বলেন, ওই তো কেকের দোকান।’ এই বলে হাঁটা শুরু করলেন তৈয়ব।
ধ্রুব নীলের সায়েন্স ফিকশন গল্প আরো আরো পেতে সাইটটি সাবসক্রাইব করে রাখুন।
রকমারি থেকে কিনুন
ধ্রুব নীলের সায়েন্স ফিকশন গল্প রক্তদ্বীপ
ধ্রুব নীলের সায়েন্স ফিকশন গল্প রক্তবন্দি
ধ্রুব নীলের সায়েন্স ফিকশন গল্প বোতল মামার টেলিস্কোপ
storiesগল্পধ্রুব নীলসায়েন্স ফিকশন