প্রেমের গল্প : মধুরিমা একটি নদীর নাম

মধুরিমা জলের মতো। আমি এমন কাউকেই চাচ্ছিলাম, যার ভেতর নিজেকে দ্রবীভূত করা যায়। গলে যাওয়া যাকে বলে। আমার ডিভোর্সটা সুপারনোভা ছিল না। সব নক্ষত্র তো বিস্ফোরিত হয় না। কিছু তারা ফুলেফেঁপে বড় হয়ে ফোঁড়ার মতো লাল হয়ে যায়। বড় হতে হতে ওটার কোনো মানে থাকে না। নীলিমার সঙ্গে আমার সংসারটা অমনই হয়ে গেল। তারপর একদিন ‘কী যেন মনে হলো’ ভান করে দুজন ঠিক করলাম, এভাবে চলতে পারে ঠিকই, তবে কী দরকার চালানোর। তারচেয়ে দুজন আরও বেশি সুখের সন্ধান করি। মধুরিমাই কি আমার সেই আরও বেশি সুখ?

আমরা আজ বিয়ে করেছি। পরিচয় কয়েক মাস আগে। মধুরিমা আমার মতো কোনো সুখের সন্ধানে ছিল না সম্ভবত। আমি তার জীবনে অনেক উড়ে আসা ড্যান্ডালিয়ন ফুল। আর সে বুকভরা নদী। যে কিনা জল হয়ে অনায়াসে ধূসর বালিয়াড়িকেও গলিয়ে দিতে পারে এক লহমায়।

‘হুকটা খুলে দাও তো।’

ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে মধুরিমা কানের দুল খুলছিল। আয়নায় দেখছি তাকে। চল্লিশ পেরুনোর ছাপ আছে বটে চেহারায়। তবে সত্যি বলতে কি, আমার অমনটাই ভালো লেগেছিল। কম বয়সী তন্বী তরুণীকে আমার কোনোকালেই জলের মতো মনে হয়নি। মধুরিমাকে সেই হিসেবে বলা চলে আস্ত নদী। যে নদী অবয়ব সর্বস্ব নয়। যে নদীতে শান্ত অথচ শক্তিশালী মরণ স্রোত বয়ে চলে। আর আমি তো আজীবন এমন জলেই ডুবতে চেয়েছি।

গলার পেছনে চিকন ফিতার মতো সোনার চেনটা খুলতে গিয়ে আমার মনোযোগ চেন খোলার প্রতি এতটাই নিবিষ্ট হলো যে আমি সহসা হুকের সন্ধান পেলাম না। মধুরিমা চট করে ঘুরে দুহাতে আমার গাল ধরে আমার চোখের ভেতর অনেকটা জোর করেই ঢুকিয়ে দিল তার দৃষ্টি। এমন আচরণে আমি এখন আর চমকে উঠি না। এমনকি আজ আমাদের বাসর হলেও অহেতুক পালপিটিশন বাড়েনি আমার। কারণ মধুরিমার নদীতে আমি বহুকাল ধরেই ডুবন্ত।

আর্ট গ্যালারিতে পরিচয়ের এক সপ্তাহ পরই একদিন সন্ধ্যেবেলায় লেকের পাড়ে বসে থাকার সময় যেদিন আমার চোখে কিছু একটা পড়ে যায়, সেদিন শাড়ি ভাঁজ করে চোখে গরম ভাপ দেওয়ার সময় চট করে মধুরিমা আমার দুগাল ধরে একটা চুমু বসিয়ে দিয়েছিল। আমিও চোখ বড় বড় করে মাথা নিচু করে বসে ছিলাম মূর্তির মতো। ঠিক এমনটাই ঘটেছে আরও কতবার। ওর অফিসের  

‘দিব একটা?’

‘না।’

সেদিনের মতো মাথা নিচু করার জো নেই। মধুরিমা আজ সাঁড়াশির মতো আমার গাল চেপে ধরেছে। অন্য সময়ের মতো অতটা আলতো করে নয়। চোখের গভীরে এমন দৃষ্টির ভার আমি নিতে পারছিলাম না। সেটাই উপভোগ করছিল সে। আমাকে অস্বস্তিতে ফেলে যে কী সুখ তার!

‘না একটা দেই।’

‘না। এখন না। এখন আদর চাই না। এখন ঘুমাব। তোমাকে ধরে ঘুমাব।’

‘আজ আমাদের বাসর হবে। তোকে আজ ইচ্ছেমতো…।’

‘না। কিছু হবে না। আমার ঘুম পাচ্ছে।’

মধুরিমা এবার রীতিমতো খামছে ধরলো আমার ঘাড়। লম্বায় আমার সমান বলে কাজটা করতে তার মোটেও বেগ পেতে হলো না। কী কাজ? নাহ, এটা বলা যাবে না।

‘অসভ্য তুমি!’

‘চুপ! তুই আমার ছোট, বুঝলি! যা খুশি করবো।’

কথাটা সত্য। মধুরিমা আমার চেয়ে বছর দুয়েকের বড় হবে। তবে উনচল্লিশ আর একচল্লিশের পার্থক্য হয় না কোনো।

মধুরিমার সঙ্গেও পেরে ওঠাও দায়। বাহুতে বেশ শক্তি রাখে। ক্যাফেটেরিয়ার সিঁড়ির ফাঁকে তো একবার এত জোরে জড়িয়ে ধরেছিল যে আমার দম আটকে আসার দশা।

এখনও ছাড়াছাড়ির নাম নেই। এবার তার দুহাত আমার কোমরে। অক্টোপাসের সাঁড়াশির মতো পেঁচিয়ে পায়ে পায়ে আমাকে সরিয়ে দিচ্ছে পেছনের দিকে। বাধ্য হয়ে বেডে বসে পড়লাম। বুঝতে পারলাম কী ঘটতে চলেছে। আমাকে আঁকড়ে ধরে রীতিমতো ধাক্কা দিয়ে শুইয়ে দিল মধুরিমা।

‘দরজা খোলা!’

ভয় দেখানোর বৃথা চেষ্টা আমার। মধুরিমার চোখে শয়তানি হাসি।

‘থাকুক খোলা। আজ আমাদের বিশেষ রাত। সবাই ধরে নিয়েছে কী ঘটবে। এখন কারও দেখতে মন চাইলে এসে দেখুক।’

‘তুমি এত নির্লজ্জ কবে থেকে!’

‘গ্যালারি থেকে যেদিন তোকে কোলে নিয়ে হসপিটালে নিয়েছিলাম।’

‘কোলে নিয়ে মানে! মোটেও না। আমি তোমার কাঁধে হাত রেখেছিলাম।’

হাসলো মধুরিমা। যেন আমিই বলছি ওদিনের ঘটনা। বিশাল এক ক্যানভাস খসে পড়েছিল আমার কপালের দিকটায়। মাথা চক্কর দিয়ে উঠেছিল। সম্ভবত জ্ঞান হারিয়েছিলাম কিছুক্ষণের জন্য। তারপর মাঝে একবার জ্ঞান ফিরলে টের পাই উষ্ণ একটা স্পর্শ। মধুরিমার বাহুতে মাথা রেখে পা ফেলে ফেলে তার গাড়িতে উঠছিলাম সম্ভবত। এরপর সেলাই আর স্যুপ খাওয়ার কিছু অস্পষ্ট স্মৃতি।

‘তুমি ইচ্ছে করে ওই দিন আমাকে চেপে ধরেছিলে?’

‘হুম।’

‘এদিকে আমার কপাল ফেটে একাকার।’

‘কিছুই হইনি তোমার বুঝলে খোকা! চারটা সেলাই লেগেছিল শুধু।’

বলতে বলতেই আমার গালে বড় একটা চুমু বসিয়ে দিল। আমি চোখ বুঁজে পড়ে রইলাম। ঠিক ওই দিনের মতো।

‘এবার নিজের বউটাকে ঠিকমতো জড়িয়ে ধরো। তা না হলে ক্যাফেটেরিয়ার ওই দিনের মতো দেব একটা চাপ।’

‘তুমি.. তুমি..একটা ডাইনি।’

মধুরিমাকে যা ইচ্ছে বলা যায়। মায়াময় চোখে সে হাসে। যেন অবাধ্য খোকা আমি। এরপর গাল ছেড়ে হাত চলে যায় মাথার পেছনে। আমার পেছনের চুল এমনভাবে ধরে যে আমি খানিকটা কঁকিয়ে উঠতে বাধ্য হই। তারপর আমাকে অবাক না করে শুরু হলো মুহুর্মুমু চুমু। শেষে বাধ্য হয়েই দম নেওয়ার জন্য ওকে বলতে হলে, থামো হয়েছে।

‘না হয়নি।’

তারপর…।

অজান্তেই আমার দুহাত চলে এলো মধুরিমার পিঠে। জোরে আঁকড়ে ধরার শক্তিটুকুও নেই। মধুরিমার পাটভাঙা শাড়ি আর পারফিউমের ঘ্রাণ মিলেমিশে আমার মগজটাকে গলিয়ে দিয়ে গেল। আমি গলে যেতে লাগলাম মধুরিমার বুকে, বাহুতে, গলায়, ঠোঁটে। এরপর গলতে গলতে একসময় শান্ত হলো সে। বাঁধন খানিকটা হালকা করে আমাকে যেন অনুকম্পা করে শ্বাস নেওয়ার সুযোগ করে দিল মধুরিমা। ততক্ষণে আমার চোখের ভেতর জমে থাকা গাঢ় কুয়াশাগুলো ঝরঝর করে মিশে গেল মধুরিমার নদীতে। এরপর আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। যে ঘুম আমি জনম জনম ধরে ঘুমাইনি।

সকালে ঘুম ভাঙল ফোনে কথা বলার শব্দে। নীলিমাকে কে যেন কল দিয়েছে। সম্ভবত তার বোন বা কোনো আত্মীয়। আধো ঘুমে থাকা আমাকে হড়বড় করে কী কী সব বলল। অফিসে যাওয়ার আগে বাজার করা, ছেলেকে স্কুল থেকে আনা, কাপড় ধোয়ার পাউডার কেনা এবং আরও কিছু।

আমি বিছানা ছেড়ে উঠে বসলাম। নাস্তা করার আগে বারান্দায় গিয়ে কিছুটা সময় বসে থাকি নির্জীবের মতো। নীলিমা তড়িঘড়ি করে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকে। আমি তার যাওয়ার দৃশ্যটাও দেখি না। তার চোখেও আমি নেহায়েত একটা অর্গানিক জড়বস্তু। হয়তো এটাই তার কাছে জীবনের চূড়ান্ত সংজ্ঞা। আর আমার মাথার কোনে চুপটি করে বসে থাকা মধুরিমা বেঁচে থাকে একটি স্রোতস্বিনী নদী হয়ে।

(শুভ রায়ের গল্পটি কেমন লাগলো তা জানাতে আমাদের মেইল করুন : matinewsbd@gmail.com-এ। আপনাদের মতামতের ওপর ভিত্তি করে এ লেখকের পরবর্তী গল্প প্রকাশ হবে)

storiesগল্পপ্রেমের গল্পরোমান্টিকরোমান্টিক গল্প