সাবরিনা তাহ্সিন
সদ্য এইচ.এস.সি পরীক্ষায় জি.পি.এ প্রাপ্তি মেধাবী দীপ্তির স্বপ্ন জাগে ,সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করবে।কিন্তু সেইবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে চান্স পায় না।সে স্বপ্নে অটল থাকে।দীপ্তি তার অন্য তিন ভাই-বোনদের মতো মাদ্রাসায় উচ্চ শিক্ষা নিবে না বলে ঠিক করেছে।কারণ, দীপ্তির এক বছরের ছোট ভাই ফয়সাল মা-বাবার ইচ্ছায় মাদ্রাসায় পড়াশোনা করছে।সেজো বোন মারিয়া ক্লাস ফাইভে পড়াশোনা করলেও মা-বাবা মারিয়াকেও ইবেতায়েরী মাদ্রাসায় ভর্তি করে দিবে বলে ঠিক করেছে।আর সর্বকনিষ্ঠ ছোট ভাই ইব্রাহিম এখনও স্কুলে ভর্তি হয় নি।তবে ইব্রাহিমকে ছোট থেকেই মাদ্রাসায় ভর্তি করাতে চায় দীপ্তির মা-বাবা।
দীপ্তির মা জুলেখা বেগম গৃহিণী ,বাসায় গৃহস্থলি কাজ আর সন্তানদের দেখাশোনার কাজে ব্যস্ত থাকেন।বাবা ইমতিয়াজ আহমেদ একজন আর্মি অফিসার। দীপ্তি তার মা-বাবাকে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেয় যে ,” আমার ভাই-বোনেরা তোমাদের ইচ্ছানুযায়ী মাদ্রাসায় পড়াশোনা করছে।কিন্তু আমি নিজের ইচ্ছানুযায়ী পড়াশোনা করবো।দয়া করে ,তোমাদের ইচ্ছা আমার উপর চাপিয়ে দিও না।” দীপ্তির এই সিদ্ধান্তের উপর মা-বাবা কিছুই বলেন না।
ইশতিয়াক আহমেদ বাসায় তেমন থাকেন না।অফিসের কাজেই সারাদিন ব্যস্ত থাকেন। জুলেখা বেগম সাংসারিক কাজকর্ম ও ইব্রাহিমকে নিয়েই সারাদিন ব্যস্ত থাকেন।
দীপ্তি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আনন্দ মোহন কলেজের সমাজকর্ম বিভাগে ভর্তি হয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগে। জুলেখা বেগম দীপ্তিকে জিজ্ঞেস করলেন, ” কী রে দীপ্তি ,এতো বিশ্ববিদ্যালয় থাকতে কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন ভর্তি হবি ?”
দীপ্তির কেবল জবাব দেয় ,” আমার ইচ্ছা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। “
কিন্তু ,দীপ্তির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পিছনে অন্য এক কারণ আছে।কলেজে পড়ার সময় আবিদ নামের এক ছেলের সাথে দীপ্তির পরিচয় হয়েছিল।প্রথমদিকে ,দীপ্তি পড়াশোনার বিষয়ে আবিদের কাছ পরামর্শ নিতো।কখনও কখনও কলেজ লাইব্রেরীতে দু’জনে মিলে বই পড়তো এবং পাঠ-সংশ্লিষ্ঠ বিষয় নিয়ে আলোচনা করতো।আবিদের দেশের বাড়ি ফরিদপুর জেলায়।সে ময়মনসিংহে কলেজ ছাত্রাবাসে থেকে অধ্যয়ন করছে।পরিচয়ের পর থেকেই দীপ্তি ও আবিদের মধ্যে এক আত্মিক বন্ধুত্ব তৈরি হয়।পাঠ-সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে নোট-সাজেশন আদান-প্রদান করতে করতে দুজনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়।বন্ধুত্ব থেকে ধীরে ধীরে প্রণয়ের সূত্রপাত ঘটে।
আবিদ ও দীপ্তি একই সাথে এইচ.এস.সি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়।আবিদ ও দীপ্তি তখন থেকেই সিদ্ধান্ত নেয় যে ,তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে।ঢাকা শহরে তাদের সংসার জীবন শুরু করবে।আর এই কারণেই দীপ্তি দ্বিতীয়বারের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেয়।কিন্তু এইবারেও দীপ্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পায় নি।
আবিদও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স না পেয়ে আনন্দ মোহন কলেজে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হয়েছিলো।তাদের দুজনের স্বপ্নসাধ অপূর্ণই থেকে গেলো।কিন্তু দীপ্তি তার সিদ্ধান্তে অটল। সে আবিদকে ফোন করে বলে , ” চলো আমরা বিয়ে করে ফেলি।”
আবিদ বলে ,” তুমি যা বলছো ,ভেবে বলছো তো ?”
দীপ্তি বলে ,” হ্যাঁ ,ভেবে বলছি।কারণ ,আমরা এখন সাবালক।আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আছে।”
আবিদ বলে ,” হুম, তা ঠিক আছে।কিন্তু আমরা দুজনেই এখন শিক্ষার্থী।আর সংসারের খরচ জোগানোর মতো কেউই কোনো জব করছিনা। তাই এভাবে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া বোকামি।”
দীপ্তি জোর গলায় বলে ,” তুমি এতো ভীতু কেন ? হ্যাঁ ,মানলাম আমরা শিক্ষার্থী।এখন পড়াশোনার ফাঁকে পার্টটাইম জব করছে অনেকেই।আমরাও সেরকম পার্টটাইম জব করবো না হয়।”
আবিদ বলে ,” বেশ , ধরো আমরা বিয়ে করলাম। কিন্তু মাথা গোঁজার জন্য তো বাসা ভাড়া করে থাকতে হবে।সেই বাসা ভাড়ার টাকা জোগাড় করবো কীভাবে ?”
দীপ্তি বলে ,” ওটা নিয়ে কোনো চিন্তা করো না।মা আমার বিয়স্ক্রর জন্য কিছু গহনা বানিয়েছিলেন।ঐ গহনা বিক্রি করে ঢাকা জোগাড় করবো ।তারপরেটা পরে দেখা যাবে।”
আবিদ বলে ,” দেখো দীপ্তি ,পরে যাতে কোনও ঝামেলা না হয়।”
পরের দিন ভোরে দীপ্তি তার বিয়ের মায়ের বানানো গহনা ব্যাগের মধ্যে ভরে রাণী জুয়েলারীর দোকানে গিয়ে বিক্রি করে দেয়।আশি হাজারের মতো টাকা হয়।সেই টাকা ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে আবিদকে ফোন করে কাজী অফিসে আসতে বলে।সাক্ষী হিসেবে আবিদ তার এক সহপাঠীকে নিয়ে কাজী অফিসে যায়।কাজী অফিসে আবিদএর সাথে দীপ্তির বিয়ে সম্পন্ন হয়।”
কিন্তু এখন তারা কী করবে ?কোথায় যাবে ?তা ঠিক বুঝতে পারে না।ঐদিকে বাসায় গহনা খুঁজে না পাওয়ায় জুলেখা বেগম থানায় সাধারণ ডায়েরী করে রাখে।পুলিশ অনুসন্ধান করতে করতে সেই রাণী জুয়েলারী দোকানে গিয়ে জুলেখা বেগমের দেওয়া গহনার ছবি দেখিয়ে দোকানদারকে গহনা বিক্রির বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে দোকানদার জবাব দেয় ,”হুম, আজকে সকালে এক মেয়ে আমার দোকানে এসে গহনা বিক্রি করেছিলো। “
পুলিশ সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখতে চাইলএ দোকানদার ভোরের সিসি ফুটেজ দেখায়।ফুটেজে দেখা যায়, দীপ্তির গহনা বিক্রির দৃশ্য। সেই সিসিফুটেজ পুলিশ জুলেখা বেগমকে দেখালে ,মেয়ের বিশ্বাসঘাতকতা দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
জুলেখা বেগম দীপ্তিকে ফোন করে।কিন্তু দীপ্তি ভয়ে ফোন ধরে না।পুলিশের সন্দেহ বেড়ে যায়।তা দীপ্তির ফোন কল ট্র্যাক করে তার অবস্থান নিশ্চিত করে পুলিশ। পুলিশ দীপ্তি ও আবিদকে ধরে নিয়ে দীপ্তিদের বাড়ীতে যায়।জুলেখা বেগম দীপ্তিকে দেখে কষে থাপ্পড় মেরে কান্নাজড়িত কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন ,” হ্যাঁ রে ,আমি তওর সাথে কী অন্যায় করেছিলাম যে ,তুই আমার সাথে এই রকম বিশ্বাসঘাতকতা করলি? এই গহনাগুলো তোর বিয়ের জন্যই রেখেছিলাম। আর তুই এই গহনাগুলো বিক্রি করে দিলি ?”
দীপ্তি এবার ভয়ে ভয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে ,” মা ,তুমি তো এই গহনা আমার বিয়ের জন্য রেখেছিলে।সুতরাং এই গহনার প্রতি আমার অধিকার আছে।আর বিয়ের প্রসঙ্গ যেহেতু আসলোই ,তাহলে বলে রাখি এই গহনা বিক্রির টাকার কিছু অংশ খরচ করে আমি আর আবিদ কাজী অফিসে গিয়ে বিবাহ কার্য সম্পন্ন করেছি।”
মেয়ের কথা শুনে জুলেখা বেগমের রাগ বেড়ে গেল।তিনি আক্রোশে বললেন ,” কী রে মেয়ে ,তোর এতো সাহস যে ,তুই গহনা বিক্রি করে এক ভুল করেছিস।আবার মা-বাবাকে না জানিয়ে বিয়েও করে ফেলেছিস!আর আবিদ কী করে ?চাল নেই ,চুলো নেই ?কীভাবে সংসার চালাবে ? হ্যাঁ ?”
দিপ্তী বলে ,” হ্যাঁ ,মা ।মানলাম আমার ভুল হয়েছে।সন্তান ভুল করলে মা সন্তানের ভুল সংশোধন করে দেয়।আমাকএ তুমি ক্ষমা করে দিও।”
জুলেখা বেগম কিছু বলেন না।
দীপ্তি আর আবিদ সেদিন দীপ্তিদের বাসা থেকে চলে যায়।কিন্তউ এতো রাতে তারা কোথায় যাবে?ভেবে পায় না।
দীপ্তি আবিদকে বলে ,” এক কাজ করো, তুমি কলেজ হোস্টেলে চলে যাও।কলেজ রোডে আমার এক বান্ধবী থাকে।আমি বান্ধবীকে বুঝিয়ে বলে দুই-তিন তাদের বাসায় থাকবো।আর দুই তিনদিনের ভিতর একটা বাসা ভাড়া খুঁজে বের করতে হবে।”
দুই-তিনদিনের ভিতর দীপ্তি ও আবিদ বোর্ডঘরের দিকে ছোট দুই রুমের ভাড়া বাসায় উঠে।সংসারের টুকিটাকি জিনিস দিয়ে রুমটা সাজিয়ে তোলে।আবিদ একটা দোকানে সেলসম্যান হিসেবে পার্টটাইম জব করে।দীপ্তি পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে তিন-চারটা টিউশনি করে।এভাবেই তাদের সংসার জীবন চলতে লাগলো।প্রায় ১ বছর কেটে যেতে লাগলো ,কিন্তু মায়ের সাথে দীপ্তির সম্পর্কে মরিচা ধরতে শুরু করলো।তবে ছোট ভাইবোনের সাথে দীপ্তি দেখা করে ,কথা বলে।কখনও দীপ্তি ছোট ভাই-বোনের সাথে দেখা করার ছলে টিফিনে করে খাবার নিয়ে যায়।মায়ের বাসার সাথে দীপ্তির প্রায়ই যাতায়াত হয় ঠিকই। কিন্তু জুলেখা বেগম মেয়ে দীপ্তিকে কখনও ক্ষমা করতে পারেন নি।জুলেখা বেগম দীপ্তির সাথে কথা বলা তো দূরের কথা ,মুখ পর্যন্ত দেখতে ঘৃণাবোধ করেন।দীপ্তি তার মনের মানুষকে জীবনসাথী হিসেবে পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু অন্যদিকে মা-মেয়ের সম্পর্কে ফাটল ধরেছে।তবে ,দীপ্তির দৃঢ় বিশ্বাস, একদিন মা নিশ্চয়ই তার সমস্ত অপরাধ ক্ষমা করে তাকে কাছে টেনে নিবে।