(মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্পটি লিখেছেন বাংলাদেশের খ্যাতনামা গল্পকার ধ্রুব নীল। এ গল্পে এক দারুণ মেধাবী কিশোরের গাণিতিক দক্ষতার কারণে কী করে একটি গ্রামের বাসিন্দারা পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাচারের হাত থেকে বেঁচে গেল, সেটাই দেখানো হয়েছে। শিশু কিশোরদেরকে অঙ্কের একটা মজার খেলাও শেখা হবে এই গল্পে। এই গল্পে দূরত্ব মাপার কৌশলটি পুরোপুরি সঠিক ও প্রমাণিত।)
‘গেলরে! বলটা একেবারে মরণ কুয়োয়। তুলবো কী করে! খেলা ডিসমিস। ওই সবুজ, তুই ফেলেছিস, তুই তুলবি।’
শরিফুলের কথায় উসখুস করছে সবুজ। তার কিকেই ফুটবলটা সোজা গিয়ে পড়েছে গভীর এক পরিত্যক্ত কুয়ায়। নিচে পানি থাকলেও কেউ জানে কত গভীর ওই কুয়া।
মায়াপুর হাইস্কুলে পড়া ওরা সবাই। কেউ এইটে তো কেউ টেনে। রতনও আছে দলে। সে হলো ‘দুধভাত পেলেয়ার’। টিংটিঙে সরু। জোরে বাতাস এলেও নাকি তার হাঁটতে কষ্ট হয়। পাওয়ারওয়ালা চশমা পরে। অবশ্য কেউ তার মাথায় গাট্টা মারে না। মারলে যদি আবার চশমা পড়ে যায়। তবে রতনের মাথা ভালো। পরীক্ষায় সব সময় ফার্স্ট। অঙ্কে তার সঙ্গে স্যারেরাও পারে না।
সবুজ মাথা চুলকে বলল, ‘কাক আর কলসির গল্পের মতো দেখবো নাকি। সবাই মিলে কুয়োর ভেতর পাথর ফেলি। তাতে পানি উঠতে উঠতে বলটাও উঠবে।’
মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প
সবাই হেসে ওঠার আগে রতন সিরিয়াস গলায় বলল, ‘কুয়োর ব্যাস আর গভীরতা দেখে মনে হচ্ছে কয়েকশ টন পাথর ফেলতে হবে। মায়ানগরের নদীর তীরে যত পাথর আছে তাতে কাজ হবে না।’
‘এখন উপায়?’
শরিফুল বলল, ‘বড় দড়ি আর ঝুড়ি লাগবে। নিচে ফেলে বলটা তুলতে হবে।’
সবুজ বলল, ‘কত বড় দড়ি? ঝুড়ি তো আমাদের ঘরে আছে।’
‘কুয়াটা কত গভীর জানতে সুবিধা হতো। মাপবো কী দিয়ে?’
রতন গেল কুয়ার কাছে। তুলে নিল একটা মাঝারি সাইজের পাথর। সবাই গোল হয়ে ঘিরে ধরল। রতন ইশারায় বলল, সবাই চুপ!
পাথরটা ফেলে আঙুলের কড়ায় সেকেন্ড গুনলো। তিন সেকেন্ড পর কানে এলো ঝুপ শব্দটা। এরপর কুয়োর পাশে শ্যাওলা পড়া মাটিতেই খড়ি দিয়ে ইংরেজিতে লিখতে লাগল সূত্র। ডি সমান হাফ জিটি স্কোয়ার। রুট ওভার টুডি বাই জি…।
অঙ্ক করা শেষে সবাইকে বলল, কুয়াটা সাড়ে একশ তেত্রিশ ফুট গভীর। এরচেয়ে একটু বড় দড়ি বানালেই বলটা তোলা যাবে। তবে ঝুড়ির ভেতর একটা ইট দিতে হবে। তাতে ঝুড়িটা প্রথমে পানিতে ডুববে এরপর টান দিয়ে বলসহ ওঠানো যাবে।
এই হলো রতন। যে কারণে দুধভাত হলেও দলে সে জায়গা পায়। সেদিন বলটা ওঠানোর পর সন্ধ্যায় সবার হাতে ভরপেট সিঙ্গাড়া খেয়ে বাড়ি গেল রতন।
মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প
পরদিন সকাল সাড়ে আটটা বাজতেই হই হই কাণ্ড। রতনদের উঠোনে গোল হয়ে ফুল ভল্যুমে রেডিও শুনছে বড়রা সবাই। রতনের কানে ভাসা ভাসা কিছু কথা এলো, ‘বাংলার মানুষ মুক্তি চায়। তারা বাঁচতে চায়। তারা অধিকার পেতে চায়…।’
উঠোনে শরিফুল আর সবুজকেও দেখল। শরিফুলকে খুশি খুশি দেখাচ্ছে। ‘বিরাট গ্যাঞ্জাম চলতেসে। স্কুল বন্ধ হবে। উর্দু ক্লাস করতে হবে না। কী মজা।’
পরের প্রায় এক মাস মায়াপুরে কিছুই হলো না। এপ্রিলের পঁচিশ তারিখে খবর এলো পাকিস্তানি সেনারা রানীনগর উপজেলা ঘিরে ফেলেছে। জিপ গাড়ি নিয়ে এসেছে। হাতে বন্দুক। সবাইকে নাকি মেরে ফেলছে। রতনের গ্রামের কয়েকজন পালাতে গিয়ে ধরা পড়েছে। কারণ গ্রাম থেকে বের হওয়ার সোজা পথটা রানীনগর দিয়েই। একটা ব্রিজ পার হতে গিয়ে ধরা পড়েছে ওরা। অন্যদিকে আছে নদী। যারা পেরেছে তারা আগেই নৌকা সব নিয়ে চলে গেছে।
রতন, শরিফুল ও সবুজের বাবা-মাসহ মায়াপুরের সবার মুখ শুকিয়ে কাঠ। এভাবে মানুষ মানুষকে মুড়িমুড়কির মতো মেরে ফেলতে পারে সেটা তারা ভাবতেও পারছেন না।
‘রতন! রানীনগরের খবর পেয়েছিস? সব তো শেষ।’
রাতে জানালার কাছে ফিসফিসিয়ে বলল শরিফুল। সঙ্গে সবুজও আছে। সে নাকি কদিন আগে রাতের আঁধারে ব্রিজ পার হয়েছিল। খবর পেয়েছে, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে দেশে। অনেকে নাকি পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু গ্রামের কারও কাছে বন্দুক নেই।
শরিফুল বলল, ‘মিরাজ ভাই একটা পানসি নৌকায় নদী পার হয়ে এসেছে। তার কাছে খবর আছে। একটু পর মিটিং হবে।’
রতনদের উঠানেই হয় যাবতীয় মিটিং। সবার কথা বলাবলির মাঝে মিরাজও হাজির। বলল, ‘মিলিটারিরা এই গ্রামে আসবে কাল। সব নাকি জ্বালিয়ে দেবে।’
রতনের মুখে ভাবান্তর নেই। যত চিন্তা সব চলে মাথার ভেতর। সবার কথাবার্তা শুনছে মন দিয়ে।
মিরাজ জানাল, ‘ওদের কয়েকটা জিপ নষ্ট হয়ে গেছে। সম্ভবত তেল শেষ। তবে শুনলাম সকাল নাগাদ ঠিক হয়ে যাবে। এরপরই ব্রিজ পেরিয়ে মায়াপুর।’
‘ব্রিজটা ভাইঙা ফেলা যায় না?’
জয়নাল মুন্সির কথায় বাকিরা চুপ। বুদ্ধিটা ভালো। প্রশ্ন হলো ভাঙবে কী দিয়ে? হাতুড়ি, শাবল নিয়ে ব্রিজের কাছে যাওয়ার আগেই তাদের মেরে ফেলবে। কারণ ব্রিজের মাঝে নাকি দুজন পাকিস্তানি মিলিটারিকেও দেখা গেছে।
শরিফুল তার গুলতি দিয়ে অন্ধকারে এদিক ওদিক নিশানা করছে। যেন শত্রু এলে এটা দিয়েই যুদ্ধ করবে। তার দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবল রতন।
এমন সময় মিরাজ বলল, ‘আমার কাছে দশটা হাতবোমা আছে। বেশ পাওয়ারফুল বোমা। এর কয়েকটা মারতে পারলে ব্রিজটা ভাঙবে। এমনিতেই তো নড়বড়ে।’
সবুজ বলল, ‘ব্রিজের কাছে যাব কী করে? কত দূরে যাব? আর দূর থেকে ছুড়লে যে বোমাগুলো ব্রিজেই পড়বে সেটার গ্যারান্টি কী?’
মিরাজ বলল, ‘ব্রিজের আগে একটা জঙ্গলের মতো আছে। সেখানে বট আর আম গাছ আছে। কিন্তু ওটার ওপর উঠে হাত দিয়ে বোমা মারা সম্ভব নয়। অতদূর ছুড়তে পারব বলে মনে হয় না। তারওপর দুজন মিলিটারি পাহারাও দিচ্ছে।’
এরপর সবাইকে অবাক করে রতন বলল, ‘আমি যাব ওই জঙ্গলে। গাছে উঠতে হবে।’
এরপর বন্ধুদের দেখিয়ে বলল, ‘সঙ্গে তোরাও চল। আমি গাছে উঠতে জানি না। একা ভয় করবে। আর ব্রিজের রেলিংয়ে যে বাঁশগুলো লাগানো আছে সেগুলো সিরাজ কাকা বেঁধেছিলেন না? কত ফুট লম্বা ছিল বাঁশগুলো কাকা?’
সিরাজ আমতা আমতা করে বললেন, ‘ফুটের হিসাব তো জানি না বাবা। আমার হাতে পনের হাত করে ছিল পইত্যেকটা।’
রতন সঙ্গে সঙ্গে স্কেল এনে মেপে ফেলল সিরাজ মিয়ার হাত।
‘ষোল ইঞ্চি হাত। তার মানে প্রতিটা বাঁশ দুইশ চল্লিশ ইঞ্চি। শরিফুল তুই গনি মিয়ার দোকান থেকে শক্ত দেখে তিন ইঞ্চি রাবারের একটা বড় মজবুত গুলতি বানিয়ে আন। আর ওজন মাপার একটা দাঁড়িপাল্লাও লাগবে।’
গনি মিয়া আর শরিফুল দুজন একসঙ্গেই দৌড় দিল।
রতনের গলার স্বরে এমন কিছু ছিল যে, তার কথায় কান না দিয়ে পারল না কেউ। তবে গাছে উঠে সে কী করবে আর বাঁশের মাপ জেনে কী হবে জানতে চাইল না কেউ।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই গুলতি আর দাঁড়িপাল্লা হাজির। মিরাজের কাছ থেকে নিয়ে বোমাগুলোর ওজন বের করল রতন। প্রতিটার ওজন সাড়ে চারশ গ্রাম। খাতায় সব লিখে নিচ্ছে রতন।
নতুন করে বানানো গুলতির সাইজটা দশাসই। তবে বড় প্রশ্নটার উত্তর পাচ্ছে না শরিফুল ও অন্যরা। গুলতিতে বোমা রেখে ব্রিজ বরাবর ফেলবে কী করে? বোমা জায়গামতো না পড়লে তো মহাবিপদ।
রতন বলল, ‘আগে যেতে হবে জঙ্গলে। গাছে উঠবো। ওই গাছ থেকে ব্রিজ কত ফুট দূরে সেটা মাপতে হবে।’
রতনের কথার বাইরে যাওয়ার উপায় নেই কারও। টিংটিংয়ে চশমা পরা ছেলেটাই যেন এখন গ্রামের বিরাট নেতা।
গাছের নিচে চুপিসারে দাঁড়িয়ে গ্রামের গোটা দশেক মানুষ। দুই লাফে একটা মাঝারি দেখে আমগাছে চড়ল সবুজ। রতন গাছে চড়তে জানে না। সবুজই টেনে তুলল ওকে। চাঁদের আলোয় দূরের ব্রিজটা দেখতে পাচ্ছে পরিষ্কার।
এবার ডান হাতের বুড়ো আঙুলটাকে খাড়া করে টান টান করে হাত বাড়াল রতন। বন্ধ করল বাঁ চোখ। বুড়ো আঙুলের একটা প্রান্ত রেখেছে ব্রিজের রেলিংয়ে বাঁধা বাঁশের এক প্রান্তে। এরপর বাঁ চোখ বন্ধ করে মেলল ডান চোখ। বুড়ো আঙুলটাও যেন দুম করে সরে গেল ডানে। এবার আঙুলটাকে দেখা গেল বাঁশের একেবারে ডান প্রান্ত বরাবর। মুখে হাসি ফুটল রতনের। একই কাজ কয়েকবার করে নিশ্চিত হলো। খাতায় আর লিখতে হলো না। মুখেই মুখেই গুণ করল। ‘দুইশ চল্লিশ গুণ দশ সমান দুই হাজার চারশ ইঞ্চি সমান দুইশ ফুট। এখান থেকে ব্রিজটা দুইশ ফুট দূরে!’
গ্রামের লোক হাততালি না দিলেও সবার চোখ চকচক করে উঠল।
মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প
‘এবার লাগবে সাড়ে চারশ গ্রাম ওজনের পাথরের টুকরো’। ঘোষণা দিল রতন। শুরু হলো খোঁজ খোঁজ। নদীর পাড়ে ছুট সবুজ। চটের ব্যাগে পাথর বোঝাই করে ফিরে এলো। সেখান থেকে বেছে বেছে ওজন করে কয়েকটা নিল রতন।
এরপর ডাক পড়ল শরিফুলের। গুলতির রাবারের নিচে মোটা করেই চামড়ার টুকরো বেঁধেছে ও। তাতে গোলগাল পাথর ভরে সহজেই ছোড়া যাবে।
রাবার টেনে বড় একটা পাথর দূরে ফেলল শরিফুল। রতনের কথামতো একদম নব্বই ডিগ্রি কোণ করে। কতটুকু রাবার টেনে আনল সেটা স্কেল দিয়ে নিখুঁতভাবে মেপে নিল রতন। গুলতি থেকে ছুটল পাথর। পাথরটা কতদূর গেল সেটাও মেপে নিল।
এদিকে মাঝরাত পেরিয়ে গেছে। ওসমান ও তার স্ত্রীর বানানো চা নাশতা খেয়ে ঘুম কেটে গেল সবার।
দশমবারের মতো গুলতি টেনে ছুড়ল শরিফুল। কত ইঞ্চি টানলে কত ফুট দূরে গিয়ে পড়ছে পাথরটা সেটা লিখতে লিখতে রতন একটা হিসাব পেয়ে গেল। শরিফুলকে টানতে হবে গুনে গুনে বাইশ ইঞ্চি।
কিন্তু ইঞ্চির হিসাব মনে রাখতে পারবে না শরিফুল। সহজ বুদ্ধি পেল রতন। গুলতির রাবার যখন শরিফুলের ঠিক নাক বরাবর আসবে তখনই যেন সে থেমে যায়। তাতেই কাজ হবে। আরও তিনবার প্র্যাকটিস করে শরিফুল অবাক হলো, রতনের কথাই ঠিক!
মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প
সে রাতে মায়াপুর গ্রামের লোকজন ব্রিজের দুইশ ফুট দূরের জঙ্গলে দাঁড়িয়ে দেখল এক অদ্ভুত দৃশ্য। শরিফুল গুলতি হাতে গাছের ডালে গেঁড়ে বসল। তার ঠিক পেছনে বোমার থলে হাতে মিরাজ। বড় করে শ্বাস নিল শরিফুল। আলতো করে বোমাটাকে গুলতিতে ধরে টেনে আনল নাক পর্যন্ত। ব্রিজ বরাবর তাক না করে রতনের কথামতো একদম নব্বই ডিগ্রি সোজা ধরেছে। বাতাসের গতি কমতেই ইশারা দিল রতন। গুলতি ছুড়ল শরিফুল।
প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে উঠল ব্রিজ। বাইশ ইঞ্চি মাপে ভুল হলো না শরিফুলের। দশটা বোমার মধ্যে আটটাই পড়েছে জায়গামতো। তাতেই ব্রিজ ভেঙেচুরে একাকার। টহল দেওয়া দুই পাকিস্তানি সেনার কী দশা সেটা জানার দরকার হলো না কারও। জিপ তো দূরে থাক, লাফিয়েও কেউ পার হতে পারবে না ওই ব্রিজ। তারচেয়েও বড় কথা, বিরাট কোনো সশস্ত্র প্রতিরোধ হচ্ছে ভেবে ওই রাতেই রানীনগর ছেড়ে পালিয়ে গেল হানাদার পাকিস্তানি সেনারা।