রম্যরচনা : অ্যান্ড্রোমিডার মশা

শক্তিশালী স্পিকারে অস্বাভাবিক গুঞ্জনটা কানে আসতেই আনন্দ এবং ভয় একসঙ্গে ছেঁকে ধরলো জাতীয় গ্যালাক্সি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী উহুকে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো কিছুক্ষণ গুঞ্জনটা শুনলেন। খানিক পরেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলেন পাশের যোগাযোগ মডিউল রাখা রুমটায়। চেয়ারে বসে ঝিমুচ্ছিল চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী আঁই-রোবট। দেখেই মেজাজ খিঁচড়ে গেল বিজ্ঞানী উহুর। ‘সরকারি রোবটগুলো কোনও কাজের না’ বলে কোনও রকম মেজাজ কন্ট্রোল করলেন। নিজেই যোগাযোগ মডিউল অন করে কল করলেন ঢাকা উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিমের চার সিটি করপোরেশনের প্রশাসককে।
‘সম্মানিত প্রশাসকবৃন্দ। আমাদের ধারণা সত্যি প্রমাণ হয়েছে। ভিনগ্রহের প্রাণীর সঙ্গে মানুষের এই প্রথমবার সাক্ষাৎ ঘটতে যাচ্ছে।’
‘যা কইবা খুইলা কও। মাইঝরাইতে আমার ভিনগ্রহের প্রাণীরে মেহমানদারির খায়েশ নাই। তাছাড়া মিডিয়ারে খবর না দিয়া আমগোরে ডাকলা ক্যান? এইখানে সিটি করপোরেশনের কুনু হাত নাইক্কা।’
এমন মন্তব্য শুনে খুব একটা হতাশ হননি বিজ্ঞানী। বললেন, ‘আপনাদের ডেকেছি কারণ দীর্ঘদিনের পর্যবেক্ষণ শেষে আমরা নিশ্চিত হয়েছি, প্রাণীগুলো ঠিক মানুষের মতো নয়। এটা দেখতে অনেকটা মশার মতো। তাই ইয়ে.. মানে..। আর মশাগুলো ঢাকার দিকেই আসছে।’
‘ধুর মিয়া! শহরের মশা নিয়া কূল পাই না, আর আপনি ইমপোর্টেড মশা নিয়া আইবার লাগসেন।’ আরেকজন বলল, ‘এই মশা যেহেতু বাইরের, তাই আমার মনে হয় না এরা আমার এখতিয়ারে আছে।’ আরেক প্রশাসক বললেন, ‘আরে ভাই, এইটা যে মশা সেটা নিশ্চিত হইলেন কেমনে? এই মশা মিডিয়ার সৃষ্টি।’
বিজ্ঞানী ইনিয়ে বিনিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করলেন, ‘ইয়ে মানে, মশার মতোই তো প্রাণীটা।’
‘আগে আসুক, রক্ত খাইয়া যাক, তারপর দেখুম।’
এই বলে একে একে চার সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাই অফলাইনে চলে গেলেন।
বিজ্ঞানী উহু অসহায় দৃষ্টিতে তাকালেন আঁই-রোবটের পানে। নোয়াখালী জোনের জন্য বিশেষভাবে নির্মিত এ রোবটটি তার আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের কারণেই এখানে চাকরি পেয়েছে। বিজ্ঞানীর দিকে তাকিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলো আঁই-রোবট। ব্লিপ ব্লিপ শব্দ করে খানিকটা কেশে নিয়ে বলল, ‘ছার, আঁর মনে অয় যা করনের আঙ্গোরেই করন লাইগবো। নইলে কাম্বাই হাডাই আলাইবো (কামড়ে ফাটিয়ে ফেলবে)।’
স্মার্ট ট্রান্সলেটর যন্ত্রের সাহায্যে আঁই-রোবটের কথার মর্ম বুঝতে পারলেন বিজ্ঞানী উহু। তবে অনেক ভেবেও কূল পেলেন না। অপেক্ষায় রইলে ভিনগ্রহের মশার আগমণের।
পরদিন টিভি খুলতেই শিউরে উঠলেন বিজ্ঞানী। ঢাকা শহর ছেয়ে গেছে নতুন মশায়। মানুষ ঘর ছেড়ে বের হচ্ছে না। সবাই মশারির তলায়। আগানে বাগানে অফিস আদালতে সবাই স্প্রে হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। টিভিতে লাইভ সম্প্রচার চলছে। নগরীর পরিত্যক্ত একটা ভবনে প্রাথমিক আস্তানা গেড়েছে এলিয়েন মশার দল। সেখানে আবার সোয়া দুইশ টিভি চ্যানেলের ক্যামেরা গিয়ে হাজির। কামড় খেতে খেতে বলে যাচ্ছে সাংবাদিকরা, ‘হ্যাঁ, দর্শক আপনারা জেনে থাকবেন, এরই মধ্যে অ্যাঁ.. মশাগুলো উঁ.. ঠাস.. যা বলছিলাম.. ও মাগো.. ভিনগ্রহের এই মশারা ভীষণ আক্রমণাত্মক। তারা সংঘবদ্ধ। নিচ্ছি কুহুহি ব্র্যান্ডের কয়েল বিরতি। অবাক হলেন উহু। এর মাঝে আবার বিরতিও! বিজ্ঞাপন শুরু। এক কয়েল চলবে টানা বত্রিশ দিন। ধোঁয়া নেই, কারণ এই কয়েল জ্বালাতে আগুনই লাগে না। ইলেকট্রোম্যাগনেটিক কয়েল! মশা যে গ্রহেরই হোক না কেন, ধরাশায়ী হবেই!
ভিনগ্রহের প্রাণী আসতে না আসতেই ব্যবসা! বিড় বিড় করে রাগ ঝাড়লেন বিজ্ঞানী উহু। একটু পর শোনা গেল চিকন সুরের কথা। মশাদের সংবাদ সম্মেলন শুরু। তাদের প্রতিনিধি হিসেবে টিভি চ্যানেলের মাইক্রোফোনগুলোর সামনে এগিয়ে এসেছে একটা বিশাল সাইজের মশা। সদ্য শেখা বাংলায় জ্ঞানী মশাটা বললো।
‘সম্মানিত মানুষবৃন্দ। সমগ্র গ্যালাক্সিতে বসবাসের কোনও জায়গা আমরা খুঁজে পাই নাই। অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সিতে আমাদেরও একটা গ্রহ ছিল। কিন্তু.. (কান্নার মতো চিঁ চিঁ শব্দ).. কিন্তু সেখানকার সরকার বড্ড বেশি পরিচ্ছন্ন। চারদিক ঝকঝকে তকতকে, কোথাও কোনও বদ্ধ জলাশয় ডোবা পানাপুকুর নাই.. উফ! কী ভয়ঙ্কর সেই দৃশ্য! তবে এই এক বঙ্গদেশকেই পাইলাম যেখানে আজ পর্যন্ত আমাদের বাসস্থান অক্ষুণ্ন আছে। সুজলা সুফলা নর্দমা, জলাশয় আর নোংরায় ভরা এই ঢাকায় আমরা খুঁজে পেয়েছি ঠিকানা। এই জন্য সবার আগে আমাদের সবার পক্ষ থেকে আমি চার প্রশাসককে আমাদের সূঁচের অগ্রভাগ থেকে ধন্যবাদ জানাই। আর কৃতজ্ঞতাস্বরুপ আমরা চার ভাগে ভাগ হয়ে প্রত্যেক নগর প্রশাসককে সম্মানিত করতে তাহাদিগের শরীর হইতে এক চুমুক করে রক্তপান করে আসবো।
ব্লিপ ব্লিপ ব্লিপ। চার প্রশাসকই বিজ্ঞানী উহুকে একসঙ্গে কল দিয়েছেন।
‘ও বিজ্ঞানী.. এইডা তো ভালই যন্ত্রণা হইলো। কিসু একডা কর!’
‘ওহে গবেষক, বাইরের মশারা তো আমাদের ইজ্জত রাখলো না।’
‘যদিও আমার কাছে বিষয়টা বিরোধীদলের চক্রান্ত মনে হয়েছিল তথাপি এই বিদেশি জঙ্গি মশাদের বিরুদ্ধে এখন সবাইকে একতাবদ্ধ..ওহ না কী সব বকছি! বিজ্ঞানী! নতুন কোনও স্প্রে আছে?’
বিজ্ঞানী উহু মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। সবাই তার দিকে তাকিয়ে থাকলেও তিনি তাকালেন আঁই-রোবটের দিকে। আঁই-রোবট ঝিমুচ্ছে আর একটু পর পর জাবর কাটছে। ইদানীং কী একটা পাতা চিবুতে থাকে সারাদিন। এই পাতার রসে নাকি চার্জ আছে।
‘হুম, ছার আঁই বুদ্ধি হাইসি। আঁই মশাগুনের লগে কতা কমু।’
আশার আলো দেখতে পেলেন বিজ্ঞানী। আঁই-রোবটও দেরি না করে হাঁটতে শুরু করে দিল। আয়েশি ভঙ্গিতে হাঁটার ধরন দেখে আবারও সরকারি রোবট বলে তিরষ্কার করতে যাচ্ছিলেন বিজ্ঞানী। তবে করলেন না। ভাবলেন, কত ধীরস্থির! অথচ কত কী যে আছে ওই ন্যানোটেক মগজে!
ঘণ্টাখানেক পরই ফিরে এলো আঁই-রোবট। ধুম করে বসে পড়লো চেয়ারে। বিজ্ঞানী টিভি অন করলেন। চারদিকে কেবলই বিজয়োল্লাশ। ভিনগ্রহের মশারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা চলে যাবে।
‘একি! তুমি কী ঘটিয়ে দিয়েছো হে রবুচন্দ্র!’
‘হেগুনেরে এক্কেন কতা কইসি।’
‘কী বলেছো তাদের?’
‘কইসি এই দেশে এমনে জায়গা কম। নিজেরগো গেরামে য’গই (চলে যাও)। হিয়ানে তোমরা ইচ্ছামতো থাকতে ফাইরবা।’
‘তুমি বললে আর অমনি রাজি হয়ে গেল?’
‘না, আঁই তো কইসি তোঙ্গো শহরে যদি ময়লা, ডোবা-নালা আর অব্যবস্থাফনা থাকে তো আংগো শহরের ম্যানেজারগো লইয়া যাও। উনারা বেগগিন ঠিক করি দিব। কিল্লাই বাবু এডে গুতাগুতি করন! (কেনরে বাপু এখানে গুতোগুতি করছো)’
‘বলছো কী!’
ব্লিপ ব্লিপ ব্লিপ।
নগরকর্তারা আবার ফোন দিয়েছেন। গলা ফাটিয়ে বাঁচানোর আকুতি করছেন তারা। এলিয়েন মশার দল তাদের ছেঁকে ধরেছে। মশার হাত থেকে বাঁচতেই সবাই স্পেসশ্যুট পরে নিয়েছেন। সেটা দেখে মশারা আরও খুশি। কাজ এগিয়ে গেছে তাদের। খানিক পর ঘন কালো মশার চাদরে ঢাকা পড়লেন চার নগরপতি। চার জনকেই উড়িয়ে নিয়ে গেল হাইপারসনিক মশার দল।

রম্যরচনা