রোমান্টিক গল্প : ইমার জন্য অপেক্ষা

টার্গেট মিস হলেই প্রবাল সেন ক্ষ্যাপা যুবক। চোখের মণিতে যেন ফণা ওঠে। টার্গেট থেকে চোখ না সরিয়েই আলগোছে সরিয়ে দেয় হোগলার জঙ্গল। তারপর ফের মনযোগ। নিশানা করার কাঁটা, বন্দুকের ট্রিগারের উপর সূক্ষ্ম গিরিখাত, আর প্রবাল সেনের চোখ; সব মিলে মিশে একাকার। প্রায় অসীম সময় নিয়ে দম ছাড়তে ছাড়তে এক পর্যায়ে ট্রিগারে চাপ। সাদা বকটা মুহূর্তে লাল। প্রবাল সেনের বয়স ধপ করে বেড়ে চল্লিশ। কল্পনায় নিজের মুখে আংশিক বলিরেখাও দেখেন।

তবে বন্দুক হাতে জোবারপাড় গ্রামে ফেরার সময় একটা পর্যায়ে নিজেকে খানিকটা বুড়িয়ে ফেলেন প্রবাল সেন।

সুপারি বাগানের যে দিকটায় বড় বড় দুটো তালগাছ আছে, সেখানে ঠিক ঐ বকটার মতো অপেক্ষায় থাকে ইমা। ইমার কাছে নিজের বয়সটা কোনো এক কারণে কখনই মূখ্য ছিল না। যুগ যুগ ধরেই যেন কিশোরি। তবে তার সামনে দাঁড়ানো মাত্রই প্রবাল সেন চল্লিশোর্ধ্ব।

 

– কি গো শিকারি, আজ খালি হাতে ফিরলে যে! বলেছি না ঘুঘু নিয়ে আসতে।

প্রবাল সেনের মুখে লজ্জার ছাপ নেই। তিনি সচরাচর শিকার করা পাখি সঙ্গে নিয়ে আসেন না। তার সঙ্গে থাকা কিশোরের দলই ভাগবাটোয়ারা করে নিয়ে যায়।

প্রবাল সেন মুহূর্তে মধ্যে কোনো উত্তর দিতে পারলেন না। ভ্রূ কুঁচকে একবার শুধু সূর্যের অবস্থান মেপে নিলেন। এই আংশিক উপেক্ষায় তিনি ইমাকে তাদের বয়সের ব্যবধানটাই বুঝিয়ে দিতে চাইছেন।

উত্তর না পেয়ে ইমাও কখনো অভিমান করেনি। আজও তাই হাসিমুখে বলল, তোমার হাতে বন্দুক দেখে কেউ ভয় পায় না? ডাকাত ভাবে না?

 

প্রবাল সেন তাচ্ছিল্যের হাসি হাসার চেষ্টা করলেন। বললেন, ডাকাতই তো, নতুন করে আবার ভাবার কী আছে।

ইমা লজ্জায় মাথা খানিকটা নিচু করলো। সে যা ভেবে কথাটা বলেছে তার সঙ্গে প্রবাল সেনের উত্তরের ব্যবধানটাও যেন তাদের বয়সের মতো। অবশ্য প্রবাল সেনের চলে যাওয়ার তাগাদা বলছে তিনি কিছু ভেবে কথাটা বলেননি। মূল ব্যাপারটা হলো পাখি মারার বন্দুক হাতে তিনি শিকারকে সব সময় মৃত ভাবেন, সেখানে অন্যরা কী ভাবলো সে ভাবনা অবান্তর। তবে ইমা ঠিক বলেছে। আর কেউ না ভাবুক প্রবাল সেন নিজেকে ডাকাতই মনে করেন।

 

খানিক নীরবতার পর ইমা তার আঁচলের অর্থহীন নিরাপত্তা কুঠুরি থেকে একটা চিরকুট বের করলো। চিরকুটে যত্ন করে লেখা কথাগুলো প্রবাল সেনের কাছে অর্থহীন কিনা তা বোঝার অভিজ্ঞান ইমার হয়নি। তবু মনে করে প্রতিদিন এই সময়ে একই চিরকুট সে প্রবাল সেনকে দিয়ে আসছে।

চিরকুট নিতে প্রবাল সেন হাত বাড়ান না। ইমাই তার প্যান্টের পকেটে গুঁজে দেয়। এরপর কিছু না বলে শালিকের মতো চটজলদি জায়গাবদল। দৃষ্টিসীমার মধ্যে যতোক্ষণ প্রবাল সেনকে দেখা যায় ততোক্ষণ ইমা নিজেকে শালিক ভেবে নেয়।

 

চিরকুট গুঁজে দেয়ার দৃশ্য কেউ দেখল কিনা তা নিয়ে ভাবেন না প্রবাল সেন। হাতে বন্দুক থাকলে তার অনেক কিছুই ভাবতে ইচ্ছে করে না।

ইমার দৃষ্টিসীমার বাইরে গেলে চিরকুটে একপাক চোখ বুলিয়ে নেন। একই জায়গায় দাড়ি কমাগুলো ঠায় দাঁড়িয়ে। প্রত্যেকবার একই বানান ভুল। প্রবাল সেন জানেন কী লেখা আছে, তবু পড়েন। চিরকুটে নতুন কিছু লেখা আশা করেন কিনা তা বোঝার উপায় নেই। হাতে বন্দুক থাকলে প্রবাল সেন মাঝে মাঝে নিজেকেই বুঝতে পারেন না।

রাত দ্বিপ্রহরের পর বিলের পাশের জঙ্গলে বেড়াতে যান প্রবাল সেন। আগে এমনি এমনি গেলেও এখন অনেকটা বাধ্য হয়েই বেরিয়ে পড়েন। প্রবাল সেনের সহসা ঘুম আসে না। এদিকে রাত হলেই বেঞ্জামিন চাচার ভীতিকর গোঙ্গানি ক্রমে অসহনীয় হয়ে ওঠে। প্রবাল সেনের তখন ইচ্ছে হয় পাখির মতো বুড়ো বেঞ্জামিনটাকেও চুপ করিয়ে দিয়ে আসে।

 

তবে বিলের পাশে দাঁড়াতেই আবার সব মনে পড়ে তার। প্রতিরাতেই মনে পড়ে। তাজা রক্তের মতো মতো সব ঝকঝকে দৃশ্য। ঐ বেঞ্জামিন চাচার কাঁধে চড়ে প্রথম স্কুলে যাওয়া। চাচাই তাকে ঘুঘু আর বক চেনায়। এরপর কিশোর বয়সে দোনলা বন্দুকে কার্তুজ ঢোকানো। সেই সময় থেকেই প্রবাল সেনের পিছু নিয়েছিল ইমা। তখন অবশ্য শিকার করা পাখির নিয়ে যাওয়ার আশায় ঘুরতো। এখন নিজেই প্রবাল সেনের অবহেলার শিকার হতে রোজ অপেক্ষায় থাকে। বেঞ্জামিন চাচার সাপেক্ষে তাই প্রবাল সেন ও ইমা দুজনই এখন বড় হয়েছে।

 

বিলের পানিতে আধখানা চাঁদ। পানির দিকে চেয়ে প্রবাল সেন ঠায় দাঁড়িয়ে অহেতুক ভাবছিলেন। এখন নিজেকে তার একটা শ্যামলা বক মনে হচ্ছে। অদেখা শিকারির ভয়ে শিউরেও উঠলেন। বিলের ওপারে একা নারকেল গাছটা যদি হয় নিশানার কাঁটা, তবে দূরের উঁচু উঁচু টিলা দুটোর ফাঁক দিয়ে নিশ্চয়ই কেউ একজন সমান্তরালে চোখ রাখার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

 

দ্রুত অন্যদিকে মন ফেরালেন প্রবাল সেন। অন্যদিকে ঘোরাতেই মাছরাঙার মতো উড়ে আসে ইমা। এরপর শত চেষ্টা করলেও সে যেতে চায় না। কল্পনায় প্রবাল সেন ঐ মাছরাঙাকে বন্দুক উঁচিয়ে ভয় দেখান। এরপর শুরু হয় পাখির অশরীরি হাসি। মাঝে মাঝে বিশেষ অর্থবোধক শীষ দেয়। প্রবাল সেন বুঝতে পারেন, যার অর্থ, কী শিকারি! শিকার করবে না? প্রবাল সেন একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে বিলে ভাসতে থাকা অর্ধেক চাঁদ বরাবর ঢিল ছোড়েন। মুহূর্তে অর্ধেক চাঁদ ভেঙে অসংখ্য টুকরো। শব্দ শুনে পেছনের সুপারি বন থেকে খিস্তি আওড়াতে আওড়াতে একটা ডাহুক উড়ে যায়। প্রবাল সেন ওদের নিয়ে তেমন একটা ভাবেন না।

 

বিশেষ কোনো কারণ নেই, তবু চিরকুটের নির্দেশ অমান্য করেন না প্রবাল সেন। অথবা বলা যায়, তার অমান্য করার ক্ষমতা নেই। কেননা, শিকারে যাওয়ার সময় ইমার অপেক্ষার স্থানটুকু তাকে মাড়াতেই হয়।

– কাল বুঝি রাত জেগেছো?

প্রবাল সেন স্বভাবসুলভ নিরুত্তর।

– তুমি কি শুধু পাখিই মারবে? বাঘ ভালুক মারবে না?

প্রবাল সেন এবারও কিছু বললেন না। আজ তার বন্দুক ফাঁকি দিয়ে দুটো বক পালিয়েছে। রোদের তেজে দৃষ্টিভ্রমের কারণে হতে পারে।

ইমার কথার মাঝে কেমন যেন দূরে কোথাও ট্রেন চলে যাওয়ার আভাস পেলেন প্রবাল সেন। কিন্তু তার কিছু জানতে ইচ্ছে করে না। পাল্টা কোনো প্রশ্নও করেন না।

 

রাস্তাটা অনেকদূর পর্যন্ত নির্জন। দুপাশে অনেক পাখি। তবে ইমার সামনে কখনো টার্গেট করেন না প্রবাল সেন।

পাশাপাশি আধমাইল হেঁটে যাওয়ার পরও ক্লান্তি নেই ইমার চোখে। আছে পড়ন্ত বিকেলের বিষণ্নতা। প্রবাল সেনের শিকারি চোখে কিছুই এড়ায় না। ইমা এখনো ভালমতো অপেক্ষা করতে শেখেনি।

– দেখি তোমার জন্য ঘুঘু না হলেও বক নিয়ে আসবো।

প্রবাল সেনের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন বিষণ্ন ভরা বিদ্রƒপের হাসি দিল ইমা।

– আমার ঘুঘু চাই। পারলে ওটা নিয়ে এসো।

 

প্রবাল সেন আড়চোখে পাশের মেহগনির দিকে তাকালেন। খুব কাছেই একটা ঘুঘু বসে আছে। শিসার বুলেট ছুঁতে হাত নিশপিশ করছে। তারপরও একটা কিছু ভেবে আর নিশানা করলেন না। ব্যাপারটা টের পেল না ইমা। সে মাথা নিচু করে হাঁটছে। মাঝে মাঝে প্রবাল সেনের গতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না। দৌড়ে আসতে হচ্ছে।

– এতো জোরে হাঁটো! পাশাপাশি হাঁটার জন্য লোক নেই তো, তাই!

– তার দরকার নেই।

– আরেকজনের তো থাকতে পারে।

প্রবাল সেন আবারো নিরুত্তর। ইমাও উত্তরের অপেক্ষা না করে আঁচলে হাত দিল।

– নাও।

প্রবাল হাত বাড়ালেন না। তবে আজ ইমাও চিরকুট গুঁজে দিচ্ছে না। বাড়িয়ে ধরে আছে। প্রবাল সেনের ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছে হয়তো। কেউই জিতলো না। দূরে লোক আসতে দেখে চট করে চিরকুট লুকিয়ে ফেলল ইমা। প্রবাল সেন তা দেখেও না দেখার ভাণ করলেন। ইমা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, কাল চারটায় এসো। আমি গেলাম।

 

সেদিন চারটায় ইমা আসেনি। পরের দুদিনও আসেনি। প্রবাল সেন খবর নিয়েছেন তারও দুদিন পর। ইমার নাকি অসুখ করেছে। কিন্তু কী তা কেউ বলেনি। শিকারি হয়েও প্রবাল সেনের হঠাৎ মনে হলো তিনি অনেক কিছু দেখেন না। ইদানীং তাই বকরাও বেঁচে যাচ্ছে। ইদানীং প্রবাল সেনকে তারা ভয়ও পাচ্ছে না।

তবু শিকারির চোখ। একদিন ঠিকঠাক বাগে পেলেন ঘুঘুটাকে। কাউকে নিতে দিলেন না। কিশোরের দল মুখ বাঁকিয়ে চলে গেলো। প্রবাল সেন হাতে রক্তাক্ত ঘুঘুটাকে নিয়ে হাঁটছেন লম্বা রাস্তা ধরে। বিড়বিড় করে নিজেই দুবার আওড়ালেন, ইমা খুব খুশি হবে, খুব।

প্রবাল সেন আজও হাঁটছেন ঘুঘু হাতে। খবরটা শুনেছেন আগেই। তবু হাঁটছেন। ইমা চলে গেছে দ্বিপ্রহরের চাঁদ ভেজা বিলের মতো রহস্যময় কোথাও। প্রবাল সেন তবু হাঁটছেন লম্বা রাস্তা ধরে। শিকারিকে নিজের উপর বিশ্বাস রাখতে হয়। তাই প্রবাল সেন বিশ্বাস করছেন চিরকুট হাতে কোথাও না কোথাও একজন তার অপেক্ষায় আছে।

 

লেখক: ধ্রুব নীল

 

storiesstoryগল্পধ্রুব নীলরোমান্টিক গল্প