রোমান্টিক প্রেম ও বিরহের উপন্যাস : তাহার বৃষ্টি
নাবিলা জাহান
ভয়ংকর মেঘ জমতে শুরু করেছে। যে কোনো সময় বৃষ্টি আসবে। সাধারণ বৃষ্টি না। মুষলধারে বৃষ্টি।
পরপর তিনবার কপালের ঘাম মুছল শিপু। গরম মোটেও পড়ছে না বরং ঠাণ্ডা বাতাসে চুল কিছুটা উড়ছে। কালো সানগ্লাসের কারণে তার চোখ দেখা যাচ্ছে না, তা না হলে দেখা যেত চোখ দুটোকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে সে।
ব্যাগের মধ্যে হাত দিতেই চোখ কুঁচকে যায় শিপুর। হঠাৎ হঠাৎ ফট্ করে চোখ কুঁচকে ফেলার অভ্যাস আছে তার। সানগ্লাস ব্যাগের মধ্যে ঢোকানো। সানগ্লাসের কোন দরকারই নেই এখন, এমনিতেই অন্ধকার।
ভাংতি ট্যাকা দেন
-কোত্থেকে দেবো? ভাংতির মেশিন আছে নাকি!
-হেইডা আমি কেমনে জানি! ভাংতি দিবার আছে দ্যান!
-ভাংতি নেই!
-খুঁইজা দেখেন
কলাপাতা রংয়ের শাড়ির সাথে লাল ব্লাউজ পরেছে শিপু। ঠোঁটে লিপষ্টিক নেই। শুধু কপালে একটা নীল টিপ। চুল দেখে মনে হচ্ছে অনেক সময় নিয়ে আঁচড়ানো হয়েছে সেগুলো। অন্যসময় হলে অসংখ্য চোখজোড়া তার গায়ে লেগে থাকত। কিন্তু যেকোন সময় বৃষ্টি আসতে পারে। সবাই ব্যস্ত হয়ে এদিক সেদিক চলে যাচ্ছে। অসম্ভব রূপবতী শিপুর দিকে কেউ তাকাচ্ছে না।
পাঁচশো টাকার একটা নোট নিয়েই বেরিয়েছে শিপু। তার ব্যাগ দেখে মনে হবে একব্যাগ পাহাড় বয়ে বেড়াচ্ছে। অনায়াসে পুরো একটা সংসার ঢুকিয়ে রাখা যাবে তাতে।
কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘাড় ঘোরালো শিপু। সব দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। খোলা থাকলেও বিশেষ কোন কাজ হতো বলে মনে হল না। একশ টাকার ভাংতি চাইলে আগ্রহ সহকারেই দিত সবাই, তার জন্য যথেষ্ট সুন্দরি সে। কিন্তু পাঁচশো টাকার জন্য বোধহয় নয়।
-তাড়াতাড়ি করেন, তুফান আইয়া পড়লো!
শিপু ভয়ংকর ভাবে চোখ কোঁচকানোর চেষ্টা করে। রিকশাওয়ালা জানে তার কাছে ভাংতি নেই, এরপরও বলছে তাড়াতাড়ি করতে, “ব্যাটা ফাজিল!”
ঘাড় ফেরাতেই শাহেদকে দেখতে পায় শিপু। কেন যেন সন্ন্যাসী ভাব নিয়ে দুলতে দুলতে আসছে। তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে, আজ কি হতে যাচ্ছে! শিপু ভাবছে, সে এতক্ষণ শান্ত থাকার অভিনয় করে এসেছে। শাহেদও কি নির্বিকার হবার ভান করছে? শান্ত থাকার চেয়েও নির্বিকার হবার ভান করা সহজ। শাহেদ কি সহজ সরল কোন অভিনয় করছে?
রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুল কিনছে শাহেদ। বিরক্তিতে তৃতীয়বার চোখ কুঁচকায় শিপু। তার ইচ্ছে করছে চিৎকার করে শাহেদকে ডাকে। শিপুকে দেখে শাহেদের কোন ভাবান্তর হল না। এই ব্যাপারটা অসহ্য লাগে শিপুর। তার ধারণা তাকে দেখে একটু অপ্রস্তুতের হাসি হাসবে, আবার একটু অসহায় ভাবে এদিক সেদিক তাকাবে। কেন না, তার এখানে আসাটা নিতান্তই ঝোঁকের মাথায় নেয়া সিদ্ধান্ত। শাহেদ কি ধরেই নিয়েছিল সে আসবে! যদি এমনই ভেবে থাকে সে–
-ধর তোমার জন্য–
হাত বাড়িয়ে ফুল গুলো নেয় শিপু। তার চোখ এখনও স্বাভাবিক হচ্ছে না। এখনও কুঁচকে আছে।
-এমন ভাবে তাকাচ্ছো কেন?
-দশটা টাকা দাওতো! ভাড়া দিতে পারছি না!
শাহেদ আবারও নির্বিকার। তার পকেটে দশ টাকাই ছিল। ফুল কিনে ফেলেছে।
-নীল টিপ দিয়েছো কেন? মোটেও মানায়নি! লাল টিপ দেওয়া উচিৎ ছিল।
শিপু একটু হাসার চেষ্টা করে।
-তোমার কাছে টাকা নেই?
-দশ টাকা ছিল, গোলাপ কিনে ফেলেছি, ডিমান্ড বুঝে দামটা দিল বাড়িয়ে, দুটো গোলাপ মাত্র, দশ টাকার কমে দিবেই না!
-বিয়ে করতে এসেছো দশ টাকা নিয়ে?
বাতাস আরো বেড়ে গেছে। মাঝে মাঝে দুয়েক ফোঁটা বৃষ্টিও পড়ছে। শাহেদ ঘাড় ঘুরিয়ে আকাশ দেখে।
-এতো ভয়াবহ অবস্থা! তুমি আসলে কী করে!
শিপু কড়া একটা কথা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই রিকশাওয়ালা তাগাদা দেয়।
-আফা ট্যাকা দিলে দ্যান! না দিলে আমি যাইগা!
শিপু পাঁচশো টাকার নোটটা এগিয়ে দেয়।
-নিন্, পুরোটাই নিন্!
রিকশাওয়ালাকে চমকে উঠতে দেখা গেল না। সেও মাঝে মধ্যে ঘাড় ঘুরিয়ে আকাশ দেখায় ব্যস্ত। টাকাটার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না।
-কি হল নিন্!
-লাগবো না।
-লাগবো না মানে!
শিপুকে অবাক করে দিয়ে অতিদ্রুত প্যাডেল চালিয়ে রিকশাওয়ালা চলে যায়। সাবলীল ভঙ্গিতে আবার নোটটাকে ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখে সে। শাহেদ মৃদু মৃদু হাসছে। ঘটনা উপভোগ করেছে সে।
-হাসছো কেন?
-এমনি
-অসহ্য!
হালকা বৃষ্টি পড়া শুরু হয়েছে। শিপুর মুখ ভিজে চুইয়ে চুইয়ে পানিও পড়ছে। রুমাল দিয়ে মুখ মুছে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে সে। শাহেদের দিকে তাকাচ্ছে না এখন।
-এবার তাহলে যাওয়া যাক।
-নাও ব্যাগটা ধর।
-জিজ্ঞেস করলে না কোথায় যাবো?
শিপু ঠোঁট বাঁকিয়ে রহস্যময় ভঙ্গীতে হাসে।
আকাশের অবস্থা ক্রমেই ভয়াবহ হতে শুরু করেছে। তবে বৃষ্টি পড়ছে না ততটা। হেঁটে চলে যাওয়ার মত। শিপু হাঁটছে শাহেদের বাঁ দিক ঘেঁসে। ব্যাগটাকি ইচ্ছে করেই বাঁ হাতে নিয়েছে শাহেদ? ব্যাগটা ডান হাতে নিলেও পারত সে। তাহলে তার ডান হাতটা ধরতে পারত সে। তা না, বাঁ হাতেই ব্যাগ নিয়েছে। শিপুর ইচ্ছে হল বলে, ব্যাগটা ডান হাতে নাও। কিন্তু বলতে পারল না, থাক।
আসার সময় ছাতা নিয়ে আসেনি সফিক। মাঝে মাঝেই গজ গজ করে আকাশের দিকে তাকাচ্ছে। তৃতীয়বার আকাশের দিকে তাকাতেই শাহেদকে চোখে পড়ে তার। শিপুর দিকে কয়েকবার আড়চোখে তাকায়। ভয়ংকর সুন্দরি দেখাচ্ছে তাকে। এমন একটা সুন্দরি মেয়েকে ভাবী বলে ডাকতে হবে, আফ্সোস্ হয় তার।
-কিরে! শা– তুই!
শিপুর দিকে তাকায় সফিক। শিপুও বোকার মত একটু হাসে। সুন্দরি মেয়ের বোকা হাসি দেখে স্বয়ং সম্রাট এডওয়ার্ড পরাস্ত হতে বাধ্য, আর সফিকের কথা না বললেই চলে।
-সব রেডি? রহস্যময় কণ্ঠে বলে শাহেদ। শিপু আবার চোখ কুঁচকে তাকায়।
-হ্যাঁ, শুধু তোদের জন্যই অপেক্ষা করছি।
শিপু চোখে প্রশ্ন নিয়ে শাহেদের দিকে তাকায়। শাহেদ চোখ নাচিয়ে হাসে, কিছুটা বাচ্চা ছেলের মত। যেন অনেক কিছু করে ফেলেছি।
খুব সহজেই অনেক বড় একটা কাজ হয়ে গেল। সফিক আর তার দুসম্পর্কের এক খালা থাকে দুজন সাক্ষী। আর অনেক কষ্টে নগদ দুহাজার টাকার বিনিময়ে সংগ্রহ করা একজন মৌলানা। খালার বাসাতেই বিয়ের আয়োজন করা হল।
খালার নামটা অদ্ভুত, সফিক ডাকছে -জরু খালা বলে, শিপুও নির্বিদ্বায় জরু খালা ডাকা শুরু করে দিল। খালা অনবরত পান খাচ্ছেন। পান খেতে খেতে বলছেন,
-সবাইকে ভাগিয়েছি, বিয়েটা হোক ভালয় ভালয়, শোন্ মেয়ে নিজের বাড়ির মত ভাববি, গলা ভেজাতে চাইলে ফ্রিজে কোক আছে, ইচ্ছে মত নিবি আর খাবি, হু কেয়ারস্!
শিপু হু কেয়ারস্ ভাব নিয়ে ঢক্ ঢক্ করে দুগ্লাস কোক খেয়ে ফেলল। খাওয়ার পর মনে হল দুগ্লাস খাওয়া ঠিক হয়নি, ভয়ংকর হেঁচকি উঠতে পারে।
-খালা আমাকে কেমন লাগছে?
-সুন্দর লাগছে না।
-কেন?
-তোকে শুধু সুন্দর লাগছে না, বেশি সুন্দর লাগছে।
-ও।
-বিয়ের সময় মেয়েদের এমনিতেই রূপ খোলে।
-বিয়ের সময় রূপ খোলে কেন? অন্যসময় খুলতে সমস্যাটা কী?
-ওসব বুঝবি না! এখনও কাঁচা বয়স!
-আমার বয়স মোটেও কাঁচা নয় খালা, আমি বড় হয়ে গেছি, বয়স পেকে গেছে, দেখছো না কেমন পালিয়ে বিয়ে করছি!
-পালিয়ে বিয়ে করা টেকসই হয় না। তবে তোকে দেখে মনে হচ্ছে টেকসই হবে।
খালার কথায় অতটা মন দিতে পারছে না শিপু। শাহেদ কোথায় যেন বেরিয়ে পড়েছে। তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শিপুর ছোট্ট একটা সন্দেহ হচ্ছে শাহেদ ফিরবে সন্ধ্যার পর, ফিরেই বলবে, -ইন্টারভিউ দিয়ে আসলাম, বোধহয় এবারও হচ্ছে না। তারমানে বিয়েটাও হচ্ছে না।
শিপুকে তখন হাসি হাসি মুখ করে বলতে হবে, আমাকে একটা ট্যাক্সি ঠিক করে দাও।
শাহেদ একটু পরেই ফিরে আসলো। কী জন্যে বেরিয়েছিল বুঝতে পারছে না শিপু। নিজের ওপর একটু রাগ হচ্ছে তার। অযথা শাহেদকে সন্দেহ করে ফেলেছে। অলক্ষুণে ঘটনা! বিয়েটা টেকসই হবে কিনা তা নিয়েও খানিকটা ভেবে ফেলেছে শিপু। গলার কাছে একটা হেঁচকি এসে আটকে আছে তার। বিয়ের সময় হেঁচকি ওঠা কি অলক্ষুণে কিছু?
শাহেদকে মোটেও নার্ভাস দেখাচ্ছে না। শিপুও চুপ করে বসে আছে, যেন কিছুই হয়নি। বিয়ে হওয়ার ছিল হয়েছে। শাহেদ বেরিয়েছিল টুপি নিয়ে আসতে। টুপি বড় হয়ে গেছে। বারবার কপাল ঢেকে যাচ্ছে। আর বারবার ঠেলে উপরে তুলতে হচ্ছে সেটা। শিপুর ভয়াবহ হাসি পাচ্ছে। কিন্তু এখন হাসার সময় নয়। হাসিগুলো অল্প অল্প করে জমছে। যে কোন মুহূর্তে বিস্ফোরণ হতে পারে।
**
চায়ের কাপে চুমুক দিতেই রহিমুল্লাহ সাহেবের মেজাজ তিরিক্ষী হয়ে যায়। সম্প্রতি রিটায়ার নিয়েছেন। বয়স ষাট পেরুলো। ঘটনা আর বয়স দুটোই মেজাজ খারাপ করার মতো।
চিনির বদলে লবণ দেওয়া হয়েছে। কাপটা একটু উঁচুতে তুললেন তিনি। সবগুলো চা প্রথমে মেঝেতে ঢাললেন, তারপর আস্তে করে কাপটা ছেড়ে দিলেন। নীলুকে দেখেই একটু লজ্জা পেয়ে গেলেন রহিমুল্লাহ সাহেব। নীলুর হাতে চায়ের কাপ।
-ধরো, এইবার চিনি দেওয়া হয়েছে।
মেঝেতে লবণ দেওয়া চা গড়াগড়ি খাচ্ছে। তার সাথে কাপের ভাঙা টুকরো। রহিমুল্লাহ সাহেব ভাঙা টুকরোগুলোর দিকে লজ্জিত চোখে তাকিয়ে আছেন। কাপটা না ভাঙলেও চলতো।
নীলু কি তার কাপ ভাঙ্গার দৃশ্যটা দেখে ফেলেছে? নীলুকে তিনি খুবই পছন্দ করেন। তার এই মেয়ে যেন হঠাৎ করেই অনেক বড় হয়ে গেছে।
বলা নেই কওয়া নেই ফট্ করে একদিন শাড়ি পরে এসে তাঁকে সালাম করে বসলো।
নীলু বসে বসে কাচ ভাঙা তুলছে। রহিমুল্লাহ সাহেবের খুব ইচ্ছে হল বলতে, -আস্তে আস্তে তোল্, হাত কেটে যাবে! কিন্তু লজ্জার কারণে বলতে পারলেন না।
-চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে বাবা।
রহিমুল্লাহ সাহেব হাতে চায়ের কাপ নিলেন। কিন্তু চুমুক দিতেও তাঁর লজ্জা করছে।
-তুমি এমন করে দেখছো কেন বাবা? চায়ের কাপ ভাঙা কোন অপরাধ না। আমিও যাচ্ছি, আমারটাও ভাঙতে হবে। নীলু মুখে ওড়না দিয়ে হাসতে লাগলো।
রহিমুল্লাহ সাহেবের মেজাজ সাথে সাথে ভাল হয়ে যায়। তাঁরও একটু হাসতে ইচ্ছে হল।
-একটু বোস মা!
-পারব না, সময় নেই।
নীলুর কাজ শেষ। সে এখন চলে যাবে। বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। চায়ের কাপে খুব আয়েশ করে চুমুক দেন রহিমুল্লাহ সাহেব।
-এমন বিশ্রী করে চা খাও কেন বাবা?
-শাহেদ গাধাটা কোথায়? বৃষ্টি বাদলার দিনে বাইরে এত কাজ কিসের!
রহিমুল্লাহ সাহেব অন্যদিকে তাকিয়ে কথাটা বললেন। তা না হলে দেখতে পেতেন নীলুর চেহারা ক্ষণিকের জন্য মলিন হয়ে গিয়েছিল।
-আমি কী করে বলবো! আমি কি সবার খবর নিয়ে বেড়াই নাকি!
-বাইরে যা অবস্থা! কোথায় যে গেল!
নীলু জানে এসব অর্থহীন কথা। শাহেদ কিছুক্ষণের মধ্যে ঠিকই এসে পড়বে। বৃষ্টিতে ভিজে চুপসে হয়ে আসবে। এসেই বলবে, -গরম গরম চা! নীলু বিড় বিড় করে বলে, -চা চা করোনা, আগে ভেজা কাপড় পাল্টাও!
-কী বলছিস্ মা?
বৃষ্টির কারণে রহিমুল্লাহ সাহেবের মন কিছুটা ভাল। কিছুক্ষণ পর পর ঝাল মুড়ি দিয়ে চা খাওয়া যাবে। সাথে পুরনো চানাচুর। পুরনো চানাচুরের স্বাদ অন্যরকম। চায়ের সাথে খেলে অমৃত সমান। মন ভাল থাকার কারণেই বোধহয় নীলুকে বারকয়েক মা বলে সম্বোধন করলেন। নীলু একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায়। ধরা পড়ে যাওয়ার ভঙ্গি করে দ্রুত কাপের টুকরোগুলো নিয়ে চলে যায়। অপ্রস্তুত অবস্থায় ধরার জন্যই বোধহয় ডান হাতের মধ্যমার কিছুটা কেটে যায়। রহিমুল্লাহ সাহেব আয়েশী ভঙ্গীতে বলেন, -নাহ্ গাধাটা আসলেই একটা গাধা!
**
ঘোমটা দেওয়া একটা মেয়ে ঘরে ঢুকেই কোন কথা না বলে টপ্ করে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে বসলো। রহিমুল্লাহ সাহেব চমকে উঠলেন। ভাগ্যিস চায়ের কাপটা হাতে ছিল না। না হলে দ্বিতীয় দফায় কাপ ভাঙা হতো। প্রথমে ভাবলেন, আজ বুঝি তার মেয়ে নীলুর জন্মদিন।
জন্মদিনে নীলু এমন পাগলামী করে বসে। সেজেগুজে এসে সালাম করে চমকে দেবে। রহিমুল্লাহ সাহেব মনে করতে পারলেন না আজ কত তারিখ। তাঁর স্মৃতি শক্তি ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। মেয়েটা মাথা নীচু করে থাকায় চেহারা দেখতে পারছেন না। পাশে ঘাড় কাত করে শাহেদ দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল মেয়েটিকে নিয়ে আসার। সে তার দায়িত্ব পালন করেছে। এখন বান্দা হাজির। পরবর্তী আদেশের অপেক্ষায় আছে।
জেবুন্নেছা বেগম এগিয়ে আসতেই একটা ধাক্কা খেলেন। সুন্দরি একটা মেয়ে ভিজে একাকার হয়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পরবর্তী ধাক্কটা খেলেন যখন মেয়েটা তাকে সালাম করতে এগিয়ে আসলো। তাঁর হাতে কেরোসিনের টিন, তা না হলে বলতেন, -না থাক্, সালাম লাগবে না কিন্তু হঠাৎ বিস্ময়ের কারণে কথাটা বলতে পারলেন না। সবার আগে যে কথাটা বলার প্রয়োজন বোধ করলেন তা হল,
-ভেতরে এস, ভেজা কাপড়ে থাকা ঠিক না, কাপড় পাল্টাতে হবে
শিপু এমনই কিছু একটা আশা করছিল। সময় নষ্ট না করে জেবুন্নেছা বেগমের পেছন পেছন চললো সে। শাহেদের কোন ভাবান্তর নেই। রহিমুল্লাহ সাহেব সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাঁর ভাইয়ের ছেলেকে দেখতে লাগলেন। তাঁর কেন জানি মনে হচ্ছে, ছেলেটা মোটেও গাধা না, গাধা হবার ভান করছে! ঘুঘুর ভান বের করতে হবে!
-শোন্
শাহেদ তার জুতার ফিতে খুলছিল। ডাক শুনে ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়। রহিমুল্লাহ সাহেব তাঁর কণ্ঠটাকে কিছুটা কঠোর করার চেষ্টা করলেন।
-মেয়েটা কে?
-আমার বৌ।
শাহেদের উত্তরের ধরন শুনে বিষ¥য়ে বাক্রুদ্ধ হবার অবস্থা হল তাঁর। তাঁর মুখ দিয়ে হড়বড় করে অনেকগুলো কথা এসে যাচ্ছিল। অনেক কষ্টে নিয়ন্ত্রন করলেন নিজেকে। মনে মনে বললেন, -হারামজাদা! তোর বিয়ের শখ বের করব!(যদিও বিয়ে হয়ে গেছে, তবু তিনি তা ভাবতে পারছেন না)।
-মেয়ের নাম কি?
প্রশ্নটা করেই বুঝলেন প্রশ্নটা করা ঠিক হয়নি। তাঁর উচিৎ ছিল মেয়ের বংশ জিজ্ঞেস করা। কোথাকার কোন মেয়ে কে জানে! রাস্তার মেয়ে কিনা!
-শিপু।
রহিমুল্লাহ সাহেবের ইচ্ছে হল শাহেদের গালে শব্দ করে একটা চড় বসিয়ে দেন। নাম জিজ্ঞেস করলে পুরো নাম বলতে হয়, এই গাধাটা তাও শিখেনি!
-পুরো নাম বল্!
শাহেদ একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায়। শিপুর পুরো নাম সে জানেনা। কখনও জিজ্ঞেস করেনি।
-জানিনা।
-জানিনা মানে!
-কখনও জিজ্ঞেস করিনি।
-কদিনের সম্পর্ক?
-চাচা আমরা কি বেরিয়ে যাবো?
রহিমুল্লাহ সাহেব আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না।
-হারামজাদা বেরুবি মানে এখুনি বেরুবি! আমার ত্রি সীমানার মধ্যে তোকে যেন আর না দেখি!
শাহেদ মোজা জোড়া ভাঁজ করে জুতোর মধ্যে ঢুকিয়ে রাখে। মনে হচ্ছে না সে কিছু শুনতে পারছে। চিৎকার শুনে নীলু দৌড়ে আসে।
-এখন এসব রাখোতো বাবা, পরে আমাকে বলো, আমি ঘাড় ধরে বের করব।
কথাগুলো বলতে বলতে নীলু শাহেদের দিকে তাকায়। নীলুর সূক্ষ্ম দৃষ্টি অগ্রাহ্য করে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে থাকে শাহেদ।
নীলুর হাল্কা আকাশী রংয়ের একটা শাড়ি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে শিপু। তার হাতে নির্দিষ্ট কোন কাজ নেই। নীলুও কোথায় যেন বেরিয়ে গেছে। তা না হলে তার সাথে কিছুক্ষণ গল্প করা যেত। নীলুকে দেখেই শিপুর মনে হয়েছে মেয়েটার মধ্যে অদ্ভুত কিছু একটা আছে। সে এসেছে প্রায় ঘণ্টা তিনেক হল, এর মধ্যে নীলুর সাথে দুবার মুখোমুখি হয়েছে সে। কিন্তু, একটা ছুতো ধরে নীলু রীতিমত পালিয়ে যায় তার সামনে থেকে। শিপু খুব সূক্ষ্ম একটা ব্যাপার আন্দাজ করে নিয়েছে। অবশ্য তাই যদি হয়, তা শাহেদ তাকে অনেক আগেই বলতো। তবু ব্যাপারটা শিপুর মাথা থেকে যাচ্ছে না। বরং আরো গাঢ় হচ্ছে।
রহিমুল্লাহ সাহেব বাজারে গেছেন। যাওয়ার সময় শাহেদকে কি কি যেন বললেন। অবশ্য ভাল না খারাপ কিছু বলেছেন, শাহেদকে দেখে তা বুঝতে পারল না শিপু। শাহেদের জন্য একটু মায়া হয় তার। নীলুর পড়ার টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় শিপু। সুন্দর করে সাজানো গোছানো বই। গোছানো বই দেখতে তার মোটেও ভাল লাগছে না । তার ইচ্ছে করতে লাগলো টেবিলটা এলোমেলো করে দিতে। শিপু বুঝতে পারছে না তার কি খুব খুশী লাগছে? কিন্তু খুশী হওয়ারতো কোন কারণ নেই? শাহেদকে বিয়ে করার মধ্যে আনন্দের কিছু আছে বলে তার মনে হচ্ছে না। চাচার কথাই ঠিক, আসলেই একটা গাধা! হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠে শিপু। মনের মধ্যে বারবার ঢিলে টুপি পরা শাহেদের ছবি ভেসে উঠছে। বারবার হাত দিয়ে টুপি ঠিক করতে হচ্ছে। কিন্তু টুপিটাও বারবার কপাল ঢেকে দিচ্ছে।
জেবুন্নেছা বেগম রুমের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। হাসির শব্দ শুনে ভেতরে তাকালেন। শিপু একা একা হাসছে দেখে ভয় পেয়ে গেলেন তিনি। মানসিক রোগী নয়তো মেয়েটা? পাগলকে তিনি মারাত্মক ভয় পান। একদিনের ঘটনার পর থেকেই,
সেদিনও এমন বৃষ্টি হচ্ছিল। তিনি রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। রাস্তায় আধা উলঙ্গ এক পাগল। যাকে সামনে পাচ্ছে তাকেই কামড়ে দিতে চায়। শেষপর্যন্ত এক কুকুরের পা কামড়ে ধরলো পাগলটা। কুকুরটার চিৎকার ছিল ভয়াবহ। জেবুন্নেছা বেগম দৃশ্যটা সহ্য করতে পারলেন না। সাথে সাথে জ্ঞান হারিয়েছিলেন। অবশ্য ঘটনা তেমন মিলছে না। সুন্দরি একটা মেয়ে সবাইকে কামড়াতে চাইবে, এমনটা বোধহয় সম্ভব নয়। সুন্দরি মেয়েরা পাগল হলে কারণে অকারণে হাসবে, হাসিই তাদের পাগলামীর লক্ষ্মণ, জেবুন্নেছা বেগমের তাই ধারণা। তিনি খানিকটা সন্দেহের চোখে শিপুর দিকে তাকালেন।
নীলুর একটা বইয়ের পাতা ওল্টাতেই কয়েকটা ডায়রীর পাতা চোখে পড়ে শিপুর। মনের এক অংশ বলছে, পড়াটা ঠিক হবেনা! আরেক অংশ খুব বিজ্ঞের সাথে যুক্তি দেখালো, -পড়ে দেখতে পারো, এখানেই হয়তো লুকিয়ে আছে একটা রহস্য!
শেষ পর্যন্ত কাগজগুলো হাতে নেয় শিপু। খুব যত্ন করে লেখা হয়েছে চিঠিটা। হাতের লেখা একদম মাপমতো। কাউকে উদ্দেশ্য করে লেখা হয়েছে চিঠিটা। কিন্তু চিঠিতে কারও নাম লেখা নেই। কে জানে! হয়তো তার স্বভাবই এমন। চিঠিটা পড়বে কিনা ভাবছে শিপু। শেষপর্যন্ত ভাবলো, নাহ্ অল্প একটু পড়ে দেখা যায়। মনের দুর্বল অংশ পরাজিত হল। কাগজগুলো থেকে খুব মিষ্টি একটা ঘ্রাণ বেরুচ্ছে। হয়তো সুগন্ধী কালির কলম দিয়ে লেখা। বোধহয় ঘ্রাণটাও চিঠিটার একটা বিশেষত্ব। পরিষ্কার আর নির্ভূল ভাবে প্রতিটা শব্দ পড়তে পারছে শিপু।
“এই যে শুনুন!,
কি! অবাক হলেন? আচ্ছা বলুনতো অবাক হলেন কেন? আমি চিঠি লিখেছি সে জন্যে? থাক্ উত্তর দিতে হবেনা। আমি বুঝে নেব একটা কিছু। আমি একদমই চিঠি লিখতে পারিনা। এই যাহ্! ভুলেই গেলাম কেমন আছেন আপনি? অবশ্য ভাল থাকার কথা না! আমার চিঠি পেয়েও ভাল থাকবেন?
শিপুর লোভটা একটু বেড়ে গেছে। পুরোটা না পড়ে বোধহয় ছাড়বেনা।
আচ্ছা, ঐ দিন ছাই রংয়ের শার্ট কেন পরেছিলেন বলুনতো? একদম গাধার মত লাগছিল। অং ষরশব ধং ধ পড়সঢ়ষবঃব গাধা। আপনি আবার ভাববেন না যে, গাধার ইংরেজী আমি জানিনা। গাধা হল অংং । এস্ দিয়ে আরো একটা নাম হয়। বলুনতো সেটা কি? কি ভাবছেন? এ্যাস্ দিয়ে কী হয় বের করে ফেলেছেন? এস্ দিয়ে হয় সুইট পেইন। মানে হল মিষ্টি ব্যাথা। ব্যাথা আবার মিষ্টি হয় কি করে! আমিও কি বোকা! কী সব অদ্ভুত কথা বলছি! আপনি অবশ্য বলেছিলেন, -অদ্ভুত মেয়েতো! বলুনতো, কথাটা কেন বলেছিলেন?
হঠাৎ একটা জায়গায় এসে শিপুর খট্কা লাগে। -অদ্ভুত মেয়েতো! শব্দটা কেমন যেন পরিচিত লাগছে। কিন্তু কেন পরিচিত মনে হচ্ছে তা সে বের করতে পারছে না। পাতাগুলোকে চিঠির মত মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে এমনি এমনি লেখা। কাউকে দেওয়ার জন্যেও নয়। শিপু ভেতরে ভেতরে কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করে। কাগজগুলো আবার আগের মত বইয়ের ভাঁজে রেখে দেয় শিপু। বইটাকেও আগের জায়গায় ঠিকঠাক মত রাখে। যাতে কেউ কিছু বুঝতে না পারে। কিন্তু এতক্ষণ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নীলু সবই দেখে। ইচ্ছে করেই রুমে ঢুকেনি এতক্ষণ। শিপুকে হয়তো অপ্রস্তুত করতে চায় না সে। তার হাতে বড় একটা ব্যাগ। কিছু একটা নিয়ে এসেছে সে।
**
এর আগে কখনও স্যূট টাই পরা পাগল দেখেননি রহিমুল্লাহ সাহেব। তাঁর চোখ কুঁচকে গেল। বোঝা যাচ্ছে চোখ স্বাভাবিক হতে একটু বেশি সময় নেবে। পাগলটা হাত পা নেড়ে ট্রাফিক কন্ট্রোলের চেষ্টা করছে।
যদিও রাস্তায় কোন গাড়ি নেই। কয়েকটা রিকশা আছে শুধূ। পাগলের ব্যাপারে কাউকে উৎসাহী হতে দেখা গেল না। রহিমুল্লাহ সাহেবের মন শুধু একটু খুঁতখুঁত করতে লাগলো। তার সুট-টাই পরে অফিসে যাওয়ার খুব শখ ছিল। কিন্তু দীর্ঘ বত্রিশ বছরের চাকরি জীবনে তিনি তা পরতে পারেননি। বেতন পেতেন মাত্র চার হাজার। এখন থেকে পাবেন পেনশন্। নাহ্ রাস্তার পাগল হওয়াই এর চেয়ে ভাল ছিল!
মেজাজ খারাপ থাকার কারণে রহিমুল্লাহ সাহেব বাজারের লি¯টটার কথা ভুলে গেলেন। কেরোসিনের জায়গায় সয়াবিন তেল কিনে ফেলেছেন। সয়াবিন তেলে হবে কেরোসিনের গন্ধ। খাওয়ার সময় মুখকে ভীষণ ভাবে বীকৃত করে বলবেন, -একি রান্না! বীভৎস!
শাহেদের খোঁজ নেই। কোথায় গেছে কেউ বলতে পারছে না। এর মাঝে সফিক এসে একবার তার খোঁজ করে গেছে। সফিক যখন আসে নীলু তখন চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় ঘুরছিল। তখন প্রায় সন্ধ্যা। বারান্দায় কয়েকটা গোলাপের টব ছাড়া আর কোন ফুলগাছ নেই। গাছে এখনও ফুল ধরেনি, দুয়েকটা কলি ধরেছে শুধু। সবকিছুর একটা করে নাম দেওয়ার অভ্যাস থাকলে যেমনটা হয়, গাছগুলোরও একটা করে নাম দেওয়া হয়েছে। টবের গায়ে নাম লেখা আছে। সাদা গোলাপটার মধ্যে লেখা -সমুদ্র আর লাল গোলাপটার মধ্যে লেখা -তুমি, অদ্ভুত নাম! গাছের নাম -তুমি!
সফিক এসেই এমন ভাবে কাশতে থাকে যেন তার ভয়ংকর কাশি রোগ আছে। যক্ষা টাইপের একটা কিছু হবে। নীলু বুঝতে পারে কাশিটা হল অভিনয়। মনে মনে বলে -ছ্যাবলা!।
-তুমি কি বলতে পারো, শাহেদ কোথায় গেছে?
সফিকের বলার ধরন দেখে ভয়ানক হাসি পায় নীলুর। তার মনে হচ্ছে যেন নাটকের শ্যূটিং চলছে। সে ভুল করে হেসে ফেলেছে। এখুনি পরিচালক এসে ধমক লাগাবেন।
-না
-ও আচ্ছা
-বসুন চা খেয়ে যান
সফিক আরেকটা কাশি দেয়। তার উচিৎ ভদ্রতা করে বলা না থাক্ পরে কিন্তু সে তা বলতে পারছে না। তার প্রচণ্ড চা খেতে ইচ্ছে করছে। চা খেলে নীলুর সামনে কিছুক্ষণ থাকা যাবে। নীলুর সামনে থাকতে তার খুব ভাল লাগে। কিন্তু কেন লাগে তা সে জানেনা। মাঝে মাঝে ভাবে প্রেম টেম নয়তো? পরেই ভাবে, নীলু তার প্রেমিকা হিসেবে যুৎসই নয়। প্রেম টেম কিছুই না! নীলু একটু সুন্দরি এই টুকুই!
-কি ভাবছেন?
নীলুর চোখে হাসি ঝিলিক দিয়ে উঠে। তার খূব মজা লাগছে। সে ভাল করেই জানে এই ছ্যাবলাটা তাকে পছন্দ করে। শাহেদের কাছে সে আসেনি। সে এসেছে তাকে দেখতে। কিন্তু চেহারা দেখে মনে হচ্ছে ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের লোক। নীলুর প্রতি খুবই উদাসীন। সুন্দরি হয়েছেতো কি হয়েছে! আমি তাকাবো না! এমন একটা ভাব।
-বাইরে দাঁড়িয়ে কেন? বসুন না!
-না না, আরেকদিন আসবো, এমনি এসেছিলাম, আমি যাই।
সফিক খুব ব্যাস্ত ভঙ্গিতে হেঁটে চলে যায়। চোখ কুঁচকে একবার ঘড়ির দিকেও তাকায়। পুরোটাই নিখুঁত একটা ভান।
নীলু হাসে। শাহেদ ভান করতে পারে না। যা করে তাই স্বাভাবিক। শাহেদের কথা ভাবতেই শিপুর কথা মনে পড়ে নীলুর। তার ভেতরটা কেমন যেন দুলতে থাকে। কেমন যেন একটা কৌতুকের মত মনে হয় ব্যাপারটা। শাহেদ যে এভাবে হুট করে বিয়ে করে বসবে, কল্পনাতেও ভাবেনি নীলু। তার ধারণা ছিল বিয়ের কথা বললেই শাহেদ আকাশ থেকে পড়ে বলবে, -বিয়ে আবার করে নাকি কেউ! কিন্তু শাহেদ আকাশ থেকে পড়েনি। সে বিয়ে করেছে। বড়লোকের এক শিক্ষিত সুন্দরি মেয়েকে। নীলু ঠিক করেছিল আজকে সারাদিন সে আর শাহেদের কথা ভাববে না।
অথচ শাহেদের ভাবনাই তার মাথায় সবচেয়ে বেশী ঘুরপাক খাচ্ছে। চা শেষ হয়ে গেলে আরেক কাপ চা নিয়ে আসে নীলু। বারান্দায় হাঁটতে হাঁটতে প্রথম কিছু দিনের কথা মনে পড়ে তার। ‘তুমি’ গাছে তখন একটা কলি আধ ফোটা হয়ে দুলছিল।
শাহেদের যখন দশ বছর বয়স, তার মা বেগম মমতাজ মারা যান। মৃত্যুর কারণটা রহস্যময়! কেউ বলে বিষ খেয়েছিলেন মহিলা। কেউ বলে ষড়যন্ত্র! গলা টিপে মেরে ফেলেছে কেউ। এরপর থেকেই শাহেদের বাবা রমিজউল্ল্যার মাথায় গণ্ডগোল দেখা দেয়। রাস্তার কুকুর বেড়ালের সাথে কথা বলা শুরু করেন।
-কী রে! ভাত খাস নাই?
-ঘেউ!
-ক্যান যে ওরা বোজে না! ল-খা-
খেতে বললেও কিছু দিতে পারতেন না রমিজউল্ল্যা। কুকুর বেড়ালের একটা দল নিয়ে সারাদিন ঘুরে বেড়াতেন। শেষের দিকে নিজের ছেলেকেও চিনতে পারলেন না। শাহেদকে দেখলেই চেঁচিয়ে উঠতেন,
-এ্যাই পোলা! তুই কেরে? বাপের নাম কী?
শাহেদ শান্ত কণ্ঠে বলে,
-আমার বাবার নাম মোহাম্মদ রমিজউল্লাহ।
-খিদা লাগছে? খাবি? ল খা।
শূন্য হাত বাড়িয়ে দিতেন শুধু। নির্বিকার থাকার স্বভাবটা শাহেদের তখন থেকেই। নীলুদের বাড়িতে আসার পর প্রথম প্রথম খুঁজেই পাওয়া যেতো না তাকে। পাওয়া যেতো ছাদে। ছাদে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকত সে। এজন্য নীলু তার নাম দিয়েছিল -ছাদু মিয়া। শাহেদ ছাদে না গেলে নীলু ছড়া বলতো,
ছাদু মিয়ার ভাঙ্গা ঠ্যাং
ছাদে গিয়ে ধরবে ব্যাং
শাহেদ ছোটকাল থেকেই একটু খুঁড়িয়ে হাঁটতো। বাঁ পাটা একটু খাটো ছিল তার।
নীলুকে ঢুকতে দেখেই শিপু একটু মিষ্টি করে হাসে। কিন্তু হাসির কোন উত্তর পাওয়া গেল না। শিপু কেন যেন একটু অসহায় বোধ করছে। নীলু শিপুর দিকে সরাসরি তাকাচ্ছে না। তার দৃষ্টি টেবিলের দিকে। অনেকটা আদেশের সুরে বলল নীলু,
-আপনাকে একটু পাশের রুমে যেতে হবে, আমি একটু কাজ করব।
শিপুর মনে হল সে কেঁদে ফেলবে যে কোন মুহূর্তে। প্রচণ্ড অসহায় মনে হচ্ছে নিজেকে। শাহেদও নেই যে একটু কথা বলা যাবে।
চোখ সামান্য একটু ভিজে উঠতেই একঝলক হাসি দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় শিপু। তারপর রীতিমত দৌড়ে পালায়। নীলুর কোন ভাবান্তর হয় না। সে তার রহস্যময় কাজ করতে থাকে।
ঘরের মধ্যে পা দিতেই রহিমুল্লাহ সাহেব তাঁর ভুল বুঝতে পারলেন। কেরোসিন আনা হয়নি, মোমবাতিও আনা হয়নি। আর ইলেকট্রিসিটিও চলে গেল তখনই।
কেরোসিনের টিনে সয়াবিন তেল নিয়ে ঘরে ঢুকতে তাঁর লজ্জা করছে। স্ত্রীর কাছে হাসির পাত্র হতে হবে তাঁকে। নাহ্ দেরী করা ঠিক হবেনা। কেউ দেখে ফেলতে পারে। পাশের ড্রেনে সবগুলো তেল ফেলে দিলেন। ফেলতে একটু মায়া হয় তাঁর। এই তেলের দাম নিয়েই একবার দোকানদারের সাথে হাতাহাতি পর্যন্ত হয়,
-তেল কত?
-বেয়াল্লিশ
-বেয়াল্লিশ মানে!
-চাইর দশ দুই বেয়াল্লিশ্
-গতকালই তো চল্লিশ ছিল!
-গতকাল চল্লিশ আইজ বেয়াল্লিশ, গতকাল শেইভ করছেন আইজ দাড়ি উঠছে, মামলা খালাস!
রহিমুল্লাহ সাহেব নিজেকে আর সামলাতে পারলেন না। পাশে রাখা নড়বড়ে টুলটায় সজোরে লাথি মেরে বসলেন।
রান্না ঘরে ঢুকে বাজারের ব্যাগ রাখতে রাখতে বললেন,
-গাধাটাকি সত্যি সত্যিই চলে গেছে নাকি?
জেবুন্নেছা বেগম বেগুণ ভাজি করছিলেন। তেল আনা হয়নি দেখেও কিছু বললেন না। শীতল গলায় উত্তর দিলেন,
-একটা বড় ছেলেকে শুধু শুধু গাধা বলবেন না! শুনতে খারাপ লাগে!
রহিমুল্লাহ সাহেব ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড উৎসাহ বোধ করলেন।
-বলবো, বলবো! একশবার বলবো! গাধা! গাধা! গাধা! গাধা টু দি পাওয়ার হান্ড্রেড!
জেবুন্নেছা বেগম ঘাড় ঘুরিয়ে কড়া চোখে স্বামীর দিকে তাকালেন। ভাজি পুড়ে যাচ্ছে দেখে তাড়াতাড়ি ঘাড় ফেরাতে বাধ্য হলেন। রহিমুল্লাহ সাহেব ভাবেন, তিনি তাঁর স্ত্রীকে মোটেও ভয় পান না। কিন্তু মাঝেই মাঝেই তাঁর স্ত্রীর চেহারা অদ্ভুত হয়ে যায়। তিনি এই অদ্ভুত চেহারাকে খুবই ভয় পান।
-একটু চা করে দিওতো
-দেখছো না কী করছি! বাইরে থেকে খেয়ে আসো!
রহিমুল্লাহ সাহেবের রাগ আরেকটু বেড়ে যায়। কিন্তু রাগ প্রকাশের সাহস তাঁর হল না। সুতরাং গজগজ করতে করতে একটা কিছু বলা যায়। তিনি তাই করলেন।
-চা পাতা কেনা হয়, চিনি দুধ সব কেনা হয়! এরপরও বাইরে থেকে চা খাও! যত্তসব!
ভাজির শব্দের কারণে কথাগুলো জেবুন্নেছা বেগমের কান পর্যন্ত গেল না।
**
শিপু ভয়াবহ চেষ্টা করেও তার কান্না থামাতে পারছে না। কারোর ওপর অভিমানের কান্না নয়। অনেকটা আত্মাভিমানের কান্না। বালিশের অনেকটা ভিজে গেছে। সে প্রাণেপনে চেষ্টা করছে আগের ঘটে যাওয়া মজার স্মৃতিগুলো মনে করতে। কিন্তু মজার স্মৃতি ভাবতে চাইলেই দুঃখের স্মৃতিগুলো ভেসে উঠে। আর ভেতর থেকে কান্নাটা আরো উৎসাহ পায়।
গলা ফুলে উঠে আবার কান্না পায়। দুঃখের স্মৃতি বলতে কিছু টুকরো ঘটনাই তার বেশি মনে পড়ছে। তাদের সম্পর্ক হবার মাস দেড়েক পরের কথা,
সেদিন শিপুর ক্লাশ ছিল দেড়টায়। এবং শাহেদের সাথে তার দেখা হবার কথা বারোটায়। পুরো একঘণ্টা অপেক্ষা করল শিপু। কিন্তু শাহেদের দেখা নেই। পরে, একটা পঁচিশ মিনিটে শাহেদকে হেঁটে হেঁটে আসতে দেখে সে। ভয়ানক মেজাজ গরম হয়েছে শিপুর। শাহেদকে দেখেই ক্লাশে রীতিমত ছুটে চলে যায় সে। শাহেদ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সে ঘড়িতে দেখে বারোটাই বাজে। তার তো দেরী হয়নি! শিপু এমন করল কেন? ভয়ংকর শীত পড়ছিল তখন। সে একটা শার্ট পরেছে শুধু। দুপুরে না খেয়ে প্রায় চার ঘণ্টা সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল শাহেদ। অবশেষে শিপু আসে সেখানে।
-কি ব্যাপার! ভ্যাগাবণ্ড হয়ে গেলে নাকি! দাঁড়িয়ে আছ কেন?
শাহেদ চুপ করে শিপুর দিকে তাকিয়ে থাকে। কি উত্তর দেবে, ঠিক ভেবে পায়না সে। পরে সুবোধ ছেলের মত বলে,
-সরি! আমার ঘড়ি নষ্ট ছিল, সময় মতো আসতে পারিনি।
শিপু তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে শাহেদের দিকে তাকায়। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে একটা সূক্ষ্ম অভিনয় লুকিয়ে ছিল। শাহেদ তা ধরতে পারে না।
-এতক্ষণ বসে আছ কেন?
বলেই ঘড়ি দেখে শিপু। সন্ধ্যে হয়ে আসছে প্রায়।
-এমনি।
শাহেদকে কেমন যেন অসহায়ের মত লাগে। শিপুর দিক থেকে চোখ সরিয়ে অন্য দিকে তাকায়।
-এমনি মানে! যাও! সন্ধ্যা হয়ে গেছে, আমি চলে যাবো।
শাহেদ আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়। পকেটে হাত দিয়ে একটা শুকিয়ে যাওয়া গোলাপ বের করে। গোলাপটা শিপুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
-হ্যাপী বার্থডে টু ইউ মিস্ শি-
হ্যাপী বার্থ ডে হলেও পরিস্থিতি ততটা হ্যাপী নয়। শিপু হাত বাড়িয়ে গোলাপটা নেয়। শিপু বুঝতে পারছে না সে কি করবে। তার মাথা কেমন যেন ঘুরতে লাগলো। হাত পা সব অবশ হয়ে আসছে যেন। শাহেদ ছোট ছোট পা ফেলে ততক্ষনে অনেক দুর চলে গেছে। চিৎকার করেও আর ডাকা যাবেনা। তবু শিপুর তখন ইচ্ছে করছিল চিৎকার দিয়ে বলতে, -আই লাভ ইউ শাহেদ, ফর এভার এণ্ড এভার। কিন্তু অনেক ইচ্ছে আছে যা ইচ্ছে হয়ে থাকাতেই আনন্দ। শিপু চিৎকারটা দিতে পারল না।
-ভেতরে আসবো?
রিনরিনে একটা কণ্ঠ শুনতে পায় শিপু। বালিশের মধ্যে তাড়াতাড়ি চোখদুটোকে ঘষে মুছে নেয়। নীল টিপ পুরো কপালে লেগে গেছে। দুষ্টু একটা মেয়ের মত লাগছে তাকে। দরজার কাছে তের চৌদ্দ বছর বয়সী একটা মেয়ে। শিপুর দিকে একরাশ কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে আছে। শিপু তার সেই বিখ্যাত মিষ্টি হাসি দিল। হাসি দেখে মেয়েটা বুঝলো সম্মতির লক্ষ্মণ। ঘরের মধ্যে ঢোকার ভঙ্গী দেখে মনে হয়, বয়সের তুল নায় নিজেকে একটু বেশী বুদ্ধিমতী ভাবে মেয়েটা।
-তুমি আরিফা, তাই না?
মেয়েটি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে। খুব দ্রুত। শিপু হতে বাড়িয়ে আরিফার হাত ধরে তাকে পাশে বসায়।
-তুমি কাঁদছিলে কেন?
আরিফার কাছ থেকে -তুমি সম্বোধন শুনে ভীষন ভাল লাগে শিপুর। প্রশ্ন শুনে একটু হাসে শিপু।
-তুমি কোথায় ছিলে এতক্ষণ?
প্রশ্ন এড়িয়ে যায় শিপু।
-এই মাত্র খালার বাসা থেকে এলাম, উহ্ অসহ্য! কই বললে নাতো? কাঁদছিলে কেন?
শিপু একটু অন্যমনস্ক হয়ে যায়।
-চোখে ময়লা হয়েছিল, ময়লা পরি®কার করার জন্য কাঁদছিলাম।
-উঁহু, এসব গল্প উপন্যাসের কথা বললে হবেনা! আমাকে সত্যি উত্তর দিতে হবে! কাঁদছিলে কেন?
-তোমাকে সত্যি উত্তর দিতে হবে কেন?
-কেন না আমি মিথ্যে বলি না
-তাই বুঝি?
-অবশ্য কাঁদাটা দোষের কিছুনা। আমার আপাও মাঝে মাঝে কাঁদে। তার কান্না রোগ আছে। একবার টানা দুই ঘণ্টা কেঁদেছিল। শাহেদ ভাই তাকে কি যেন বলেছিল! আর তাতেই শুরু হয় কান্না, রেকর্ড করা কান্না, আমি ঘড়ি দেখেছিলাম। প্রায় দুই ঘণ্টাই হবে। তুমি কতক্ষণ কেঁদেছো?
শাহেদের কথা আসতেই শিপুর মনে একটু ধাক্কা লাগে। সে ভাবতে থাকে, কি এমন কথা শাহেদ নীলুকে বলেছিল! যার জন্যে দুই ঘণ্টা কাঁদতে হবে! প্রশ্নটা কাঁটার মত আটকে থাকে মনে। আরিফার কথায় আবার স্বাভাবিক হয় শিপু।
-আমি একটু বেশিই কথা বলি। ক্লাশের সবাই আমাকে বাচাল আরিফা ডাকে, আরো একটা আরিফা আছেতো ক্লাশে তাই! তাকে আমরা ডাকি—-
আরিফা হঠাৎ আটকে যায়। একটা অসভ্য শব্দ বেরিয়ে যাচ্ছিল মুখ দিয়ে, অল্পের জন্য বের হয়নি। কে জানে শিপু কি ভাববে?
শিপু একটু মৃদু হাসে। তাতে আরিফা আরেকটু জড়সড় হয়ে যায়। এখন সে পালিয়ে যেতে পারলেই বাঁচে।
-তোমার আপু দরজা বন্ধ করে রেখেছে কেন?
বিষয়টা অন্যদিকে ঘুরে গেছে বলে আরিফা একটু স্বস্তিবোধ করে।
-কে জানে! এই রোগটার নাম দিয়েছি দরজা বন্ধ রোগ। এরজন্যে একবার আপু ভয়ংকর পিটুনিও খেয়েছে বাবার হাতে। সময় অসময় নেই দরজা বন্ধ করে রাখো!
আরিফাকে দেখে শিপুর মনে হয় অনেক বড় হয়ে গেছে মেয়েটা। তার খুব ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে একটু জড়িয়ে ধরে। তবু কেমন যেন একটু সংকোচ লাগে তার।
-আচ্ছা আমি তোমার কি হই বলতো?
শিপু চোখ নাচিয়ে প্রশ্ন করে।
-তোমকে ভাবী বলে ডাকা যায়, অবশ্য আমি মনে মনে তোমার একটা নাম দিয়ে দিয়েছি, শুনবে?
শিপু বাচ্চা মেয়ের মত খুব দ্রুত মাথা নাড়ে।
-তোমার নাম হল প্রিয়দর্শিনী
-প্রিয়দর্শিনী কেন?
-তুমি দেখতে ভীষন সুন্দর তাই!
-তুমিও সুন্দর
-উঁহু আমি সুন্দরি না! আমি সুন্দরি হলে–
আরিফার কথা আবার আটকে যায়। আবারো লজ্জা পায় সে। লজ্জা ঢাকার জন্য তাড়াতাড়ি বলে,
-মাঝে মাঝে আমি তোমার হাতে মুখ ঘষবো, সুন্দর হওয়ার জন্য।
-সুন্দর হতে চাও কেন?
আরিফা রহস্যময় হাসি দেয়। দুষ্টুমির হাসি না। কেমন যেন মেয়েলী একটা হাসি। কে জানে, কি ভেবে হেসেছে সে।
-আমি একটা কাজ করব, কিছু মনে করবেনাতো ভাবী?
-ভাবী ডাক শুনে হঠাৎ ভীষন ভাল লাগে শিপুর। মনে হচ্ছে যেন এই প্রথম কেউ একজন তাদের বিয়ের স্বীকৃতি দিল। ভাল লাগা ভাবটা গোপন রাখে শিপু।
-তোমার যা খুশি কর!
আরিফা হঠাৎ শিপুর গালে একটা চুমু খায়। চুমুটা দিয়েই দৌড় দেয়। পেছন ফিরে তাকালে দেখতে পেতো, প্রিয়দর্শিনীর চোখ ভিজে গেছে। তবে এবার আর বালিশের মধ্যে মুখ গুঁজেনা সে। এই কান্না হল সবাইকে দেখানোর কান্না। লুকিয়ে রাখার কান্না নয়।
**
রাত দশটা বাজে। শাহেদ এখনও ফেরেনি। শিপুকে অতটা চিন্তিত দেখাচ্ছে না। তবে রহিমুল্লাহ সাহেবকে দেখা গেল পায়জামা পাঞ্জাবী পরে টর্চলাইট নিয়ে বেরুচ্ছেন। বিড় বিড় করে বললেন, -গাধাটাকে একটা রাম ধোলাই দিতে হবে! পেয়েছেটা কি! ঘরে বৌ রেখে উনি লাপাত্তা হয়ে ঘুরবেন! হারামজাদা এখনও রাম ধোলাইয়ের মজা পায়নি!
শিপু রান্নাঘরে বসে বসে জেবুন্নেছা বেগমের ডাল রান্না দেখছে। তার শুধু দেখতেই ইচ্ছে করছে। কিছু করতে ইচ্ছে করছে না। চাচী কি তাকে অসভ্য ভাবছেন? ভাবুক! শিপু কারো ভাবনাকে কেয়ার করেনা। জেবুন্নেছা বেগম তার সাথে মাঝে মাঝে টুকটাক কথা বলছেন,
-বেগুণ খাওতো মা?
শিপুর মেজাজ একটু খারাপ হয়। সেকি বাইরের কেউ? তাকে এভাবে জিজ্ঞেস করার অর্থটা কি? বেগুণ ভাজি তার খুব প্রিয় একটা খাবার। কিন্তু তার বলতে ইচ্ছে হল না।
-না খাইনা, এলার্জি আছে।
-গাধাটা আগে কিছুই বলেনি! তা না হলে ভাল মন্দ একটা কিছু ব্যবস্থা করতাম।
-ওকে এরকম গাধা বলবেন না তো! মনের মধ্যে চার পা ওয়ালা একটা প্রানীর ছবি ভেসে উঠে, শুধু মুখটা ওর মত।
জেবুন্নেছা বেগম ফিক্ করে হেসে ফেললেন। শিপু সাথে সাথে ধরে ফেললো এই মহিলা খুবই সহজ সরল এবং অসম্ভব ভাল, এবং নির্ঘাৎ তাঁর হাসিরোগ আছে।
-গাধাটার সাথে তোমার পরিচয় হল কি করে?
-সে এক বিরাট ইতিহাস, এখন বলতে পারবনা।
বলতে বলতে উঠে দাঁড়ায় শিপু। চাচীর সাথে কথা বলে তার মনটা খুব হাল্কা হয়ে গেছে।
রহিমুল্লাহ সাহেব বেরিয়েছিলেন শাহেদকে খোঁজার জন্য। কিন্তু জেবুন্নেছা বেগম ভাল করেই জানেন শাহেদকে খুঁজে পাবেন না তিনি। তিনি বেরিয়েছেন সিগারেট খাওয়ার জন্য। ঘরে মেয়েদের সামনে সিগারেট খেতে লজ্জা পান তিনি। একদিন নীলুর সামনে সিগারেট ধরাতেই সে তাঁর দিকে এমন ভাবে তাকাল যেন তিনি মারাত্মক কোন ড্রাগ খাচ্ছেন। হেরোইন, গাঁজা টাইপের কিছু।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন রহিমুল্লাহ সাহেব। আজ পূর্ণিমা কিনা জানেন না। কিন্তু আকাশে চাঁদ পুরোটাই আছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলেন, কয়েক জায়গায় কালো হয়ে আছে আকাশ। বাতাসটাও সুবিধের মনে হচ্ছে না। রাতে আবার বৃষ্টি হবে। বৃষ্টি রহিমুল্লাহ সাহেবের খুবই অপছন্দের একটা জিনিস। কথা নেই বার্তা নেই হুট করে সারা দুনিয়া ভিজিয়ে দেবে। রাস্তায় কাদার জন্য হাঁটা যাবেনা। মাছ বাজারে গেলে মনে হবে, পঁচা ডোবার মধ্যে মাছ ধরতে নেমেছেন। পাজামার পেছনে থাকবে ছোট ছোট কাদার বিন্দু। ভুল করে ছাতা না নিয়ে গেলেই হয়েছে। ভিজে চুপসে যাবেন। এরপর লাগবে সর্দি কাশি। নাহ্ অসহ্য! এরচেয়ে সাইবেরিয়ার শীতও ভাল।
রহিমুল্লাহ সাহেব ভাবছিলেন নীলুর কথা। মেয়েটা খুবই চাপা স্বভাবের। মুখফুটে কিছুই বলবেনা। আর পছন্দও করেছে শাহেদের মত একটা গাধাকে! এই গাধা পছন্দের মর্যাদা বুঝবে কি করে? রহিমুল্লাহ সাহেব নিজে একটু লজ্জা পেতে লাগলেন। ভেতরে ভেতরে সূক্ষ্ম অপমানও বোধ করলেন। তিনি চেয়েছিলেন, নীলুকে শাহেদের হাতেই তুলে দেবেন, যা হোক একটা কিছু করে সংসার ধরবে ছেলেটা। তা না! হুট করে একটা মেম বিয়ে করে বসেছে হারামজাদা! রূপ দেখেই পাগল হয়ে যায় হারামজাদা! -হারামজাদা গালিটা দিয়ে খুব তৃপ্তি পান রহিমুল্লাহ সাহেব। ছোট থাকতে গাধাটা তার ভয়ে প্যান্টে ইয়ে করে দিত, আর আজ চোখ উঠিয়ে বলে, -আমার বৌ! (তার ওপর বৌয়ের পুরো নামই জানেনা!) বিড় বিড় করে বললেন, -হারামজাদার ভং বের করতে হবে। কিন্তু কিভাবে বের করবেন তা ঠিক করেননি এখনও।
আধা পাগল বাবার কাছে থেকে থেকে ছেলেটা একটু কেমন যেন হয়ে গিয়েছিল। রহিমুল্লাহ সাহেবের তখন অবস্থা ভাল। দেরী না করে শাহেদকে তাঁর কাছে নিয়ে এলেন। স্কুলে ভর্তি করালেন। প্রথম প্রথম ঘর থেকেই বেরুতোনা সে। একদিন ঘর থেকে বেরুনোর জন্যই মার দিয়েছিলেন তাকে। সেদিনও এমন বাড়ি ফেরেনি সে। পরে রাত বারোটার সময় কোত্থেকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে শাহেদ। এসেই বেসিনে মুখ দিয়ে হড়হড় করে বমি করে। আর সারা গায়ে ছিল ভয়াবহ জ্বর। জ্বর হলেও রহিমুল্লাহ সাহেব শাহেদের গালে একটা চড় বসিয়ে দেন। চড় দিয়েই তিনি বুঝতে পারেন, ছেলের গা গরম। অসুস্থ ছেলের গায়ে হাত তোলার অনুশোচনায় তিনি রাতে খেতে পারলেন না। অদ্ভুত রকম চুপচাপ থাকত শাহেদ। ঠিকমত কারো সাথে কথা বলতোনা। রহিমুল্লাহ সাহেব ভেবে পেলেন না শাহেদের মত ছেলেকে পছন্দ করল কেন মেয়েটা! মেয়েটাকে দেখে ভদ্র ঘরের মেয়ের মতই মনে হয়। নিশ্চয় পালিয়ে এসেছে। রহিমুল্লাহ সাহেব ভেতরে ভেতরে পূলক অনুভব করলেন। তাঁর নিজেরও এরকম ইতিহাস আছে। জেবুন্নেছা বেগমের সাথে তাঁর বিয়ের ইতিহাস। ভয়াবহ সেই কাহিনী! ভাবলে এখনও মনে মনে এ্যাডভেঞ্চার অনুভব করেন তিনি। সিগারেট অর্ধেকটা শেষ হয়েছে। রাস্তার আশপাশে একটা দুটো জোনাকী জ্বলছে নিভছে। রহিমুল্লাহ সাহেব ঘটনাটা প্রথম থেকে ভাবতে লাগলেন।
বিয়েতে কেউই রাজী ছিল না। শুধু তাঁরা দুজন। শেষ পর্যন্ত পালিয়ে যেতে হল তাঁদেরকে। মেয়ে কিছুই নিতে পারেনি। শুধু মায়ের একটা শাড়ি আর একটা আংটি। এইটুকু নিয়েই ঘর ছেড়ে পালানো। রহিমুল্লাহ সাহেব তখনও ছাত্র। মাসে মাসে বাড়ি থেকে টাকা পাঠানো হতো তাঁকে। একদিন এমনি এক বৃষ্টির রাতে ভিজে চুপচুপে হয়ে রহিমুল্লাহ সাহেব তাঁর সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীকে নিয়ে বাড়িতে ঢোকেন। তাঁর বাবা ইয়াজউদ্দিন সাহেব প্রচণ্ড রকমের রাগী মানুষ। নিয়মের বাইরে কিছুই সহ্য করতে পারতেন না। তিনি তাঁর ছেলে আর ছেলের বৌ দুজনের কাউকেই ভেতরে ঢুকতে দেননি। এককথায় তাদেরকে বের করে দিলেন। রহিমুল্লাহ সাহেবের মায়ের হাজার অনুরোধেও তাঁরা ভেতরে ঢুকতে পারেননি। শেষের দিকে শুরু হল মুষলধারে বৃষ্টি। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই বাইরে দাঁড়িয়ে ভিজতে লাগলেন। রহিমুল্লাহ সাহেব লজ্জায় তার স্ত্রীর দিকে তাকাতে পারলেন না। জেবুন্নেছা বেগম স্বামীর হাত শক্ত করে ধরে রেখেছিলেন আর মাঝে মাঝে বলছিলেন, -তুমি ভেবোনা, সব ঠিক হয়ে যাবে। তাঁদের বিয়ের প্রথম রাতটা কেটেছে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে।
এরপরের ইতিহাস অন্যরকম। রহিমুল্লাহ সাহেবের মা তাঁকে কিছু টাকা দিয়ে শহরে চলে যেতে বলেন। তাঁরা শহরে চলে আসেন। ইয়াজউদ্দিন সাহেবের কোন ভাবান্তর হল না। তিনি নির্বিকার থাকেন। ভয়াবহ অর্থকষ্টের মধ্যে রহিমুল্লাহ সাহেব পড়ালেখা শেষ করেন। এরপর বেসরকারী একটা কো¤পানীতে চাকরি পেয়ে যান। যুদ্ধের পরে অল্প দামে ভাল একটা বাড়িও পেয়ে যান। তার কিছু বছর পরেই নীলুর জন্ম হয়। নাতনীর জšে§র সংবাদ পাওয়া মাত্রই ইয়াজউদ্দিন সাহেব ছুটে আসেন। কিন্তু জেবুন্নেছা বেগম মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। মেয়েকে তিনি দেখতে দেননি। রহিমুল্লাহ সাহেব ছিলেন নির্বিকার। ইয়াজউদ্দিন সাহেব আর বেশি দিন বাঁচেননি। মৃত্যুর আগে সমস্ত সম্পত্তি লিখে দেন তাঁর বড় ছেলে রমিজউল্লাহ কে। শাহদেই এখন সেই সব সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী। কিন্তু বিষয় সম্পত্তির কথা উঠলেই শাহেদ এড়িয়ে যায় সবসময়। টাকা পয়সার কোন চিন্তা ভাবনাই নেই যেন ছেলেটার। সম্পত্তি দেখা শোনার জন্য কেয়ারটেকার রেখেছিলেন রহিমুল্লাহ সাহেব। তারাই এখন ওসব দখল করে বসে আছে। অবশ্য মাঝে মাঝে কিছু টাকা আসে শাহেদের নামে। তাতেও ছেলেটার কোন আগ্রহ নেই। সব চাচার হাতে তুলে দেয়। শাহেদের কাজকর্মে কিছুটা গর্বও হয় রহিমুল্লাহ সাহেবের। শুধু গাধাটা না জানিয়ে কাজ করে ফেলে। তাঁর কত আশা ছিল মেয়ের বিয়ে দেবেন। এখন মেয়ের বিয়ের কথা ভাবতেই তাঁর বুক দুুরু দুরু করে। তাঁর এই মেয়ে বড়ই অদ্ভুত! কখনযে কি করে বসে! একেকবার দরজা বন্ধ করলে আর খোলার নাম নেই। মারও খেয়েছে অনেক। তাতেও কিছু হয়নি। যতক্ষণ দরজা বন্ধ থাকে ততক্ষণ রহিমুল্লাহ সাহেব ভেতরে ভেতরে টেনশানে থাকেন, যদিও তা ঠিক প্রকাশ করতে চান না।
-ঘেউ! ঘেউ!
চমকে উঠে পেছনে তাকালেন তিনি। পাঁচ হাত দুরেই কুকুরটা বিরক্ত চোখে তাকিয়ে আছে। কুকুরকে খুবই ভয় পান তিনি। অবস্থা তেমন একটা সুবিধের না। কুকুরটা ঘনঘন লেজ নাড়ছে। তিনি নিজেকে খুবই স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছেন। কুকুরকে বোঝাতে চাইছেন, -তুমি ভেবোনা তোমাকে দেখে আমি ভয় পেয়েছি। সিগারেটও শেষ।
-ঘেউ! ঘেউ!
মনে মনে দোয়া ইউনুস পড়তে শুরু করলেন। কিছুটা এলোমেলো করে ফেলেছেন সূরায়। হাত পা ক্রমেই অবশ হয়ে পড়ছে যেন। দৌড় দিতেও সাহস হচ্ছে না তাঁর। এমন সময় শাহেদকে আসতে দেখলেন। হাতে মিষ্টির প্যাকেট টাইপের কিছু একটা। কে জানে! আবার কিসের আনন্দে আছে সে! শাহেদকে দেখে অসম্ভব ভাল লাগলো রহিমুল্লাহ সাহেবের। বিড় বিড় করে কয়েকবার -হারামজাদা বলে ফেললেন। খুবই তৃপ্তিময় গালি! চাচাকে দেখে সিগারেট ফেলে দিল শাহেদ। রহিমুল্লাহ সাহেব ব্যাপারটা খুব উপভোগ করেন। তিনি কাউকে দেখে সিগারেট ফেলেন না। এই তাঁর আনন্দ! তবে স্ত্রীর সামনে মাঝে মাঝে ফেলে দিতে হয়। ওটা কিছু না! আবার বিড় বিড় করে বললেন, -হারামজাদা সিগারেট ধরেছে! খা ব্যাটা খা! একটা দুটা বদঅভ্যাস ছাড়া চলে না! ওত ভালমানুষী দেখাবি কেন!
-চাচা!
শাহেদকে দেখে কুকুরটা আরেকটু বিরক্ত হয়। কয়েকবার র্গ র্গ শব্দ করে আস্তে আস্তে চলে যায়।
-কোথায় ছিলি?
-সন্ধায় একটা ইন্টারভিউ ছিল, দিয়ে এসেছি, এবার বোধহয় হয়ে যাবে।
-বেতন কেমন?
শাহেদ চুপ করে থাকে। সে জানে বেতন অতি সামান্য। কিন্তু ওটাই এখন তার জন্য অনেক।
-তিন হাজার
-অত টাকা দিয়ে করবিটা কি!
-ভাল একটা বাসার ভাড়াই এখন সাড়ে তিন হাজার।
রহিমুল্লাহ সাহেব চমকে উঠলেন। সিগারেট আরেকটা ধরালেন। ভাবলেন, -হারামজাদা আলাদা থাকার চিন্তা করছে নাকি!
-তুই কি বাসা নিয়ে থাকবি?
-জ্বি হ্যাঁ
-বাসা নিয়ে থাকার হলে আজ রাতেই চলে যাবি। সময় দুই ঘণ্টা। দুই ঘণ্টার মধ্যে তল্পিতল্পা গোটাবি। তল্পিতল্পার ইংরেজী জানিস্?
-জ্বীনা জানিনা।
-জানিস্টা কি তুই হারামজাদা! তল্পিতল্পা হল ব্যাগ এন্ড ব্যাগেজ। ব্যাগ এন্ড ব্যাগেজ নিয়ে বেরুবি।
-জ্বী আচ্ছা।
-বৃষ্টির মধ্যে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবি দুজন।
কথাটা বলেই একটু চমকে উঠলেন রহিমুল্লাহ সাহেব। কথাটা বলা উচিৎ হয়নি। ছেলেটা আবার কি না কি ভেবে বসে! শাহেদকে দেখে মনে হচ্ছে না তেমন কিছু একটা ভাবছে। সিগারেটের ধোঁয়া গিলতে গিয়ে কেশে ফেললেন রহিমুল্লাহ সাহেব। কাশতে কাশতে চোখের পানি বেরিয়ে যাওয়ার অবস্থা। শাহেদ এগিয়ে এসে তাঁকে ধরে।
-হারামজাদা! ছাড় তুই আমাকে! বাসা নিয়ে থাকার শখ হয়েছে। মহারাজা এখন সাবালক হয়েছেন। এখন আর নরকে থাকবেন কি করে!
-বাসায় চলেন চাচা, অনেক রাত হয়েছে।
কুকুরটা অদ্ভুত চোখে রহিমুল্লাহ সাহেবকে দেখছে। মাঝে মাঝে লেজ নাড়ছে। চাঁদ তখনও পুরোপুরি মধ্য আকাশে ওঠেনি। কিছুটা মেঘে ঢাকা পড়েছে শুধু।
শিপু তার চোখ মুখ এমন করে রেখেছে যেন তার খুব মেজাজ খারাপ। এই নিয়ে পরপর দুবার হারলো সে। লুডু খেলায় হার জিত তেমন বড় কিছু না। ভাগ্যের খেলা। তবু শিপু তার মেজাজ খারাপ করে রাখার অভিনয় করছে। আর তা দেখে আরিফা আরেকটু উৎসাহী হয়।
-নতুন বৌদের ভাগ্য সবসময় খারাপই হয়!
কথাটা বলেই ফিক্ করে হেসে উঠে আরিফা। আড়চোখে নিজের বোনের দিকে একবার তাকায়। নীলুর চেহারা কেমন যেন শুকনো হয়ে আছে। লুডুর ছক্কাটা হাতে নিয়ে আপনমনে নাড়াচাড়া করছে। শিপুর সাথে এনিয়ে দুবার কথা হয়েছে তার। শিপুর চালাকির কারণেই। চার উঠলে শিপু তার ঘুটিটাকে পাঁচ ঘর সরায়। ইচ্ছে করেই চালাকিটা করে সে। এবং নীলুকে দেখিয়ে দেখিয়ে। নীলু চোখ কট্মট্ করে বলে,
-চার উঠেছে কিন্তু!
-ওহ্ আচ্ছা!
আরিফা শাস্তি স্বরুপ শিপুর পরবর্তী চাল বাতিল করার ঘোষনা দেয়। তখন নীলু বলে,
-আর আমার পক্ষ থেকে শাস্তি হল ঘুটিটা একঘর পেছানো হবে।
শাস্তি পেয়ে শিপুর খুব মন খারাপ হয়। কিন্তু মন খারাপ হওয়া মানুষের চোখ চক্চক্ করেনা ।
খাওয়ার টেবিলে হঠাৎ থমথমে পরিবেশের সৃষ্টি হয়ে যায়। কেউ কোন কথা খুঁজে পাচ্ছে না। নীলু একটু খেয়েই উঠে চলে গেল। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করল না। অন্যসময় হলে রহিমুল্লাহ সাহেব জিজ্ঞেস করতেন, -কিরে! খাচ্ছিস্না কেন! ঘড়! ঘড়! উঠে যাওয়া চলবেনা! কিন্তু আজ বলতে পারলেন না। বলতে গিয়ে গলায় আটকে ফেললেন কথাটাকে। থাক্, আজ না খাক্, একরাত না খেলে কিছু হবেনা। শাহেদের স্বভাবই হল চুপচাপ খাওয়া। আরিফা আর শিপু মাঝে মাঝে গুুটুর গুটুর করে গল্প করছে। গল্পের মাঝে দুজনে আবার ফিক্ ফিক্ করে হাসেও। রহিমুল্লাহ সাহেব চোখ কুঁচকে তাকান। কিন্তু তারা কেউই তা লক্ষ্য করেনা। পুনরায় গল্প শুরু হয়।
আরিফা বলছে তাদের ক্লাশের ফার্ষ্ট গার্ল অপর্নার মজার একটা গল্প।
-হঠাৎ একদিন এক ছেলে এসে অপর্নাকে একটা চিঠি দিল। আমরাতো অবাক! অপর্না দেখতে মোটেও সুন্দরি নয়। এরপরও কেন চিঠি দিল! অপর্না সাথে সাথে এমন ভাব ধরলো যেন সে বিশŸসুন্দরি! অহংকারে মাটিতে পা পড়েনা। আমরা তাকে ধরলাম আইসক্রীম খাওয়ানোর জন্য। সে আমাদের আইসক্রীমের সাথে ফুচ্কাও খাওয়ায়! চিঠিটা কিন্তু তখনও খোলা হয়নি!
গল্পের এই পর্যায়ে এসে আরিফা চোখ পাকিয়ে একটা রহস্যময় হাসি দেয়। শ্রোতার আগ্রহ বোঝার জন্য শিপুর দিকে আড়চোখে তাকায়।
-তারপর?
-তারপর চিঠিটা খোলা হয়! আর ভেতর থেকে বের হয় একটা মরা টিকটিকি!
খিক্ খিক্ করে হাসতে থাকে দুজন। হাসি আর থামেনা। সংক্রামক ধরনের হাসি। জেবুন্নেছা বেগমও কিছুটা মুখ চেপে হেসে নেন। রহিমুল্লাহ সাহেবের কোঁচকানো চোখ দেখে হাসির জোর আরেকটু বেড়ে যায়।
ঘোমটা দেওয়া শিপুকে প্রথমে ঠিক চিনতে পারেননি রহিমুল্লাহ সাহেব। শিপুর হাতের চায়ের কাপের দিকেই তাঁর চোখ। সিগারেট খেতে পারলে বেশ হতো। শিপুর দিকে না তাকিয়েই বলে ফেললেন,
-বোস্ তো মা, আমার পাশে একটু বোস্
শিপু প্রথমে খুব অবাক হয়। পরে মুল ব্যাপারটা ধরতে পারে। তবু চুপচাপ রহিমুল্লাহ সাহেবের সামনে রাখা চেয়ারে গিয়ে বসে। শিপুকে দেখেই রহিমুল্লাহ সাহেবের ভ্রু কুঁচকে গেল। তিনি ভেবেছিলেন নীলু এসেছে। হঠাৎ করে মেজাজও খারাপ করতে পারছেন না। কোঁচকানো ভ্রু ও সোজা করতে ব্যার্থ হচ্ছেন।
-চায়ে কি চিনি হয়েছে?
চুমুক দেওয়ার ভঙ্গী দেখে মনে হল তিনি চিরতার রস খাচ্ছেন।
-চা সুমধুর হয়েছে।
-বলেন্কি! চা কিভাবে সুমধুর হয়! সুমধুর হয় গান, আমিতো কাপে করে গান নিয়ে আসিনি!
রহিমুল্লাহ সাহেবের ইচ্ছে হল মেয়েটার সামনে চায়ের কাপটা ভেঙ্গে ফেলেন। কিন্তু এমন মারাত্মক ভাল চা তিনি কখনও খাননি। মেয়েটার হাতে গুণ আছে বলতে হবে। রহিমুল্লাহ সাহেব কাপ ভাঙতে পারলেন না।
শিপু ঠিক করেছিল নীলুর রুমে সে আর কখনও ঢুকবেনা। কিন্তু ভুল করে ঢুকে পড়ে। ঢুকেই হতভম্ব হয়ে যায় সে। হা করে খাটের দিকে তাকিয়ে থাকে। ফুল দিয়ে অসাধারণ করে সাজানো হয়েছে খাটটাকে। গোলাপী রংয়ের নতুন চাদর বিছানো হয়েছে। বালিশের ওপর বড় একটা নীল তোয়ালে খুব যত্নের সাথে রাখা আছে। কোথাও উঁচু নিচু হয়নি। টেবিলে রাখা ফুলদানীতে উপচে পড়া ফুল। সবগুলো ফুলের মিশ্র ঘ্রানে একধরনের মাদকতা পুরো রুমে ছড়িয়ে পড়েছে। বিছানার ওপর গোলাপের পাপড়ি দিয়ে একটা অদ্ভুত রকমের ডিজাইনও করা হয়েছে। শিপুকে অবাক করে দেওয়ার জন্যে এগুলোই যথেষ্ট। শাহেদকে দেখে মনে হচ্ছে সে তেমন একটা চমকায়নি। তার ধারণা ছিল নীলু অদ্ভুত কিছু একটা করবেই।
নীলু আজ আরিফার সাথে শুয়েছে। আরিফা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আপাকে দেখে। সে জানে আজ রাতটা আপার জন্য খুব কষ্টের একটা রাত। কে জানে! হয়তো সারারাতই কাঁদবে। আরিফার ইচ্ছে করতে লাগলো আপাকে জড়িয়ে ধরে শোয়। কিন্তু সে জানে আপা সেটা পছন্দ করেনা।
হাল্কা নীল রংয়ের আলোয় লাল গোলাপ গুলোকে খয়েরী গোলাপের মত লাগছে। খাটের পাশেই জানালা। বিদুৎ চমকের উজ্জ¦ল আলো দেখা যাচ্ছে তাতে। যে কোন মুহুর্তে বৃষ্টি আসবে। বাড়িটা বিল্ডিংয়ের হলেও একপাশের ছাদ টিনের। টিনের ছাদটা নীলুর জন্য তৈরী করা হয়েছিল। নীলুর একবার শখ হয়েছিল শুয়ে শুয়ে বৃষ্টির শব্দ শোনার। মেয়ের আবদার রক্ষা করার জন্য রহিমুল্লাহ সাহেব বাড়ির ছাদ ভেঙ্গে টিন বসান। সে এক মহা হুলুস্থুল কাণ্ড। এখন সেই রুমে শিপু আর শাহেদের বাসর সাজানো হয়েছে।
শাহেদ বিছানায় শুয়ে আছে, কিন্তু চোখ খোলা। শিপুর দিকে তাকাতে তার কেমন যেন লজ্জা লাগছে। তাই, না তাকিয়েই বলল,
-শোন
শিপু ঘাড় ঘুরিয়ে শাহেদের দিকে তাকায়। সে এতক্ষণ জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল। বাইরে তাকিয়ে ভাবছিল বারান্দায় রাখা ফুলগাছ গুলোর কথা। গাছের নাম -তুমি কেন? অনেক ভেবেও বের করতে পারেনি শিপু।
-কি?
-চাকরি একটা হয়ে গেছে প্রায়
-প্রায় মানে?
-ইন্টারভিউ দেখে মনে হল হয়ে যাবে। তবে বেতনটা কম
-কিসের চাকরি?
-জানিনা এখনও
শিপু আবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। তাকিয়ে বলে,
-ভালই বৃষ্টি হবে।
-বৃষ্টি হলেই ভাল!
-বৃষ্টি হলে ভাল কেন?
শাহেদ কি যেন বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই শুরু হয় তার কাশি। শিপু এগিয়ে এসে শাহেদের কপালে হাত রাখে। হাত পুড়ে যাবে এমন গরম।
-একি! তোমার তো ভীষণ জ্বর!
শাহেদকে হঠাৎ করে ভীষণ শুকনো আর রোগা মনে হয়। কেমন যেন বাচ্চদের মত শিপুর হাত ধরে রেখেছে। শিপু বিছানা ছেড়ে উঠতে চায় কিন্তু ততক্ষনে শাহেদ খপ্ করে শাড়ির আঁচল ধরে ফেলে।
-ছাড়ো! তোমার খুব জ্বর! দেখি অষুধ আছে কিনা! পানিও দিতে হবে মাথায়।
-তুমি একটু হাত বুলিয়ে দাও মাথায়, জ্বর চলে যাবে।
-জ্বী না জনাব! এটা নাটক সিনেমা নয়! ছাড়োতো! আমার ব্যাগে অষুধ আছে নিয়ে আসি
শিপু উঠে গিয়ে অষুধ খুঁজতে থাকে। অনেক খুঁজেও পেলোনা। শেষ পর্যন্ত নীলুর দরজায় টোকা দিতে হয় তাকে। দরজা খুলেই নীলু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে শিপুর দিকে।
-তোমার কাছে জ্বরের অষুধ হবে? প্যারাসিটামল টাইপের একটা কিছু হলেই হবে, ওর আবার ভীষণ জ্বর এসেছে।
নীলু চুপচাপ তার ড্রয়ার থেকে মাথা ব্যাথার একটা অষুধ বের করে দেয়।
-এতেই হবে নীলু হাই দিতে দিতে বলল।
নীলু সাধারণত গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকে। হাইটা একধরনের সুক্ষ্ম অভিনয় হতে পারে। শিপু আর অত শত খেয়াল করেনা। সে অষুধ নিয়ে চলে আসে।
-বৃষ্টি বেশ জোরেই আসবে।
-নাও ধর।
অষুধটা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে শাহেদ। এবার পাশ ফিরে শুয়েছে সে। শিপু উঠে গিয়ে জানালা বন্ধ করে দেয়। বাইরে ভয়ংকর শোঁ শোঁ শব্দে বাতাস হচ্ছে। শিপু একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ শাহেদের দিকে তাকায়। শাহেদ ঘুমিয়ে পড়েছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। অথচ শিপুর ভীষণ কথা বলতে ইচ্ছে করছে। কত কিছুইনা বলার ছিল এই রাতের জন্য!
-শোন!
-হুঁ
-হুঁ নয় বল হ্যাঁ!
-কি?
-আমরা কি এখানেই থাকব?
-জানিনা।
-এখানে থাকলে মন্দ না, কারো সাথে ঝগড়া টগড়া করে থাকা যাবে। বিয়ের পর একটু ঝগড়া না হলে মানায় না।
-আচ্ছা।
-আমি ঠিক করেছি সপ্তাহে দুদিন তোমার সাথে ঝগড়া করব।
-আচ্ছা।
-সাধারণ ঝগড়া না সিরিয়াস টাইপের ঝগড়া!
-আচ্ছা।
-তোমার কি ঘুম পাচ্ছে?
-হুঁ
-মিথ্যে কথা! তোমার মোটেও ঘুম পাচ্ছে না! কচ্ছপের মত শুয়ে থাকলেই সেটা ঘুম হয়ে যায় না! মিথ্যে বলার জন্য তোমাকে এখন শাস্তি দেওয়া হবে, এদিকে তাকাও!
শাহেদ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়, চোখে কিছুটা কৌতুহল।
-দেখি হাতটা দাওতো
শাহেদ শিপুর কপালের দিকে চেয়ে আছে। চোখের দিকে তাকাতে বোধহয় সাহস পাচ্ছে না। শিপুই হাত বাড়িয়ে শাহেদের হাতটা ধরে ফেলে। হাত ধরে বলে,
-কবিতা শুনবে?
-বল
” অ ফৎড়ঢ় ড়ভ ধিঃবৎ
শরংংবং ঃযব হরমযঃ!
ওহ ধ ংঁফফবহ ৎধরহ!
ও পধহ’ঃ ঃবষষ সু যবধৎঃ, ধহফ
ঋববষ ঃযব ংবিধঃবংঃ ঢ়ধরহ!”
-বাংলা করে বলবো?
-হুঁ
-হঠাৎ বৃষ্টিতে!
এক ফোঁটা জল
রাত্রিকে চুমু খায়!
বলতে পারিনি মম হƒদয় কথা
মধুরতম সে বেদনায়!
-শুনলে?
-হুঁ
-আর বলবো?
-না
-ঘুম পাচ্ছে তোমার?
-হুঁ
-দ্বিতীয়বার মিথ্যে বললে তুমি! তোমার মোটেও ঘুম পাচ্ছে না। ঘুমের ভান করছ শুধু। ভান করার অপরাধে তোমাকে দ্বিতীয়বার শাস্তি দেওয়া হবে!
শাহেদ শিপুর দিকে চোখ পিট্ পিট্ করে তাকায়। আবার চোখ বন্ধ করে ফেলে সে, তবে ঘুমুচ্ছে না, কেন না তার চোখের পাপড়ি মৃদু মৃদু কাঁপছে। শিপু সেই ক¤িপত চোখের পাপড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। তার হঠাৎ ইচ্ছে করল সেই ক¤িপত চোখে শাস্তি স্বরুপ একটা চুমু দেওয়ার। মাথাটা ধীরে ধীরে নীচু করে শিপু। হঠাৎ ঝমঝম শব্দে বৃষ্টি শুরু হয়। টিনের ছাদ হওয়ায় ঝমঝম শব্দটাকে কোন একটা সুরের ছন্দের মত মনে হচ্ছে।
-একি! সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়লে নাকি!
-কি হল!
ঘুম জড়ানো কণ্ঠে জবাব দেয় শাহেদ।
-কি সুন্দর বৃষ্টি হচ্ছে! আর তুমি এখানে নাক ডেকে ঘুমুচ্ছ!
-কি করব এখন! বাইরে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখবো?
প্রকাণ্ড একটা হাই তুলতে তুলতে বলল শাহেদ। অন্যসময় হলে শিপুর এখন ভয়ংকর রাগ ওঠার কথা। কিন্তু আজ তার কাছে সবকিছুই ভাল লাগছে। এমনকি শাহেদের বিশ্রী ভঙ্গীতে হাই তোলাটাকেও অন্যরকম সুন্দর মনে হচ্ছে। একবার ভাবলো শাহেদের ওপর ভয়ংকর অভিমান করে বসবে। কিন্তু ভাবনা তার ভাবনা পর্যন্তই থাকে। তার মনে হচ্ছে রাগ করার গুণটাও সে হারিয়ে ফেলেছে।
-মাথায় হাত বুলিয়ে দেবো?
-না! মাথায় হাত বুলালে আমার ভাল লাগেনা!
-সবকিছু ভাল লাগতে হবে এমন তো কোন কথা নেই?
শিপুর চোখ একটু চক্ চক্ করছে। যেন মাথায় হাত বুলানো মহা আনন্দের কোন কাজ! বৃষ্টির ছন্দের কারণেই হোক্ বা শিপুর হাত বুলানোর কারণেই হোক, কিছুক্ষনের মধ্যেই শাহেদ ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমিয়ে গেলে তার মুখ বাচ্চা ছেলেদের মত কিছুটা ফাঁক হয়ে থাকে। শিপু গভীর মমতায় সেই ফাঁক হয়ে থাকা মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। বাইরে তখন শুধু একটা নয়, লক্ষ লক্ষ বৃষ্টির ফোঁটা রাতকে চুমু খাওয়ার জন্যে পৃথিবীতে ছুটে আসছে।
**
সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা সারার পর সফিকের প্রথম কাজটা হল শাহেদের খোঁজ নেয়া। দীর্ঘ সময় ধরে আয়নায় নিজেকে দেখবে সে। তারপর চুল আঁচড়ানো পর্ব। চুল আঁচড়ানোর পর কিছুক্ষণ এদিক সেদিব ঘোরাঘুরি করবে। পানি খাবে দুগ্লাস। রীতিমত সেজেগুজে সুবোধ বালকের মত বেরুবে সে। পকেটে অবশ্যই একটা ফুল থাকবে। যদিও কখনও কাউকে ফুলটা দেওয়া হয় না। পকেটের মধ্যেই বাসি হয়ে যায়। পরে একসময় ফেলে দেওয়া হয়। তারপর আবার নতুন উদ্যমে ফুল নিয়ে ঘোরা। আজও একটা গাঁদা ফুল নিয়ে বেরুচ্ছে। ফুলটার সাইজ একটু বড় হওয়ায় পকেটটা বিশ্রী ভাবে ফুলে আছে। কিন্তু অত শত ভাবছে না সফিক। বড় ফুল। পকেটতো একটু ফুলে থাকবেই, এটাই স্বাভাবিক! প্রতিবারই বেরুনোর আগে একটা করে প্রতিজ্ঞা করে সফিক। আজ একটা কিছু হবেই হবে! তাকে আজ একটা কিছু করতেই হবে! এমন একটা প্রতিজ্ঞা। যদিও প্রথমবারে নীলুর দেখা পাওয়াটা একটা ভাগ্যের ব্যাপার।
নীলুদের বাড়ির কাছাকাছি আসতেই সফিকের প্রতিজ্ঞা সামান্য নেতিয়ে পড়ে। বারান্দায় নীলুর বাবা বসে বসে পত্রিকা পড়ছে। মনে মনে গাল দেয় সে, -বেকার বুড়ো! খেয়ে দেয়ে কাজ নেই! বসে বসে মেয়ে পাহারা দাও!
-স্লামালিকুম চাচা।
রহিমুল্লাহ সাহেব এমন ভাবে পত্রিকা পড়তে লাগলেন যেন শুনতে পাননি। সফিক একটা মৃদু কাশি দেয়। কাশি শুনে চোখ কুঁচকে তাকান রহিমুল্লাহ সাহেব।
-কাশছো কেন? ঠাণ্ডা লেগেছে?
-জ্বি চাচা সামান্য।
-কিন্তু কাশি শুনেতো মনে হচ্ছে না ঠাণ্ডা লেগেছে, এটাতো ঠাণ্ডার কাশি না!
সফিকের ইচ্ছে হল বলে, -চাচা, আপনি কি কাশির ওপর পি. এইচ. ডি করে এসেছেন? দেখিতো কয় প্রকারের কাশি দিতে পারেন?
-শোন, তোমার সালাম দেওয়া হয়নি, নবীজী এভাবে সালাম দিতেন না। এতটুকু পড়ালেখা করেছো, এখনও সালাম দিতে শেখনি!
-জ্বী ভুল হয়েছে ক্ষমা করবেন, আস্সালামু আলাইকুম।
-সালামের অর্থ জানো?
-জ্বী জানি, আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক।
-গুড্, কিন্তু সালামতো অনেক পাই! শান্তির বর্ষণ আসেনা কেন? পত্রিকায় তো শান্তি বর্ষণের কোন খবর নাই! শুধু বোমা বর্ষণের খবর!
সফিক মনে মনে রাগ ঝাড়ে, -চাচা আপনার মাথায় তো বোমা পড়ছে না! আপনার এত চিন্তা কিসের! পত্রিকা পড়া ছাড়া আর তো কিছু করার নাই!
কিন্তু মুখে খুব বিনীত ভাবে বলে,
-শাহেদ কি বাসায় আছে?
-গাধাটাকি বাসায় থাকে! শুনলাম নাকি চাকরিও পেয়েছে!
সফিকের রাগ আরেকটু বেড়ে যায়, এতক্ষণ হল এসেছে অথচ নীলুর দেখা নাই! মনে মনে বলে,
-আমি তো তার কাছে আসি নাই চাচাজান! আপনার জ্যাষ্ঠা কন্যার মুখদর্শন সারিতে আসিয়াছি! এতক্ষণ হল এখনও বসতে বললেন না! আবার সালামের অর্থ জিজ্ঞেস করেন! আপনি সালামের উত্তর দিয়েছেন?
রহিমুল্লাহ সাহেবের জন্য চা নিয়ে আসে শিপু। সফিককে দেখেই মৃদু হাসে।
-কি ব্যাপার, বাইরে দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে আসুন না!
রহিমুল্লাহ সাহেব সফিকের উদ্দেশ্য ভালমতই জানেন, কিন্তু শিপু জানেনা। তিনি চোখ কুঁচকে পত্রিকা পড়তে লাগলেন। দেখে মনে হচ্ছে যেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ কোন খবর পড়ছেন। সফিকের খুব ইচ্ছে হল ভেতরে গিয়ে বসার। কিন্তু এখন তা সম্ভব না।
-না থাক্ আরেকদিন, আজ আসি।
রহিমুল্লাহ সাহেব বিড়বিড় করে বললেন, -হারামজাদা! তৃপ্তির গালি না বিরক্তির গালি বোঝা গেল না।
-চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে বাবা।
রহিমুল্লাহ সাহেব ব্যাপারটা খেয়াল করেননি। হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ নিতে ব্যাস্ত তিনি। শিপুর মুখে -বাবা সম্বোধন তাঁকে তেমন একটা নাড়া দেয়নি। মেয়েদের মুখে বাবা ডাক শুনতে শুনতে অভ্যাস হয়ে গেছে, তাই। শিপু কিছুটা হতাশ হয়, একটা কিছু আশা করছিল সে। তবে জেবুন্নেছা বেগমের বেলায় তার এই পরীক্ষা ভালই প্রভাব ফেলে। নাস্তা তৈরীর সময় জেবুন্নেছা বেগমের পাশে গিয়ে বসে শিপু।
-দাওতো মা আমি বানাই।
জেবুন্নেছা বেগম সামান্য চমকে উঠেন। হাল্কা ধরনের একটা অপরাধ বোধও অনুভব করলেন তিনি। শিপু কথা না বলে চুপচাপ কাজ করতে লাগলো। জেবুন্নেছা বেগম উঠে গিয়ে নিজের রুমে চলে যান। কিছুক্ষণ পরেই হাতে করে কি যেন নিয়ে আসেন।
-দেখি মা, হাত টা দাওতো
শিপু অনেকটা না বুঝেই হাত বাড়িয়ে দেয়। গয়নার বাক্স থেকে বালাটা বের করে শিপুর হাতে পরিয়ে দেন জেবুন্নেছা বেগম।
-ঘরের বৌ কে খালি হাতে থাকা ঠিক না
শিপুর মনে হল তার জীবনে এর চেয়ে সুন্দর সকাল আর আসেনি।
-যাওতো মা চা টা নীলুর বাবাকে দিয়ে এস।
শিপু ভীষণ অবাক হয়ে চা নিয়ে চলে যায়।
নীলু থার্ড ইয়ারের ছাত্রী। কেমিষ্টত্থীর মোটা মোটা বই গুলো বয়ে বেড়াতে তার ভীষণ বিরক্তি লাগে। পড়ায় তার তেমন একটা মন নেই। তবু সে ভাল ছাত্রী। একবার ভাল ছাত্রী টাইটেলটা পেয়ে গেলে সহজে তার প্রভাব কাটানো যায় না। নীলুকে তাই প্রতিদিন ক্লাশ করতে হয়। ক্লাশে তার একমাত্র বান্ধবী শ¤পা। ভীষণ রোগা মেয়েটা। লতার মত লিকলিকে লম্বা। ক্লাশে যাকে সবাই থিন ব্যাম্বো বলে ডাকে। মানে হল পাতলা বাঁশ। শ¤পা ব্যাপারটা নিয়ে তেমন মাথা ঘামায়না। মাথা ঘামানো মানেই উৎসাহ দিয়ে ফেলা, ব্যাস্ তাহলেই হয়েছে, আরো নিত্য নতুন নাম বেরুবে। শ¤পা আজ ক্লাশে আসেনি। নীলু একবার ভাবলো ফোন করবে। কিন্তু ফোন করতেও তেমন একটা ইচ্ছে হয় না তার। ফোন ধরবে শম্পার মা। মেয়ে যেমন রোগা মা তেমন স্বাস্থ্যবতী। ছোটখাটো একটা পাহাড় বলা যায়। ফোন ধরেই বলবে কাকে চাই? কেন যেন জেরা করার মত জিজ্ঞেস করে।
ক্লাশে স্যার জটিল কিসব হিজিবিজি পড়াচ্ছে। মন দিতে গিয়েও পারছে না নীলু। সে এখন পড়া ছাড়া অন্য সবকিছু ভুলে থাকার চেষ্টা করছে। কিন্তু চেষ্টা করতে গেলেই ব্যাপারটা আরো বেশি মনে আসে। গতকাল সারারাত ঘুমায়নি সে। একের পর এক মাথা ধরার ট্যাবলেট খেয়েছে। দুটো ঘুমের অষুধও খেয়েছিল। তবু ঘুমোতে পারেনি। সারারাত বৃষ্টি হয়েছে আর সারারাত সে কেঁদেছে। আরিফা জেগে থাকলে নির্ঘাৎ নতুন আরেকটা রেকর্ড লেখা হয়ে যেত। কাঁদার কারণটা হল- নাহ্ নীলু আর ভাবতে চাচ্ছে না ব্যাপারটা। সে কল্পনায় ছবি এঁকেছিল, তার আর শাহেদের প্রথম রাত। টিনের ছাদে ঝমঝম বৃষ্টি। সে শাহেদের হাত দুটো শক্ত করে ধরে রাখবে। শাহেদ জিজ্ঞেস করবে, -কি ব্যাপার! এভাবে ধরে রেখেছো কেন? সে বলবে,
-তোমাকে ছাদে যেতে দেবনা, তাই
-পাগল হলে! এখন কেউ ছাদে যাবে! হাত ছাড়ো!
নীলু আরো জোর করে ধরবে।
-ছাড়বোনা।
শাহেদ বলবে,
-অদ্ভুত মেয়েতো!
-এ্যাই মেয়ে!
নীলু প্রথমে বুঝতে পারেনি, পরে পাশের মেয়ের ধাক্কা খেয়ে বুঝতে পারল স্যার তাকেই বলছে। ঝট্ করে উঠে দাঁড়ায় সে।
-কি হয়েছে? কি ভাবছিলে?
-কিছুনা স্যার
পেছন থেকে কি যেন বলে,
-থাক্ স্যার ভাবতে দেন, ভাবতে মজা।
সবাই হো হো করে হেসে উঠে। নীলুর লজ্জায় কান্না পেয়ে যায়, কিন্তু অত সহজে সে কখনই কাঁদবেনা। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে, কে বলেছে কথাটা। স্যারও কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। হঠাৎ সবাইকে অবাক করে দিয়ে নীলু পেছন ফিরে বলে,
-সাহস থাকেত সামনে এসে বল্! হাত না, স্যান্ডেল দিয়ে চড় দেবো!
ব্যাগ গুছিয়ে দ্রুত ক্লাশ থেকে বেরিয়ে যায় নীলু। কথাটা বলতে পেরে নিজেকে অনেকটা হাল্কা মনে হচ্ছে এখন। নাহ্ ফোন করতেই হবে। শম্পাকে সে খুবই পছন্দ করে। মেয়েটাও একটু অদ্ভুত ধরনের। মাঝে মাঝেই অদ্ভুত সব কাণ্ড করে বসে। একদিনকার ঘটনা হল এমন,
ক্লাশের যে ছেলেটা সবচেয়ে বেশি ফাজলামো করতো, শ¤পা তাকে ইশারা করে ডাকে। শ¤পাকে লজ্জায় ফেলার জন্য ছেলেটা কাছে আসতে চায়নি। শম্পা সবার সামনে চেঁচিয়ে তাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-তোমার প্যান্টের জিপার লাগাও, সবাই হাসাহাসি করছে
এই হল শম্পা।
ফোন ধরলো শম্পার মা।
-কাকে চাই?
আজ মহিলার গলায় অত জোর নেই। কেমন যেন শুকনো শুকনো শোনাল।
-শ¤পা আজ ক্লাশে যায়নি?
-তুমি কে?
নীলুর প্রচণ্ড বিরক্তি লাগে, উত্তর না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করা!
-আমি নীলু
-কোন নীলু?
নীলু বিরক্তির চরম সীমায় পৌঁছে যায়। কোন নীলু? এটা কি ধরনের প্রশ্ন! সে ভেবে পাচ্ছে না সে কোন নীলু।
-আমি শম্পার বন্ধু।
-বন্ধু মানে! কণ্ঠতো মেয়েদের মত, বন্ধু হবে কেন?
নীলুর ইচ্ছে হল প্রচণ্ড শব্দ করে রিসিভারটা রেখে দেয়। তার আগেই শ¤পার কণ্ঠ শুনতে পায় সে।
-হ্যালো নীলু কেমন আছিস্?
-আমি অশŸডিম্ব আছি!
-কি রে খেপেছিস্ নাকি! আমার খুব জ্বর রে!
-কত?
-এই তো তিন চার হবে
-আমি আসছি তাহলে
-এ্যাই শোন্!
-কি?
-মিঃ আপেলের কি খবর?
-চুপ্ র্ক
-বা রে ডুবে ডুবে ওয়াটার গিলতে পার, আর—-
খট্ করে রিসিভার রেখে দেয় নীলু। তার আবার মাথা ধরেছে। মাথার মধ্যে শুধু আপেল শব্দটা ঘুরছে। শাহেদকে সে আপেল নামটা দিয়েছিল। কেন দিয়েছিল এখন তা মনে পড়ছে না। ফোনের দোকানের ছেলেটা সরু চোখে নীলুর দিকে তাকাচ্ছে। নীলুর ইচ্ছে হল বলে, -এভাবে তাকিয়ে থাকলে এক টাকাও পাবেনা।
দোকান থেকে বের হয়েই রিক্শা নিল নীলু। উঠার আগে ভাড়াও জিজ্ঞেস করেনি সে। তারমানে ওখানেও আবার মেজাজ গরম হবার সম্ভাবনা আছে। ভয়ানক গরম পড়ছে আজ। কপাল ঘামে ভিজে গেছে রুমাল খুঁজতে গিয়ে দেখল, ভুল করে আনা হয়নি। এমন ভুল তার কখনও হয় না। আজ কি সে একটু এলোমেলো হয়ে আছে? চুলগুলোও কেমন যেন রুক্ষ্ম দেখাচ্ছে। অযত্ন করে বাঁধা আছে শুধু। ঠোঁটে লিপষ্টিক দেয়নি। কোন সাজগোজই করেনি বলতে গেলে। সকালে উঠেই ক্লাশে চলে আসে সে। ইচ্ছে করেই শিপুর সাথে দেখা করেনি, কে জানে! কি ভেবে করেনি! শুধু শাহেদের দিকে একপলক তাকিয়েছিল। কোন পরিবর্তন এসেছে কিনা দেখার জন্য। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারেনি সে, কখনই বুঝতে পারেনি সে তাকে।
-কিরে! তোকে এমন শুকনো ডলফিনের মত লাগছে কেন?
শ¤পার সত্যি সত্যিই ভয়াবহ জ্বর। কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। নীলুকে দেখেই হেসে কথাটা বলে। নীলু একটু হাসে। নিস্প্রাণ হাসি।
-কিরে! কি হয়েছে! তোকে কেউ ড্রাই টাইগার বলেনিতো?
-বাজে কথা রাখতো শম্পা!
-তাহলে বল্, কবি কালীদাস তোকে কি বলেছে? তোকে বিয়ে করে সংসারী হবেতো?
-শাহেদ বিয়ে করে ফেলেছে।
শ¤পা চোখ কুঁচকে নীলুর দিকে তাকায়। ঠাট্টা করছে কিনা বোঝার চেষ্টা করছে। নীলুকে ভাল করেই চেনে সে। শাহেদ কে নিয়ে কখনই ঠাট্টা করবেনা সে, আর এমন সিরিয়াস ঠাট্টাতো নয়ই। নীলুর শুক্নো ধরনের হাসি দেখে শম্পার চোখ আরেকটু কুঁচকে যায়।
-কি বলছিস্ তুই! ঠাট্টা করবিনা একদম!
নীলু নিঃশব্দে হাসে।
-ঠাট্টা নয়, সলিড কথা, একদম হান্ড্রেড পার্সেন্ট বিয়ে, মেয়ে মহা সুন্দরি, নাম হল শিপু, পুরো নাম জানিনা, অবশ্য শাহেদও জানেনা! হি! হি!
-ফাজলামো রাখ্, বলা নেই, কওয়া নেই! হুট করে বিয়ে! বললেই হল! চল্ দেখে আসি!
-তুই যাবি কি করে! তোর যা অবস্থা!
শ¤পার কপালে হাত রাখে নীলু। তার চোখ ভিজে যাচ্ছে। বাঁ হাত দিয়ে চোখ পরিষ্কার করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে সে, যেন চোখে ময়লা পড়েছে, ময়লা পরিষ্কার করছে সে। শ¤পা হঠাৎ অদ্ভুত এক কাজ করে বসে। শক্ত করে নীলুর হাত দুটো বুকে জড়িয়ে ধরে। তক্ষুনি নীলুর গাল বেয়ে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। আর লুকোতে পারে না নীলু। পাগলীর মত শ¤পাকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠে। শ¤পার ইচ্ছে হল হাসির কোন কথা বলে নীলুকে হাসিয়ে দেয়। কিন্তু তার নিজের গলাও কেমন ভার ভার লাগছে। মুখ দিয়ে শব্দ বেরুচ্ছে না। এই সময়ে প্রত্যেকেই ক্ষনিকের জন্য বোবা হয়ে যায়।
**
রাহেলা বেগম শীতল চোখে তাকিয়ে আছেন তাঁর একমাত্র মেয়ের শিপুর দিকে। যদিও শীতল চোখে তাকানোর মত পরিবেশ নয়। শিপুও তার দৃষ্টি স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে। শিপুর বিয়ের আগেরদিন রাতের ঘটনা।
-তুই তাহলে সত্যি সত্যি ঐ ছোটলোক ছেলেটাকে পছন্দ করিস্!
-ছোটলোক শব্দটাতে ইচ্ছে করে একটু বেশি জোর দিয়েছেন। তিনি ভেবেছিলেন কথাটা শুনে শিপু একটু চোখ গরম করে ফেলবে। উল্টাপাল্টা একটা কিছু বলবে। বললে তার উত্তর কি হবে, তাও ঠিক করে ফেলেছেন রাহেলা বেগম। কিন্তু শিপুর কোন ভাবান্তর হল না। সে শান্ত কণ্ঠে বলল, -শুধু পছন্দ করি বললে ভুল হবে মা, আমরা বিয়ে করতে যাচ্ছি, খুব শিঘ্রী।
রাহেলা বেগমের ঠিক করে রাখা জবাবটা এলোমেলো হয়ে গেল। তাৎক্ষনিক ভাবে যা করা উচিৎ বলে মনে করলেন, তাই করলেন, এগিয়ে এসে শিপুর গালে সামান্য জোরে একটা চড় বসিয়ে দিলেন। চড় মারার ধরনটা ছিল খুবই হাস্যকর। বোঝা যায় চড় মারতে অনভ্যস্ত তিনি। প্রথমেই দুহাত উঁচু হয়ে গেল তাঁর। কোন হাত দিয়ে চড় মারবেন ঠিক বুঝতে পারছিলেন না। শেষ পর্যন্ত ডান হাত দিয়ে মারলেও বাঁ হাতটা উঁচু হয়েই রইল। সহজে হাতটা নামতে চায়নি। চড় খেয়ে ততটা ব্যাথিত মনে হল না শিপুকে। যেন খাওয়ার ছিল খেয়েছে, প্রয়োজনে আরো খাবে।
শিপুর বাবা ওয়াহিদ চৌধুরী মারাত্মক ধরনের শিল্পপতি ছিলেন। একের পর এক যখন লোকসান গুনতে হয় তাঁকে, তখনি একদিন হার্ট এটাক করে বসেন। তারপর ব্যবসায়ে নামে ধস্। মৃত্যুর আগে অস্বাভাবিক মোটা অংকের ব্যাংক ব্যালেন্স রেখে যান তিনি। শহরে তাঁর প্রকাণ্ড এক বাড়ি। আভিজাত্যের সমস্ত কিছুরই একটা করে স্যাম্পল পাওয়া যাবে তাতে। শিপুর শোবার ঘরে প্রকাণ্ড সব আয়না। ছাদের মধ্যে আয়না, দেওয়ালে আয়না। চারদিক থেকেই দেখা যায়। মাঝে মাঝেই শিপু রুমে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখত। দেখার সময় গুণগুণ করে গানও গাইত।
স্বামীর মৃত্যুতে রাহেলা বেগম ততটা ভেঙ্গে পড়েননি। শিপুকে নিয়েও তাঁর তত চিন্তা ছিল না। সুইডেনে তাঁর বোনের ছেলে অর্নব গেছে পড়তে। পড়া শেষ হলেই দেশে ফিরবে। আর ফিরলেই শিপুর সাথে বিয়ে। মোটামুটি কথা সব পাকা করে রেখেছেন তিনি। হঠাৎ শিপু বলে বসে সে আরেকটা ছেলেকে পছন্দ করে। ব্যাপারটাকে প্রথমে গুরুত্ব দিতে চাননি তিনি। ভাবলেন, একসাথে পড়লে এরকম কাউকে ভাল লাগতেই পারে, দোষের কিছু না। কিন্তু দোষের কিছু দেখতে পেলেন তখুনি যখন শিপুর হাতে লম্বা একটা কাটা দাগ দেখতে পেলেন। দেখেই বুঝলেন ইচ্ছাকৃত কাটা। ধারালো ব্লেড দিয়ে কাটলে যেমন হয় তেমন। -ব্যাপারটা কি জিজ্ঞেস করতেই শিপু সরল কন্ঠে বলে,-ঝগড়া হয়েছিল, রাগ করে কেটেছি। ভয়াবহ কষ্ট করে নিজেকে শান্ত রাখেন রাহেলা বেগম।
-আর কখনও ঐ নাম আমার সামনে মুখে আনবিনা
যদিও এখনও শিপু শাহেদের নাম মাকে বলেনি। শিপুকে ততটা চিন্তিত মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেন নাটকের শ্যূটিং চলছে। একটা দৃশ্য শেষ হয়েছে এখন পরবর্তী দৃশ্য বুঝিয়ে দেওয়া হবে। তবে চড়টা ঠিক যায়গায় দেওয়া হয়নি। চড়টা শিপুর কানে লেগেছিল। কান সামান্য একটু জ্বালা করছে। করুক্! শ্যূটিংয়ে এমন ভুল হতেই পারে!
শিপু বড় আয়নায় নিজেকে শেষ বারের মত দেখে। নিজেকে কেমন যেন বিধ্বস্ত মনে হয়। ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক সেদিক তাকায় শিপু। তার কয়েকটা গিফ্ট পাওয়া শাড়ি আছে। ঠিক করেছে শুধু সেগুলোই সাথে নেবে। কোন গয়না নেবেনা। শাহেদ যখন চাকরি করে তাকে গয়না দেবে তখন পরবে, এর আগে নয়। রাতেই ব্যাগ গুছিয়ে তৈরী হয়ে যায় শিপু। রাতটা কোন এক বান্ধবীর বাসায় কাটিয়ে দিলেই হল। পরদিন দুপুরেই শাহেদের সাথে তার বিয়ে হবার কথা। শাহেদকে বলেছে, সে আসবে, কে জানে শাহেদ কি ভেবেছে! ঝোঁকের মাথায় নেয়া সিদ্ধান্ত। অনেকটা অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে ঘর থেকে বের হয় শিপু। যাওয়ার আগে রাহেলা বেগমের রুমের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে বলে,-যাচ্ছি মা। রাহেলা বেগম কিছু বললেন না। ধরে নিয়েছেন চড় মারায় অভিমান করেছে। কয়েকদিন বান্ধবীর বাসা থেকে ঘুরে আসুক। শিপু ঘড়ি দেখল, রাত সোয়া নয়টা। গাড়ি নিয়ে বেরুনো যাবেনা। সে চায়না কেউ তার ঠিকানা জানুক। কাজেই রিকশা নিল সে। পূর্ণিমা না হলেও চাঁদের কারণে চারপাশে বেশ আলো ছিল। লোডশোডিংয়ের কারণে ল্যাম্পপো¯ট গুলোও ছিল বন্ধ। একাকী নির্জন রাস্তায় ঠাণ্ডা ভেজা হাওয়ার মধ্য দিয়ে শিপু রিকশা করে যাচ্ছে। তার কাছে তখন মনে হচ্ছিল যেন সে রিকশায় বসে নেই, একজোড়া গোলাপী ডানায় ভর করে উড়ে উড়ে যাচ্ছে।
**
অনেক্ষণ পর্যন্ত টেলিফোন সেটটার দিকে তাকিয়ে আছে শাহেদ। এরকম অদ্ভুত সুন্দর সেট সে আগে কখনও দেখেনি। রিসিভারটা হল একটা নগ্ন জলকন্যা। আর বাকিটা একটা শাপলা ফুলের মত। যেন শাপলা ফুলে জলকন্যা শুয়ে আছে। সেটটা দেখলেই শুধু ফোন করতে ইচ্ছে করে। সে ঠিক করে ফেলেছে টাকা হলেই প্রথম কাজ হবে এরকম একটা টেলিফোন সেট কেনা। সে বসে আছে অনন্যা প্রাইভেট লিঃ কো¤পানীর এম ডির রুমে। রুমে ঢুকেই অবাক হয়ে যায় সে। এই একমাত্র রুমে বোধহয় এসি লাগানো নেই। আর সবখানেই আছে। দ্বিতীয়বার অবাক হয় টেলিফোন সেটটা দেখে।
-বোস।
শাহেদ সেটটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়েই বসে।
-কি দেখছো?
-স্যার, টেলিফোনটা দেখছি, অসাধারণ
-ওটা আমার বন্ধু পাঠিয়েছে। সিঙ্গাপুর থেকে। পাঁচ হাজার ডলার দাম। বাংলাদেশী টাকায় কত?
-স্যার প্রায় তিন লক্ষ টাকা
-প্রত্যেক কথায় স্যার স্যার করবেনা
শাহেদ ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড হতাশ হয়। সে জানে অত টাকা তার কখনও হবেনা। আর হলেও অন্তত টেলিফোন সেটটা কিনতে পারবেনা।
-বলতো, এটার বিশেষত্ব কি?
শাহেদ ভেবে পেলোনা, কথা বলার একটা যন্ত্রের কি এমন বিশেষত্ব থাকতে পারে।
-বলতে পারবনা স্যার।
-জলকন্যার হাতের দিকে তাকাও, মাঝের দুটো আঙ্গুলে দুটো হীরের আংটি আছে। ওগুলোর জন্যই অত দাম।
অনন্যা প্রাইভেট লিঃ কো¤পানীর এম ডি হলেন ওসমান সাহেব। বয়স ষাটের কাছাকাছি। তবে তাঁর আচরনে এখনও কিছুটা ছটফটে ভাব আছে। হীরের আংটি গুলোর কথা বলার সময় মিটি মিটি হাসছিলেন তিনি। শাহেদেকে অবাক হতে দেখে খুবই মজা পাচ্ছেন যেন।
-স্যার জলকন্যার হাতে একটা ভুল আছে।
ওসমান সাহেব চোখ কুঁচকে জলকন্যার দিকে তাকালেন। কিন্তু ভুলতে কোথায় ধরতে পারছেন না। অথচ তার সামনে বসা সদ্য নিয়োগ করা পি এ বলছে এতে একটা ভুল আছে।
-কোথায়?
-স্যার জলকন্যার দুটো হাতেরই বুড়ো আঙ্গুল বাঁদিকে। অথচ বাঁ হাতের বুড়ো আঙ্গুলটা ডান দিকে হওয়ার কথা ছিল।
ওসমান সাহেব তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে জলকন্যার ডান হাতের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর মন ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। এত সুন্দর একটা জিনিস! অথচ এত বড় একটা ভুল! মনে মনে শাহেদকে উদ্দেশ্য করে বললেন, -নাহ্ ছেলেটার মাথা আছে! বুদ্ধিমান পি এ পেয়ে কিছুটা আনন্দিত হলেন তিনি। তবে মনের একপাশ ভয়ংকর ভাবে খুঁতখুঁত করতে লাগল, নাহ্ এতবড় একটা ভুল!
শাহেদ বুঝতে পারছে না তার কাজটা কি? শুধু জানে সে হল ব্যাক্তিগত সহকারি। তার মানে হাট বাজারও করতে হবে নাকি!
-ক¤িপউটার জানা আছে?
-জ্বি স্যার আছে।
-আপাতত তেমন কোন কাজ নেই, একটা আত্মকাহিনী লিখছি, টাইপ করে দিতে হবে।
-জ্বি স্যার।
-ভাল কথা, বানান ভুল করা চলবেনা
-আচ্ছা।
-বেতন কি প্রতিদিন নিয়ে যাবে, নাকি মাস শেষে?
-স্যার মাস শেষেই নেবো।
-তাই নাও, তাতে আলাদা আনন্দ আছে, ভাল কথা বিয়ে করেছ?
-জ্বি স্যার।
-বউকে গিয়ে আবার বলোনা যেন, বুড়ো আমাকে টাইপিষ্টের চাকরি দিয়েছে।
শাহেদ হেসে ফেলে। ওসমান সাহেব হাসতে গিয়ে কেশে ফেললেন। কড়া ধরনের সিগারেট খাচ্ছিলেন তিনি। সিগারেট খাওয়ার সময় হাসা ঠিক না। বুড়োকে পছন্দ হয়ে যায় শাহেদের। মানুষটাকে খুবই সহজ সরল মনে হচ্ছে। আলাদা কোন গাম্ভীর্যতা নেই। তবে প্রখর ব্যাক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ। শাহেদ যা খুব দ্রুত বুঝে নিয়েছে। উঠে দাঁড়ায় শাহেদ।
-শোন।
-জ্বি স্যার।
-যাওয়ার সময় ম্যানেজারের কাছ থেকে টাকা নিয়ে যেও। প্রথম দিন এরকম সবাইকে দেওয়া হয়। ভাল কথা বউয়ের নাম কি?
-ভাল নাম জানিনা, ছোট নাম শিপু।
ওসমান সাহেব আবার হেসে ফেললেন, তবে এবার আর কাশতে হয়নি।
-বউয়ের জন্য একটা কিছু নিয়ে যাবে, মনে থাকবে?
-থাকবে স্যার।
-ওকে, যেতে পার এখন।
-স্লামালিকুম স্যার।
শাহেদের বাঁ চোখটা সামান্য ভিজে গেছে। তার এই একটা রোগ আছে। চোখে পানি আসলে আগে বাঁ চোখে আসে।
নীলুর ড্রয়ার অর্ধেকটাই ভর্তি। সবই হিন্দী গানের ক্যাসেট। শিপু অনেক খুঁজেও কোন রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্যাসেট পেল না। তার খুব গান শুনতে ইচ্ছে করছে। টেবিলের একপাশে মিনি ক্যাসেট প্লেয়ারটা দেখেই তার ইচ্ছেটা জাগে। অনেক সময় নিয়ে গোসল সেরেছে শিপু। গত কয়েকদিনের টেনশন সব ধুয়ে চলে যাওয়ার জন্য। ছোটখাট একটা অন্যায় করে ফেলেছে সে। নীলুকে না জানিয়ে তার একটা শাড়ি পড়ে ফেলেছে। সবুজ আর নীলের ডোরাকাটা শাড়ি। তবে তাকে তেমন অপরাধীর মত লাগছে না। যেন নিজের শাড়িই পরেছে। মাঝে মাঝে আঁচল ঠিক করছে। শেষ পর্যন্ত একটা ক্যাসেট খুঁজে পেলো শিপু। তার নিজের ব্যাগের মধ্যেই। কলকাতার শিল্পীর গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত। খাটের পাশেই ছোটখাট একটা ড্রেসিং টেবিল। আয়নাটা গোল। নিজেকে কিছুক্ষণ দেখল শিপু। তারপর চিরুনিটা হাতে নিয়ে মাথায় বুলোতে লাগল। ততক্ষনে অনুরাধা নতুন গান শুরু হরেছেন,
“যদি বারণ কর তবে গাহিবনা
যদি শরম লাগে তবে চাহিবনা”
কেমন যেন অভিমান অভিমান একটা ভাব আছে গানটার মধ্যে। শিপুর হঠাৎ করে খুব অভিমান করতে ইচ্ছে করে। আগে প্রায়ই সে অভিমান করত শাহেদের ওপর। এমন কিছু অভিমানও ছিল যা শাহেদ বুঝতেই পারতনা।
সেদিন খুব সকালেই ক্লাশে চলে আসে শিপু। আকাশী রংয়ের শিফন শাড়ি পরেছিল সে। চুলে একটা রজনীগন্ধার খোঁপা। রাহেলা বেগম তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে মেয়েকে জরিপ করলেন।
-ব্যাপারটা কি?
-কোন ব্যাপার না মা, সাজতে ইচ্ছে হল সেজেছি, তুমি কি মনে করছ আমি প্রেম টেম করি? ডেটিং করতে যাচ্ছি?
রাহেলা বেগম কোন কথা বললেন না। চুপ করে থাকলেন। তিনি বেশিরভাগ সময়ই চুপ করে থাকেন।
-যাচ্ছি বলে আর দাঁড়ালো না শিপু। সে আজ সত্যিই ডেটিংএ যাচ্ছে। সারাদিন রিকশা করে ঘুরার প্ল্যান করেছে তারা।
শাহেদ পরেছে গাঢ় নীল রংয়ের ফুল হাতা শার্ট। শার্টটা দেখেই মেজাজ তিরীক্ষী হয়ে যায় শিপুর। এই গরমে পরেছে ফুল হাতা শার্ট! কেন! হাফ হাতা পরলে কি ক্ষতিটা হত! শাহেদকে কোন কথাতেই কাজ হবেনা। নির্লীপ্তভাবে একটু হাসবে শুধু। শিপু চোখ কুঁচকে তাকায় তার দিকে। মেজাজ খারাপ হলেই চোখ কুঁচকে যায় তার। অনেক চেষ্টা করেও সোজা করতে পারে না। শুরুতেই তার মেজাজ গেল বিগড়ে। শাহেদ চুপ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। -কেমন আছ টাইপেরও কিছু বলছে না। শুুধু মাঝে মাঝে হাতের আঙ্গুল গুলো তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছে। যেন আঙ্গুলের মধ্যে বিরাট কোন রহস্য আছে। শিপুর দিকে তেমন একটা তাকাচ্ছে না সে। অথচ এখন অসংখ্য চোখের দৃষ্টি শিপুর গায়ে লেগে আছে। রূপবতীদেরও একটা সীমা আছে। শিপুকে মনে হচ্ছে সেই সীমাও পার করে এসেছে। ফর্সা গলায় স্বর্ণের সরু চেন। তাতে আবার নীল লকেট।
-চল।
শিপুর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে শাহেদ। এখন আর নির্লীপ্ত ভাব নেই। সিরিয়াস টাইপের একটা গাম্ভীর্যতা এসেছে চেহারায়। শিপু মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সে আশা করছিল শাহেদ বলবে, -তোমাকে অবিকল জলপরীর মত লাগছে তার উত্তরে সে বলবে, -তুমি কি জলপরী দেখেছ নাকি?
শাহেদ কিছুই বলেনি! এবং শুধু মাত্র -সুন্দর লাগছে টুকুও বলেনি। মানুষ এতটা নির্বিকার হয় কি করে! শিপু বুঝতে দিতে চাচ্ছে যে, রাগ করেছে।
রিকশা ঠিক করেছে শাহেদ। রিকশা ভাড়া নিয়ে তর্ক করবেনা সে। এই ব্যাপারটাও অসহ্য লাগে শিপুর। তার মনে হয় ভাড়া নিয়ে তর্ক না করাটা ভীরুতার লক্ষ্মন। শাহেদ একটা আস্ত ভীরু। রাগটা আরেকটু বাড়ে তার।
রিকশায় পাশাপাশি বসে দুজন। শাহেদ একটু দুরত্ব বজায় রেখে বসে। শিপুর গা ঘেঁসে বসার চেষ্টা সে কখনই করেনা। এই একটা ব্যাপার শিপুর ভীষণ পছন্দ। ঘেঁষাঘেসি, ঢলাঢলি এসব অসহ্য লাগে তার। মাঝে মাঝে অবশ্য শাহেদের হাত ধরতে চায়। তবে হাত ধরলেই শাহেদ উস্খুস্ করতে থাকে। ঘনঘন হাতের দিকে তাকাবে। যেন হাত ধরে মহা অন্যায় করে ফেলেছে শিপু। বাধ্য হয়ে হাতটা ছেড়ে দিতে হয় তখন। হাত ছাড়লেই আবার স্বাভাবিক! কেন যেন এটাও ভীষণ ভাল লাগে শিপুর।
রিকশায় অনেক্ষণ পর্যন্ত কোন কথা হল না তাদের মধ্যে। শিপু মাঝে মাঝে আড়চোখে শাহেদকে দেখছে। কিন্তু শাহেদ সামনের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যেন কোথাও চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছে। মনে মনে প্রশ্নের উত্তর ঠিক করে নিচ্ছে।
-কি ভাবছ?
শাহেদ মাথা নিচু করে আছে। কি উত্তর দেবে ভেবে পাচ্ছে না। সে এতক্ষণ ভাবছিল নীলুর কথা। নীলু আজ ভয়ংকর জেদ ধরেছিল সিনেমা দেখতে যাবে। কিন্তু সে রাজী হয়নি। শেষে নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয় সে। আর সে চলে আসে এদিকে। তার মনে কেবল একটাই দৃশ্য ভেসে আসছে বারবার। দরজার সামনে চাচা দা নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছেন। আর ঘরের ভেতর থেকে বিলাপ করে কান্নার শব্দ আছে। সে কি সত্যটাই বলবে শিপুকে? নাহ্ এখন সত্য বলতে ইচ্ছে হয় না তার।
-কিচ্ছু না।
-ও আচ্ছা!
শিপু হাত দিয়ে কপালের চুল ঠিক করছে। শাহেদ ছোট্ট করে একটা কাশি দেয়। মাথা নিচু করেই বলে,
-তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।
শিপু অবাক হওয়ার ভান করে।
-তাই নাকি!
-হ্যাঁ।
-সুন্দর দিয়ে করবটা কি! ধুয়ে পানি খাব?
শাহেদ এবার শিপুর দিকে তাকায়। কিছুক্ষণ পরেই বলে,
-তোমাকে জলপরীর মত লাগছে।
-তুমি কি জলপরী দেখেছ নাকি? কথাটা বলতে গিয়েও বলতে পারে না শিপু। গলায় এসে আটকে যায়। তার পরিবর্তে বলে,
-আমরা কোথায় যাচ্ছি?
শাহেদ চুপ করে থাকে। সে নিজেও জানেনা তারা কোথায় যাচ্ছে।
-কি ব্যাপার কিছু বলছোনা যে!
-জানিনা।
-জানিনা মানে!
-কোথায় যাব তা আমি কি করে বলি! যাওয়ার কথা বলেছ তুমি।
শিপুর চোখ আবার কুঁচকে যায়। সুন্দরি মেয়েদের চোখ কুঁচকানো থাকলে তাদের চেহারা পাল্টে যায়। শিপুর চেহারাও পাল্টে গেল।
-তারমনে উদ্দেশ্যহীন যাত্রা! বাহ্! ভালইতো!
শিপু ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। শাহেদও হাসে, তবে সহজ সরল হাসি। সে মাঝে মাঝে খুব ব্যাস্ত ভঙ্গীতে এদিক সেদিক তাকায়। যেন খুব মনযোগ দিয়ে রাস্তা পর্যবেক্ষণ করছে। রাস্তায় সামান্য একটু ময়লা দেখলেও চোখ নাক কুঁচকে ফেলবে। শিপু হঠাৎ খোঁপা থেকে রজনীগন্ধার মালা খুলে ব্যাগের মধ্যে রাখে। খোঁপা খুলতেই চুলগুলো পুরো পিঠ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। হঠাৎ মেঘের আড়ালে সূর্য ঢাকা পড়েছে। একটু পরেই শুরু হল কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস। ঝড়ের পূর্ব লক্ষ্মন। এমন আবহাওয়া শিপুর খুব প্রিয়। বাতাসটাও তার ভীষণ ভাল লাগছে। মাঝে মাঝে চুল উড়ে গিয়ে পড়ছে শাহেদের গালে। ব্যাপারটা শাহেদের কেমন লাগছে তা বুঝতে পারছে না শিপু। অথচ তার খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছে। সে কি জিজ্ঞেস করবে তাকে? নাহ্ শাহেদ বুঝবেইনা কিছু। সে শুধু বোকার মত হা করে বলবে, -তোমার চুল আমার মুখে কেন লাগবে?
শিপুর হঠাৎ মনে হল এই মুহুর্তে শাহেদের হাত ধরতে না পারলে তার জীবনটাই বৃথা। হাত ধরাটা খুব সহজ ব্যাপার তার জন্য। খপ্ করে ধরে ফেললেই হল। হাত ধরতেই চমকে উঠে শাহেদ। অবাক হয়ে তাকায় শিপুর দিকে। আর আড়চোখে তার হাতের দিকে তাকাচ্ছে।
-হাত ধরেছ কেন?
ব্যাস্ শিপুর হল মারাত্মক অভিমান। মারাত্মক অভিমান কখনও প্রকাশ পায়না। শিপুও তাই হাতটা আস্তে করে ছেড়ে দেয়। শাহেদ বুঝতেই পারে না কিছু। যদিও হাত ধরায় তার ভীষণ ভাল লেগেছিল। অল্পের জন্য শিপু কেঁদে ফেলেনি সেদিন। শুধু চোখ সামান্য একটু ভেজা ভেজা হয়ে গিয়েছিল। সাথে সাথে প্রতিজ্ঞা করে বসে আর কখনও শাহেদের হাত ধরবেনা।
-একটা কৌতুক শুনবে?
-না শুনবোনা।
মজার একটা কৌতুক মনে এসেছিল শাহেদের। বলতে না পারার কারণে ভিতরটা কেমন যেন খুঁতখুঁত করতে লাগল।
-খুব মজার কৌতুক, শুনবে?
শিপু চোখ দুটোকে যতটা সম্ভব কঠিন করে শাহেদের দিকে তাকায়।
-ঘুরতে বেরিয়েছি নিশ্চয়ই শুধু কৌতুক শোনার জন্যে নয়
-সত্যিই খুব মজার ঘটনা, বলি?
-আর একটা কথা বললে ধাক্কা দিয়ে রিকশা থেকে ফেলে দেব।
রিকশাওয়ালা ঘটনায় খুব মজা পাচ্ছে। সে মাঝে মাঝে ঘাড় দুলিয়ে হাসে। শিপুর কথা শুনে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে তাকায়। রিকশাওয়ালার হাসি দেখে শিপুর চোখ কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে যায়।
-এই যে শুনুন! নাম কি আপনার?
-জ্বে?
-নাম কি?
-মোহাম্মদ মতলব মিয়া।
-মতলব মিয়া! আপনার মতলব তো সুবিধের মনে হচ্ছে না! এতবার পিছন ফিরে কি দেখেন?
মতলব মিয়াকে দেখে মনে হয় সে অতটা ভয় পায়নি। মাঝে মাঝে আড়চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে মৃদু শব্দে শিষ বাজায়। মতলব মিয়ার শিষের শব্দে শিপুর চেহারা ক্রমান্বয়ে কঠিন হয়ে যাচ্ছে। শাহেদ শিপুর সেই কঠিন হয়ে যাওয়া চেহারার দিকে তাকিয়ে আছে। অদ্ভুত সুন্দর লাগছে তাকে। এমন সময় মেঘের আড়াল থেকে সূর্যটা বেরিয়ে এল। সূর্যের আলোয় মেয়েদের চেহারা কিছুটা হলেও ঝলমল করে। শাহেদ অবাক হয়ে শিপুকে দেখছে। এমন আশ্চর্য সুন্দর মেয়ের পাশে বসে সে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরছে ভাবতেই কেমন এক ধরনের শিহরন জাগে মনে। তার হঠাৎ ইচ্ছে হল শিপুকে বলে, -আমার হাতটা একটু ধরবে? কিন্তু বলতে পারে না শাহেদ। কে জানে হয়তো লজ্জা লাগছে তার। আবার হয়তবা বলার ইচ্ছেতেই আনন্দ।
জেবুন্নেছা বেগম অনেক্ষণ শিপুকে খেয়াল করছিলেন। মেয়েটা সত্যি সত্যি পাগল নয়ত? না হলে এতক্ষণ কেউ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে! একবার ভাবলেন গিয়ে জিজ্ঞেস করবেন, শরীর খারাপ কিনা। আবার ভাবলেন, কি দরকার! আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকাত কোন রোগ না। থাকুক দাঁড়িয়ে! নিজের সৌন্দর্য দেখুক। বড়লোকের মেয়ে! কত কি খেয়াল! শিপুকে দেখে ভেতরে ভেতরে একটু ঈর্ষা হয় জেবুন্নেছা বেগমের। তার মেয়ে এই মেয়ের তুল নায় মোটেও সুন্দর না। নীলুকে শিপুর পাশে দাঁড় করালে দাসী বাঁদির মত লাগবে। রোদে ঘুরে ঘুরে চামড়াটা একেবারে নষ্ট করে ফেলল মেয়েটা। জেবুন্নেছা বেগম ভাবলেন, -নাহ্ মেয়েকে এবার ঘরে আটকাতে হবে, বিয়ের বয়স হয়ে গেছে। এরই মধ্যে দুয়েকটা প্রস্তাবও এসেছে। শুধু মেয়ের পড়ালেখার জন্যই দেরি করা। তা না হলে এত দেরি করতেন না। জেবুন্নেছা বেগম নিজের ভাবনায় নিজেই অবাক হয়ে গেলেন। নীলুর বয়সটা তিনি নিজেও পার করে এসেছেন। কত কি উদ্ভট সব ভেবে এসেছেন তিনি। অথচ এখন নিজেকে কেমন যেন হাত পা বাঁধা একটা প্রানীর মত মনে হয় তাঁর। যা ভাবা উচিৎ তাই ভাবছেন। নিয়মের বাইরে কিছুই আর ভাবতে রাজী নন তিনি।
দুপুরে খাওয়ার পর রহিমুল্লাহ সাহেব কোন কাজ খুঁজে পান না। মেয়েরাও থাকে বাইরে। এই সময়ে তিনি ঘুমোতে পারেন না। অথচ জেবুন্নেছা বেগম এই সময়ে না ঘুমিয়ে পারেন না। সারাদিন কাজ করে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েন তিনি। ঘরে এখন নতুন একজন মানুষ আছে, তা না হলে নিজেকে পুরোপুরি নিঃসঙ্গ মনে হত তাঁর। চশমাটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ আয়না পরি®কার করলেন তিনি। আর মাঝে মাঝে শিপুর দিকে তাকাচ্ছেন। শিপু মাঝে মাঝে এঘর ওঘর ঘুরে বেড়াচ্ছে। রহিমুল্লাহ সাহেবের খুব চা খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু শিপুকে বলবেন কিনা ঠিক করতে পারছেন না। শিপুর সাথে চোখাচোখি হতেই তিনি গভীর মনযোগ দিয়ে আয়না পরিষ্কার করতে থাকেন।
-চা খাবেন বাবা?
রহিমুল্লাহ সাহেব তীক্ষ্ম চোখে শিপুর দিকে তাকালেন। তবে চোখের দিকে তাকাতে পারলেন না। তাঁর ধারণা মেয়েটা খুবই বুদ্ধিমতী। চোখ দেখেই বুঝে ফেলবে তাঁর চা খেতে ইচ্ছে করছে। তিনি খেয়াল করলেন না শিপু তাকে -বাবা বলে ডেকেছে। তিনি কিছু না বলে শুধু -হুঁ জাতীয় একটা শব্দ করলেন। রহিমুল্লাহ সাহেবের ভীষণ ইচ্ছে হল মেয়েটাকে ডেকে বলেন, -তুই বেঁেচ থাক্ মা কিন্তু তা না বলে তিনি গভীর মনযোগ দিয়ে একটা পুরনো পত্রিকা পড়তে লাগলেন।
শিপু তাঁর সামনে চায়ের কাপ রাখল। সে নিজের জন্যেও এক কাপ নিয়ে আসে। রহিমুল্লাহ সাহেবের সামনে রাখা চেয়ারে বসে সে। আড়চোখে চায়ের কাপের দিকে তাকান রহিমুল্লাহ সাহেব। তাঁর সামনে মেয়েটাও বসে আছে। হাত বাড়িয়ে কাপ নেবেন কিনা ভাবছেন। ভেবেছিলেন চায়ের কাপ সামনে এগিয়ে দেবে মেয়েটা। শিপু খুব আয়েশ করে চায়ের কাপে চুমুক দেয়। অনেকটা ইচ্ছে করেই শব্দ করে চুমুক দেয় সে। রহিমুল্লাহ সাহেব চোখ কুঁচকে তার দিকে তাকান। তিনি নিজেও শব্দ করে চা খান। তবে আরেকজনের শব্দ সহ্য হয় না তাঁর। আস্তে করে কাপ হাতে নেন তিনি। তাঁর সামনে শিপু বাচ্চা মেয়ের মত পা দোলাতে থাকে। মনেই হচ্ছে না সে এ বাড়ির বৌ। রহিমুল্লাহ সাহেবের ইচ্ছে হল কড়া কিছু বলতে। কিন্তু মেয়েটা বুদ্ধিমতী। বুদ্ধিমতীদের কড়া কিছু বলা মুশকিল। তারা কড়া কথার মর্যাদা বুঝবেনা। ভাববে তাদের অপমান করা হয়েছে।
-চায়ে চিনি হয়েছে বাবা?
এ নিয়ে দুবার -বাবা বলেছে শিপু। কিন্তু রহিমুল্লাহ সাহেব ব্যাপারটা একবারও ধরতে পারলেন না।
-হুঁ
শিপু পা নাচানো বন্ধ করে দেয়। মিথ্যে রাগ দেখিয়ে বলে,
-শুধু হুঁ বললে বুঝব কি করে?
-চিনি হয়েছে।
গম্ভীর গলায় জবাব দেন রহিমুল্লাহ সাহেব। কিন্তু শিপু ফিক্ করে হেসে উঠে। কিছুক্ষণ পর বলে,
-আমি একদমই চিনি দেইনি, তবু মিষ্টি হয়েছে?
রহিমুল্লাহ সাহেব ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। তাঁর হাত কেঁপে উঠে চা ছলকে পড়ে পাঞ্জাবীতে। চায়ের দাগ সহজে ওঠার নয়। পাঞ্জাবীর দিকে চোখ কুঁচকে তাকান তিনি। তা দেখে শিপু আরেকবার হেসে ওঠে। উঠে গিয়ে চিনি আনতে যায় সে। রহিমুল্লাহ সাহেব অবাক হয়ে শিপুর দিকে তাকান। চায়ে চিনি না দেওয়ার রহস্যটা তিনি এখনও ধরতে পারেননি।
রহস্য তেমন কিছুইনা। শিপু চেয়েছিল চা পর্বটা একটু দীর্ঘ হোক্, ইচ্ছে করেই তাই চিনি দেয়নি। খুব সাবধানে চামচ দিয়ে চিনি নাড়ে শিপু। কেন না কাপটা রহিমুল্লাহ সাহেবের হাতে ধরা। অসাবধান হলেই চা আবারো পাঞ্জাবীতে পড়বে।
-আমি কি আপনার পাশে একটু বসব বাবা?
এবার ব্যাপারটা খেয়াল করলেন রহিমুল্লাহ সাহেব। অবিকল নীলুর মত করে তাঁকে -বাবা ডাকল মেয়েটা। নীলুর শাড়ি পরায় তাকে লাগছেও নীলুর মত। রহিমুল্লাহ সাহেব কিছু বলার আগেই তাঁর পাশে বসে যায় শিপু। রহিমুল্লাহ সাহেবের ইচ্ছে হল মেয়েটার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিতে। কিন্তু এক রহস্যজনক সংকোচে ভুগছেন তিনি। চশমা খুলে আবার পরিষ্কার করায় ব্যস্ত হলেন। শিপুর দিকে না তাকিয়েই বললেন, -তোমার ভাল নাম কি মা? শিপু অবাক হওয়ার ভান করে বলে, -কেন বাবা, শিপু কি খুব খারাপ একটা নাম? দুজনেই হেসে উঠে। রহিমুল্লাহ সাহেব হো হো করে হাসতে লাগলেন। যেন বড় কোন কৌতুক শুনেছেন এই মাত্র। সহজে হাসি থামছে না। অনেকদিন এমন করে হাসেননি তিনি। হাসি থামিয়ে আবার জিজ্ঞেস করেন তিনি,
-তোমার বাবা কি করেন?
-বাবা নেই
রহিমুল্লাহ সাহেব নেই এর অর্থ বুঝতে পারলেন না। তিনি না বুঝেই বললেন,
-কোথায় গেছেন তিনি?
-তিনি মারা গেছেন।
শান্ত কণ্ঠে জবাব দেয় শিপু। রহিমুল্লাহ সাহেবের চোখ আবার কুঁচকে যায়। মৃত্যু সংবাদ শুনলে যে সূরা পড়তে হয় তাও ভুলে গেছেন তিনি। বিড়বিড় করে পড়লেন, -লা ইলাহা ইল্লা আন্তা—-
শিপু আস্তে আস্তে উঠে চলে যায়। সে ইচ্ছে করেই উঠে চলে আসে। রহিমুল্লাহ সাহেবের অপরাধী মুখের দিকে তাকাতে তার ভাল লাগছে না।
রহিমুল্লাহ সাহেবের চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। চিনি ঠিক মত হলেও মুখ কেমন যেন তেতো হয়ে গেছে। শিপুর বাবা নেই শুনে নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হল তাঁর। তাঁর উচিৎ ছিল মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়া। তিনি তা করতে পারেননি। চশমা হাতে নিয়ে বসে আছেন তিনি। পরিষ্কার করতেও ইচ্ছে হচ্ছে না। হঠাৎ করে তাঁর মনে হল তিনি খুব নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছেন। চুপ করে হাতে ধরা চশমার কাঁচের দিকে তাকিয়ে আছেন। কাঁচের একপাশ সামান্য ঘোলাটে হয়ে আছে। এত ঘষাঘষি করেও পরিষ্কার হল না!
**
পাঁচশ টাকার কড়কড়ে নোটগুলো থেকে মিষ্টি একটা ঘ্রাণ বেরুচ্ছে। বাচ্চা ছেলের মত কয়েকবার ঘ্রাণও শুঁকলো শাহেদ। গুনতে ইচ্ছে করছে না তার। হাজার পাঁচেক হবে বোধহয়। এত টাকা দিয়ে কি করবে বুঝতে পারছে না সে। অনেককিছু কিনে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে। বিয়ের পর থেকে শিপুর জন্য কিছুই নিতে পারেনি সে। একটা শাড়িও না। শাড়ি কিনতে অনভ্যস্ত সে। দেখা যাবে, উদ্ভট রংয়ের একটা শাড়ি সে পছন্দ করে বসল। ব্যাস্ একবার পছন্দ হলেই হল, সেটাই তার চাই। নীলুকে সাথে নিয়ে আসলে বেশ হত। সে শাড়ি খুব ভাল চিনে। নীলুর জন্যেও একটা কিছু নিতে হবে। কিছু কবিতার বই নেয়া যায়। মেয়েটা কবিতা খুব পছন্দ করে। শাহেদের সবচেয়ে অপছন্দ হল কবিতা। কবিতার তেমন কিছুই বোঝেনা সে। জটিল সব শব্দ। পুরো জিনিসটাই হিজিবিজি মনে হয় তার কাছে। কড়া রোদ। দুপুুর একটার মত বাজে। এখনও খায়নি শাহেদ। কেন যেন রোদ টাকে অতটা খারাপ লাগছে না তার। বরং কেমন যেন উষক্স একটা ভাব। সামনে একটা শাড়ির দোকান দেখেই ঢুকে পড়ল সেখানে।
নীলুর ফিরতে সন্ধা হয়ে গেল। বাসায় ঢুকেই বুঝতে পারল একটা কিছু হয়েছে। কেমন যেন থমথমে একটা পরিবেশ। বারান্দায় তার বাবা চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। মাকে দেখল হারিকেনের মধ্যে তেল ঢোকাচ্ছে। নিজের রুমে ঢুকেই নীলু একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায়। শিপু বিছানায় উপুড় হয়ে কাঁদছে। বাচ্চা মেয়ের মত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না। নীলু কি করবে বুঝতে পারছে না। -কি হল কাঁদছ কেন? এটাও বলতে পারছে না। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে শেষে অন্য আরেকরুমে চলে যায় সে। এই রুমটা আরিফার নিজস্ব রুম। এখন বোধহয় নীলুকেও এই রুমে থাকতে হবে। ব্যাগ রেখেই টাওয়েল নিয়ে বাথরুমে ঢুকে সে। মুখে কিছুক্ষণ ঠান্ডা পানির ঝাপটা দেয়। আয়নায় নিজেকে দেখে খানিক্ষণ। চুলগুলো কেমন রুক্ষ্ম দেখাচ্ছে। পানি দেওয়ায় মুখের মলিন ভাবটা চলে গেছে। নিজেকে সতেজ মনে হচ্ছে তার। মাথার মধ্যে কেবল মাত্র একটাই প্রশ্ন ঘুরছে, -কি হল?। শাহেদকে ঘরে দেখেনি সে। বোধহয় অফিস থেকে এখনও ফেরেনি। নীলুর বুকটা কেমন যেন কেঁপে উঠে। শাহেদের কিছু হয়নিতো! নাহ্ তাহলে মাকে অত স্বাভাবিক লাগতনা। নিশ্চয়ই কোন কিছু নিয়ে মন খারাপ করেছে শিপু। একমাত্র সম্ভাব্য ঘটনা এটাই হবে। তবু নীলুর টেনশন কমছে না। নিজেই অবাক হয় সে। শাহেদকে নিয়ে সে অত ভাবছে কেন? তাকে নিয়ে ভাবার মানুষ এসে গেছে। খুব সুন্দরি এবং রূপবতী মানুষ। তোয়ালে দিয়ে মুখ মোছার সময় খট্ করে একটা ঘটনা মনে পড়ে যায় নীলুর। তোয়ালেটা জোর করে মুখে চেপে ধরে। ঘটনাটা কিছুতেই মনে করতে চায়না সে। তবু পুরোটাই পরিষ্কার মনে পড়ল তার।
সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত শাহেদ পড়ছে। সে থাকত ড্রয়িং রুমেরই পাশের একটা খাটে। খাটের পাশেই তার ছোট একটা পড়ার টেবিল। তাতে রাজ্যের বই খাতা। কিছু বই নীলুর ড্রয়ারেও রাখত সে। দরকার হলেই নীলুকে বলত সে। নীলু বই এনে দিত। রাত প্রায় একটা বাজে। বাইরে ভয়াবহ বৃষ্টি হচ্ছে। যে কোন মুহুর্তে ইলেকট্রিসিটি চলে যেতে পারে। সে জন্যে হাতের কাছে বড় একটা মোম আর লাইটার রাখা আছে। তখন সবে সিগারেট খাওয়া শিখেছে সে। তাই লাইটারও থাকত সবসময়। শাহেদের খুব প্রিয় একটা জিনিস হল লাইটার। যথারীতি হঠাৎ করে বাতি নিভে গেল। লাইটার দিয়ে মোমবাতি জ্বালাতেই ভুত দেখার মত চমকে উঠে শাহেদ। তার সামনে ঘোমটা দেওয়া একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অসাধারণ ভাবে সাজগোজ করা। কোন কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। মোমের আলোয় তার ছায়া দেওয়ালে নাচানাচি করছে। শাহেদ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। অপ্রাকৃতিক কোন কিছুতে সে বিশ্বাস করেনা। তবে প্রকৃতির নিয়মের বাইরেও অনেক কিছু ঘটে। সেক্ষেত্রে নিয়ম ভাঙ্গাটাই প্রকৃতির আরেক নিয়ম বলে মেনে নেয় সে। আজও কি সেই নিয়ম ভাঙ্গা কোন কিছু ঘটবে? ঘোমটা দেওয়া মেয়েটা হটাৎ খিলখিল করে হেসে উঠে। শাহেদ এতটাই অবাক হয়েছে যে পরিচিত খিল্খিল্ হাসিটা বুঝতেও তার পাঁচ সেকেন্ড সময় লাগল।
-কি ভয় পেয়েছ?
নীলুর ঠোঁটে পরিষ্কার দুষ্টুমির হাসি। আর শাহেদ রীতিমত হা করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। যেন সামনে পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য দেখতে পাচ্ছে। আর একবার ঘড়ির দিকে তাকায় সে। ঘড়িটা ঠিকমত চলছেত? প্রায় দেড়টা বাজতে চলল।
-এত রাতে!
শাহেদের মুখে কথা ফুটে। নীলু চোখ নাচিয়ে রহস্যময় হাসি দেয়। শাহেদ কিছু বুঝতে না পেরে আবার বলে,
-হাসছিস্ কেন?
-তোমাকে দেখতে এলাম।
-আমাকে! এত রাতে!
-এত রাত, এত রাত করছ কেন? কী-ই বা এমন রাত! তার আগে বল আমাকে কেমন লাগছে। শাহেদ ছোট্ট করে একটা ঢোক গিলে। নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করে বলে,
-সুন্দর।
-শুধু সুন্দর?
শাহেদ কি বলবে ঠিক বুঝতে পারছে না। বোধহয় এখন তার বেশি সুন্দর টাইপের কিছু বলা উচিৎ। কিন্তু গলা দিয়ে ঠিকমত শব্দ বেরুচ্ছে না তার। নীলু উত্তরের জন্য অপেক্ষা করেনা, তার আগেই ফট্ফট্ করে বলে যায়,
-অনেক সময় নিয়ে সেজেছি কিন্তু! লিপ¯িটক, আইভ্রু, টিপ্– আচ্ছা নীল টিপে আমাকে কেমন লাগছে?
-অন্ধকারের জন্য বোঝা যাচ্ছে না, কাল টিপের মত লাগছে।
পরিবেশটা কিছুটা সহজ করার জন্য কথাটা বলে শাহেদ। নীলুর চোখে মৃদু হাসির ঝিলিক দেখা যায়। হয়তো শাহেদকে নার্ভাস হতে দেখে মজা পাচ্ছে সে।
-কি! আমাকে খুব খারাপ মেয়ে ভাবছ, তাই না? এত রাতে এক যুবকের রুমে এক সুন্দরি যুবতী মেয়ে-আচ্ছা আমি সুন্দরি তো?
শাহেদ তার টেবিলের ওপর পড়ে থাকা খোলা বইটার দিকে তাকিয়ে থাকে। যেন নীলুর কথা শুনতে পায়নি। নীলু এগিয়ে এসে শাহেদের পাশেই খাটের মধ্যে বসে। এবার নীলুকে পুরোপুরি দেখতে পায় শাহেদ। মোমের আলোয় তেমন একটা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে না সে, তবে নীলুর হাত বুকের আড়াআড়ি ভাবে বুকের ওপর রাখা। ডান হাত দিয়ে বাঁ হাতের কব্জি ধরে রেখেছে সে। হঠাৎ বাঁ হাতটা শাহেদের দিকে বাড়িয়ে ধরে সে। এবার আগের চেয়েও একটু বেশি চমকে উঠে শাহেদ। রক্তে ভেসে যাচ্ছে নীলুর বাঁ হাতটা। মোমের আলোয় লাল রক্তকে কালোর মত লাগছে। শাহেদ দিশেহারার মত এদিক সেদিক তাকায়। আর নীলুর ঠোঁটে সেই রহস্যময় হাসি। যেন শাহেদের দিশেহারা ভাবটা খুব উপভোগ করছে। শেষে নিজের পকেটে হাত দেয় শাহেদ। ভাগ্যিস্ রুমালটা ছিল পকেটে। তড়িঘড়ি করে নীলুর হাতে পেঁচিয়ে দেয় রুমালটা। রুমালটাকে ঠিকমত বাঁধা যাচ্ছে না। তা দেখে খিলখিল করে হাসতে লাগল নীলু। শাহেদ বুঝতে পারছে না এতে এতো হাসির কি আছে! অবশেষে রুমাল দিয়ে নীলুর কাটা জায়গাটা চেপে ধরে শাহেদ।
-কিভাবে হল?
এতক্ষনে একটু কথা বলে শাহেদ। নীলুর হাসির মাত্রাটা আরেকটু বেড়ে যায়। তবে নিঃশব্দ হাসি। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকের জন্য নীলুর মুখে সাদা আলো এসে পড়ছে। তাতে তার হাসিটা আরো ভৌতিক হয়ে যায়। শাহেদ অবাক হয়ে নীলুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ হাসি থামায় নীলু। একদম ডেড ষ্টপ্ যাকে বলে। চেহারা পুরোপুরি স্বাভাবিক। একটু আগে যে হেসেছিল, তারও কোন চিহ্ন নেই। ঠোঁটের রহস্যময় হাসিটাও মুছে গেছে।
-ইচ্ছে করে কেটে ফেলেছি।
শাহেদের চেহারা দেখে মনে সে কথাটা ঠিক বুঝতে পারছে না। কেউ আবার ইচ্ছে করে হাত কাটতে পারে নাকি! সে কাটা যায়গায় অবাক হয়ে তাকায়। রুমাল বেয়ে তার হাতও খানিকটা ভিজে গেছে রক্তে। নীলুর হাতটা ছেড়ে দেওয়ার সাহসও পাচ্ছে না সে। নীলু কড়া চোখে তাকায় শাহেদের দিকে।
-কি হল! একটা যুবতী মেয়েকে একা পেয়ে ধরে রেখেছ কেন? তোমার মতলবটা কি শুনি?
শাহেদ আলতো করে হাতটা ছেড়ে দেয়। যেন রুমালটা পড়ে না যায়। আর ব্যস্ত হয়ে এদিক সেদিক তাকায়।
-চাচা চাচী দেখলে কি বলবেন!
নীলু ঘাড় ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকায়।
-কি বলবেন তা আমি কি করে বুঝব? আমার ইচ্ছে হয়েছে এসেছি। কোন খারাপ উদ্দেশ্য নিয়েতো আসিনি! তোমার অত ভয় লাগছে কেন? কোন উদ্দেশ্য আছে নাকি?
নীলু চোখ কুঁচকে তাকানোর চেষ্টা করে। তার চোখে স্পষ্ট কৌতুকের আভাস। কিন্তু শাহেদ অতটা বুঝতে পারে না। সে নীলুর দিকে অনুনয়ের চোখে তাকিয়ে বলে,
-প্লিজ এমন করিসনা! তুই তোর রুমে চলে যা!
-যদি না যাই!
শাহেদের প্রচণ্ড পানির পিপাসা হয়। টেবিলে জগ রাখা আছে। কিন্তু পানি ঢেলে খাওয়ার মত শক্তিও যেন তার নেই। হাত পা সব অসাড় হয়ে আছে। মোমের আলোয় নীলুকে কেমন যেন ভয়ংকর লাগছে তার কাছে। তার ওপর তার হাতের মধ্যে লেগে আছে রক্ত। রক্তের মধ্যেই চোখ পড়লেই বুকের মধ্যে ধক্ করে ওঠে। এমন সময় নীলু হাত বাড়িয়ে শাহেদের হাত ধরে। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের আলোয় শাহেদ দেখল নীলু কাঁদছে। নীলুকে এক অদ্ভুত মেয়ে মনে হয় তার কাছে। হঠাৎ হঠাৎ করে কোন কারণ ছাড়াই কেঁদে বসে। যদিও নীলুর কান্নার অ®পষ্ট ধোঁয়াটে একটা কারণ আছে। নীলু শাহেদের দিকে তাকায়। চোখে একরাশ পানিও ঠোঁট বাঁকিয়ে একটু হাসে সে। হাসি নাকি কান্না, কোনটা সত্যি বুঝতে পারছে না শাহেদ। সে শুধু অবাক হয়ে নীলুকে দেখে আর মনে মনে বলে -অদ্ভুত মেয়েতো!। নীলু আবার হাত সরিয়ে নেয়। চোখ মুছতে মুছতে বলে,
-তোমাকে একটু ভয় পাইয়ে দিতে এসেছি মিঃ আপেল এবং আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট সফল। তুমি ভয় পেয়েছ। আমার হাত কাটেনি, আলতা দিয়ে রক্ত বানিয়েছি, হি হি হি
শাহেদের বিষ¥য় এখনও পুরোপুরি কাটেনি। একটা মেয়ে এত রাতে অস্বাভাবিক ভাবে সেজে এসে তাকে ভয় দেখাবে, এটা সে বিশ্বাস করতে পারছে না।
হঠাৎ করেই নীলু উঠে চলে যায়। চলে যাওয়ার মুহুর্তেই বিদ্যুৎ আবার চমকায়। নীলুর মুখ পরিষ্কার দেখতে পায় শাহেদ। চোখের পাপড়ি সব ভেজা। এক সাথে অনেক পানি বের হলে যেমনটা হয়। নীলু সত্যি সত্যিই কেঁদেছিল। শাহেদ একদৃষ্টে তার হাতের দিকে তাকিয়ে থাকে। আলতার মত মনে হচ্ছে না। সত্যিকারের রক্তের মতই লাগছে।
**
মাঝে মাঝে অকারণে অভিমান হয় শিপুর। কারো ওপর অভিমান নয়। এমনি এমনি অভিমান। বুকের মধ্যে আস্তে আস্তে অভিমান দলা পাকায়। শেষে কোন কারণ ছাড়াই বাচ্চা মেয়ের মত কেঁদে ওঠে। তার হঠাৎ মনে হল সবাই তাকে একটা রাস্তার মেয়ে ভাবছে। তার মনে হচ্ছে সে মদের আসরের একজন পার্টটাইম নর্তকী ছিল। টাকা পেলেই বিভিন্ন উৎকট ভঙ্গীমায় নাচ দেখাত। এখন সে ভুল করে এখানে চলে এসেছে। যদিও তা মনে হওয়ার ততটা সিরিয়াস কোন কারণ ছিল না। তবু কান্না থামাতে পারে না শিপু। বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ওঠে।
অবশ্য কাঁদার একটা সূক্ষ্ম কারণ আছে। তার ধারণা, নীলুর মা জেবুন্নেছা বেগম তাকে সামান্য অবজ্ঞা করার চেষ্টা করছেন। মহিলাকে প্রথম প্রথম তার সহজ সরল মনে হচ্ছিল। কিন্তু বিকেলে যখন সে রান্নাঘরে জেবুন্নেছা বেগমের পাশে গিয়ে বসে, তখনই সে বুঝতে পারে তার আসার কারণে তিনি কিছুটা বিরক্ত হয়েছেন। জেবুন্নেছা বেগম বসে বসে রুটি সেঁকছিলেন। শিপুকে দেখে প্রথমে চোখ তুলে তাকান। কিন্তু পরেই আবার মাথা নিচু করে রুটি সেঁকতে থাকেন। তবে তার সূক্ষ্মভাবে ঠেঁাঁট বাঁকানোটা শিপুর চোখ এড়ায়না। শিপু হাসি হাসি মুখ করেই বলে,
-মা আমি রুটি সেঁকতে জানি, আমাকে দিন্।
জেবুন্নেছা বেগম এমন ভাবে চোখ কুঁচকে তাকান যেন একটা বাচ্চা মেয়ে এসে তার কাজের বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। তিনি কিছু না বলে চুপ করে নিজের কাজে ব্যস্ত থাকেন। শিপু প্রথমে ভাবল চলে যাবে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে একটু জেদ হয়। সে হাত দিয়ে কপালের চুল ঠিক করে। আড়চোখে একবার জেবুন্নেছা বেগমের দিকে তাকায়। তার ইচ্ছে হচ্ছিল জোর করে মহিলার হাত থেকে রুটি সেঁকার খুন্তিটা নিয়ে নেয়।
জেবুন্নেছা বেগম সরু চোখে শিপুকে দেখেন। দেখে মনে হচ্ছে যেন রান্নাঘরে এসে চুল ঠিক করে ভীষণ অপরাধ করে ফেলেছে সে। সরু চোখে তাকানোয় তাঁর মুখের সহজ সরল ভাবটা এখন আর নেই। কিছুটা চাপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
-তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।
শিপু খানিকটা চমকে উঠে। কিন্তু তা বুঝতে দিতে চাচ্ছে না। সে আনমনে চুল ঠিক করতে থাকে। জেবুন্নেছা বেগমের দিকে এখন আর তাকাচ্ছে না সে। জেবুন্নেছা বেগম আরো চাপা কণ্ঠে বললেন,
-এটা রান্নাঘর, ড্রেসিং টেবিল নয়।
শিপু স্বাভাবিক ভাবেই চুল থেকে হাত সরিয়ে নেয়। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তার কাজ শেষ হওয়াতেই হাত সরিয়েছে সে, জেবুন্নেছা বেগমের কথা শুনে নয়। এবার কৌতুহলী চোখে জেবুন্নেছা বেগমের দিকে তাকায় সে।
-কি বলবেন?
রুটি পুড়ে যাচ্ছে দেখে তড়িঘড়ি করে চুলোর আগুণ কমিয়ে দিলেন।
-বলছিলাম তোমার মা বাবার কথা।
মুখের কথা কেড়ে নিয়েই শিপু বলে,
-শুুধু মায়ের কথা বলুন, বাবা নেই, মারা গেছেন।
তীক্ষ্ম চোখে শিপুর দিকে তাকান তিনি। যেন ভিনগ্রহের কোন প্রানীকে দেখছেন। কড়া কোন কথা বলার ইচ্ছে হল জেবুন্নেছা বেগমের। কিন্তু ঠিক কি বলবেন বুঝে উঠতে পারছেন না তিনি। ভাবছেন, বাবা নেই মানে উল্টাপাল্টা মেয়েও হতে পারে। সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছেন তিনি। শিপুর কেমন অস্বস্তি হতে লাগল। মহিলাকে দেখে তার মনে হচ্ছে, একটা সরীসৃপ তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার একদম ভেতর পর্যন্ত তাকিয়ে দেখছে। শিপু তার নিজের পায়ের আঙ্গুলের দিকে তাকিয়ে থাকে।
-তোমার মা কি করেন?
শিপুর অস্বস্তিকর ভাবটা কিছুটা কমে।
-ব্যাংকে যথেষ্ট টাকা আছে, মাকে কিছুই করতে হয় না।
-বাবা মারা গেছেন কবে?
-আমার দশ বছর বয়সের সময়।
শিপু খুব দ্রুত উত্তর দেয়। যেন সে এ ধরনের প্রশ্নই আশা করছিল।
-তোমার মা আর বিয়ে করেননি?
শিপুর মাথা হঠাৎ কেমন যেন ঘুরে উঠে। সে ঠিক বুঝতে পারছে না তার কি রাগ করার কথা। নাকি সে স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিবে, -না করেননি। শিপুর কেমন বমি বমি লাগে। তার ইচ্ছে হল রান্নাঘরেই বমি করে বসতে। কোন উত্তর না দিয়ে শিপু তার রুমে চলে যায়। তার রুম মানে নীলুর রুম। এই রুমটাতে ঢুকলেই শিপুর মনে হয় সে পুরো বাড়িটা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। পুরো বাড়িটা হলুদ রং করা। শুধু এই রুমের দেওয়ালে নীল রং করা। হাল্কা আকাশী নীল রং। শিপুর মনে হয় এই রুমটাতে কিছুটা কান্না কান্না ভাব আছে। ঢুকলেই মনে হয় এখন কিছুক্ষণ কেঁদে নেয়া যায়। খুবই হাস্যকর একটা ভাবনা। কিন্তু শিপুর হাসি পাচ্ছে না। তার চোখ ভয়ংকর ভাবে ভিজে গেছে। তবে এখনও গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়েনি। সব পানি আগে চোখে জমা হচ্ছে। একেই বোধহয় চোখ টলমল করা বলে। দেখলে মনে হবে যেন পানির নিচে একটা চোখ ভেসে বেড়াচ্ছে। কে জানে তখন হয়ত চোখকে অন্যরকম সুন্দর মনে হয়।
রাতে খেতে বসে শাহেদের মনে হল সবাই কেমন যেন তাকে একটু এড়িয়ে চলতে চাইছে। সে ভেবেছিল নতুন কাপড় পেয়ে সবাই একটু হলেও চমকে উঠবে। কিন্তু কেউই তেমন একটা ভাব দেখায়নি। শুধু রহিমুল্লাহ সাহেব তাঁর শার্টটা হাতে নিয়ে চোখ কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন।
-এটা পড়লেত আমাকে বুড়ো দেখাবে রে!
শাহেদ জবাব দেয়,
-এ্যাডভান্স অনেক টাকা পেয়েছি, মাথার ঠিক ছিল না, চিন্তা ভাবনা করে কেনা হয়নি।
-শুধু শুধু টাকা নষ্ট করলি কেন?
শাহেদের তেমন একটা ভাবান্তর হয় না। সে নির্লীপ্ত ভাবে বলে,
-টাকা মানেই নষ্ট করার জিনিস।
-টাকা নষ্ট করার জিনিস! তুই আমাকে জ্ঞান দিচ্ছিস্! পড়ালেখা করে এখন দর্শনবিদ্যা ফলাচ্ছিস্! হারামজাদা বের হ ঘর থেকে!
শাহেদের কোন পরিবর্তন নেই। শুধু চোখ একটু কুঁচকে যায়। ঘর থেকে বের হতে বললেও সে ঘরের ভেতর ঢোকে। আরিফা নতুন জামা পেয়ে প্রথমেই বিশাল একটা হাই তুলল। এমন ভাবে জামাটা হাতে নিল যেন প্রতিদিনই তাকে এমন নতুন জামা দেওয়া হয়। আজও নিয়মমাফিক জামা নিচ্ছে সে।
-কি রে! তোকে এমন ক্যাঙ্গারুর মত দেখাচ্ছে কেন?
আরিফা সরু চোখে শাহেদের দিকে তাকায়। কিছুটা গাম্ভীর্যতা আনার চেষ্টা করে চোখে। সে জানে, সে রেগে গেলে একের পর এক বিদ্ঘুটে প্রানীর সাথে তুল না করা হবে তাকে। সে এবার একটা নকল হাই দেওয়ার চেষ্টা করে। ছোট্ট করে বলে,
-থ্যাংক ইউ
-এমন ভাবে হাই দিস্না, ঘরে অনেক মশা, যেকোন মুহুর্তে ফটাস্ করে ঢুকে যাবে। অবশ্য মশা ঢুকলেও সমস্যা নেই, তোর তো আবার মশা খাওয়ার অভ্যাস আছে।
আরিফাকে দেখে মনে হচ্ছে যে কোন মুহুর্তে একটা বিস্ফোরন হতে পারে। তবে বিস্ফোরনের আগ মুহুর্তেই শিপু এসে পড়ে। তার চোখ ততটা ফোলা দেখাচ্ছে না। তবে কিছুটা লালচে হয়ে আছে। শিপু আরিফার দিকে তাকিয়ে সামান্য চোখ নাচায়। আরিফা খুব সিরিয়াস ভাবে বলে,
-ভাবী তুমি এই গন্ডারটাকে এখান থেকে বের হতে বল!
শিপু রাগী চোখে তাকায় শাহেদের দিকে। শাহেদ মৃদু মৃদু হাসে।
-কি ব্যাপার মিঃ তেলাপোকা হাসছেন কেন? শুনতে পাননি কি বলা হয়েছে? নাও গেট আউট্!
শাহেদ রুমে চলে যায়। রুমে টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে কি যেন দেখছিল নীলু। আজ কয়েকদিন ধরে শাহেদের সাথে তার তেমন একটা কথাও হয়নি। শুধু দরজা খুলে দেওয়ার সময় বলেছিল, -এত দেরী হল যে উত্তরে শাহেদ সামান্য একটু হাসে শুধু।
চোখাচোখি হতেই চোখ নামিয়ে ফেলে নীলু। তার হাতে একটা কবিতার বই। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কবিতা দেখছিল সে। শাহেদের আগমনে তেমন একটা ভাবান্তর হয় না তার। শাহেদ হাতের প্যাকেটটা বিছানার ওপর রাখে। রাখার সময় ইচ্ছে করেই একটু শব্দ করে। সে আশা করছিল নীলু তাকে প্যাকেটটার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করবে। নীলু কিছুই বলছে না। শুধু আড়চোখে একবার শাহেদের হাতের দিকে তাকায়।
-দেখ্তো পছন্দ হয় কিনা।
-পছন্দ হয়েছে।
-না দেখেই!
শাহেদের কপালে একটু ভাঁজ পড়ে। নীলু একটা অদ্ভুত টাইপের মেয়ে। না দেখেই বলে কিনা পছন্দ হয়েছে। শাহেদ শাড়ির প্যাকেটটা না খুলেই রেখে দিল। নীলু হঠাৎ শাহেদের দিকে তাকিয়ে সামান্য একটু হেসে ওঠে।
-ভাবীর জন্য কি নিলে, দেখাবেনা?
-ওর জন্য কিছু নেয়া হয়নি, সে নিজের কাপড় নিজে নিতেই পছন্দ করে।
নীলু আবার চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। মাঝে মাঝে বইয়ের পাতা ওল্টায়। একসময় বইটি হাতে নিয়েই রুম থেকে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার আগে শাড়ির প্যাকেটটা আলগোছে তুলে নেয়। তুলে নেয়ার ধরন দেখে বোঝা যায় নিঃশব্দেই রুমের বাইরে যেতে চাচ্ছে সে। শব্দ করতে চায়না।
জেবুন্নেছা বেগম শাড়ি পেয়ে খুব খুশি হয়েছেন। বারবার উল্টেপাল্টে শাড়িখানা দেখছেন তিনি। শাড়িটা ধরার আগে ভাল করে হাতও ধুয়ে এসেছেন তিনি।
-পছন্দ হয়েছে চাচী?
জেবুন্নেছা বেগম কিছুটা চঞ্চল কণ্ঠে জবাব দিলেন,
-কেন শুধু শুধু আমার জন্যেও আনতে গেলি।
-অনেক টাকা একসাথে পেয়ে গেছি।
-তাই বলে!
শাহেদ ঘড়ি দেখে। রাত এগারটার মত বাজে। তার এখনও খাওয়া হয়নি। ভয়ংকর ক্ষিদে পেয়েছে। ঘরের অন্যরা খেয়েছে কিনা কে জানে। শিপু এসে শাহেদের পাশে দাঁড়ায়।
-তুমি যাও হাত মুখ ধুয়ে এস, টেবিলে খাবার দেওয়া হয়েছে
-তুমি খেয়েছ?
শিপু কিছু না বলে চুপ করে থাকে। তার চুপ করে থাকার অর্থ হল সে খায়নি। সবাই যখন খেতে বসেছিল, তখন আরিফা তাকে ডাকতে যায়। সে, -খেতে ইচ্ছে করছে না বলার পর কেউ আর তাকে খেতে বলেনি। রহিমুল্লাহ সাহেব কয়েকবার বলেছিলেন, -মেয়েটা কি না খেয়ে থাকবে নাকি? অন্য সবাই চুপচাপ খাওয়া শেষ করে উঠে যায়। শুধু নীলু ঠিকমত খেতে পারেনি। সে স্পষ্টই বুঝেছে শিপু কারুর ওপর রাগ করে খাচ্ছে না। কিন্তু তার কেন যেন মনে হচ্ছে তার কিছুই করার নেই।
রাতে খাওয়ার পর শাহেদের প্রচণ্ড সিগারেট খেতে ইচ্ছে করে। আগে ছাদে গিয়ে আরাম করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেতে পারত। এখন ছাদে যেতে তার কেমন যেন অস্বস্তি লাগে। শিপুর সামনে সে সিগারেট খেতে পারে না। কাশি এসে যায়। ভয়ংকর কাশি। বিয়ের আগে রাতের বেলায় ছাদে গিয়ে সিগারেট খাওয়া আর আকাশে উড়ে বেড়ানোর আনন্দ তার কাছে একরকম ছিল। প্রায় সব পূর্ণিমাতেই ছাদে রাত কাটাত শাহেদ। নীলুর দায়িত্ব ছিল তার জন্য ছাদে চাদর আর বালিশ নিয়ে যাওয়া এবং যথেষ্ট সময় নিয়ে বিছানা তৈরি করা। আরিফার দায়িত্ব ছিল ফ্লাস্ক ভর্তি করে চা নিয়ে যাওয়া। রহিমুল্লাহ সাহেব শাহেদের এই ছাদে গিয়ে সিগারেট খাওয়ার ব্যাপারটা জানতেন। তাঁর নিজেরও তখন খুব ছাদে যেতে ইচ্ছে করত। কিন্তু জেবুন্নেছা বেগমের ভয়ে যেতে পারতেন না। তাঁর ধারণা তাঁর স্ত্রী রেগে গেলে ভয়ংকর কিছু করে ফেলতে পারে। ঠিক নেই তাঁকে হয়তবা ধাক্কা দিয়ে ছাদ থেকে ফেলেও দিতে পারে। জেবুন্নেছা বেগমের সামনে তিনি কখনই সিগারেট খেতে পারতেন না। আজও বোধহয় পূর্ণিমা। বাইরে চাঁদের আলোর বন্যা বয়ে যাচ্ছে।
শিপুর প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। নীলুর কাছে গিয়ে অষুধ চাইতেও ইচ্ছে হচ্ছে না তার। শাহেদকে দেখল নীলুর রুমে ঢুকতে। মাঝে মাঝে চাপা হাসির শব্দও শোনা যাচ্ছে। হাসির শব্দটা মাথায় খুব ত্মীক্ষ্ম ভাবে ঢুকে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন পাশের রুম থেকে হাসির শব্দ গুলো তার মাথায় এসে জমা হচ্ছে। শিপুর চোখ ভয়ংকর লাল হয়ে গেল। যেন যেকোন মুহুর্তে ফেটে রক্ত গড়িয়ে পড়বে। বিছানায় শুয়ে জোর করে চোখ বন্ধ করে শিপু। মনে হয় সহজে ঘুম আসবেনা তার। উল্টোদিক থেকে সংখ্যা গুনতে শুরু করল। একশ-নিরানব্বই– পঁচাত্তর পর্যন্ত গুনতেই আবার হাসির শব্দ শুনতে পায় সে। সংখ্যা এলোমেলো হয়ে যায়। পঁচাত্তর থেকে ছিয়াত্তর সাতাত্তর গুনতে থাকে সে। আবার একশ থেকে শুরু করে, একশ-নিরানব্বই—-।
শাহেদের ভীষণ গল্প করতে ইচ্ছে হচ্ছিল তখন। অনেকদিন এরকম গল্প করা হয় না। আগে ছাদে এরকম করে সবাই মিলে গল্প করত তারা। শাহেদের কাজ ছিল কৌতুক বলা। আরিফার ধারণা তার মাথায় কৌতুক রোগ আছে। আজও একের পর এক গল্প করে যাচ্ছিল তারা। আরিফা মাঝে মাঝে খিল খিল করে হেসে উঠছিল। নীলু ঠোঁট বাঁকিয়ে একটু আধটু হাসে। হাসার সময় ঘাড় ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকায় নীলু। তার হাসির ধরনটা ঠিক বোঝা যায় না। আকাশের অবস্থা ততটা ভাল নয়। ছাদে যাওয়া তাই সম্ভব হয়নি।
-শোন্ তারপর হলকি, ভদ্রলোকের মানিব্যাগে পাওয়া গেল-
কৌতুকটা আরিফা আগেই শুনেছিল। এ পর্যন্ত বলাতেই সে হেসে উঠে। তার হাসিতে শাহেদের কণ্ঠ চাপা পড়ে যায়।
নীলু একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে শাহেদের দিকে। এরকম করে সে আরও একবার তার দিকে তাকিয়েছিল। সেদিনের মত আজও শাহেদ সেই তাকানোর অর্থ বুঝতে পারেনি।
আকাশ খুব পরিষ্কার ছিল। অসংখ্য তারা জ্বলজ্বল করছিল। তার চেয়েও বড় কথা ভরা জ্যোৎস্না ছিল সে রাত। ছাদে কেবল দুটি প্রানী। নীলু আর শাহেদ। নীলুর পরনে জেবুন্নেছা বেগমের পুরনো একটা শাড়ি। শুধু চুল গুলো বাঁধা ছিল। আর কপালে একটা টিপ। চাঁদের আলোয় টিপের সত্যিকারের রংটা বোঝা যাচ্ছিল না। শাহেদ পকেটে হাত দিয়ে প্যাকেটটা বের করে। সিগারেট আছে দুটো। রাতের জন্য যথেষ্ট। নীলু আড়চোখে প্যাকেটটার দিকে তাকায়। ভয়ংকর ভাবে চোখ কুঁচকে যায় তার। চাঁদের আলোয় নীলুকে অসাধারণ সুন্দর দেখাচ্ছিল। সুন্দরি মেয়েদের চোখ কুঁচকে তাকানোর মধ্যেও আলাদা একধরনের সৌন্দর্য আছে। শাহেদ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে প্যাকেটটা একপাশে রেখে দেয়। কথার ফাঁকে একসময় খাওয়া যাবে। তখন নীলু খেয়াল করবেনা। নীলু চোখ কোঁচকানো অবস্থাতেই চাঁদের দিকে তাকায়। যেন চাঁদের মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু দেখতে পেয়েছে। তার পাশেই রাখা ক্যাসেট প্লেয়ার। নীলু হিন্দী গানই শুনে শুধু। লতা মঙ্গেশকরের গান চলছে। শাহেদ ওসব গানের তেমন কিছুই বোঝেনা। নীলু মাঝে মাঝে শিল্পীর সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে গুণগুণ করছে। শাহেদের সামনাসামনি বসলেও তার দিকে তেমন একটা তাকাচ্ছে না সে।
-কি ব্যাপার! শরীর খারাপ নাকি তোর?
শাহেদের কথা শুনে ঘাড় ফিরিয়ে তার দিকে তাকায় নীলু। তার চোখে কেমন যেন শান্ত শান্ত একটা ভাব। চোখ দেখে মনে হচ্ছে না সে অসুস্থ। তবু -হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে সে। শাহেদ এগিয়ে এসে নীলুর কপালে হাত রাখে। কপালেই হাত রাখলেই বোধহয় অসুস্থতা বোঝা যাবে। নীলু চোখ বন্ধ করে ফেলে।
-কই! গা তো ঠান্ডা!
নীলু নিঃশব্দে রহস্যময় ভাবে হাসে। লতা মঙ্গেশকর ব্যাকুল হয়ে গানের শেষ লাইন ধরেছেন,
-জ্বিয়া জ্বলে—— জ্বাঁ জ্বলে
শাহেদ রুমেই ঢুকেই দেখে শিপু ঘুমিয়ে পড়েছে। টেবিলের ওপর পিরিচ দিয়ে ঢাকা এক গ্লাস পানির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে সে। এভাবে সুন্দর করে সাজানো পানি দেখলে খেতে ইচ্ছে করে। সে জানে শিপুর রাতে পানি খাওয়ার অভ্যেস আছে। অথচ কিভাবে জানে তা মনে করতে পারছে না। তাদের বিয়ে হয়েছে মাত্র দুদিন হল। তার কাছে মনে হচ্ছে যেন অনেকদিন হয়ে গেছে। শিপুর সাথে কয়েকটা কথা বলতে পারলে ভাল লাগত। ঘুমানোর আগে তার কথা বলতে ইচ্ছে করে। একবার ভাবল শিপুকে জাগাবে। পরেই ভাবনাটা বাদ দিয়ে দিল। ঘুমন্ত শিপুকে দেখতে খুব সুন্দর লাগছে। উপুড় হয়ে শুয়ে আছে সে। মুখ একপাশে বাঁকা করে। হাত দুটো বুকের মধ্যে ভাঁজ করা। কেমন যেন অভিমানী ভঙ্গিতে শুয়ে আছে। কপালে কিছু চুল এলোমেলো ভাবে পড়ে আছে। শাহেদের ইচ্ছে করতে লাগল এগিয়ে এসে চুল গুলো সরিয়ে দেয়। শিপুর কপালেই হাত রাখতেই নড়ে উঠে শিপু। আস্তে করে হাতটা সরিয়ে নেয়। এবার পাশ ফিরে শোয় শিপু। শাহেদ নির্বীকার ভাবে টেবিলের ওপর রাখা পানিভর্তি গ্লাসটার দিকে তাকিয়ে থাকে। বৃষ্টি আসি আসি করেও আসছে না। শুধু কিছুক্ষণ পরপরই মেঘের ডাক শোনা যাচ্ছে। শিপুর জন্য আকাশী রংয়ের একটা শাড়ি নিয়েছিল সে। নীলুকে তখন মিথ্যে বলেছিল। কেন বলেছে শাহেদ জানেনা। শিপুকেও বলা হয়নি শাড়িটার কথা। প্যাকেটেই রয়ে গেছে সেটা।
**
ওসমান সাহেব দীর্ঘ পাঁচমিনিট ধরে হাতের কাগজটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। শাহেদও প্রায় পাঁচ মিনিট হল এসেছে। তার পায়ে ঝিঁ ঝিঁ ধরে গেছে। ওসমান সাহেব তাকে এখনও বসতে বলেননি। হয়ত শাহেদকে তিনি দেখতেই পাননি। শাহেদ ভাবল ভদ্রতা সূচক একটা কাশি তার আগমনটা জানিয়ে দিতে। কিন্তু ওসমান সাহেবের চোখের দিকে তাকিয়ে কাশি দিতে পারে না সে। কাগজটার দিকে গভীর মনযোগের সাথে তাকিয়ে আছেন তিনি। কাশির আওয়াজ শুনে বিরক্ত হতে পারেন। আড়চোখে একবার কাগজটার দিকে তাকায় শাহেদ। দেখে মনে হচ্ছে চিঠির মত একটা কিছু হবে। এবং চিঠি যে লিখেছে তার হাতের লেখা খুবই সুন্দর। টেবিলের দিকে তাকিয়ে শাহেদের মনে হল কি যেন নেই। পরক্ষনেই ধরে ফেলল সে জলকন্যা টেলিফোন সেটটা নেই। নিজের ওপর খানিকটা রাগ হল শাহেদের। তার ভুল ধরে দেওয়ার জন্যেই সেটটা সরিয়ে ফেলেছেন ওসমান সাহেব। সুন্দর জিনিসের অত ভুল ধরতে নেই। সামান্য একটু মন খারাপ হয় তার। ওসমান সাহেব মাথা তুলে শাহেদকে দেখলেন। খানিকটা চোখ কুঁচকে যায় তাঁর। ইশারা করে বসতে বললেন। সাথে সাথে আবার গভীর মনযোগের সাথে কাগজটা দেখতে লাগলেন। শাহেদ ভাবল, এক পাতার একটা চিঠি পড়তে বুড়োর এতক্ষণ লাগছে কেন? নাকি অন্যকিছু দেখছে।
-কোল্ড হেল! কোল্ড হেল মানে বুঝ? ঠান্ডা দোযখ!
ওসমান সাহেব মাথা না তুলেই বললেন। তাঁর চেহারাতেও খানিকটা ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব আছে। শাহেদ নির্লীপ্ত ভাবে বলে,
-জ্বি স্যার।
ওসমান সাহেব কাগজটা ভাঁজ করে পকেটে রাখেন। পকেটে রাখার অর্থ হল এটা একটা চিঠি। অফিসিয়াল কাগজ হলে নিশ্চয়ই পকেটে রাখতেন না। শাহেদের দিকে সরু চোখে তাকান তিনি। তার ভাব ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে শাহেদের ইন্টারভিউ নিতে বসেছেন তিনি। যেকোন মুহুর্তে হাসি হাসি মুখে ভয়ংকর প্যাঁচালো কোন প্রশ্ন করে বসতে পারেন।
-আমি এসি লাগাইনা এজন্যে, অনেকেই বলে আধা পাগল, এসি ছাড়লেই মনে হয় ঠান্ডা দোযখে আছি। তোমার কি মনে হয়?
-জ্বি স্যার।
ওসমান সাহেব মৃদু মৃদু হাসেন। তাঁর হাসি দেখে মনে হয় গোপন একটা কিছু জেনে ফেলেছেন। শাহেদের কেমন যেন অস্বস্তি লাগে। বুড়োকে সে ঠিক অপছন্দ করছে না। তার মনে হচ্ছে ওসমান সাহেব আসলেই আধা পাগল। একবার ভাবল চিঠিটার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করবে। পরেই ভাবল, না থাক, কি দরকার! ওসমান সাহেব সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন,
-তোমাকে দেখছি শুধু শুধু কাজে নিয়েছি। একবারও জিজ্ঞেস করলে না ঠান্ডা দোযখের সাথে চিঠিটার কি সম্পর্ক।
-কি সম্পর্ক স্যার?
ওসমান সাহেব এবার শব্দ করে হেসে উঠেন। যেন শাহেদের কাছে মজার কোন কৌতুক শুনেছেন এইমাত্র। সিগারেটের ছাই ফেলতে ফেলতে বললেন,
-টেবিলের ওপর রাখা ফাইলটা নাও। যা লেখা আছে শুরু করে দাও। সময় কম।
শাহেদ মনে হয় হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। যাক্ এতদিনে একটা কাজ পাওয়া গেল। সাদা রংয়ের ফাইলটা তুলে নেয় শাহেদ। তার কাজের জন্য আলাদা একটা রুমের ব্যবস্থা করা আছে। রুমটা প্রথমবার দেখেই পছন্দ হয় তার। একপাশে কিছু সাজানো ফুলগাছও আছে। নকল গাছ না, সত্যি সত্যি গাছ। সত্যি গাছে আবার সত্যি ফুলও আছে। তা না হলে ফুলের ঘ্রান পেতনা সে। তার রুমে এসি থাকলেও তা চলছে না। মাথার ওপর সিলিং ফ্যান ঘুরছে। কে জানে এসি হয়ত নষ্ট। শাহেদের কোন ভাবান্তর হয় না। কাজ পেয়েই সে সন্তুষ্ট। নিজেকে এই প্রথম একটা কিছু মনে হচ্ছে তার।
আয়নায় অনেক্ষণ নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন তিনি। চামড়ায় তেমন একটা ভাঁজ পড়েনি। শুধু চুল কিছুটা পেকে গেছে। আয়নাটা পরি®কার করা হয়নি। নীলু আগে প্রতিদিন আয়না পরি®কার করতো। অপরি®কার আয়নায় তাঁকে কেমন যেন বুড়ো বুড়ো লাগছে। নীলুর কথা মনে হতেই একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন রহিমুল্লাহ সাহেব। তিনি তাঁর নিজের মেয়েকে এখনও ঠিক মত বুঝে উঠতে পারেননি। নাকি এ বয়সে তেমন একটা বোঝাও সম্ভব না। রহিমুল্লাহ সাহেব চোখ কুঁচকে আয়নার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তবে আয়নায় তিনি এখন আর নিজেকে দেখছেন না। তিনি ভাবছেন শিপুর কথা। মেয়েটাকে প্রথমে অহংকারী মনে হয়েছে তাঁর কাছে। কিন্তু অহংকারী মেয়ে তাঁকে কখনও -বাবা বলে ডাকবেনা। -বাবা ডাক শুনে প্রথমেই তিনি ভেতরে ভেতরে একটা ধাক্কা খান। কিন্তু অতটা বুঝতে দেননি। তাঁর মনের ক্ষুদ্র একটা অংশ শিপুকে তেমন একটা পছন্দ করতে পারছে না। নীলুর বিয়ে নিয়ে তেমন একটা ভাবেননি তিনি। এখন ভাবার সময় এসেছে। তাঁর মনে হচ্ছে, মেয়ের বিয়ে এক মহা জটিল ব্যাপার। আয়নার দিকে এবার সরু চোখে তাকচ্ছেন তিনি। কেউ দেখলে মনে করবে তিনি আয়নার খুঁত বের করতে ব্যস্ত। সরু চোখে আয়নার দিকে তাকিয়ে তিনি মেয়ের বিয়ে সংক্রান্ত জটিল সমস্যার সমাধান খুঁজে বেড়াচ্ছেন।
**
নীলুর শরীর খারাপও করেনি মাথাও ধরেনি, তবু সে ঠিক করেছে আজ ক্লাশে যাবেনা। আজ সারাদিন মায়ের সাথে রান্নাঘরে কাটাবে। রান্নাঘরে ঢুকলে মাকে রোবটের মত মনে হয়। তার কাছে রান্না করাটা মহা আনন্দের একটা বিষয় হলেও মাকে দেখে তা মনে হয় না। রান্না করার আছে করে যাচ্ছে করে যাচ্ছে। প্রতিদিনই একই স্বাদ। লবন কখনও কম বেশি হবেনা।
-কি রে! তুই ক্লাশে গেলি না?
নীলু অলস ভঙ্গীতে একটা হাসি দেয়। সবুজ পাড়ের পুরনো একটা শাড়ি পরেছে সে। জেবুন্নেছা বেগম শাড়িটার দিকে তাকিয়ে চোখ কুঁচকে ফেললেন।
-আজ আমি রান্না করব মা।
জেবুন্নেছা বেগম শাড়ি থেকে চোখ তুলে এবার নীলুর দিকে তাকান। মনে হচ্ছে যেন তিনি নীলুর কথা ঠিক বুঝতে পারছেন না।
-তুই রাঁধবি মানে! আর শোন্! তোকে এই শাড়ি পরতে কে বলেছে?
-কেন কি হয়েছে? আমাকে কি কাজের বুয়ার মত লাগছে?
নীলুর কন্ঠে একটু নকল রাগ। এগিয়ে এসে মায়ের কাঁধে হাত রাখে সে। জেবুন্নেছা বেগমের মুখ কেমন একটু মলিন দেখায়। নীলুর দিকে না তাকিয়েই বললেন,
-তোকে রান্নাঘরে আসতে হবেনা! শুধু শুধু চামড়া নষ্ট!
নীলু এবার দুহাত দিয়ে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে।
-মা, আমার চামড়া এমনিতেই নষ্ট, আমি হলাম চামড়া নষ্ট মেয়ে। তুমি দেখছনা ভাবী আমার চাইতে কত ফর্সা!
জেবুন্নেছা বেগমের চোখ কেমন যেন সরু হয়ে যায়। হয়ত শিপুকে ভাবী বলার কারণেই। নীলু মায়ের হাত থেকে জোর করে চামচটা কেড়ে নেয়। মাছ আর আলু দিয়ে রান্না হচ্ছিল। চামচে করে একটু লবন চেখে দেখল সে।
-হুঁ, হয়েছে
জেবুন্নেছা বেগম একদৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার মতে, এই মেয়ে ভয়াবহ বুদ্ধিমতী। সবকিছু বুঝে ফেলে। নীলুকে আগামী কাল দেখতে আসবে। মেয়েকে তাই রান্নাঘর থেকে সরাতে চাচ্ছেন তিনি। চামড়া নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে। নীলুকি বুঝে ফেলেছে? তাকে কাল ছেলেপক্ষ দেখতে আসবে। জেবুন্নেছা বেগমের একটু ভয় ভয় করতে লাগল। এই মেয়ের কোন বিশ্বাস নেই। বিয়ের কথা শুনে কে জানে কি করে বসে! জেবুন্নেছা বেগম কিছু বলার আগেই নীলু বলল,
-তুমি কি ভাবছ মা? আমার বিয়ের কথা?
-উদ্ভট কথা বলিসনা! তোর বিয়ের কথা ভাবব কেন?
-বারে! মেয়ে বড় হয়েছে, বিয়ে দিতে হবেনা? লোকে কি বলবে!
নীলু মিটি মিটি হাসতে থাকে। জেবুন্নেছা বেগমের ভয় আরেকটু বেড়ে যায়। নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছেন তিনি।
-দেখি আমাকে দে! তুই পারবিনা!
নীলু মায়ের হাতে চামচ দিয়ে দেয়। তারপর হাত পেছনে ঘুরিয়ে চুল বাঁধে। কপালে হাত দিয়ে দেখল টিপ দেওয়া হয়নি। আজ খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেছিল সে। উঠেই সাথে সাথে ছাদে চলে যায় সে। ভোরবেলায় ছাদটাকে অন্যরকম সুন্দর মনে হয় তার কাছে। সোয়েটার গায়ে দিয়ে আসেনি। ঠান্ডা বাতাসে মাঝে মাঝে কুঁকড়ে যাচ্ছিল সে। ঘড়ি দেখল, সাড়ে পাঁচটার মত বাজে। ঘড়ি থেকে চোখ ওঠাতেই শিপুকে দেখতে পেল সে। দেখে বুঝল অনেক সময় নিয়ে সেজেছে সে। নীলুকে দেখেই ঘাড় বাঁকিয়ে সামান্য হাসলো শিপু। তবে হাসির উত্তরে নীলু তেমন একটা হাসেনি। শিপু এগিয়ে এসেই নীলুর পাশে দাঁড়ায়।
-উফ্ ভীষণ ঠান্ডা তাই না?
নীলু ছাদে রাখা দুটো গোলাপ গাছ দেখছিল। এই গাছগুলি কিছুদিন আগে নিয়ে এসেছিল সে। এখনও কোন নাম দেওয়া হয়নি। নাম দিতেও ইচ্ছে হচ্ছে না তার। শিপুর কথা শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে একবার দেখে নীলু। কিন্তু কিছু বলল না। শিপু কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো সরায়। এবার নীলুর দিকে না তাকিয়েই বলে,
-আমি জানি তুমি ওকে খুব পছন্দ করতে।
গাছের মরা পাতা ফেলতে গিয়ে হঠাৎ থমকে যায় নীলু। তারপর সামান্য মুচকি হেসে আবার পাতা পরি®কারে ব্যস্ত হয়। শিপু হয়ত কোন উত্তর আশা করেনি। সে আবার বলে,
-সে আমাকে তোমার কথা কখনও বলেনি।
এবার নীলুও একটা উত্তর দেয়। কেমন যেন কৌতুকের সুরে বলে,
-বললে কি হত?
শিপু এই প্রশ্নের হঠাৎ কোন উত্তর খুঁজে পায়না। আমি জানতাম শাহেদ ভাই তোমাকে খুব পছন্দ করত। তার একটা বইয়ে আমি তোমার ছবি দেখেছি। ওহ্ সরি -তুমি করে বলে ফেললাম।
শিপু রাগ হবার ভান করে বলে,
-উঁহুঁ কোন সরি মেনে নেয়া হবেনা। তুমি করে বলায় তোমার শাস্তি হবে!
নীলু হেসে ফেলে। অতটা শব্দ করে হাসি নয়। আবার নীরব হাসিও না।
-কি শাস্তি হবে?
শিপু কণ্ঠ একটু কড়া করার চেষ্টা করে।
-এখুনি দুকাপ গরম গরম চা চাই!
-দুকাপ কেন?
-বারে! আমি আর তুমি খাব!
নীলু আবার গোলাপ গাছগুলির দিকে তাকায়। অন্যমনস্ক ভাবে বলে,
-শাহেদ ভাই ওঠেনি?
-নাহ্! বাবুর ওঠার সময় এখনও হয়নি
শিপু একটা নকল দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নকল দীর্ঘশ্বাসের শব্দ অ®পষ্টভাবেই শোনে নীলু। তারপর আবার মৃদু হাসে সে। হাসতে হাসতে চায়ের জন্য নিচে যায়।
চা নিয়ে আসে আরিফা। আজ সেও খুব ভোরে ভোরে উঠেছে। কেমন যেন গম্ভীর দেখাচ্ছে তাকে। নকল গাম্ভীর্যতা না সত্যি সত্যিই গম্ভীর। কিছুদিন আগেই চৌদ্দবছর পার করেছে সে। শিপু দেখল, আরিফাকে খুব বড় বড় দেখাচ্ছে। হঠাৎ করে যেন যুবতী হয়ে গেছে। চেহারা প্রায় নীলুর মতই। তবে বোনের চেয়েও আরো বেশি ফর্সা আরিফা। সদ্য ঘুম থেকে ওঠায় তাকে আরো বেশি সুন্দর লাগছে। এলোমেলো শুকনো চুলগুলো সারা পিঠে ছড়িয়ে আছে। এই মুহুর্তে শিপুর ইচ্ছে করল আরিফার একটা নাম দিয়ে দেয়। কি নাম দেওয়া যায় ভাবতে ভাবতেই চা নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায় আরিফা।
-নাও।
শিপু হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ নেয়।
-চিনি হয়েছে কিনা দেখ।
শিপু না খেয়েই বলল, -হয়েছে
আরিফা চোখ কুঁচকে তাকায়। শিপু মিটি মিটি হাসে।
-এসব অদ্ভুত কথা আমাকে বলবেনা, আমি এখও ছোট্ট মেয়ে নই।
-হুঁ, আপনি এখন আর কিশোরী নন! আপনি হলেন -এ কমপ্লিট যুবতী
আরিফা আরেকটু গম্ভীর হয়ে চায়ে চুমুক দেয়। আরিফার গায়ে সোয়েটার দেখে শিপুরও কিছুটা শীত শীত করতে লাগল। কিছুক্ষণ পরপর কেঁপে উঠছে সে। গাড় নীল রংয়ের শাড়ি পরেছে শিপু। নীল রংয়ের টিপও পরেছে সে। গোল টিপ না, লম্বাটে টিপ। চুল অনেক্ষণ আঁচড়ে তারপর বেঁধেছে। গোসল করায় তার চোখমুখ চক্চক্ করছে। হঠাৎ মনে হল শিপুর, আরিফার কি মন খারাপ? নাকি তার ওপর রাগ করে আছে। রাগের কারণ কী?
-কি হল মিস্ আরিফা? কথা বলছেন না কেন?
কথাটা একটু হেসে বলার চেষ্টা করে শিপু। আরিফা তীক্ষ্ম চোখে শিপুর দিকে তাকায়। তীক্ষ্ম চোখে তাকানোয় তার কপাল কিছুটা কুঁচকে গেছে। কপালে ভাঁজ পড়ায় তাকে কিছুটা যুবতীর মতই দেখাচ্ছে।
-এভাবে সেজেছো যে? কোথাও যাবে নাকি?
শিপু আবার হাসে। উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকে। আরিফাও অতটা উত্তর আশা করছে না।
-অবশ্য এমনি এমনি সাজা যায়, আমি সাজি মাঝে মাঝে
-কেমন লাগছে আমাকে?
-সত্যি বলব? নাকি মিথ্যে বলব?
-মিথ্যেটাই শুনি আগে।
-তোমাকে সুন্দর লাগছে।
আরিফার চোখে হাসি চিক্চিক্ করতে লাগল। সত্যিটা বলার জন্যে মনে হচ্ছে উন্মুখ হয়ে আছে সে।
-সত্যিটা শুনবেনা?
শিপুর ঠোঁটে তখনও কিছুটা হাসি।
-সবসময় সত্যিটা শুনতে হয় না।
-এসব দার্শনিক টাইপের কথা বলবে না। শুনতে অসহ্য লাগে। এখন বল সত্যিটা শুনবে কিনা!
শিপু ওপর নীচ মাথা নাড়ে। কিন্তু আরিফা তাতে সাড়া দেয়না। শিপু আড়চোখে আরিফার দিকে তাকায়।
-কই! বলবে না!
আরিফা একবার ভেবেছিল সত্যিটা বলবে না। কিন্তু তার ভীষণ বলতে ইচ্ছে হওয়ায় শেষপর্যন্ত বলেই ফেলল,
-সত্যিটা হল তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।
শিপু একটু থমকে যায়। হাত কেঁপে একটু চা ছলকে পড়ে। সে এমনটি আশা করেনি। আরিফার চোখেও মুচকি হাসি। শিপুকে অবাক করতে পেরে সে কিছুটা আনন্দিত। এখন আর তেমন একটা বড় মনে হচ্ছে না তাকে। ছোট্ট মেয়ের মতই মনে হচ্ছে।
**
শ¤পা ক্রমাগত হেসেই যাচ্ছে। তার হাসি থামছে না। কেউ দেখলে মনে করবে এই মেয়ের কাজই হচ্ছে হেসে যাওয়া। গড়াগড়ি খাওয়া হাসিনা। তিন সেকেন্ড বিরতিতে খিলখিল করে হেসে যাওয়া। হাসির বিপরীত হচ্ছে কান্না। কিন্তু কেউ এইভাবে কাঁদতে পারবেনা। কান্নাটা একবারে শুরু আর একবারে শেষ। তিন সেকেন্ড পরপর কাঁদা সম্ভব না। পাগলরা এইভাবে কাঁদতে পারে। শ¤পাকে দেখতে কিছুটা পাগলীর মতই লাগছে এখন। হাসির কারণটা এখনও ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। কারণ না জানায় নীলুও হাসতে পারছে না। এই ধরনের হাসিতে অন্যজনের বিরক্ত হবার কথা। নীলুকে দেখে বোঝা যাচ্ছে না সে বিরক্ত হয়েছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে শ¤পার হাসিতে তার তেমন কোন আগ্রহ নেই। হাসতে হাসতেই শম্পা বলে, শোন্ টক্টকে লাল রংয়ের কোট পরেছে, অল্পদামে পেয়ে কিনে নিয়েছে, হি হি হি, তাও আবার, হি হি, মেয়েদের কোট, হি হি হি— হাসির মাত্রা আরেকটু বেড়েছে। নীলু বিরক্ত হয়ে শম্পার দিকে তাকায়।
-দ্যাখ্ না বুঝে পরেছে, আর, তুই এত হাসবিনাতো! সবাই কেমন করে তাকিয়ে আছে!
শ¤পার হাসি থেমে গেছে। তবে হাসির রেশ কাটেনি এখনও। মাঝে মাঝে হেঁচকি উঠছে। ক্লাশ রুমের পাশের সিঁড়িতে বসে আছে দুজন। আসার পর থেকেই শ¤পার হাসিরোগ শুরু হয়। টানা পাঁচ মিনিট হাসার পর এবার চুপ হয়ে যায় শ¤পা। তার চুপ করে থাকারও সমস্যা আছে। পাশের জন একনাগাড়ে বকবক করে গেলেও সে কিছু বলবেনা। একসময় পাশের জন বিরক্ত হয়ে তার দিকে চোখ কুঁচকে তাকাবে। তখন সে গম্ভীর হয়ে বলবে, -এমন করে কি দেখছিস্! পাশের জন তখন বাধ্য হয়ে বলবে, -কিছু না এমনি। নীলুও চোখ কুঁচকে তাকিয়ে আছে শ¤পার দিকে। সে শ¤পাকে বুঝতে চেষ্টা করছে। এক ছ্যাবলার সাথে প্রেম হয়েছে তার। সেই ছ্যাবলা আজ লাল রংয়ের কোট পরে এসেছে। তা দেখেই শ¤পার হাসি শুরু। কোটটা মেয়েদের নাও হতে পারে। এই অংশটা শ¤পার বানানো। এই মেয়ে প্রয়োজনমত কথা বানাতে পারে। একসময় বানানো কথাকেই সত্যি বলে বিশ্বাস করবে। তার প্রেমে পড়ার ঘটনাটাও এমন ধরনের। ছ্যাবলার নাম হাসান। বাংলায় মাষ্টার্স করছে। বাংলায় যারা পড়ে তারা সাধারণত কথা বলায় খুবই চালাক হয়। ফট্ফট্ করে কথা বলে যাবে। হাসানকে দেখে নীলুর মনে হয় এই ছেলে কথার -ক ও বলতে পারে না। পারবে শুধু ঝিম মেরে বসে থাকতে। আর মাঝে মাঝে অফিসের বস কে -ইয়েস্ স্যার -নো স্যার বলতে। তার দ্বারা হঠাৎ লাল কোট পরা অস্বাভাবিক কিছুনা। শম্পার মত মেয়ের পক্ষে এমন ছেলের প্রেমে পড়া প্রায় অসম্ভব পর্যায়ের ঘটনা। এই অসম্ভব ঘটনা সম্ভব হয়েছে নীলুর মাধ্যমেই। সেদিন শম্পার সাথে সামান্য ঝগড়া বেধে যায় তার। ঝগড়ার কোন বিষয় ছিল না। তুচ্ছ একটা রং নিয়ে ঝগড়াটা বাধে।
-আমি সিওর ওটা খয়েরী শম্পার কড়া -সিওর কে সাথে সাথে উপেক্ষা করে নীলু বলে,
-তুই সিওর সিওর করে চিৎকার করলেতো হবেনা! এটা গাড় লাল রংয়ের শার্ট, সূর্যের আলো পড়ায় এমনটা লাগছে
-তুই সূর্য বিজ্ঞানী হয়েছিস্! তোর কথায় রং সব পাল্টে যাবে। সাদা হবে কালো, খয়েরী শার্টকে বলবি টকটকে হলুদ শার্ট!
নীলু বুঝতে পারে শম্পা রেগে যাচ্ছে। তার রাগ দেখে খানিকটা বিরক্ত হয় সে।
-আমি টকটকে হলুদ বলিনি, বলেছি ওটা গাড় লাল হবে। সূর্যের কড়া আলোর জন্যই খয়েরীর মত লাগছে।
শম্পার কথা শুনেই মনে হল সে ভয়াবহ ভাবে রেগে গেছে।
-তা সূর্যকন্যার এত গাড় লাল প্রীতি কেন? লালের সাথে আবার কি হয়েছে আপনার!
-দ্যাখ্! বাজে কথা বলবিনা! তুই জিজ্ঞেস কর উনাকে!
তর্ক হচ্ছিল হাসানের গায়ের শার্টের রং নিয়ে। এক রংয়ের ফুল হাতার শার্ট পরেছিল হাসান। বিতর্কিত রংয়ের শার্ট পরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিল সে। শ¤পারা বসেছিল তার পাশেই রাস্তার একপাশে। ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে আড্ডা দিতে এসেই তর্ক বেঁধে যায় তাদের মধ্যে। শম্পাকে দেখে মনে হচ্ছে শার্টের রং জিজ্ঞেস করার প্রস্তুতি নিচ্ছে সে।
-এক্সিউজমি!
হাসান পেছন ফিরতেই তাদেরকে দেখতে পায়। তার এদিকে আসার কথা ছিল না। তার খালু ফিজিক্সের প্রফেসর। খালু তাকে আসতে বলায় সে এসেছে। নিজের ক্লাশ রুম ছাড়া এদিক ওদিক ঘোরাঘোরি করার মত ছেলে সে নয়। দুজন অসামান্য সুন্দরি মেয়ে তাকে এক্সিউজমি বলেছে, সে ঠিক বূঝতে পারছে না সে কি বলবে। ইংরেজীতে একটা কিছু বলতে পারলে ভাল হত। -হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ টাইপের কিছু একটা। কিন্তু সে কিছু বলতে পারে না। এগিয়ে এসে তাদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে শুধু। শম্পা জিজ্ঞেস করে,
-আচ্ছা আপনার শার্টের রংটা কি বলুনতো?
অনেকটা ইন্টারভিউ বোর্ডে করা প্রশ্নের মত শোনাল কথাটাকে। হাসান একটু হচ্কচিয়ে যায়। এভাবে শার্টের রং জিজ্ঞেস করার মানে কি? তাকে নিয়েকি রসিকতা করার চেষ্টা করছে মেয়েগুলি?
-কি ব্যাপার বলছেন না কেন?
হাসান ভাবল, এখন তার একটা কিছু বলা দরকার। একপলক শার্টের দিকে তাকায় সে। তাকিয়েই পড়ল মহা ফ্যাসাদে। রংটাকে হঠাৎ করে চিনতে পারে না সে। কেমন যেন কালো কালো মনে হয় তার কাছে। একবার ভাবল জানিনা বলে দেবে। কিন্তু কিছু না বলে বোকার মত একটু হাসে হাসান।
-কি ব্যাপার শার্ট পরেছেন! অথচ শার্টের রং বলতে পারছেন না।
শ¤পার মেজাজ খারাপ থেকে খারাপতরর দিকে এগুচ্ছে। হাসানকে কেমন অপরাধীর মত লাগে দেখতে। শার্টের রং বলতে না পারার অপরাধবোধে তার মাথা খানিকটা নীচু হয়ে যায়। নীলু কড়া চোখে তাকায় শ¤পার দিকে। যার অর্থ, -দ্যাখ বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে!। হাসান দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি চলে যাবে বুঝতে পারছে না। তার দাঁড়িয়ে থাকতে ভীষণ অস্বস্তি লাগছে। সে খানিকটা ইতস্তত করতে লাগল। কয়েকবার এদিক সেদিক তাকায়। তখনই নীলু তার নাম ঠিক করে, -ছ্যাবলা। ছ্যাবলার অর্থটা ঠিক পরিষ্কার নয় তার কাছে। তবে নামটার মধ্যে একধরনের ছাগল ছাগল গন্ধ আছে, তাই -ছ্যাবলা। হাসান ছোট করে একটা কাশি দেওয়ার চেষ্টা করে। কাশিটা ঠিকমত আসছে না। ঘে্যাঁৎ করে একটা শব্দ হল শুধু। ভাগ্যিস্! অতটা জোরে হয়নি। তবে কথা বলার জন্য গলা কিছুটা তৈরি হয় তার।
-মনে হয় লাল হবে এটা।
নীলু শম্পার দিকে চোখ নাচিয়ে তাকায়। শম্পার সেদিকে খেয়াল নেই। সে ছ্যাবলাকে রীতিমত ধমক দেয়,
-মনে হয় আবার কি! এটার রং খয়েরী, বুঝলেন! পিওর খয়েরী!
-জ্বী আচ্ছা, খয়েরী।
হাসানকে দেখে মনে হচ্ছে সে আর কখনও এই শার্ট পরবেনা। পাপি-শার্ট আজই ফেলে দিতে হবে।
-জ্বী আমি কি চলে যাব?
শম্পার চোখে বিজয়ীর হাসি। লাল-খয়েরী যুদ্ধ শেষ। যুদ্ধে তার জয় হয়েছে। জয়ের হাসি হেসে সে বলে,
-ওকে মিষ্টার আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
হাসানের মুখে প্রায় চলে এসেছিল -আপনাকেও ধন্যবাদ কথাটা। কিন্তু এখন আর গলায় কথা আসছে না। তাড়াতাড়ি সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচে সে।
দুদিন পরেই নীলু দেখে হাসান আর শ¤পা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফুচকা খাচ্ছে। -ব্যাপার কি? জিজ্ঞেস করতেই শ¤পা রহস্যময় হাসি দেয়। ছ্যাবলাটার গায়ে ছিল সেই লাল-খয়েরী রংয়ের শার্ট। এক শার্ট মানুষ এতদিন পরে কিভাবে? ভেবে পায়না নীলু। শ¤পাকেও তার একটা নাম দিতে ইচ্ছে হয় তার, -ফুচকি বেগম, ফুচকা খাচ্ছে তাই ফুচকি বেগম। নামটা মনেই হতেই ফিক্ করে হেসে ফেলে নীলু।
-কি রে! হাসছিস্ কেন? পাগল নাকি তুই! কারণ ছাড়াই হাসাহাসি!
-হি হি, হাসার কারণ আছে, লাল রংয়ের মেয়েদের কোট পরে একটা ছেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাও আবার মাষ্টার্ষের ছাত্র! কি মারাত্মক কথা!
-মারাত্মক আবার কি! তুই-ই তো বললি ভুল করে পরেছে, তাই বলে এত হাসতে হবে!
নীলু হাসি হাসি চোখে শম্পার দিকে তাকায়। ভাবছে, -ইহাকেই বলে প্রেম!, একটু আগে নিজেই হেনে খুন! এখন আরেকজনের হাসায় দোষ হয়েছে।
শম্পা ব্যাগ গুছিয়ে ওঠার ভঙ্গী করছে।
-কি রে চলে যাচ্ছিস্ যে! যা বাবা! সরি বললাম! আর হাসবনা প্রমিজ–
প্রমিজ বলতে বলতেই আবার হাসি পায় নীলুর। দুর থেকে লাল কোট পরা হাসানকে আসতে দেখে সে।
নীলুকেই দেখেই হাসান কেমন সংকুচিত হয়ে যায়। মেয়েটা সহজ সরল, কিন্তু চোখের দিকে তাকালে মনে হয় যেন সব দেখে ফেলছে।
হাসান মুখ প্রশস্ত করা হাসি দিয়ে বলল, -কেমন আছেন নীলুকেই বলা হয়েছে। নীলুকেও তাই জোর করে খানিকটা ঠোঁট বাঁকাতে হল। যার অর্থ, ঠিক ভাল আছি না, মোটামুটি ভাল। নীলুর এবার ওঠার পালা। শ¤পা মাথা নিচু করে আছে। তার মুখ দেখেই নীলু বুঝল, কোন কারণে রেগে আছে মেয়েটা। লাল কোট পরা প্রেমিকের জন্যই বোধহয়। সে চায়নি নীলু হাসানকে এভাবে দেখে ফেলুক। দেখে ফেলায় লজ্জা পাচ্ছে এখন। নীলু মনে মনে আবারো বলল, -ইহাকেই বলে প্রেম, প্রেমিকের লজ্জায় প্রেমিকার লজ্জাতর অবস্থা এই অবস্থার একটা নাম দেওয়া যায়, ভাবল নীলু। অতিরিক্ত লজ্জা পাওয়ায় শ¤পাকে এখন অন্যরকম লাগছে। তার গাল লাল না হয়ে আরো ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। অতিরিক্ত ফর্সা মেয়েদের তেমন একটা সুন্দর লাগেনা। কিন্তু শম্পাকে লাগছে। তার বেলায় মনে হচ্ছে ফর্সাটা আরেকটু বেশি হলে ভাল হত।
হাসান বলল, -শম্পা, কেমন আছ তুমি?
কেমন যেন নাটকের ডায়ালগের মত মনে হচ্ছে কথাটাকে। তাতে করে শ¤পার লজ্জা আরেকটু বেড়ে যায়। মনে মনে হয়ত ভাবছে, -ওহ্ গড! ওর মাথায় বুদ্ধি এত কম কেন!
নীলু শ¤পার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নেয়। আর কিছুক্ষণ থাকলে বেচারী লজ্জায় মরেই যাবে। হাসানের দিকে তাকিয়ে আবারো একটু হাসে নীলু। এই হাসার অর্থ হল -আপনারা গল্প করুন, আমি গেলাম। শ¤পার কাছ থেকে বিদায় নেয়ার প্রয়োজন বোধ করল না সে। শ¤পা শুধু মাথা নিচু করে বলল, -ফোন করবি। নীলু বলল, -আচ্ছা করব, তুই-ই ধরবি, খালা যেন না ধরে, বুঝলি?। শ¤পা শুধুু বলে -হুঁ। নীলু ঘাড় ঘুরিয়ে আবারো দেখে শ¤পাকে। কেমন যেন নারী নারী একটা ভাব চলে এসেছে শ¤পার মধ্যে। এবং তাকে অসম্ভব রূপবতী দেখাচ্ছে। শিপুর সাথে তার কিছুটা মিল আছে মনে হল নীলুর।
বাসার উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করে নীলু। আকাশে আবার মেঘ ধরেছে। বৃষ্টি আসতে পারে। নীলু ব্যস্ত হয়ে রিকশা খুঁজছে। পেছনে তাকালে দেখত দুই যুবক যুবতী পর®পরের দিকে গভীর ভালবাসার সাথে তাকিয়ে আছে। কেউ কোন কথা বলছে না। যুবতীর লজ্জা ধীরে ধীরে লজ্জাতরর দিকে যাচ্ছে। তার লজ্জা ভাঙ্গানোর জন্যই বোধহয় হঠাৎ করে আকাশ ভাঙ্গা বৃষ্টি শুরু হল।
**
কুকুরটা মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে তাঁকে দেখছে। শান্তশিষ্ট দৃষ্টি। শুধু একটু ঘনঘন লেজ নাড়ছে। আয়েশ করে রাস্তার একপাশে শুয়ে আছে কুকুরটা। আসন্ন বৃষ্টি সম্পর্কে সে নির্বিকার। বৃষ্টি আসলে আসুক, তখন চলে যাওয়া যাবে। রহিমুল্লাহ সাহেবের তা মনে হচ্ছে না। তিনি কুকুরটার কাছ থেকে একটু দুরে দাঁড়িয়ে আছেন। এবং ঘনঘন কুকুরটার প্রতি বিষদৃষ্টি নিক্ষেপ করতে লাগলেন। তাঁর ধারণা তিনি কুকুরটার কাছাকাছি আসলেই সে একছুটে এসে তাঁকে কামড়ে ধরবে। আর কামড় দেওয়া মনেই চৌদ্দটা ইন্জেকশান। মানে মোরব্বা চিকিৎসা। তার চেয়েও বড় কথা তিনি লুঙ্গি পরে বাজারে এসেছেন, একবার যদি লুঙ্গি কামড়ে ধরে তবেই লঙ্কাকান্ড! রহিমুল্লাহ সাহেব ঘামতে লাগলেন। কয়েকবার হুস্ হাস্ করে কুকুরটাকে তাড়ানোর চেষ্টা করলেন। তাতে কোন লাভ হল না। কুকুরটাকে দেখে মনে হচ্ছে অযাচিত আওয়াজ শুনে সেই বরং বিরক্ত। রহিমুল্লাহ সাহেবের মনে হল হুস হাস্ করে মানুষ মুরগী তাড়ায়। কুকুরকে তাড়ানোর আলাদা কিছু শব্দ আছে যা এই মুহুর্তে তাঁর মনে পড়ছে না। এমনিতেই অনেককিছু ভুলতে বসেছেন তিনি। তিনি একশভাগ নিশ্চিত যা যা বাজার আনতে বলা হয়েছিল তার অর্ধেকেরও বেশি ভুলে গেছেন। আর ভুলে যাওয়ার কারণ হিসেবে কুকুরটাকেও ঠিক দোষ দিতে পারছেন না তিনি। চিকনকন্ঠে যদি বলেন, -কুকুরের কারণে সব ভুলে গেছি তাহলে তাঁর স্ত্রী ভাববে, নির্ঘাৎ তাঁর মাথায় দোষ আছে। অনেকেই কুকুরটার পাশ দিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে। কিন্তু রহিমুল্লাহ সাহেব যেতে পারছেন না। তার কেবলি মনে হচ্ছে কুকুরটা তার জন্যই অপেক্ষা করছে। তিনি আসা মাত্রই লাইট ক্যামেরা একশান বলে দৌড় দেবে। ঘটনার আকস্মিকতায় তিনি হয়তো দৌড়ানোই ভুলে যাবেন। পা দুটোকে তখন মনে হবে দুটো জলহস্তীর পা। ঘড়িতে দেখলেন এগারটা বাজে। প্রায় পনের মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। রাস্তার লোকজন কৌতুহলী হয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে তাঁর দিকে। কেউ কেউ সাংঘাতিক সরু চোখে তাকাচ্ছে। রহিমুল্লাহ সাহেবের সমস্যা কেউ বুঝতে চেষ্টা করছে না। সরু চোখে তাকিয়ে ভাবছে, -বুড়ার দেখি মনে এখনও চিম্সা ভাদ্র!( চিম্সা ভাদ্র হল শুকিয়ে চিম্সে যাওয়া ভাদ্র), রাস্তায় দাঁড়িয়ে চিপা জামা পরা মেয়ে দেখা হচ্ছে, যত্তসব! রহিমুল্লাহ সাহেব ভাবলেন কাউকে বলবেন, ভাই আমাকে একটু গার্ড দিয়ে রাস্তাটা পার করে দেন। কিন্তু ভাই বলে ডাকার মত কাউকে পেলেন না। যুবক বয়সী ছেলের সংখ্যাই বেশি। সামনেই মেয়েদের কলেজ। এই সময়ে যুবকদের ভিড়টা একটু বেশিই হয়।
-কেমন আছেন চাচা?
ছেলেটাকে প্রথমে ঠিক চিনতে পারলেন না তিনি। তবে কোথায় যেন দেখেছেন। সালাম না দেওয়ায় তাঁর কিছুটা বিরক্ত হবার কথা ছিল। কিন্তু উল্টো তিনি খুশি হয়েছেন। প্রচণ্ড খুশির কারণে তিনি সামান্য ভুল করে ফেললেন।
-জ্বি ভাল।
-একি চাচা! আপনি আমাকে -আপনি করে বলছেন কেন! আমি সফিক, আমাকে তুমি করে বলেন!
রহিমুল্লাহ সাহেব মনে মনে প্রার্থনা করলেন, বাপধন তোকে আমি শতবার আপনি বললেও কিছু হবেনা, কম হয়ে যাবে। কিন্তু মুখে বললেন,
-এদিকে কেন?
সফিক নির্দ্বিধায় বলে,
-এই তো এমনি ঘুরতে আসা।
অন্যসময় হলে রহিমুল্লাহ সাহেব ভয়ংকর রেগে যেতেন। ভাবতেন, হারামজাদা! এমনি এমনি ঘুরা হচ্ছে! বদ্ ছেলে! মেয়েদের কলেজের সামনে এমনি এমনি ঘুরে ফুর্তি করা হচ্ছে! গলায় আবার পাতলা স্বর্নের চেন! পুরুষ মানুষের স্বর্ন পরা পাপ, তাও শেখা হয়নি! কিন্তু এখন তাঁর এগুলি কিছুই মাথায় আসছে না। আড়চোখে রাস্তায় তাকিয়ে দেখলেন কুকুরটা চলে গেছে। বুক কিছুটা হাল্কা হল তাঁর।
-বাজারে যাচ্ছিলেন চাচা?
-হুঁ
-আমাকে দিন আমি করে দিই। পরিচিত দোকান আছে, কম রেইটে পাবেন।
রহিমুল্লাহ সাহেব আশ্চর্যজনক ভাবে বাজারের ব্যাগটা সফিকের হাতে তুলে দিলেন।
-চাচা চা খাবেন?
চায়ের ব্যাপারে কখনই না বলতে পারেন না রহিমুল্লাহ সাহেব। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন তিনি। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে না বলাটা অভদ্রতা হতে পারে। এই ভেবে সফিকের সাথে পাশের রেষ্টুরেন্টে ঢুকে পড়লেন তিনি।
সফিকের এদিকে আসার উদ্দেশ্য হল নীলু। সে মেয়েদের কলেজটায় পড়েনা, তবে তার আসার রাস্তা এটাই। গত কয়েকদিন নীলুকে দেখেনি সে। তার ভাষায় তার মাথা তাই খানিকটা -আউলা হয়ে গেছে। ব্রেন ঠিকমত কাজ করছে না। -আউলা মাথাটাকে ঠিক করার জন্য নীলুকে একনজর দেখতে হবে। দেখার কাজটাও খুব কৌশলের সাথে সারতে হয়। এমন ভাবে নীলুর দিকে তাকাবে সে যেন নীলু ভাবে তার কাজই হচ্ছে পথচারীর ওপর নজর রাখা। নীলুর দিকে তাকিয়ে সে নিছক তার ডিউটি পালন করছে, আর কিছুনা। যদিও নীলু তাকে সবসময় দেখতে পায়না, তবু তার মনের একটা অংশ চায় নীলু তাকে দেখুক্। দেখে ভাবুক, ছেলেটার কি মাথা খারাপ! এই বৃষ্টির মধ্যেও আমাকে দেখার জন্য দাঁড়িয়ে আছে!। সফিক বুঝতে পারে মনের এই অংশটা স্বার্থপর। তবু মাঝে মাঝে তার খুব স্বার্থপর হতে ইচ্ছে করে। মাঝে মাঝে স্বার্থপর হওয়া দোষের কিছুনা।
চা খেতে খেতে সফিককে দেখলেন রহিমুল্লাহ সাহেব। ছেলেটাকে আগে ভ্যাগাবন্ড টাইপের মনে হত। এখন অতটা খারাপ মনে হচ্ছে না। চুল সুন্দর করে আঁচড়ানো। চুল আঁচড়ানো ছেলে দেখতে তাঁর খুবই ভাল লাগে। কেমন যেন বাধ্য ছেলের মত লাগে। তিনি নিজে কখনও বাধ্য ছিলেন না। ইয়াজউদ্দিন সাহেবের যথেষ্ট অবাধ্য ছেলে ছিলেন তিনি। চায়ে চুমুক দিতে দিতে রহিমুল্লাহ সাহেব বললেন, -করছটা কি এখন?
সফিক গা দুলিয়ে হেসে উঠে। তার বলতে ইচ্ছে হল, -আপাতত আপনার মেয়ের পেছনে ঘুরঘুর করছি, চান্স পেলেই কেল্লা ফতে কিন্তু মুখে বলল,
-চাকরির চেষ্টা করছি, ইনশাল্লাহ ফটাস্ করে একটা হয়ে যাবে
রহিমুল্লাহ সাহেবও গা দুলিয়ে হাসতে লাগলেন। বাইরে ততক্ষনে বৃষ্টি নেমে গেছে। বৃষ্টির ঝাপটা এসে তাঁর মুখ খানিকটা ভিজিয়ে দিচ্ছে। সফিককে দেখলেন খুব শান্ত ভঙ্গীতে চা খাচ্ছে। চুল আঁচড়ানো সফিককে খুব বাধ্য ছেলের মত মনে হল তাঁর কাছে। রহিমুল্লাহ সাহেবের মনে হল তাঁরা বাপ ছেলে হোটেলে বসে চা খাচ্ছেন। চা শেষ করে সিগারেট ধরালেন তিনি। দিনের প্রথম সিগারেট। ফুরফুর করে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছেন আর বাইরের দিকে তাকিয়ে আছেন। ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে বৃষ্টি দেখছেন তিনি। ধোঁয়াটে বৃষ্টি দেখতে অতটা মন্দ লাগছে না।
**
-দেখতো কেমন লাগছে আমাকে?
শিপু স্কুল পালানো মেয়ের মত ঘাড় বাঁকিয়ে হেসে বলে। শাহেদ আজ তাড়াতাড়ি অফিস থেকে চলে এসেছে। তাড়াতাড়ি চলে আসায় তার কেবলি মনে হচ্ছে কি যেন করা হয়নি। তাই কি করা হয়নি তাই ভাবছিল। বিছানার ওপর বসে বসে পা নাচাচ্ছিল সে। শিপুর কথা শুনে ফিরে তাকায়। মাথা খারাপ করার মত সেজেছে সে। শাহেদের নিয়ে আসা আকাশী নীল রংয়ের শাড়ি। শাড়ির সাথে মিলিয়ে হালকা নীল রংয়ের ব্লাউজ, কপালে লাল টিপ আর খোঁপায় অচেনা একটা ফুল। সব মিলিয়ে অস্বাভাবিক সুন্দর লাগছে তাকে। শাহেদ একদৃষ্টে শিপুর দিকে তাকিয়ে আছে। তার মনে হচ্ছে শিপুকে সে বাস্তবে দেখছে না। নিশ্চয়ই কোন স্বপ্ন দৃশ্যের অংশ। যেকোন মুহুর্তে স্বপ্ন ভেঙ্গে যাবে। কিন্তু স্বপ্নে পারফিউমের ঘ্রাণ পাওয়ার কথা না। শাহেদ খুব স্পষ্ট রেভলনের ঘ্রাণ পাচ্ছে। এটা শিপুর প্রিয় পারফিউম। তার মানে বাস্তব দৃশ্য।
-কি ব্যাপার কিছু বলছনা যে!
-সুন্দর।
শিপু ভ্রু কুঁচকে তাকায়। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, সুন্দর বলা হয়নি, খারাপ বলা হয়েছে। শাহেদ চোখ নামিয়ে ফেলায় তার ভ্রু আরেকটু কুঁচকে যায়।
-শুধু সুন্দর?
শাহেদ বুঝতে পারছে না সুন্দরের সাথে -শুধু এসে যোগ হল কেন। শাহেদের একবার ইচ্ছে হল বলতে -খুব সুন্দর, কিন্তু কথাটা বিশেষ একটা পছন্দ করেনা সে। সুন্দর সুন্দরই। -শুধু আর -খুব যোগ করাটা তাই ভাল লাগেনা তার। তাতে সুন্দরকে একটু কম সুন্দর মনে হয়।
-কোথাও যাবে নাকি? শাহেদ পা নাচাতে নাচাতে বলল।
-এমন বিশ্রী ভাবে পা নাচাচ্ছ কেন?
শাহেদ পা নাচানো বন্ধ করে। শিপু কথা না বলে ঘুরে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। খোঁপাটা খুলে ফেলে সে। পিঠ জুড়ে এলোমেলো চুল ছড়িয়ে পড়ে সাথে সাথে। এখন তাকে অন্যরকম সুন্দর লাগছে। এভাবে সাজার একটা কারণ আছে। আজ শিপুর জন্মদিন। প্রত্যেক জন্মদিনে শাহেদ তাকে একটা ফুল দিয়ে বলত, -হ্যাপী হ্যাপী বার্থ ডে টু ইউ মিস্ শি-
শিপু তখন বলত, -ওয়ান থ্যাংক এন্ড মেনি লাভ ফর ইউ
আজ শাহেদ তাকে কিছুই বলেনি। এত করে সাজার পরও শাহেদ বুঝতে পারেনি আজ এগারই অক্টোবর। শিপু বুঝতে পারছে না, তার কি মন খারাপ হয়েছে? শাহেদের ওপর তেমন একটা রাগ করতে পারে না সে। চোখের কোন একটু ভিজে গেছে তার। কান্নার মত মনে হচ্ছে না সেটাকে। মনে হচ্ছে চোখে ময়লা পড়েছিল, ডলাডলি করায় পানি বের হয়েছে। আলতো করে পানিটা মুছে ফেলে শিপু। আজ সারাদিন তার আনন্দে থাকার কথা। এখন বিকেল হয়ে গেছে, রাতটা পার হলেই শেষ। আরিফা কিছুক্ষণ আগে চা নিয়ে এসেছিল। শাহেদ সেই চা খুব আরাম করে খাচ্ছে।
আরাম করে খাওয়ার সময় সুরুৎ করে একটা শব্দ হয়। শাহেদ খাচ্ছে চুকচুক শব্দ করে। অদ্ভুত ভঙ্গীতে চা খাওয়া। শিপু বিরক্ত চোখে তার দিকে তাকায়। তার প্রচণ্ড ধমক দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু তার একটু আটকে আটকে যাচ্ছে। ধমক দিতে পারল না শিপু। চা হতে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো সে।
বিকেলের শেষ আলো এসে মুখে পড়ছে। সোনালী রোদ এসে মুখে পড়ায় শিপুকে এবার অন্যরকম সুন্দর লাগছে। তাকে এখন সোনালী কন্যা টাইপের একটা বিশেষন দেওয়া যায়।
হঠাৎ খিক্খিক্ হাসির শব্দ শুনে পাশে তাকায় শিপু। আরিফা তার পাশ ঘেঁসে দাঁড়িয়ে আছে।
-কী হল?
শিপুর কথায় আরো কিছুক্ষণ খিক্খিক্ করে হাসে আরিফা। মনে হচ্ছে যেন মজার একটা কিছু বলার প্রস্তুতি নিচ্ছে সে। এটা হল প্রস্তুতি মূলক হাসি। কথাটা বলার পর সত্যিকারভাবে হাসা যাবে। শিপু উৎসুক হয়ে আরিফার দিকে তাকায়। আরিফা চোখ নাচিয়ে বলে,
-জান! আপু কি বলেছে!
-কি?
-তোমার কথা বলেছে!
আরিফা কথাটাকে আরেকটু জমানোর চেষ্টা করে। বোধহয় সে সার্থক হয়েছে। শিপু একটু ভাবনায় পড়ে যায়। নীলু তাকে নিয়ে কি বলল! শিপু খানিকটা বিস্মিত হয়। আরিফা চুপ করে থাকে। কিছুক্ষণ শিপুর বিস্ময় উপভোগ করে সে। তারপর বলে, -আপু বলেছে তুমি বলেছে তুমি নাকি পরীর মত সুন্দর, পরীদের ডানা থাকে তোমার নাকি ডানা নেই
শিপু ভাবছে এই কথার কোথায় হাসির গন্ধ আছে। আরিফা আবার বলে,
-আপু বলেছিল মাকে, আমি শুনে ফেলেছি, খিক্ খিক্
শিপু স্বাভাবিক ভাবেই বলে, -তোমার আপু কি কখনও পরী দেখেছে? আমি যে পরীর মত সুন্দর সেটা বুঝল কি করে?
-কে জানে!
আরিফার মুখ এখনও হাসি হাসি, সে আবার বলে,
-আমি জানি আপু কথাটা কেন বলেছে
-কেন?
-আপু তোমাকে পছন্দ করতে পারছে না, তাই। কেন পছন্দ করতে পারছে না সেটা—
আরিফার মুখে হঠাৎ কথা আটকে যায়। বাকীটা বলার ভয়ংকর ইচ্ছে হচ্ছে তার। কিন্তু শিপুকে বলার মত কথা না সেটা। কথাটা বান্ধবীদের বলা যায়। শিপুকে বললে তার মন খারাপ হতে পারে। কথা আটকে যাওয়ায় আরিফার আর দাঁড়াতে ইচ্ছে হল না।
-আরিফা এদিকে আয়।
মায়ের ডাক শুনে যেন চাঁদ হাতে পায় সে। -আসছি বলেই পালিয়ে বাঁচে। পেছনে শিপু দাঁড়িয়ে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু চায়ে ঠিক মন দিতে পারছে না সে। চোখ কুঁচকে কি যেন ভাবছে শিপু। ভয়ংকর কিছু ভাবার আগেই এমন করে চোখ কুঁচকে যায়।
রাতে খাওয়ার সময় চুপ করে খাওয়া সারে সবাই। কেউ কোন কথা বলে না। পিন ড্রপ সাইলেন্স। শিপু ব্যাপারটা খুব উপভোগ করে। তার তখন ইচ্ছে করে মেঝেতে একটা পিন ফেলে দেখতে, টুং করে আওয়াজ হয় কিনা শোনার জন্য। শোনা গেলেই প্রবাদটা সার্থক হয় তার কাছে। নীলু অর্ধেক খেয়েই উঠে পড়ে। তাকে কেউ জিজ্ঞেস করেনি কিছু। বোধহয় অর্ধেক খাওয়াই তার অভ্যাস হয়ে গেছে।
রহিমুল্লাহ সাহেব চোখ কুঁচকে মাছের মাথার দিকে তাকিয়ে রইলেন। মাথা তিনি খান না। এটা সবাই ভাল করেই জানে। মাথা প্রিয় হল শাহেদের। অথচ তাকে দেওয়া হয়নি। সূক্ষ্ম একটা ঘোলাটে ভাব আঁচ করতে পারছেন তিনি। মাছটার মাথার মধ্যে আবার কালো একটা চোখও আছে। কেমন যেন জীবন্ত মনে হচ্ছে। জীবন্ত মাছের দিকে তাকিয়ে থেকে খাওয়া সম্ভব নয়। আবার উঠে চলে যেতেও পারছেন না তিনি। শিপু মেয়েটা তাহলে সমস্যায় পড়ে যাবে। সে বেচারীও না খেয়ে উঠে যেতে পারে। খাক্ মেয়েটা। বাড়িতে হয়ত কত ভাল করেই খেত! এখানে একটু আরাম করেই খাক্! রহিমুল্লাহ সাহেব আড়চোখে একবার শিপুকে দেখে নিলেন। শিপু মাথা নিচু করে খেয়ে যাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে খুবই মজা করে খাচ্ছে সে। রহিমুল্লাহ সাহেবের ইচ্ছে হল মাছের মাথাটা শিপুর প্লেটে উঠিয়ে দিতে। কিন্তু তাঁর বেশির ভাগ ইচ্ছাই অপূর্ণ থেকে যায়। আজও একটা ইচ্ছে না হয় অপূর্ণ থাক্! ইচ্ছে হয়েছে এটাই বড় কথা! শিপুর জন্য কেমন যেন একটু মায়া অনুভব করলেন তিনি।
রান্নাটা অসাধারণ হয়েছে। এমন রান্না অনেকদিন হল খায়নি শিপু। খাওয়া শেষ করে হাত ধুতেই জেবুন্নেছা বেগম তাড়াহুড়ো করে বললেন,
-করছ কি! ভাত নিলে না কেন? এই সামান্য একটু খেয়ে সারারাত কাটাবে কি করে!
শিপু তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলে,
-নীলুতো অর্ধেক খেয়েই উঠে গেল, তাকে কিছু বলেননি কেন? তার ক্ষিদে লাগবে না?
কথাটার মধ্যে সূক্ষ্ম একটু উপহাসের ছোঁয়া থাকলেও জেবুন্নেছা বেগম তা ধরতে পারলেন না। ধরতে পেরেছেন রহিমুল্লাহ সাহেব। মনে মনে প্রশংসা করলেন শিপুর, -ঠিক ধরেছিস্ মা, এক্কেবারে টু দি পয়েন্ট কথা
শিপুর টু দি পয়েন্ট কথাকে অগ্রাহ্য করে জেবুন্নেছা বেগম বললেন,
-তোমার কি সুতীর শাড়ি নেই? সারাক্ষণ এই শাড়ি পরে থাক কেন? রাতে শোয়ার সময় আমার একটা সূতীর শাড়ি নিয়ে নেবে।
শিপুর কেমন যেন একটু লজ্জা লজ্জা করতে লাগল। সে শুধু -হুঁ করে একটা শব্দ করে। আর কিছু না বলে নিজের রুমে চলে যায় সাথে সাথে।
-শোন, তোমার সাথে কিছু কথা আছে।
শাহেদকে দেখে মনে হচ্ছে সে এধরনের কথা আগে কখনও শোনেনি। হা করে তাকিয়ে আছে সে।
-খুব ইম্পর্টেন্ট কিছু কথা।
হা করা মুখ বন্ধ করে শাহেদ বলে,
-বল!
-এখন নয় পরে, আমি আগে খুব কড়া করে দুটো কফি বানাব, কফি খেতে খেতে বলা হবে।
-এখানেতো কফি নেই!
-আমার ব্যাগে একটা কফির জার আছে। একদম নতুন। ঢাকনা খোলা হয়নি এখনও।
-ঠিক আছে তাহলে বানিয়ে আনো।
-তুমি এমন রোবটের মত কথা বলছ কেন? কফি না খেলে কি কথা বলা যাবেনা? কফি ছাড়াও কথাগুলো বলা যায়। কথা বলার সময় মাঝে মাঝে চুপ করে থাকতে হবে। তখন কফি খাব আমরা, বুঝলে?
শাহেদ আবারো রোবটের মত বলে, -ও আচ্ছা। তাকে তেমন একটা চিন্তিত দেখাচ্ছে না। সে ভাবছে আগামীকাল অফিসে যাবে কিনা তা নিয়ে। তার বস্ ওসমান সাহেব হুট করে কোথায় যেন চলে গেছেন। কাউকে কিছু বলে যাননি। শুধু শুধু অফিসে যাওয়াটা তাই অপ্রয়োজনীয় মনে হচ্ছে তার কাছে।
-কতটুকু চিনি দেব?
শিপুর প্রশ্নে শাহেদের মাথায় নতুন চিন্তা ভর করে। সে ঠিক মনে করতে পারল না সে কত চামচ চিনি খায়। কেউ তাকে এই প্রশ্ন তেমন একটা জিজ্ঞেস করেনা। আগে সবার জন্য একসাথে চিনি দিয়ে চা বানানো হত। কে কত চামচ খায়, তা নিয়ে কারো মাথা ব্যাথা ছিল না।
-তুমি যতটুকু খাও ততটুকু।
শিপুর চোখ দেখে মনে হচ্ছে সে এমনটা আশা করেনি। কথাটায় কেমন যেন -ভালবাসা -ভালবাসা একটা গন্ধ আছে। রোবটের কণ্ঠে ভালবাসার গন্ধ থাকা বেমানান।
-দুচামচ দিলে হবে?
-আচ্ছা।
শিপু কফি বানাতে চলে যায়। শাহেদ বিছানায় পা তুলে বসে। সিগারেট ধরাতেই নীলুকে দরজার পাশে দেখতে পায় সে।
-ভেতরে আসব?
মুখে সিগারেট থাকায় কথা বলতে পারল না শাহেদ। শুধু -হুঁ করে করে একটা শব্দ করল।
-এসেছি একটা ক্যাসেট নিয়ে যেতে, তোমাকে এমন শুকনো দেখাচ্ছে কেন? অসুখ হয়নিতো!
শাহেদ একগাল ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে -না সুচক মাথা নাড়ে।
-দেখিতো! বলেই নীলু হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসে। কপালে হাত দিতেই ভয়াবহ ভাবে চমকে উঠে শাহেদ। মাথা পেছনে সরাতে গিয়েও সরাতে পারে না সে। সিগারেটে টান দিতেও ভুলে গেছে যেন।
-কই গাতো ঠান্ডা! এখনও হাত সরিয়ে নিচ্ছে না নীলু। শাহেদ ভাবছে যেকোন মুুহুর্তে শিপু এসে ঢুকতে পারে। নীলুটাযে কি! এখনও হাত সরিয়ে নিচ্ছে না কেন!
-কি হল এমন করে তাকাচ্ছ কেন? তোমাকে স্পর্ষ করে পাপ করে ফেলেছি? পাপ করলে আমি নরকে যাব, তোমার ভয় কিসের! যাও! হাত সরিয়ে নিচ্ছি! এভাবে তাকাতে হবেনা!
মৃদু শান্ত লয়ে কথাগুলো বলে নীলু। শাহেদ এতক্ষনে বুঝতে পারল নীলুকে কেমন যেন অপ্রকৃতিস্থ লাগছে। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে তার দিকে। চোখে চোখ পড়তেই চোখ নামিয়ে নেয় শাহেদ। ড্রয়ার ঘাঁটাঘাঁটি করে ক্যাসেট খুঁজছে নীলু। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে ভয়াবহ বিরক্ত হয়েছে সে। শেষ পর্যন্ত ক্যাসেট খুঁজে পায়না নীলু। যাওয়ার সময় হাতে করে গল্পের বই নিয়ে যায়।
নীলু বেরুতেই শিপু ঢুকে। অল্পের জন্য ধাক্কা খায়নি তারা। তবে কফি একটু ছলকে পড়ে শুধু।
শিপু শান্ত দৃষ্টিতে শাহেদের দিকে তাকায়। শাহেদ ভেবেছিল একটা কিছু বলবে শিপুকে। -ক্যাসেট নিতে এসেছিল বা -কেমন আছি দেখতে এসেছিল এ টাইপের একটা কথা। শিপুর শান্ত দৃষ্টি দেখে সব কথা গুলিয়ে ফেলে শাহেদ। বোকার মত একটু হাসে শুধু। সে ভেবেছিল শিপুও হাসির উত্তরে হাসবে। শিপুর শান্ত দৃষ্টির কোন ব্যাতিক্রম হয়নি দেখে হাসিটা হঠাৎ করেই মিলিয়ে যায় আবার।
ছাদে শীতল পাটি বিছানো হয়েছে। মশার জন্য কয়েলও আনা হয়েছে। ফ্লাস্ক ভর্তি কফি একপাশে রাখা। মগের মধ্যে চাঁদের প্রতিচ্ছবি পড়েছে। দেখলে মনে হবে যেন মগের মধ্যে ছোট চাঁদ খাচ্ছে তারা। শিপু মনে মনে কথাগুলো গুছিয়ে নিচ্ছে। কথা গোছাতে একটু সময় বেশি নিচ্ছে সে। শাহেদ ভাবল এই সময়ে একটা সিগারেট ধরানো যায়। কিন্তু শিপুর দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে এই সময়ে সিগারেট ধরানোটা সে ঠিক পছন্দ করবেনা। তাকে আরো কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে। শিপু পা গুটিয়ে খুব আয়েশী ভঙ্গীতে বসেছে। মগের সাইজ দেখে মনে হচ্ছে কফি সহজে শেষ হবেনা। দীর্ঘ সময়ের জন্য তৈরি করা কফি। কফির কড়া ঘ্রানে চারপাশ মৌ মৌ করছে। শাহেদের দিকে শান্ত ভাবে তাকায় শিপু। বোধহয় কথাগুলো অনেকটা গোছানো হয়েছে।
-শোন্ আমি তোমাকে কিছু প্রশ্ন করতে চাই। আশা করি পাল্টা প্রশ্ন না করে সরাসরি উত্তর দেবে।
শিপুর কথায় শাহেদ কেমন যেন একটু লজ্জা পায়। শিপু তাকে কখনও এমন করে কিছু বলেনি। আজ হঠাৎ শিপুকে দেখে তার মনে হল সে কোন অপরিচিত মেয়ের পাশে বসে আছে। লজ্জার কারণে সে বলল, -হুঁ।
-হুঁ মানে!
-বল।
-মন দিয়ে শুনছতো?
শাহেদ ওপর নীচ মাথা নাড়ল। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে খুব বাধ্য ছেলে। মন দিয়ে এখন একগাদা উপদেশ শুনবে। মগে মাঝে মাঝে দুয়েকটা চুমুক দিচ্ছে সে। কফি ভীষণ কড়া হয়ে গেছে। খেতে মোটেও ইচ্ছে করছে না তার। সিগারেট ধরাতে পারলে বেশ হত।
-কফি কেমন হয়েছে?
-ভাল।
-চেহারা এমন করে রেখেছ কেন? যেন বিষ খেতে দিয়েছি! কি! বিষ খেতে দিয়েছি?
শাহেদ চুপ করে আরেকটা চুমুক দেয়। মারাত্মক তেতো লাগছে কফিটা।
-তুমি আমাকে নীলুর ব্যাপারটা বলনি কেন?
-কোন ব্যাপারে?
-অভিনয় করবেনা! এখানে শ্যূটিং চলছে না! যা বলছি স্পষ্ট জবাব দাও!
-বলার মত কিছু ছিল না তাই।
শিপু অন্যমনস্ক হয়ে আকাশের দিকে তাকায়। চাঁদটা ঠিক মাথার উপরে এখন। চাঁদের দিকে তাকাতে হলে মাথা পুরোপুরি ঘোরাতে হবে। তাই সহজে চাঁদের দিকে তাকাতে পারছে না সে। তাকানোর তেমন একটা ইচ্ছেও তার নেই বোধহয়।
আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়েই শিপু বলে,
-তার মানে তুমি বলতে চাইছ নীলুর ব্যাপারে তোমার কোন ধারণাই ছিল না।
-তুমি কি বলতে চাইছ আমি বুঝতে পারছি না।
শাহেদ এবার আগ্রহ সহকারে চুমুক দেয়। কফি খেতে এখন বেশ লাগছে তার। পোড়া গন্ধটাতে একধরনের মাদকতা আছে। বারবার চুমুক দিতে ইচ্ছে হয়।
-আমি বলতে চাইছি নীলু তোমাকে ভালবাসে এবং গভীর ভাবে বাসে, তা-কি তুমি জানতেনা?
শাহেদ চুপ করে থাকে। বুঝতে পারে কিছু একটা জবাব দেওয়ার দরকার। কিন্তু মুখ দিয়ে কিছু বেরুচ্ছে না তার। সে একদৃষ্টিতে ফ্লাস্কের দিকে তাকিয়ে আছে। তার কফি শেষ হয়ে গেছে। এখন কি আর একটু নেবে? নাকি সিগারেট ধরাবে?
-চুপ করে থাকবেনা!
-তা জেনে তুমি কি করবে?
-আমার শর্ত ছিল পাল্টা প্রশ্ন করা যাবেনা। তুমি শর্ত ভঙ্গ করছ!
শাহেদ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকে। খালি মগের দিকে তাকিয়ে বলে,
-সে একটা অদ্ভুত মেয়ে, তাকে আমি কখনই বুঝতে পারিনি।
-নীলু মোটেও অদ্ভুত মেয়ে নয়! সে তোমাকে ভালবাসে এবং প্রচণ্ড রকম ভালবাসে। তোমার তা বোঝা উচিৎ ছিল!
-বুঝে আমি কি করব?
শিপু বিষ¥য় মাখা চোখে শাহেদের দিকে তাকায়। যেন তার কথা ঠিক বুঝতে পারছে না সে। এবার শাহেদের দিকে তাকিয়েই সে বলে,
-এবং তুমিও তাকে ভালবাস, আমি বলতে চাচ্ছি তোমার অবচেতন মন আমাকে নয় নীলুকেই ভালবাসে।
এটুকু বলে শিপু একটু চুপ করে থাকে। কথাটার একটু বিশেষত্ব পাওয়ার জন্যই এই চুপ করে থাকা। শাহেদের কোন ভাবান্তর হয়নি। সে আগে থেকেই এমন একটা কিছু আঁচ করতে পেরেছিল। এখন শুধু দুয়ে দুয়ে চার হল। ঠোঁটকে চ্যাপ্টা করে সামান্য হাসার চেষ্টা করল সে। কিন্তু হাসিটা বের হতে না হতেই আবার মিলিয়ে যায়। শিপু আবার বলে,
-দেখ, তুমি যাই বল, এটাই সত্যি! আমি স্পষ্টই টের পাচ্ছি আমি ভুল যায়গায় এসেছি!
-তোমার হঠাৎ এমন মনে হল কেন?
শাহেদ এতক্ষনে একটা কিছু বলতে পারে। কথাটা বলে ফেলায় নিজেকে একটু ভার মুক্ত মনে হচ্ছে।
-মনে হবার অবশ্যই একটা কারণ আছে। এই পরিবারটার কথাই ধর। সবাই ধরে নিয়েছিল তোমার আর নীলুর বিয়ে হবে এবং সবার মধ্যে এ ধরনের একটা অবস্থা সৃষ্টির জন্য দায়ী তুমি। তুমি স্বীকার করতে হয়ত চাইবেনা, কিন্তু তোমার অবচেতন মন নীলুকে ঠিকই মেনে নিয়েছিল। শুধু মুখ ফুটে কথাটা বলতে পারনি তুমি। তার আগেই আমার সাথে পরিচয় হয় তোমার। এবং বাইরের মনের সাথে অবচেতন মন হেরে যায়।
-তুমি ঠিক কি বলতে চাইছ?
এইবার বোধহয় সিগারেট ধরানোর সময় এসেছে। কথার স্রোতে শিপু তা ঠিকমত খেয়াল নাও করতে পারে। সিগারেটে টান দিয়েই বুঝল ড্যাম হয়ে গেছে। ঠান্ডার কারণেই এই অবস্থা। অবশ্য এখন ড্যাম সিগারেটও তার কাছে অমৃত সমান। শিপুর কথাগুলি এখন অনেকটা হাল্কা মনে হচ্ছে। যেন ধোঁয়ার মত বাতাসে ভাসতে ভাসতে উড়ে চলে যাচ্ছে কথাগুলো। শাহেদ খুব মনযোগী শ্রোতার মত শোনে।
-আমি বলতে চাচ্ছি তুমি একটা ভুল করে ফেলেছ। তবে ততটা সিরিয়াস ভুল না। ভাবনা চিন্তার এখনও যথেষ্ট সময় আছে।
-বুঝিয়ে বল, আমাকে এখন কি করতে হবে?
-তোমাকে তোমার মনের সাথে কথা বলতে হবে। মনকে জিজ্ঞেস করে দেখ, মন কি চায়?
শাহেদের বলতে ইচ্ছে হল, -মন চায় একটা জলকন্যা টেলিফোন সেট, জলকন্যার বাঁ হাতে সূক্ষ্ম একটা ভুল থাকতে হবে
কিন্তু এখন কৌতুক করার পরিবেশ নেই। শিপুর কথার উত্তরে শাহেদ তার দিকে তাকিয়ে দুষ্টুমির হাসি দেয়। যেন বাচ্চা কোন ছেলে আচার চুরিতে ধরা খেয়েছে। কিন্তু শিপুর শান্ত চোখের কাছে তার অর্থহীন হাসি খানিকটা চাপা পড়ে যায়।
-কফি খাবে?
-খাব
শাহেদ আনন্দিত চোখে ফ্লাস্কটার দিকে তাকায়। কফি একেবারে আগুণ গরম। যেন এইমাত্র বানানো হয়েছে। ফ্লাস্কের আবিস্কারক কে মনে মনে একটা ধন্যবাদ দেয় সে।
-শোন ভেবে দেখ, গভীর ভাবে ভেবে দেখ, আমাকে বিয়ে করায় সবাই কি রকম একটা ধাক্কা খেয়েছে, অথচ নীলুর সাথে যদি তোমার বিয়ে হত—
শাহেদ খুব বড় করে একটা হাই তোলে। কফির মগ হাতে সাধারণত কেউ হাই তোলে না। শাহেদের ঘুম পাচ্ছে। সিগারেট কফি খেয়েও কাজ হচ্ছে না। নিকোটিন আর ক্যাফিন, বিষে বিষক্ষয়। তাই কোনটাই বোধহয় কাজ করছে না। হাই তুলতে তুলতে শাহেদ বলে,
-তুমি নীলুকে জিজ্ঞেস করে দেখ, সে বলবে সম্পূর্ন উল্টোটা।
-সে তোমাকে ভালবাসে বলেই উল্টো কথা বলবে।
-ভালবাসা দেখি মহা জটিল ব্যাপার! এত প্যাঁচ আছে জানলে কি কেউ ভালবাসে!
-ভালবাসা মোটেও জটিল নয়! জগতের সবচেয়ে সরল স্বীকারোক্তি।
-তোমার কথাটা কেমন যেন কবিতার মত লাগছে।
শিপুর নিচের ঠোঁট কামড়ে কি যেন ভাবে, তারপর হঠাৎ বলে,
-তোমার কি মনে হয় আমি ফান করছি?
-মোটেও না তুমি ফান করার মত মেয়েই না, আর কথা হচ্ছে ভালবাসার মত সহজ সরল কথা নিয়ে। সরল কথা নিয়ে মজা করা যায় না। মজা করবে সবাই জটিল কথা নিয়ে।
-তুমি ব্যাপারটাকে হাল্কা করার চেষ্টা করছ।
শাহেদ আবারো বোকার মত হাসে। শিপুকে দেখে মনে হচ্ছে, কথা আবার নতুন উদ্যমে শুরু করতে যাচ্ছে সে।
-যা হোক আমরা ভুল করে বসেছি, এখন সময়কে উল্টোদিকে ঘোরানো যাবেনা। তাই একটা কাজ করতে হবে।
শাহেদের ইচ্ছে হল সময়কে উল্টোদিকে ঘোরানো নিয়ে একটা কথা বলার। কিন্তু তাতে সাহস হল না তার। সে বলল,
-কি কাজ?
-তোমার সাথে আর আমার থাকা সম্ভব নয়, আমি চলে যাব এবং সম্ভবত কালই চলে যাব। সহজ করে যাকে বলে ডিভোর্স
শাহেদের মাথায় ডিভোর্সের বাংলা কি হবে, তা ঘুরতে লাগল। ডিভোর্সের বাংলা হল বিবাহ বিচ্ছেদ। আচ্ছা, বিবাহ বিচ্ছেদের বিপরীত শব্দ কি হবে? বিবাহ মিলন? বিবাহ মিলনটা কখন হয়?
-তুমি কি শুনছ আমার কথা?
-হুঁ
-শুধু হুঁ বললে হবেনা, বল শুনছি!
-শুনছি, আচ্ছা বিবাহ বিচ্ছেদের বিপরীত শব্দ কি হবে?
শিপু ভ্রু কুঁচকে শাহেদের চোখের দিকে তাকায়। সে কি পুরো ব্যাপারটাকে নিছক মজা হিসেবে নিয়েছে? তাহলে খুবই ভুল হয়েছে তার। শিপু মানসিক ভাবে পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে গেছে। কাল সকালেই সে চলে যাবে। সন্ধ্যার দিকে তার ব্যাগ গোছানোও হয়ে গেছে। শাহেদকে কথাগুলো বলাই শুধু বাকী ছিল।
শাহেদ আরেকটা সিগারেট ধরায়। তার মন বলছে, -পাশেই তোমার স্ত্রী, (যা হোক আজ রাতেতো ডিভোর্স হচ্ছে না) এত ঘনঘন সিগারেট খাওয়া কিন্তু ঠিক হচ্ছে না। মনের আরেক অংশ তাৎক্ষনিক ভাবে সক্রিয় হয়ে উঠে, হোক না স্ত্রী! পরিস্থিতি অনুযায়ী মাঝে মাঝে চেইন স্মোকার হতে হয়। তা ছাড়া, এমনিতেতো কালকে সে চলেই যাচ্ছে। একরাতে সামান্য বেশি খেলে কি-ই বা এমন হবে!
-তুমি বলতে চাচ্ছ তুমি চলে যাওয়ার পর আমার কাজ হবে নীলুকে পটিয়ে বিয়ে করে ফেলা।
শিপুর মেজাজ ফ্লাস্কে রাখা কফির মত গরম হয়ে যায়। এতক্ষণ ভালই লাগছিল খেতে। এখন মনে হচ্ছে যেন এতক্ষণ চিরতার রস খাচ্ছিল সে। থু করে থুথু ফেলে ছাদে। শাহেদের দিকে না তাকিয়েই বলে,
-আমার যতটুকু করার দরকার আমি ততটুকুই করব, বাকীটা তোমার ব্যাপার। নীলুর ব্যাপার কোন কিছু বলার অধিকার আমার নেই।
শাহেদ কি যেন বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই উঠে দাঁড়ায় শিপু। কথাটা বলতে গিয়েও বলে না সে। শিপু ছোট্ট করে একটা হাই তুলল। নকল হাই না, সত্যিকারের হাই। তার ভয়ানক ক্লান্ত লাগছে। যেন অনেকদুর থেকে ভারী কিছু নিয়ে হেঁটে এসেছে। এখন নিজেকে একটু ভারহীন মনে হচ্ছে। -আমি যাচ্ছি বলে আর দাঁড়ায়না শিপু। শাহেদকে পাশ কাটিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যায়। নামার সময় সিঁড়ির কিছুটা অন্ধকার অংশ পার হতে হয়। অন্ধকার অংশে এসে শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ চেপে ধরে শিপু। অনেক্ষণ ধরে কান্না জমেছিল চোখে। এখন নদীতে জোয়ার এসেছে। ফুঁপেয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে শিপু।
শাহেদ কিছুক্ষণ ঘাড় বাঁকা করে চাঁদের দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ তাকালেই ঘাড় ব্যাথা করে। তবু কেন জানি বারবার চাঁদের দিকে তাকাতে ইচ্ছে করে। সে জানে, চাঁদের আলো ধার করা আলো। কিন্তু তার ধারণা চাঁদের নিজেরও কিছু আলো আছে। সে আলো সবসময় ধরা দেয়না। তবে ভেজা ভেজা চোখ দিয়ে চাঁদের দিকে তাকালে সে আলোর অনেকটা দেখা যায়।
**
নীলুকে আসতে দেখতে না দেখতেই সাইকেলের চাকা ভয়াবহ আওয়াজ করে ফেটে যায়। সফিকের মেজাজ সাথে সাথে সপ্ত আকাশে চড়ে যায়। ভেবেছিল সাইকেলে করে নীলুর পেছন পেছন রাস্তার মোড় পর্যন্ত যাবে। তার আগেই টায়ারের ভয়াবহ ষড়যন্ত্র। মনে মনে কয়েকশ রকম গালি দেয় সফিক।
-হারামজাদা সাইকেল তোকে দিয়ে আমি কটকটি খাব!
কয়েকটা লাথি মারে সাইকেলটাকে। তাতে ফল হল, জুতোর সামনের কিছু অংশ গেছে ছিঁড়ে। এখন নীলু তাকে ছেঁড়া জুতো সহ দেখবে। অবস্থা বেগতিক। সাইকেলটাকে ধড়াম্ করে আছড়ে মারে সফিক। ভয়ংকর রাগ দেখানোর এটা একটা পদ্ধতি। অবশ্য আওয়াজ করার আরেকটা সূক্ষ্ম কারণ হল নীলুর দৃষ্টি আকর্ষন করা। সফিক বিষদৃষ্টিতে সাইকেলটার দিকে তাকিয়ে আছে। এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন নীলুকে সে দেখতেই পাচ্ছে না।
নীলু এতক্ষণ পুরো ব্যাপারটাই দেখছিল, এবং তার হঠাৎ ইচ্ছে হল একটু মজা করার। এই ধরনের মজায় অবশ্য একটু রিস্ক আছে। তবু ভাবল মজা করতে হলে রিস্ক কিছুটা নিতেই হবে। রিকশা দাঁড় করিয়ে সে সফিকের উদ্দেশ্যে চিৎকার দেয়, সফিক ভাই।
সফিক ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক সেদিক তাকায়। নীলুর কণ্ঠ তার ভালই চেনা আছে। তবু মনে হচ্ছে যেন সে বুঝতে পারছে না তাকে কে ডাকছে। নীলুর দিকে চোখ পড়তেই দৃষ্টি আটকে যায় সফিকের। নীলু রিকশা থেকে নামেনি। রিকশার ওপর বসেই তাকে ডাকছে। সফিকের মনে হল সে শূন্যে ভাসছে। নিউটন ফিউটন সব মিথ্যা। সে তার কোন ওজন বুঝতে পারছে না। মনে হচ্ছে লাফ দিলেই ভেসে থাকতে পারবে অনায়াসে। শত চেষ্টা করেও মুখে হাসি আনতে পারছে না সফিক। নীলু বসে মিটিমিটি হাসছে। নিশ্চয়ই তাকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে। সফিক ভাবল, -নাহ্ মেয়েটার বুদ্ধি বেশি! ধরা খেয়ে যেতে পারি!
-কেমন আছ নীলু?
-জ্বী ভাল, আপনার হয়েছেটা কি বলুনতো! কিছুদিন হল বাসায় আসছেন না যে!
সফিক ঠিক কি উত্তর দিবে ভেবে পাচ্ছে না। তার কাছে পুরো ব্যাপারটা অসম্ভব একটা সপ্নের মত লাগছে। অসম্ভব সপ্নের মানে হল স্বপ্নেও যা সম্ভব নয়। কিন্তু বাস্তবে সম্ভব হয়ে গেছে। নীলুর পরনে গাড় নীল রংয়ের শাড়ি। সফিক কোথায় যেন শুনেছে সপ্ন নাকি সাদাকালো হয়। রং দেখা যায় না। সে পরিষ্কার নীল শাড়ি আর লাল ব্লাউজ দেখতে পাচ্ছে। হাতকাটা ব্লাউজ পরায় নীলুর হাতও খানিকটা দেখা যাচ্ছে। হাত ততটা ফর্সা না। তবে সফিকের মনে হচ্ছে এমন হাত এই পৃথিবীর কেবল মাত্র দুটি মানুষের আছে। একজন হলেন বৃটেনের রানী এলিজাবেথ আর একজন হল নীলু। (সুন্দরি মেয়ের কথা আসলেই সফিকের মনে শুধু এলিজাবেথের ছবি ভেসে ওঠে)।
-তুমি এখানে!
অনেক কষ্টে দুটি মাত্র শব্দ উচ্চারণ করতে পারে সফিক।
-হ্যাঁ আমি, ক্লাস করে আসছি। আপনাকে এখন আমার সাথে রিকশায় উঠতে হবে। আমাকে খুব সুন্দরি লাগছেতো! সুন্দরি লাগায় ভয় পাচ্ছি। আমাকে একটু বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসবেন।
সফিকের মনে হচ্ছে, যেই সে রিকশায় উঠতে যাবে সাথে সাথে তার পা ফস্কাবে এবং সে চিৎ হয়ে রাস্তায় পড়ে যাবে। ঘুম থেকে উঠে দেখবে বিছানা থেকে পড়ে গেছে সে। কিন্তু গাড় নীল দেখে আবার কিছুটা বাস্তব মনে হয়।
-কই উঠুন না!
নীলুর পাশে বসে সফিক। যথেষ্ট পরিমান ফাঁকা যায়গা রেখে বসা। ঘাড় ঘুরিয়ে নীলুকে দেখারও সাহস হচ্ছে না তার। বারবার মনে হচ্ছে পেছন থেকে এখুনি একটা ট্রাক এসে ধাক্কা দেবে তাদেরকে। সে পড়ে যাবে কিন্তু নীলু পড়বেনা, নীলু তখন চিৎকার দেবে, সফিক— আর সফিক তখন ঘুম থেকে উঠে দেখবে তার মা তাকে চিৎকার করে ডাকছেন, -সফিক—– সফিক—
-কি হল! এমন রোবটের মত বসে আছেন কেন? আপনিও কি ভয় পাচ্ছেন? ভাবছেন রাস্তার কোন বখাটে মেয়ে আপনাকে দেখে বিরক্ত করবে?
সফিক খিল্খিল করে বাচ্চা ছেলের মত হেসে উঠে।
-আপনি জিজ্ঞেস করেছিলেন আমি কেমন আছি, আমি কিন্তু মিথ্যে করে বলেছি ভাল আছি। আসলে আমার মন কিন্তু খুব খারাপ! জিজ্ঞেস করুন কেন খারাপ?
-কেন খারাপ?
-কি আশ্চর্য! আপনি দেখছি পুরনো আমলের রোবট! শেখানো বুলি আওড়াচ্ছেন!
সফিক ছোট্ট করে একটা কাশি দেয়। কাশি দিয়েই বুঝতে পারে এই মুহুর্তে দেওয়াটা ভুল হয়ে গেছে। নীলু ভীষণ বুদ্ধিমতী মেয়ে। তার সামনে অভিনয় করা যায় না। নীলু সফিকের দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি দেয়। হাত দিয়ে কপালে পড়ে থাকা চুল সরিয়ে বলে,
-তাহলে শুনুন কেন মন খারাপ, আমার এক বান্ধবী আছে শ¤পা, যাকে আমরা বলি থিন ব্যাম্বো। থিন ব্যাম্বো মানে হল পাতলা বাঁশ, হি হি–, যা হোক তার দীর্ঘ চার মাসের চলন্ত প্রেম হঠাৎ ফুট্টুস্! ফুট্টুস্ মানে বুঝলেনতো?
সফিকের এমনিতে লজ্জা করছিল। নীলু অবলীলায় প্রেম ভালবাসার ব্যাপার নিয়ে কথা বলছে। তার ওপর ফুট্টুস্ এর মানে জিজ্ঞেস করছে তাকে। মাথা নীচু থাকা অবস্থাতেই কোনরকম বলল সে,
-না জানিনা
-ঘোড়ার ডিম জানেন আপনি! ফুট্টুস্ হল চিড়িয়া উড়গ্যায়া! হিন্দী বুঝেনতো? নাকি সেটাও বুঝেন না? তার মানে হল পাখি উড়ে গেছে। থিন ব্যাম্বো এখন আরেকজনকে পছন্দ করে বসে আছে।
সফিকের মাথা আরেকটু নিচু হয়ে যায়।
-কি ব্যাপার রিকশার নিচে কি খুঁজছেন?
সফিক হন্তদন্ত হয়ে মাথা তুলে নীলুর দিকে তাকায়।
-কিছুনা এমনি
নীলু আবার রহস্যময় হাসি দেয়। সফিকের লজ্জা আরেকটু বেড়ে যায়। কোনরকম এদিক সেদিক তাকিয়ে পালিয়ে বাঁচে সে।
-এবার নামুন! চলন্ত রিকশা থেকে নামতে পারবেনতো? নাকি পড়ে যাবেন? বলেই আবার হাসে নীলু।
-আপনাকে এখানেই নামানোর কারণ হল, আর বেশি গেলে বাবা দেখে ফেলতে পারেন। দেখলে আমার খবর হয়ে যাবে।
সফিক হা করে তাকিয়ে থাকে নীলুর দিকে। পুরো ব্যাপারটা এখনও তার মাথায় ততটা পরিষ্কার হয়নি। তার কাছেও নীলুকে কিছুটা অদ্ভুত মেয়ে মনে হয়। সবচেয়ে বড় কথা তার ভয়াবহ আনন্দ লাগছে। দূর্ঘটনার বিপরীত হল সুঘটনা। তার কোন সুঘটনা ঘটিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। সুঘটনার মধ্যে একটাই ঘটল, তা হল খুশিতে কেঁদে ফেলেছে সফিক। হাত দিয়ে চোখ মুছতে দেখা গেল তাকে।
**
নীলু ঘরে ঢুকতেই চাপা উত্তেজনার গন্ধ পেল। উত্তেজনার গন্ধের সাথে বিশ্রী একরকমের মশলার গন্ধও পেল। নিশ্চয়ই বড় খালা এসেছে। বড় খালাই এমন বিশ্রী মশলা দিয়ে পান খান।
খালাকে দেখেই নীলু চোখ কপালে তুলে ফেলল,
-একি খালা! তুমি এত মোটা হলে কি করে!
বড় খালার নাম শাহানা আক্তার। সবাই ডাকে শানু বলে। নীলুরা ডাকে শানু খালা বলে।
-কোথায় মোটা হয়েছি! আগের চেয়ে মাত্র তিন কেজি বেড়েছি! তাওতো তোর খালুজান বলে আমি নাকি শুকিয়ে যাচ্ছি।
-খালুতো এমন বলবেই। বিকজ্ খালু লাভস্ ইউ ভেরী মাচ!
-কি হিজিবিজি বললি?
-হিজিবিজি নয় খালা, ইটস্ ট্রু! এন্ড নাথিং ইজ বেটার ট্রু দ্যান ইট!
খালার দুই পিচ্চি ছেলে মেয়েও এসেছে। তারা ইতিমধ্যেই একজন আরেকজনের সাথে যুদ্ধে নেমেছে। রহিমুল্লাহ সাহেব মাঝে মাঝে ধমক দিয়ে তাদেরকে চুপ করতে বলছেন। কিন্তু তাতে কোন কাজ হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। খালাকে দেখেই নীলু বুঝতে পারল এখুনি মহা গুরুত্বপূর্ন কোন বিষয়ে কথা বলবেন এবং অবশ্যই তা শাহেদকে নিয়ে। নীলুর শুনতে ইচ্ছে না হলেও শুনতে হবে এবং হাসি হাসি মুখেই শুনতে হবে।
-শাহেদ নাকি পালিয়ে বিয়ে করেছে, বিয়ের কয়েকদিন পরেই নাকি বৌ ফুটুস্!
-এত বিশ্রী করে কথা বলবেনাতো খালা! বৌ ফুটুস্ হয়নি, বৌ গেছে মায়ের কাছে।
-ঐ হল, দেখিস্ আর আসবেনা! অন্যকোন নাগর পেয়ে গেছে! এখন ফুর্তি করে বেড়াচ্ছে!
নীলু বুঝতে পারল খালা ইচ্ছে করেই এ ধরনের শব্দ ব্যাবহার করছেন। তাঁর ধারণা শিপুর নামে বাজে কথা বললে নীলু খুশি হবে। তাঁর উদ্দেশ্য অতি সহজ সরল। নীলুর আর একমুহুর্তও কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। সে তার রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়।
শিপু চলে গেছে গতকাল। ভোরে ভোরেই বের হয়ে গেছে বাড়ি থেকে। সবাই ঘুমে থাকলেও শুধু শাহেদ জেগেছিল। অনেকটা জেগে জেগে ঘুমাচ্ছিল সে। তার চোখ মেলতে মোটেও ইচ্ছে করছিল না। তার ঘুম ভাঙ্গে শিপুর খুট্খাট্ শব্দে। শিপুর পরনে ছিল বিয়ের দিনের সেই সবুজ কলাপাতা রংয়ের শাড়ি। শুধু এখন সানগ্লাসটা পরেনি সে। পরার দরকারও নেই। শাহেদের দিকে না তাকিয়েই বলে,
-আমি যাচ্ছি।
ঘুমের জন্য শাহেদের কথা বলতে ইচ্ছে করল না। সে শুধু হুঁ করে একটা শব্দ করে।
-এবং আমি চাই তুমি আমার সাথে দেখা করার হাস্যকর ধরনের চেষ্টা করবেনা।
-আচ্ছা।
-টেবিলের ড্রয়ারে একটা আংটি রেখে গেলাম, তোমার আর নীলুর বিয়ের অগ্রিম উপহার!
কথাটা বলেই শিপু ফিক্ করে হেসে উঠে। হাসি শুনে মনে হচ্ছে যেন হঠাৎ করে সে গোপন কিছু জেনে ফেলেছে। এখন সুযোগ মত গোপন কথাটা ফাঁস করে দিয়েছে। শাহেদ শিপুর দিকে তাকিয়ে দেখল, তাকে মোটেও সিরিয়াস দেখাচ্ছে না। হাসি হাসি মুখে চুল ঠিক করছে। ঠোঁটে লিপষ্টিকের ফিনিশিং টান দিয়ে নিল। শিপুর এমন একটা অভ্যাস আছে, যেখানেই যাক সেজেগুজে বেরুবে। শিপুকে একটা কিছু বলতে ইচ্ছে করছে তার। বিদায় সম্ভাসন টাইপের কোন কথা। মনে মনে ভাবল, -মামলা তাহলে সত্যি সত্যিই ডিস্মিস্
-এত ভোরে যাবে কি ভাবে?
শিপু মিষ্টি করে একটু হাসল। যার অর্থ হল, -তোমাকে অতশত ভাবতে হবেনা
মাঝে মাঝে গুণগুণ করে দুয়েক লাইন সূরও তুলছে। সূর শুনে মনে হল রবীন্দ্র সঙ্গীত হতে পারে।
শিপু চলে যাওয়ার পর ঝাড়া পাঁচ মিনিট চোখ বন্ধ করে রাখল শাহেদ। মাথায় ভোঁতা একধরনের ব্যাথা করছে। ব্যাথাটার একটা নাম দিয়ে দিল সে। রবীন্দ্র সঙ্গীত ব্যাথা। শিপুুর গুণগুণ করে তোলা সূরটাই ব্যাথা ধরিয়ে দিয়েছে। এখন শুধু বারবার মাথার মধ্যে সেই সূরটাই ঘুরছে। যথেষ্ট আকুতি করে গাওয়া কোন প্রেমের গান হবে হয়ত। শাহেদ গানের লাইন গুলো ধরার চেষ্টা করে। সূরটাকে যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি আউট করতে হবে। না হলে ব্যাথা ক্রমেই বাড়তে থাকবে।
সারাটা দিন শাহেদ আগের মত ঘুরে বেড়াল। বাসার কেউ শিপুর ব্যাপারে জানতে চায়নি। আরিফা শুধু মাঝখানে একবার জিজ্ঞেস করেছিল, -ভাবী কোথায়? শাহেদ একগাল হেসে বলে, -চলে গেছে আরিফাও হেসে উঠে, হাসিতে হাসিতে কাটাকাটি। দুপুরে খাওয়ার টেবিলে বসে রহিমুল্লাহ সাহেব একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, -তোর বৌ কোথায়? শাহেদ খেতে খেতেই জবাব দেয়, -চলে গেছে।
-চলে গেছে মানে!
শাহেদের ইচ্ছে হল বলে, -পাখীকে বেঁধে রাখা যায়নি চাচাজান, পাখী হাওয়া!
-সে আর আসবেনা
-আসবেনা কেন?
জেবুন্নেছা বেগম আড়চোখে একবার স্বামীর দিকে তাকান। যার অর্থ, -এমন ফালতু বিষয় নিয়ে এত কথা বলছো কেন? চলে গেছে আবার আসবে!
রহিমুল্লাহ সাহেব তাকনোর অর্থ বুঝলেন না। তিনি মাথা নেড়ে বিড়বিড় করে কি যেন বললেন, বোঝা গেল না। শাহেদও চুপচাপ খাওয়া শেষ করে উঠে চলে যায়।
নীলু নিজেকে অনেকক্ষণ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আয়নায় দেখল। অনেক সময় নিয়েই সেজেছে। বিকেলে তেমন একটা সাজেনা সে। হাল্কা ধরনের কাপড় পরবে, তারপর চায়ের কাপ হাতে ছাদে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করবে। এই ছিল তার বিকেলের কাজ। আজ হঠাৎ সাজতে ইচ্ছে হয় তার। শাহেদের দেওয়া শাড়িটা পরেছে। গাড় নীল রংয়ের শাড়ি। নীলুর সাথে নীলের মিল আছে। শাহেদ কি সেই ভেবে শাড়িটা পছন্দ করেছে? নীলু ভেবেছিল জিজ্ঞেস করে দেখবে। পরে ভাবল, না থাক্ ওকে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই, ও বলবে পছন্দ হয়েছে তাই নিয়েছি, আর কি!
গাড় নীল নীলুর মোটেও পছন্দ নয়। তার পছন্দ হল গাড় বেগুনী রং। শাহেদ তা জানে, তারপরও সে নীল রংয়ের শাড়ি আনবে। নীলু চোখ কুঁচকে আয়নায় তাকে দেখে। নাহ্ নীল রংয়ের শাড়িতে তাকে অতটা খারাপ দেখাচ্ছে না। শুধু চেহারায় একটু নীল ভাব চলে এসেছে। গাড় নীল নীলুর পছন্দ নয়, তার কারণ হল, নীল হল কষ্টের রং। কষ্টের রং কে কেন সে পছন্দ করতে যাবে? নীলু হাসি হাসি মুখ করে আয়নার দিকে তাকায়। কিন্তু আয়নায় নীলুকে মনে হচ্ছে মুখে একগাদা নীল কষ্ট নিয়ে হাসার চেষ্টা করছে।
-কি রে! কোথাও যাবি নাকি?
জেবুন্নেছা বেগম কখন রুমে এসে পড়েছেন নীলু তা টের পায়নি। টের পেলে সে এভাবে হাসি হাসি মুখ করে নিজেকে দেখতনা। হাসি হাসি মুখে আয়নায় নিজেকে দেখে কিশোরী মেয়েরা। নীলু একটু বেশি পরিমানে যুবতী হয়ে গেছে।
-এমনি সেজেছি! ভাল লাগছে না দেখতে?
জেবুন্নেছা বেগম প্রায় বলে ফেলেছিলেন, -ভাল দেখানোর কি দরকার! শেষ মুহুর্তে নিজেকে সামলে ফেললেন।
-তোর সাথে কিছু কথা আছে
নীলু আয়না থেকে মুখ ফিরিয়ে মায়ের দিকে তাকায়। কিন্তু মুখ থেকে এখনও হাসি মুছতে পারেনি। এমন এফ বি আই এর মত কথা বলছ কেন? যা বলবে সরাসরি বলে ফেল।
-এফ বি আই টা আবার কি?
-কি আশ্চর্য এফ বি আই এর নাম শুননি! ডেঞ্জারাস জিনিস! ওরা পারে না এমন কোন কাজ নেই।
জেবুন্নেছা বেগম বড় একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। নিজেকে সামলানোর আবার একটু ব্যর্থ চেষ্টা করলেন তিনি। কেন না, তাঁর এই চেষ্টা নীলু ধরে ফেলেছে। ভেতরে ভেতরে বেশ মজা পাচ্ছে সে। তবে মায়ের আসার উদ্দেশ্যটা ঠিক বুঝতে পারছে না এখনও।
-শাহেদের সাথে মেয়েটার কি হয়েছে?
নীলু চোখে কাজল দিচ্ছিল, কাজল দিতে দিতে বলল,
-কোন মেয়ের কথা বলছো? শিপু?
-হ্যাঁ
-নামটা বললেই পারতে, অত অভিনয় করছ কেন? আমার সাথে অভিনয় করবেনা।
জেবুন্নেছা বেগম সূক্ষ্ম অপমানটা ধরতে পারলেন না। ধরতে পারলে বড় করে আরেকটা নিঃশ্বাস ফেলতেন তিনি। নিঃশ্বাস না ফেলেই বললেন,
-আমার মনে হয় মেয়েটা সুবিধের ছিল না। উল্টাপাল্টা গোছের কিছু।
নীলু ভুল করে কাজল চোখের বাইরে দিয়ে দেয়। তাকে এখন কাজল চোখা ডাইনীর মত লাগছে। হাত দিয়ে কাজলও মুছছে না সে। মায়ের কথা শুনে মারাত্মক অবাক হয়েছে সে।
-উল্টাপাল্টা গোছের বলতে তুমি কি বোঝাতে চাচ্ছ
-সব তোকে বোঝাতে হবেনা!
নীলু হাত দিয়ে একপাশে লেগে থাকা কাজল ঘসতে থাকে।
-শাহেদ ভাই নিশ্চয়ই অমন ছেলে না, যে উল্টাপাল্টা মেয়েকে হুট করে বিয়ে করে ফেলবে!
-ওতো একটা গাধা! গাধার আবার বুদ্ধি কিসের! তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে কিছু করানো কঠিন কিছুনা!
নীলু খুব কঠিন একটা কথা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই তার গলা শুকিয়ে কাঠ। গলা দিয়ে সহজে কথা বেরুবেনা। কঠিন কথা বলার জন্য গলা হতে হবে তরল। নীলু কঠিন কথাটা বলতে পারল না। শুধু শান্ত কণ্ঠে বলল,
-মা, শিপু আর যাই হোক সে কোন পতিতা নয়! শাহেদ ভাই অতটা গাধা না!
জেবুন্নেছা বেগম একটুু চমকে উঠলেন। এই মেয়ের ভীষণ বুদ্ধি! তার মনের সূক্ষ্ম জিনিসটা ধরে ফেলেছে। তিনি আর তেমন কিছু বলতে পারলেন না। শান্ত একটা নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। চলে যাওয়ার আগে নীলুকে বললেন,
-শাহেদ একটা সোনার ছেলে, তার মত ছেলে একটু আধটু ভুল করবেই, তাতে কোন দোষ নেই, মানুষ হয়েছে তো ভুল করবেই!
জেবুন্নেছা বেগম নীলুর উত্তর শোনার জন্য অপেক্ষা করলেন না। রান্না ঘরের দিকে চলে গেলেন। আয়নায় নীলুকে ভীষণ ঘোলাটে দেখাচ্ছে। চোখ ভেজা থাকলে আয়নায় ঘোলাটে ছবি দেখা যায়। আয়নায় নীলু যেন জলে ভেসে বেড়াচ্ছে। নীলু নীল আর সবুজ টিপ নিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেছে। কোনটা লাগাবে বুঝতে পারছে না। গাড় নীলের সাথে কোন টিপ মানাবে? নীল নাকি সবুজ? নীলু নীল টিপটাই বেছে নেয়। আয়নায় নীলুর মুখে নীলের তীব্রতা আরো বেড়ে যায়। আয়নায় নীলুর কষ্ট যেন আরেকটু বেড়ে গেছে।
**
রাহেলা বেগম আশ্চর্যজনক ভাবে শান্ত রইলেন। শিপুকে দেখে তিনি চমকে উঠলেন না বা রেগেও গেলেন না। রাহেলা বেগমের শান্ত ভাব দেখে শিপু সামান্য অবাক হয়। সে ভেবেছিল মা একসাথে একগাদা প্রশ্ন তাকে জিজ্ঞেস করবে। এবং কিছুতেই তার বিয়ের কথা বিশ্বাস করবেনা। শিপু আড়চোখে মায়ের দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ আগে ঘুম থেকে উঠেছেন তিনি। ভাব দেখে মনে হচ্ছে হাই তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এবং শিপুকে আবারো অবাক করে দিয়ে মাঝারি সাইজের একটা হাই তুললেন তিনি। শিপুকে শান্ত চোখে পর্যবেক্ষণ করছেন। মনে হচ্ছে যেন চোখ দিয়ে শিপুকে বোঝার চেষ্টা করছেন। এখনও বোঝা শেষ হয়নি। বোঝা শেষ হলেই চোখ সরিয়ে ফেলবেন মনে হচ্ছে।
-নাস্তা করেছিস্?
পর্যবেক্ষণ বোধহয় শেষ। রাহেলা বেগম চোখ নামিয়ে ফেলেছেন। শিপু ভাবছে অন্য কিছু। সে ধরে নিয়েছিল মা তাকে জিজ্ঞেস করবে, -কোথায় ছিলি? বা -কেন এসেছিস্? এই ধরনের কোন প্রশ্ন। রাহেলা বেগম তা জিজ্ঞেস করেননি। শিপুর মনে হচ্ছে বড় ধরনের কোন যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। সে আজ পাঁচদিন হল বাড়ি আসেনি। তার মত একটা মেয়ের জন্য পাঁচদিন বাড়ির বাইরে থাকা নিশ্চয়ই অনেক ভয়াবহ একটা ব্যাপার। সে এই ভয়াবহ ব্যাপারটার গভীরতা অনুভব করার চেষ্টা করছে। বুঝতে পারলে সুবিধে হত। যুদ্ধে আক্রমনের কৌশলটা কিছুটা আন্দাজ করতে পারত তাহলে।
শিপু একপাশে আস্তে করে ব্যাগটা রাখল। আপাতত কোন শব্দ করতে চাচ্ছে না সে। ব্যাগ রেখে মায়ের দিকে এগিয়ে যায়।
-কেমন আছ মা?
রাহেলা বেগম সাথে সাথে জবাব দিলেন,
-ভাল।
শিপু এ ধরনের উত্তরও আশা করেনি। সে আশা করেছিল, রাহেলা বেগম কপাল ভাঁজ করে বলবেন, -কেমন আছি তা জেনে তোর কি! যুদ্ধের শুরুটা কেমন হবে তা ঠিক বুঝতে পারছে না সে।
রাহেলা বেগমের হাতে কফির কাপ। তিনি চা খান না। শিপুর বাবাও চা খেতেন না। স্বামী চা না খাওয়ায় স্ত্রীও খান না। সহজ যুক্তি। শিপু তাকিয়ে আছে একপাশে রাখা ফুলের টবের দিকে। টবে একটা প্লা¯িটকের গাছ আছে। তাতে আবার লাল নীল ফুল। একই গাছে দুই রংয়ের ফুল! টবটাও খুব ®েপশাল ধরনের টব। সবুজ একটা মৎস্যকন্যা। মৎস্যকন্যার গায়ে কোন কাপড় নেই। কাপড় পড়া মৎস্যকন্যা নিশ্চয়ই অতটা স্পেশাল হবেনা। যেই আসুক, একবার হলেও মৎস্যকন্যার দিকে আড়চোখে তাকাবেই। মৎস্যকন্যার দিকে তাকালে শিপুর লজ্জা লাগত। তবে এখন আর লজ্জা পাচ্ছে না সে। সে তাকিয়ে আছে শূন্য দৃষ্টিতে। শূন্য দৃষ্টিতে লজ্জা দেখা যায় না। নিজের রুমে চলে যাবে কিনা ভাবছে সে। রুমে চলে যাওয়া মানে যুদ্ধ অর্ধেকটা শেষ হয়ে যাওয়া।
-এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? নাস্তা না করে থাকলে, খেয়ে নে, পাউরুটি আর মাখন আছে। মাখন ফ্রিজে রাখা, কলাও আছে।
শিপুর সামান্য ক্ষিদে ক্ষিদে ভাব আছে। তেমন খেতে ইচ্ছে করছে না এখন। তার ইচ্ছে করছে রুমে গিয়ে ভয়াবহ একটা ঘুম দিতে। রাতে ভাল ঘুম হয়নি তার। রুমে যাওয়ার কথা মনে হতেই শিপুর মনে হল রুমটাকে সে খুব যত্নের সাথে সাজিয়ে ছিল। এখন কি রুমটাকে সে নিজের রুম ভাববে? শিপু নিজের রুমে যাচ্ছিল, পেছন থেকে রাহেলা বেগম বললেন, -ব্যাগ নিয়ে যা, ব্যাগ কি এখানে থাকবে নাকি!
মিষ্টি একটা পারফিউমের গন্ধ পাচ্ছে শিপু। ছেলেদের পারফিউমের গন্ধ। ছেলে আসবে কেন? শিপুর চোখ কুঁচকে যায়। পাশের রুম থেকে খুটখাট্ আওয়াজও শোনা যাচ্ছে। তৃতীয় কোন ব্যক্তি এসেছে নাকি? তার পরিচিত তেমন কোন আত্মীয় নেই। ছোট মেয়ে রেখে কোন স্বামী মারা গেলে সেই স্ত্রীর প্রতি অনেকেরই নজর পড়ার কথা। নজর পড়ার মত যথেষ্ট সম্পত্তি রেখে গেছেন শিপুর বাবা। কিন্তু তাদের বেলায় ঘটেছে উল্টোটা। সবাই একেএকে নিজেদের গুটিয়ে নেয়। খুট্খাট্ শব্দটা এবার আরেকটু বেড়ে যায়। শিপু ভাবল উঠে দেখবে কিনা। কিন্তু তার ভীষণ ক্লান্ত লাগছে এখন। উঠতে ইচ্ছে করছে না। নরম বিছানায় শুয়ে তার ঘুম চলে আসার অবস্থা। চোখ বন্ধ করে শব্দটা থেকে মন সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে সে। আচ্ছা শাহেদ এখন কি করবে? শাহেদের কথা ভাবতেই ঠোঁট সামান্য বেঁকে যায় শিপুর। শাহেদ কি নীলুকে বলে বসবে? -আমি তোমাকে বিয়ে করব নিঃশব্দে হাসে শিপু। শাহেদকে দিয়ে মনে হয় সব সম্ভব। খুট্ করে বড় একটা শব্দ হল। নাহ্ শাহেদকে নিয়ে আর ভাববেনা সে। তার ভাবনা সে নিজেই ভাববে। আর যদি নীলুর ইচ্ছে হয় তবে সেও ভাবুক। শিপু বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ শুয়ে থাকায় তার মুখে কেমন যেন রুক্ষ্ম ভাব চলে এসেছে। শাড়ির ভাঁজও কিছুটা এলোমেলো হয়ে গেছে। পাশের রুমে যেতে হলে মাকে পাশ কাটিয়ে যেতে হবে। মায়ের সামনাসামনি হওয়ার তেমন ইচ্ছে নেই তার। কিছুক্ষণ একা একা থাকতে চায় সে। কিন্তু কৌতুহলের কারণে চিন্তাটা বাদ দিয়ে দেয় শিপু।
পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই রাহেলা বেগম বললেন,
-অর্নব এসেছে। দুদিন হল, কিছুদিন থাকবে এখানে। তোর কথা জিজ্ঞেস করেছিল, বলেছি বান্ধবীর বাসায় গিয়েছে।
শিপু ভাবল বলে ফেলবে, -কেন বিয়ে করে ফেলেছি এটা বলতে পারলে না?
কিন্তু এখন তা বলাটা বোধহয় ঠিক হবেনা।
দরজার ফাঁক দিয়ে ভেতরে উঁকি দিল শিপুু। কাজটা মোটেও ঠিক হচ্ছে না বুঝতে পারলেও কৌতুহল দমাতে পারছে না সে। তার কৌতুহল খুট্খাট্ শব্দের উৎপত্তিস্থলের প্রতিই নিবিষ্ট। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকবে কিনা ভাবছে শিপু। তার আগেই দরজার ফাঁক দিয়ে চোখাচোখি হয়ে যায় অর্নবের সাথে। অর্নব মিষ্টি করে হাসে।
-আসুন
শিপু একটু হাসতে চেষ্টা করে। হাসির উত্তরে হাসি। অর্নব এতক্ষণ ধরে তার ব্যাগ থেকে কাপড় নিয়ে কাবার্ডে ঢোকাচ্ছিল। টেবিলের ওপর একরাশ এলোমেলো জিনিসপত্র। আফটার শেভ থেকে শুরু করে একটা ক্যামেরাও আছে সেখানে। নিশ্চয়ই ছবি তোলার রোগ আছে তার। শিপু চোখ কুঁচকে ক্যামেরার দিকে তাকায়। তার ধারণা ফটোগ্রাফাররা একটু ছ্যাবলা ধরনের হয়। সুন্দরি মেয়ে দেখলেই ছবি তোলার জন্য ছোঁক ছোঁক করে। কিছু বললেই বলবে, শিল্প খুঁজে বেড়াচ্ছি, যত্তসব।
অর্নবের মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুল। চেহারায় সরলতার ছাপ স্পষ্ট। তাকে দেখে মনে হচ্ছে না মেয়ে দেখে ছবি তোলার জন্য ছোঁক ছোঁক করবে।
-আপনি শিপু, তাই না?
অর্নব আবারো হাসে। হাসিটা অনেকটা বাচ্চা ছেলের হাসির মত। শিপু খানিকটা এগিয়ে এসে বলে,
-আপনি অর্নব তাই না?
অর্নব যেন খুব মজা পেয়েছে এমন ভাবে হাসতে থাকে। শিপু আবার বলে,
-আচ্ছা, অর্নব মানে জানেনতো?
-জ্বি না।
-কি আশ্চর্য! নিজের নামের অর্থই জানেন না! অর্নব হল সমুদ্র।
অর্নবকে কিছুটা লজ্জিত দেখাচ্ছে। নামের অর্থ না জানার কারণে, নাকি শিপুর সামনে নিজের অজ্ঞতার কারণে তা বোঝা গেল না। আপাতত গোছানো বন্ধ।
শিপু হাত দিয়ে এলোমেলো চুল ঠিক করে নেয়। এলোমেলো চুল নিয়ে একটা ছেলের সামনে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে ভাল লাগছে না তার।
অর্নবের গায়ে লাল রংয়ের টি শার্ট। শার্টের একপাশে একটা হলুদ রংয়ের দাগ দেখতে পেল শিপু। দাগটা চোখে লাগার মত। অর্নবকে দেখে মনে হচ্ছে নিজের সম্পর্কে সে খুবই উদাসীন। সিরিয়াস ধরনের পড়ুয়া ছাত্ররা যেমন হয় তেমন।
-আপনি খুব ভাল লেখেন অর্নব এবার শিপুর দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলে।
শিপু হঠাৎ চমকে উঠে। ভেতরে ভেতরে একটু রাগও হয় তার। তার মানে অর্নব তার ডায়রী পড়ে ফেলেছে। ডায়রীটা সে নিয়ে যায়নি। টেবিলের ওপরেই রেখে গিয়েছিল। আর অর্নব ততক্ষনে তা পড়ে ফেলেছে। অর্নবের হাসি হাসি মুখ দেখে রাগ প্রকাশ করতে পারছে না শিপু। সামান্য একটুু হাসে শুধু।
-ডায়রী পড়ে ফেলেছি বলে দুঃখিত। আপনি কোন নাম লেখেননি, শুধু কবিতাগুলো লেখা ছিল। আমি বুঝতে পারিনি। আই এম সরি!
শিপু অর্নবের দিকে ভাল করে তাকাল। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে সত্যিই দুঃখ পেয়েছে। তার জন্য শিপুর একটু মায়া হয়। মায়া সূলভ কিছু একটা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে তার। শিপু বলল,
-আপনি কি ফটোগ্রাফার নাকি?
অর্নব লজ্জিত হাসি দেয়। যার অর্থ হল সে সত্যিই একজন ফটোগ্রাফার।
-আমি কিন্তু ফটোগ্রাফারদের একদম পছন্দ করিনা
শিপু একটু কৌতুকের কণ্ঠে কথাটা বলে। কিন্তু অর্নব কৌতুকের কণ্ঠ বুঝতে পারেনি। সে অবাক হয়ে একবার শিপুর দিকে তাকায় আরেকবার তাকায় ক্যামেরার দিকে। সে কি বলবে ঠিক বুঝতে পারছে না। ততক্ষনে শিপু আবার বলে,
-তবে আপনি ঐ ধরনের ফটোগ্রাফার না। ছবি টবি কিছু তুলেছেন? দেখাবেন না আমাকে?
অর্নব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
-দেখবেন?
-এখন না। আমার ভয়ংকর ক্ষিদে পেয়েছে। ক্ষিদে পেটে শিল্পর মর্ম বোঝা যাবেনা।
অর্নব আবার হেসে উঠে। শিপুর বলতে ইচ্ছে হল, -এত হাসবেন না, যারা শুধু শুধু হাসে তাদেরকেও আমার পছন্দ নয়।
কিন্তু অর্নবের হাসির ভঙ্গী দেখে কথাটা আর বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না তার। হাসুক্ যত খুশি। অল্প সময়ের জীবন, যতটা সম্ভব হেসে হেসে কাটুক্! শিপু তার ভাবনাতেই চমকে উঠে। সে এমন দার্শনিক টাইপের চিন্তা করছে কেন? সে কি আগের থেকে পাল্টে গেছে?
**
সফিক বিছানায় শুয়ে চেয়ার থেকে পানির বোতল নেয়ার চেষ্টা করছে। সে গ্লাসে করে পানি খেতে পছন্দ করেনা। তাই বোতল রাখা। পুরো শক্তি দিয়ে হাত বাড়িয়েও ধরতে পারছে না সে। বরং হাতের সাথে ধাক্কা লেগে বোতলটা আরো দুরে সরে যাচ্ছে। গতকাল ভয়াবহ ধরনের এক্সিডেন্ট হয়েছে তার। অল্পের জন্য প্রান রক্ষা। পেছনের ট্রাকটাকে খেয়াল করেনি সে। খেয়াল যখন হয়েছে তখন আর বেশি সময় ছিল না। কাজেই চোখ বন্ধ করে একপাশে লাফ দিল। সবাই বলছে, হিরো হবার শখ হয়েছে নাকি! কিন্তু ততক্ষনে হিরোর ডান পা গর্তে পড়ে ভয়ংকর ভাবে ভেঙ্গে যায়। ভাঙ্গার সময় কট্ করে একটা আওয়াজও শুনে সে। তারমানে হাড়টাড় একটা কিছু আউট অফ লাইন হয়েছে। আউট অফ লাইন হওয়া পা নিয়ে সফিক এখন পানির বোতল ধরার চেষ্টা করছে। পাশের রুমেই মা আছে। ইচ্ছে হলেই ডাকা যায়। কিন্তু তার ডাকাডাকি করতে ইচ্ছে করছে না। ডাকাডাকি করা মানেই সে হেরে গেছে। ধরতে পারলে খাবে না হলে খাবেনা এমন ভাবে সফিক তাকায়। একসময় ক্লান্ত হয়ে চোখ বন্ধ করে সে। চোখ বন্ধ করে ভাবে, নীলু থাকলে বেশ হত। সারাক্ষণ পাশে বসে থাকত। সে পানি খেতে চাইলে হন্তদন্ত হয়ে গ্লাসে ঢেলে দিত। আচ্ছা, কল্পনায় নীলুর সাথে একটু কথা বললে কেমন হয়! সফিক কল্পনা করতে খুব পছন্দ করে। কল্পনায় যা ইচ্ছে তা ভাবা যায়। এর মধ্যে কল্পনায় নীলুর সাথে তার অনেক অনেক কথা হয়ে গেছে। আজও কল্পনায় কথা শুরু করে সফিক।
-তোমকেতো অপ্সরীর মত লাগছে! (কল্পনায় সে চোখ বন্ধ করে কথাটা বলেছে)।
-চোখ বন্ধ করে বলছ অপ্সরীর মত লাগছে আমাকে?
সফিক চোখ না খুলেই বলবে,
-চোখ খুললে আরো সুন্দর কিছু দেখে ফেলতে পারি। অপ্সরীর চেয়ে সুন্দর কোন উপমা আমার জানা নেই।
নীলু সফিকের কপালে হাত রাখবে, হাত রেখে বলবে,
-অত উপমা দিতে হবেনা! আমি নীলু নীলুই থাকব!, আচ্ছা, তুমি কি অপ্সরী দেখেছ নাকি?
-না।
-তাহলে বললে যে?
সফিক তখন পাশ ফিরে শোবে। নীলুর হাত কপালের নিচে চাপা দিয়ে।
-অপ্সরী দেখতে চাই না। দেখলে তোমাকে আর অপ্সরী বলে ডাকতে ইচ্ছে করবেনা।
নীলু মৃদু হাসবে। সফিক কল্পনাতে সেই হাসিও দেখবে। কল্পনায় যা দেখার নয় তাও দেখবে সফিক। ঘাড় ঘুরিয়ে সফিক বলবে,
-পানি খাব।
নীলু তাড়াহুড়ো করে পানি ঢালবে, কিন্তু পানি কিছুতেই গ্লাাসে পড়বেনা। সব পানি গ্লাসের বাইরে পড়বে। নীলু দুঃখকাতর কণ্ঠে বলবে, -এই যাহ্! পানি সব পড়ে গেল! ঘরে যে আর পানি নেই!
(কল্পনার এই অংশটা সফিকের নিজের বানানো, ইচ্ছে করেই ঘরকে পানিশূন্য করে নিয়েছে সে)।
কথাটা শুনে সফিক বোকার মত নীলুর দিকে তাকাবে। কিছুক্ষণ তাকানোর পর দেখবে নীলু কাঁদছে। তার চোখ বেয়ে টলটল করে পানি পড়ছে। একফোঁটা এসে সফিকের গালেও পড়বে। সফিক হেসে বলবে,
-এই তো পানি! দাও পানি খাব!
নীলু চোখে পানি নিয়ে হেসে ফেলবে, তার হাসি দেখে সফিক বলবে,
-আরেকটু হাস, আরেকটু হাসলে আরেক গ্লাস পানির সমান হবে।
নীলু এবার খিলখিল করে হাসবে। আপাতত কল্পনাটা এখানেই শেষ করা যায়। কল্পনা বেশিক্ষণ করলে মজা নেই। এবার কিছুক্ষণ নীলুর চেহারা কল্পনা করা যায়। কল্পনায় নীলুর চেহারায় একটা কাটা দাগ দিয়ে দেয় সফিক। যদিও তার চেহারায় ওরকম কোন দাগ নেই। সফিক তবুও দাগটা দেবে। দাগটার দিকে সে গভীর আকুতির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। যেন নীলুকে নয় দাগটাকেই ভালবাসে। এই দাগের কোন অর্থ নেই। তবুও সফিক তা দেবে। কেন দেয় তা সে নিজেও বুঝতে পারে না। বুঝতে চায়ও না সে। দেবার আছে দিয়েছে।
আজ দাগটাকে কিছুতেই স্পষ্ট করতে পারছে না। বারবার অস্পষ্ট হয়ে দাগটা মুছে যাচ্ছে। বেশি কল্পনা করতে গেলে দাগটা হয়ে যায় বিভৎস একটা গর্ত। নীলুর চেহারাটাও যায় নষ্ট হয়ে। তবু হাল ছাড়ছে না। আরো মন দিয়ে কল্পনা করছে সে।
**
শাহেদ অনেক রাত করে বাসায় ফিরেছে। তার শার্ট ভিজে চুপসে আছে। মাথার চুল গড়িয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। অফিসে বেশিক্ষণ ছিল না সে। দুয়েকটা চিঠি লিখেই চলে আসে। দুপুরের কাঠ ফাটা রোদে ঘণ্টা দুয়েক ঘুরে বেড়ায় সে। উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে ঘোরা। উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে ঘোরারও সূক্ষ্ম একটা উদ্দেশ্য থাকে। শাহেদের কোন উদ্দেশ্য নেই। হাঁটতে হাঁটতেই একসময় শুরু হয় বৃষ্টি। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে শাহেদ নক্ করে সফিকদের দরজায়। সফিকের বাবা শাহেদকে মাত্রাতিরিক্ত পছন্দ করেন। তাঁর পছন্দটা একটু বাড়াবাড়ি ধরনের পছন্দ। শাহেদ সামান্য অস্বস্তি বোধ করে। দরজা খুললেন সফিকের মা।
-স্লামালিকুম খালাম্মা, কেমন আছেন?
সুফিয়া বেগমের মুখ মলিন দেখে শাহেদ কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে যায়। সে হাসি হাসি মুখ করে রেখেছিল। কিন্তু মলিন মুখের সামনে হাসি হাসি মুখ করে থাকা যায় না। আরেকজনের মলিনতা নিজেকেও ধরে বসে। শাহেদও তার মুখ কিছুটা মলিন করে ফেলে।
-এস।
অন্যসময় হলে সুফিয়া বেগম আহ্লাদ করে বলতেন,-তোকে ঢুকতে দেবনা শয়তান ছেলে, এতদিন পরে এসে বলে কেমন আছেন খালা! আজ কিছুই বললেন না।
সফিককে দেখে চমকে উঠে শাহেদ।
-শালা তোর তো দেখি ছ্যাড়াব্যাড়া অবস্থা! হল কী করে?
সফিক হাসার চেষ্টা করে। পায়ে ভয়ংকর ব্যাথা নিয়ে সহজে হাসা যায় না।
-আগে বল তোর বৌয়ের খবর কি? এতদিনে কতটুক্ কি করেছিস্!
শাহেদকে দেখে মনে হচ্ছে সে সত্যি সত্যি লজ্জা পেয়েছে। শাহেদ লজ্জা ঢাকতে পারে না। সফিক তাতে আরেকটু মজা পেয়ে যায়।
-কি রে শালা! এত তাড়াতাড়ি আমাকে তুই আংকেল বানিয়ে ফেলবি নাকি!
শাহেদ এবার শব্দ করে হাসে। শিপুর ব্যাপারটা এখনও বলতে চাচ্ছে না সে। শিপুকে এড়িয়ে যায় শাহেদ।
-চাকরি বাকরী কিছু করবি না? চাচাকে আর কত জ্বালাবি?
সফিক হো হো করে হেসে উঠে।
-তুই শালা বিয়ে করে চেঞ্জ হয়ে গেছিস!
-এখানে বিয়ে আসছে কেন?
-আসবে আসবে! সবই আসবে এখন! আগে বলতি চাকরি ফাকরি সব ভুয়া, আর এখন মুখে কবুতরের বুলি আওড়াচ্ছিস্!
সফিক অন্যদিকে তাকিয়ে বলছিল কথাগুলো। এবার শাহেদের দিকে তাকায়।
-কবুতরের বুলি কি জিনিস্ বুঝলিতো? কবুতর থাকে খাঁচায়, তুইও ঢুকেছিস্ খাঁচায়, এখন খাঁচার গান ঝাড়ছিস্!
শাহেদের ইচ্ছে হল বলে, -কবুতর এখন মুক্ত, মুক্ত কবুতর ভিজতে ভিজতে এখন তোর কাছে এসেছে কিন্তু বললে সফিক সন্দেহ করে বসবে। এরপর শুরু হবে তার ছোঁক ছোঁক স্বভাব। সফিককে বললেই সফিক এখুনি উঠে শিপুর কাছে চলে যাবে। পায়ের কথা বললে বলবে, -পা অতি নগন্য জিনিস, পায়ের চাইতে প্রেম বড়
শাহেদ সফিকের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকায়। সফিককে তার খুব আপন মনে হয়। অদ্ভুত ধরনের এক ছেলে। তার মাথাতেই প্রথম বুদ্ধিটা আসে। সেদিন তারা রাতে বাইরে ঘুরছিল। দুজনের হাতেই জ্বলন্ত সিগারেট। সফিকই প্রথম বলে,
-এক কাজ কর বিয়ে করে ফেল, বিয়ের বিকল্প নেই, নো বিকল্প।
-থাম্ , কি প্যাঁচাল শুরু করলি, বিয়ে অত সহজ জিনিস না, চাকরি বাকরী নেই, খাওয়াব কি! রাখব কোথায়?
সফিক সিগারেটে জোরে একটা টান দেয়। তার মানে সে এখন জটিল ধরনের কোন ফিলসফি ঝাড়বে। শাহেদকে দেখে মনে হয় এধরনের দর্শনবানী শোনার বিন্দুমাত্র আগ্রহ তার নেই। কিন্তু তার অনাগ্রহটা ধরতে পারলে সফিক আরো তিনগুণ বেশি ফিলসফি বের করবে। শাহেদ চোখে মুখে আগ্রহ নিয়ে সফিকের কথা শুনে। সফিক মৃদু একটা কাশি দিয়ে তার কথা শুরু করে।
-তুই কয় প্লেট ভাত খাস্? দুই প্লেট? এখন থেকে এক প্লেট খাবি! আর তুই নিশ্চয়ই কোন মেয়ের সাথে এক বিছানায় রাত কাটাস্ না? তুই এখন থেকে শিপুকে নিয়ে শুবি।
অন্যসময় হলে শাহেদ বলতো, -ঠিক আছে, শার্ট প্যান্ট, স্যান্ডো গেঞ্জি সব ভাগাভাগি করে পরব। কিন্তু কিছুই বলতে পারেনি শাহেদ। শূন্য দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকে শুধু। মাঝে মাঝে কিছু ধোঁয়া ছাড়ে আকাশে। সফিকের কথাগুলো বিভিন্নভাবে মাথায় ঘুরছে। মাথার এক অংশ কিছু অংকও করে ফেলল সাথে সাথে। দুই প্লেট ডিভাইডেড বাই টু ইকুয়েল টু এক প্লেট, ওয়ান খাট্ ডিভাইডেড বাই টু সমান পয়েন্ট ফাইভ খাট্। একসময় সিগারেট শেষ হয়ে যায় শাহেদের। কিন্তু চাঁদ থেকে চোখ সরিয়ে নিতে ইচ্ছে করছে না তার।
সফিকদের বাড়ি থেকে বেরুতেই আবার বৃষ্টি শুরু হল। শাহেদের হাতে সদ্য ধরানো সিগারেট। সিগারেট ফেলে দিবে কিনা ভাবছে সে। ভাবতে না ভাবতেই সিগারেট চুপসে ন্যাতা হয়ে যায়। সে বিরক্ত চোখে সিগারেটের দিকে তাকায়। ছুঁড়ে একপাশে ফেলে দেয়। সিগারেট ছাড়া নিজেকে উদ্ভ্রান্তের মত মনে হয় তার। বৃষ্টিতে ভিজতে অতটা মন্দ লাগছে না। একটু ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে শুধু। লাগুক ঠান্ডা। বৃষ্টিতে ভিজতে হলে একটু আধটু ঠান্ডা লাগাতে হবে। সব আনন্দের জন্য একটু কষ্টও পাওয়া উচিৎ। তা না হলে আনন্দ ঠিকমত উপভোগ করা যায় না। তবে বৃষ্টিটা অতটা উপভোগ করতে পারছে না শাহেদ। তার ঠোঁট কাঁপছে। হাঁটতেও ইচ্ছে করছে না এখন আর। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজতে পারলে ভাল হত। তাতে নির্ঘাৎ নিওমোনিয়া হবে। শাহেদ এলোমেলো ভাবে হাঁটতে থাকে। মাঝে মাঝে এক পা আরেক পায়ের সাথে বাড়ি খাচ্ছে। অনেকটা ঘোরের মধ্যে হাঁটে সে।
**
-কি হল খাবেনা তুমি?
নীলুর চোখে হাসি ঠিক্রে পড়ছে। যেন খুব মজার একটা কথা বলে ফেলেছে। শাহেদ বিছানায় গলা পর্যন্ত চাদর দিয়ে শুয়ে আছে। তার শরীর ভয়াবহ ধরনের খারাপ। জ্বরটর এসেছে বোধহয়। সিগারেটে অরুচি এসে গেছে। ধোঁয়াকে অসহ্য মনে হচ্ছে এখন। শাহেদ চোখ বন্ধ করে জ্বরের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করছে। জ্বরটা মনে হচ্ছে সবে -সা তে আছে। কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে তারাসপ্তকে উঠবে। সব কিছু কেমন যেন দুলছে। শাহেদের মনে হচ্ছে সে কোন নৌকায় শুয়ে আছে। নৌকা এখন শান্ত নদীতে আছে। হাল্কা হাল্কা দুলছে শুধু। কিছুক্ষণ পর নদীতে ঝড় উঠবে। নৌকা আরো বেশি করে দুলবে। নীলুর কথা ঠিকমত বুঝতে পারছে না শাহেদ। সে একবার ঘাড় ফিরিয়ে নীলুর দিকে তাকায়। এমনি এমনি তাকানো। এমনি এমনি তাকানোর কোন অর্থ নেই। কিন্তু শাহেদের দৃষ্টি দেখে নীলুর মনে হচ্ছে শাহেদ তাকে চিনতে পারছে না। নীলু ঠোঁট কামড়ে ধরে চোখ পাকিয়ে তাকায়। শাহেদ কিছুটা হাসার চেষ্টা করে। নীলু শাহেদের পাশে গিয়ে বসবে কিনা ভাবছে। রাত এগারটা বাজলেও পুরো বাড়ি জমজমাট হয়ে আছে। নীলুর দুঃসম্পর্কের এক ফুফুও এসেছেন। ফুফুর সাথে এসেছেন ফুফা। তিনি রহিমুল্লাহ সাহেবের সাথে খোশগল্প শুরু করে দিয়েছেন। মাঝে মাঝে চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ শোনা যাচ্ছে। এরই মধ্যে পাঁচ ছয়টা ছেলে মেয়ের সাথে নীলুর ভাব হয়ে গেছে। ওরা দল বেঁধে নীলুকে মামী ডাকা শুরু করে দিয়েছে, (শাহেদ হল ওদের সবার প্রিয় মামা)। নীলুও হাসি হাসি মুখ করে ওদের ডাকে সাড়া দিচ্ছে। শাহেদের সাড়া শব্দ না পেয়েই তাকে দেখতে আসে নীলু।
শাহেদ পাশ ফিরে শোয়। চাদর দিয়ে এখন পুরো শরীরটাই ঢাকা। কে জানে, সে হয়তো ভাবছে নীলু এগিয়ে এসেই কপালে হাত রাখতে চাইবে। তার চেয়ে চাদর দিয়ে পুরোটা ঢেকে দেওয়াই ভাল। নীলু বিছানার পাশে কোলের ওপর হাত গুটিয়ে বসেছে। আর মাঝে মাঝে পা দোলাচ্ছে। ভঙ্গী দেখে মনে হচ্ছে, শাহেদকে বিশেষ কিছু বলতে যাচ্ছে সে।
-আচ্ছা ভাবীর সাথে তোমার হয়েছেটা কি বলতো?
শাহেদ চাদরের ভেতর থেকেই জবাব দেয়,
-কিছু হয়নি, এমনি এমনি চলে গেছে।
নীলু ফিক করে একটু হেসে উঠে। মাপা মাপা হাসি। শাহেদ যেন শুনতে না পায়।
-আর আসবেনা? নীলু কণ্ঠটাকে একটু স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। কিন্তু তারপরও একটু হাসি হাসি ভাব থেকে যায়।
-না
শাহেদের কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তাই শুধু -না বলেই শেষ। নীলুকে দেখে মনে হচ্ছে তার কথা এখনও শেষ হয়নি। সবে শুরু করেছে। পা নাচানো বন্ধ করে বলল,
-কি নিয়ে অভিমান হয়েছে জানতে পারি?
-অভিমান হয়নি, সহজ সরল বিচ্ছেদ, সিম্পল ডিভোর্স।
শাহেদ অনেকটা ঘোরের মধ্যে কথাগুলো বলে। নীলু ঘোরটা ধরতে পারে না। সে বলতে থাকে,
-ডিভোর্সের কারণটা কি আমি?
-হ্যাঁ
নীলু আবার হাসে এবার কিছুটা শব্দ করে হাসে সে।
-আমার অপরাধ?
-কোন অপরাধ নেই, ড্রয়ারে তোর জন্য একটা চিঠি আছে।
নীলু চোখ কুঁচকে টেবিলের দিকে তাকায়। হঠাৎ চিঠির কথা শুনে হাসি মুছে যায় তার। কেমন যেন চিন্তিত লাগে নীলুকে। নীলু শাহেদের দিকে না তাকিয়েই বিড় বিড় করে বলে, -তারমানে পাখী সত্যিই ফিনিশ্, উড়গ্যায়া–। গুণগুণ করে একটা সূর ধরে নীলু। তার প্রিয় একটা হিন্দী গানের সূর। সূরটা তীক্ষ্ম হয়ে শাহেদের মাথায় গিয়ে ঢুকছে। ফিতের মত সূরটা কেমন যেন প্যাঁচাতে থাকে মাথায়। শাহেদ বুঝল, অবস্থা ভাল না। গা কাঁপিয়ে জ্বর আসতে যাচ্ছে। মাথায় পানি দিতে পারলে ভাল হত। কোল্ড চিকিৎসা। টে¤পারেচার নিচের দিকে নামাতে হবে। মাথার উত্তাপ গিয়ে পৌঁছবে পানিতে। পানি হবে গরম। চা বানাতে হলে গরম পানির প্রয়োজন। আর কি কি প্রয়োজন? চা পাতা, দুধ আর চিনি নাকি লবন? নীলু তাকে একবার লবন দিয়ে চা বানিয়ে দিয়েছিল। এবং রাগ দেখিয়ে শাহেদ পুরো চা টা একচুমুকে সাবাড় করে। সেই মুহুর্ত গুলোর কিছু ভাসা ভাসা ছবিও তার মাথায় ভাসতে থাকে। চোখ বন্ধ করে অন্যকিছু ভাবার চেষ্টা করে শাহেদ। ভাবতে ভাবতে একসময় স্বপ্ন দেখে সে।
স্বপ্নে শিপু হাসি হাসি মুখ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
-কেমন আছ তুমি?
-দেখছনা অসুস্থ! গায়ে হাত দিয়ে দেখ, ভীষণ জ্বর!
শিপু হাসে কিন্তু কপালে হাত দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসেনা। দুর থেকেই বলে,
-কেন! নীলুকে বল জ্বর দেখে দিতে!
-নীলু কে?
-কেন! নীলু তোমার বৌ।
স্বপ্নে শাহেদ খুব দুঃখী দুঃখী ভাব নিয়ে শিপুর দিকে তাকায়। তার মনে হয় নীলুকেই বলতে হবে, নীলু তার বৌ। এরপর শিপু হাসি হাসি মুখ নিয়ে আস্তে আস্তে দুরে সরে যায়। শাহেদ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শিপুর যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকে।
-প্রিয় নীলু,
কি ভাবছ? প্রিয় বলেছি কেন? তুমি আসলেই আমার খুব প্রিয়। কেন প্রিয় তা বলতে পারবনা, তবে প্রিয়। আগেই বলে রাখি, আমি চিঠি লিখেছি খুব কম। একদম ছোট থাকতে বাবার কাছে দুয়েকটা লিখেছিলাম। এরপর চিঠি লেখার আর কাউকে খুঁজে পাইনি। অনেকদিন পর আবার তোমাকে লিখছি। তুমি কি ভাবছ বলব? তুমি ভাবছ, নতুন করে আবার কি ঝামেলা বাধাতে চাচ্ছে মেয়েটা! (ভাবনাটা সত্যি না ভাবার জন্য ভাবা)।
আচ্ছা, শাহেদ কি খুব রাগ করে আছে? তার রাগ কিন্তু ধরা যায় না। একবার হলকি! সে আমার ওপর ভীষণ রাগ করে আছে, অথচ হাসি হাসি মুখে আমাকে বলল, কেমন আছ? আমি না বুঝেই বললাম, খারাপ আছি! আর তাতেই উনি অভিমান করে বসেন। টানা তিনদিন কথা বলেনি আমার সাথে। আমাদের সম্পর্কটা একটু অদ্ভুত ধরনেরই ছিল। যাহ্ কি সব ছাই পাশ দিয়ে চিঠি ভরিয়ে ফেললাম। এবার আসল কথায় আসা যাক্।
আসল কথাঃ
আমরা দুজন দুজনকে অদ্ভুত রকমের ভালবাসি। কিন্তু অদ্ভুত ভালবাসার সমাপ্তিতে বিয়ে হওয়াটা বেমানান। আমরা ভুল করে একটা বেমানান কাজ করে ফেলেছি। অদ্ভুত ভালবাসার মিথ্যে আনন্দ। কেমন যেন কবিতার মত হয়ে গেল কথাগুলো। তুমি কবিতা খুব পছন্দ কর তাই না? আমি তেমন একটা পছন্দ করিনা। মনে হয় অল্প কথায় অনেক কিছু শেষ করে ফেলেছে। কবিদেরকে আমার অলস টাইপের লেখক মনে হয়, হিঃ হিঃ—
যা বলছিলাম, শাহেদ একটা ঘোরের মধ্যে বাস করছে। সে ঠিক বুঝতে পারছে না সে ঠিক কাকে ভালবাসে, আমাকে নাকি তোমাকে, আমি জানি সে তোমাকেই ভালবাসে। প্রচণ্ড রকম ভালবাসে। একটা উদাহরন দিচ্ছি।
মরুভুমির উটের প্রিয় খাবার হল খেজুর পাতা। মুখ রক্তাক্ত হয়ে যায়, এরপরও থামাথামি নেই, খেয়েই যায়! কিন্তু শাহেদ তো উট নয়! সে কেন শুধু শুধু নিজেকে এভাবে কষ্ট দিবে? তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে। আমি কি বলতে চাইছি তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ (অবশ্য আমি কতটুকু বোঝাতে পেরেছি জানিনা)।
আর কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে না। আর শোন, তোমার বৃষ্টি রুমটা অসাধারণ। আমারও ভীষণ ইচ্ছে ঐ রকম একটা বৃষ্টি রুম বানানো। কিন্তু ছাদ ভেঙ্গে ফেলে টিন বসানোটাই একটু সমস্যা। মাঝে মাঝে তোমার রুমে গিয়ে বৃষ্টি শুনে আসবো, ঠিক আছে?।
ওহ্ সরি! তোমাকে শুভেচ্ছা জানানো হয়নি।
তোমাকে অনেক অনেক বৃষ্টিময় শুভেচ্ছা।
ইতি
শিপু
নীলুর কেমন যেন হাসি পায়। হাসিটা পেটের মধ্যে ছটফট্ করছে, কিন্তু বেরুনোর পথ খুঁজে পাচ্ছে না। পুরো চিঠিটা একটা কৌতুকের মত মনে হচ্ছে তার কাছে। শিপুর হাতের লেখা কেমন যেন বাচ্চা মেয়েদের মত। নীলু ঠিক বুঝতে পারছে না চিঠির কোন যায়গায় হাসি আছে। তার মাথায় শুধু শাহেদের বিশেষ একটা ছবি ভাসছে। চার পাওয়ালা শাহেদ। জাবর কেটে কেটে খেজুর পাতা খাচ্ছে। কিছুক্ষণ ফিক্ ফিক্ করে হাসে নীলু।
-কি রে হাসছিস্ কেন?
আরিফা নীলুর পাশে শুয়েছিল। ঘুমিয়ে পড়ার ভান করে এতক্ষণ পুরো চিঠিটাই পড়ে ফেলেছে সে। তার মোটেও হাসি পাচ্ছে না। চিঠি পড়ে কেন জানি তার ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল। মন খারাপ হয়ে যাওয়া মানে এখন একের পর এক বকবক করে যাবে সে। নীলুর ঘুমের বারোটা বাজাবে। নীলু চিঠিটা ভাঁজ করে বালিশের নিচে গুঁজে রাখে। তার চোখে এখনও হাসি লেগে আছে। ড্রয়ারে শুধু চিঠি নয় একটা আংটিও পেয়েছে সে। দামী আংটি হবে, আলো পড়তেই চিক্চিক্ করে উঠে। হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে আবার ড্রয়ারেই রেখে দেয় সেটা।
-কি রে তুই ঘুমাসনি?
আরিফা একটা নকল হাই তোলে। নীলুর একটা হাত অলস ভাবে ধরে বলে,
-ভাবী খুব ভাল, তাই না?
-এখন আর ভাবী নেই, ভাবী ফুটুস্ হয়ে গেছে।
-আমার মনে হয় চলে আসবে আবার।
নীলু আরিফার দিকে তীক্ষ্ম চোখে তাকায়। আরিফা চোখ বন্ধ করে আছে। নীলুর তীক্ষ্ম চোখ দেখল না সে।
-আসবেনা।
-না আসলেই ভাল আরিফা হাসতে হাসতে বলে।
নীলুর ইচ্ছে হল কড়া কোন কথা বলে আরিফাকে চুপ করিয়ে দিতে।
-কথা বলিস্না ঘুমা!
-ঘুম আসছে না।
-চোখ বন্ধ করে ভেড়া গুনতে থাক, ঘুম এসে যাবে।
আরিফা চোখ বন্ধ করে রহস্যময় হাসি দেয়। তাকে দেখে মনে হচ্ছে অনেক কিছু বুঝে ফেলেছে সে। নীলু জোর করে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর ভান করে। তা না হলে আরিফা একের পর এক কথা বলেই যাবে। নীলুর এখন কারো কথা শুনতে ইচ্ছে করছে না। চুপ করে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে।
**
অর্নবের দিকে আড়চোখে অবাক হয়ে তাকায় শিপু। মানুষ কারণে অকারণে এত হাসতে পারে তার জানা ছিল না। অর্নবকে দেখে মনে হচ্ছে চব্বিশ ঘণ্টায় বার ঘণ্টাই সে হাসে। এত হাসির রহস্যটা কি! জিজ্ঞেস করে দেখবে কিনা ভাবছে শিপু।
-নিন্ আইস্ক্রীম খান্।
অর্নবের নিজের হাতে একটা আইস্ক্রীম, অন্য হাতটা শিপুর দিকে বাড়ানো। বিকেলে তারা একসাথে ঘুরতে বেরিয়েছিল। প্রস্তাবটা শিপুই দেয় প্রথমে। একা ঘরে বসে দমবন্ধ লাগছিল তার। ভাবল, একটু ঘুরে আসা যাক। অর্নবকে কোন কারণ ছাড়াই বলে বসে সে, -ঘুরতে যাবেন?
অর্নব দ্রুত শার্ট প্যান্ট পাল্টে তৈরি হয়ে যায়। কাপড়ের ব্যাপারে যথেষ্ট উদাসীন সে। কেন না শার্টের একপাশে সামান্য ছিঁড়ে থাকলেও সে খুব সহজ ভঙ্গীতে শিপুর সাথে বেরিয়ে পড়ে। সাথে করে ক্যামেরা আনতে চাইলে শিপু রিতীমত ধমকে উঠে তাকে, খবরদার ক্যামেরা নিয়ে যেতে পারবেন না! অর্নব হাসি হাসি মুখে বলে, -ওকে, রেখে যাচ্ছি।
প্রায় আধঘণ্টা পাশাপাশি হাঁটার পরও তেমন একটা কথা হয়নি তাদের মধ্যে। অর্নবের সব কথাতেই হুঁ, হ্যাঁ বলে পাশ কাটিয়ে যায় শিপু। অর্নবকে দেখে মনে হচ্ছে না সে তাতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। সে নতুন উদ্যমে তার কথা শুরু করে।
-আচ্ছা, মজার একটা কথা শুনবেন?
-না শুনবনা, আমার মজার কথা শুনতে ইচ্ছে করেনা। আপনি দুঃখের কথা বলুন।
অর্নব হো হো করে হাসতে থাকে।
-আর শুনুন সারাক্ষণ অমন করে হাবেন না। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি আমাকে দেখানোর জন্য হাসছেন। সত্যি হাসিনা, দেখানো হাসি।
-আপনাকে দেখিয়ে হাসব কেন?
-আমাকে পটানোর জন্য, আপনি জানেন না আপনার সাথে আমার বিয়ে হবে?
বলেই হি হি করে হাসে শিপু। অর্নব গভীর আগ্রহের সাথে একটা কৃষক্সচুড়ার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন শিপুর কথা শুনতে পারছে না সে।
-গাছের দিকে তাকিয়ে কি খুঁজছেন?
-আপনার দিকে তাকালে আপনি ভাববেন আপনাকে পটাতে চাচ্ছি, তাই গাছ দেখছি, গাছকে পটাতে কোন দোষ নেই।
শিপু বাচ্চা মেয়ের মত খিল খিল করে হেসে উঠে।
-আপনার হাসি কিন্তু খুব সুন্দর।
-হাসির আবার সুন্দর অসুন্দর কি! সব হাসিই সুন্দর।
-আচ্ছা সব কান্না কি দুঃখের?
-কে জানে!
অর্নব তীক্ষ্ম চোখে এখনও কৃষক্সচুড়ার দিকে তাকিয়ে আছে। গভীর মনযোগ দিয়ে কৃষক্সচুড়ার ফুল দেখার রহস্য শিপু ধরতে পারল না। অর্নব বলল,
-দুর থেকে কৃষক্সচুড়ার ফুল কেমন লাগে জানেন? মনে হয় যেন গাছে আগুণ লেগে গেছে। লাল আগুণ!
-গাছে লাল আগুণ দেখার কোন শখ নেই আমার! আর অত স্পেশাল চোখও আমার নেই। আপনি হলেন ফটোগ্রাফার, আপনার দেখার আছে দেখে নিন্।
-আচ্ছা, একটা কথা বলি?
অর্নব আগ্রহী চোখে শিপুর দিকে তাকায়। এমন চোখকে অগ্রাহ্য করা কঠিন।
-বলুন।
-আপনি কোন কারণে আমাকে সহ্য করতে পারছেন না, ঠিক বলেছি?
শিপু হাসি হাসি চোখে কৃষক্সচুড়ার দিকে তাকায়। তার মনে হচ্ছে অর্নব মিথ্যে বলেনি। গাছে সত্যি সত্যি আগুণ ধরে গেছে। ফায়ার সার্ভিস কে খবর দেওয়ার মত আগুণ। লাল আগুণের দিকে তাকিয়ে শিপু বলে,
-এমন মনে হওয়ার কোন কারণ তো আমি দেখছিনা! আমার মন ভাল নেই।
অর্নব আবার রহস্যময় ভাবে হাসে। মন কেন ভাল নেই তাও জিজ্ঞেস করছে না। শিপুই আবার বলে,
-শুনুন আমি আপনাকে খুব সিরিয়াস একটা কথা বলতে যাচ্ছি, আপনি শুনছেনতো?
-সিরিয়াস কথায় বোধহয় মন দিতে পারবনা। আমার মন পড়ে আছে ক্যামেরাটার মধ্যে। আপনার কথা শোনাটা বোকামী হয়ে গেছে। গাছটার একটা ছবি তুলতে পারলে বেশ হত।
শিপুর ভাবান্তর হল না। সে তার সিরিয়াস কথা বলে ফেলল,
-শুনুন, মা বোধহয় আপনাকে মিথ্যে বলেছে, আমার আরেকজনের সাথে বিয়ে হয়েছিল।
-হয়েছিল বলছেন কেন?
অর্নব আগের মতই করুণ চোখে কৃষক্সচুড়ার দিকে তাকিয়ে আছে। ছবি তুলতে না পারার কষ্টে তার হাসি হাসি মুখ দুঃখী দুঃখী মুখ হয়ে গেছে।
-হয়েছিল মানে হয়েছিল, এখন আর নেই, কাট্টাকাট্টি হয়ে গেছে।
-ওহ্।
অর্নবকে দেখে ভীষণ মজা লাগছে শিপুর। বেচারা হঠাৎ করেই ধাক্কাটা খেল। অর্নবের দিকে তাকাতে একটু মায়াও হয় তার।
শিপুর দিকে সরাসরি তাকাতে পারছে না অর্নব। কেমন যেন অস্বস্তি বোধ হয়। অর্নব মোটেও ধাক্কা খায়নি। বরং তার কেমন যেন লজ্জা লজ্জা করতে লাগল। অনেকটা লজ্জা ঢাকার জন্যই সে বলে,
-গাছেরা গান খুব ভালবাসে, জানেনতো? তাদের প্রিয় গান হল রবীন্দ্রসঙ্গীত।
-আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, এই মাত্র গাছেরা এসে আপনাকে তথ্যটা বলে গেছে। কি বলেছে?
অর্নব একটু শুক্নো গলায় হাসে। হাসির কথা শুনে জোর করে হাসার মত। অর্নবের হাসি শেষ না হতেই বলা নেই কওয়া নেই বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়া শুরু হল। অর্নব হা করে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। যেন এই প্রথম বৃষ্টি দেখছে সে।
-কি হল আপনার! বৃষ্টি দেখে ভয় পেয়েছেন মনে হচ্ছে।
অর্নব তড়িঘড়ি করে মুখে একটু হাসি হাসি ভাব আনার চেষ্টা করে।
-না না ভয় পাব কেন? বৃষ্টি খুব ভাল লাগে আমার। বৃষ্টির পর গাছের সত্যিকার রং ফুটে উঠে।
-এত গাছ গাছ করছেন কেন?
অর্নব মাথা নিচু করে হাসে। যেন শিপু তার গোপন একটা কিছু জেনে ফেলেছে। শিপুও কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে যায়। একজন মানুষের প্রকৃতি প্রেম থাকতেই পারে। সেটা অস্বাভাবিক কিছুনা। তাই বলে এভাবে লজ্জা দেওয়াটা ঠিক হয়নি তার।
-এবার বোধহয় চলে যেতে হবে।
অর্নব দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু শিপুর মধ্যে যাওয়ার কোন লক্ষ্মন নেই। সে এরই মধ্যে একটা বৃষ্টির গান শুরু করে দিয়েছে। অর্নব দ্বিধায় পড়ে গেল। আবার বসে পড়বে কিনা ভাবছে। বসলে মারাত্মক ধরনের লজ্জা পেতে হবে তাকে। শিপু ভাববে, সে শিপুকে ছেড়ে যেতে চাচ্ছে না।
-কি ব্যাপার! চলে যাচ্ছেন নাকি?
অর্নব হাত তুলে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বলে,
-নাহ্ একটু রিলাক্স করে নিচ্ছি। অনেক্ষণ বসে থাকায় পায়ে ঝিঁ ঝিঁ ধরে গেছে।
শিপুর সূক্ষ্ম হাসি খেয়াল করে না অর্নব।
-বসে পড়ুন সামান্য বৃষ্টিতে ভিজলে আপনার নিওমোনিয়া হবে না। নাকি আমার সাথে বৃষ্টিতে ভিজতে লজ্জা পাচ্ছেন!
অর্নব দেরি না করে বসে পড়ে। বৃষ্টি আরেকটু বাড়তেই শিপু গেয়ে উঠে,
-গগনে ঘনঘটা শিহরে তরুলতা
ময়ূর ময়ূরী নাচিছে হরসে
**
মাথায় ঠান্ডা পানির ছোঁয়া লাগতেই চোখ মেলে তাকায় শাহেদ।
-কে? শিপু?
-আমি নীলু।
-কি ব্যাপার! ক্লাশে যাস্নি তুই! কে বলেছে মাথায় পানি দিতে!
-কেউ বলেনি, এমনি এমনি দিচ্ছি। আর এখন রাত দশটা বাজে। রাত দশটায় আমার ক্লাশ নেই।
শাহেদ চোখ বন্ধ করে ভাবতে চেষ্টা করে। সফিকের বাসা থেকে বেরুনোর সময় বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিল সে। শুধু এটুকুই ঠিকমত মনে আছে তার। সফিকের বাসায় কেন গিয়েছিল তাও মনে পড়ছে না। সফিকের কথা মনে আসতেই তার মনে হল সফিকের ডেঞ্জারাস কিছু হয়েছে, ক্যান্সার ফ্যান্সার টাইপের কিছু।
-চোখ বন্ধ করে ঘুমাও, ঘুম না আসলে ভেড়া গুনতে থাক।
শাহেদ বাধ্য ছেলের মত কথা শোনার চেষ্টা করে। শুধু ভেড়া গুনতেই একটু সমস্যা হচ্ছে তার।
ভেড়ার যায়গায় সে মানুষ গুনতে শুরু করে দিয়েছে। রাস্তার একগাদা মানুষের মধ্যে দাঁড়িয়ে গুণছে। একই মানুষ দুবারও গুনে ফেলছে সে। ভুল হলে আবার প্রথম থেকে গোনা শুরু করতে হচ্ছে।
এরই মধ্যে রাস্তায় রহিমুল্লাহ সাহেবকেও দেখতে পেল শাহেদ। চাচা রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছেন। তাকে দেখেই মুখ ভর্তি ধোঁয়া ছাড়লেন তিনি। ধোঁয়ার সাথে তার কথাও শুনতে পেল শাহেদ।
-হারামজাদা! তুই আমাকে গুণছিস্না কেন? আমি কি মানুষ না!
শাহেদ বিনীত ভাবে বলে, -ভুল হয়ে গেছে চাচা।
শাহেদ রহিমুল্লাহ সাহেবকে এক ধরে গুনতে শুরু করে। তার মানে আবার প্রথম থেকে গুনতে হবে তাকে। ভীড়ের মধ্যে একটা পরিচিত মুখও মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছে। শাহেদ মুখটি দেখেই চিনতে পারল। তার বাবা রমিজউল্লাহ সাহেবের মুখ। তিনি শাহেদকে দেখেই লজ্জিত ভাবে হাসলেন। দুর থেকেও শাহেদ তার বাবার কণ্ঠ শুনতে পেল,
-কি রে ব্যাটা! ক্ষিদা লাগছে? খাবি?
-জ্বী না বাবা, ক্ষিদা লাগে নাই।
-না লাগলেও খা, ধর– খা-
রমিজউল্লাহ সাহেব শুন্য হাত বাড়িয়ে ধরেন শাহেদের দিকে। শাহেদ শান্ত চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে। বাবাকেও গুণবে কিনা ভাবছে সে। বাবাতো বেঁচে নেই। মৃত মানুষকে গোনাটা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছে না। আশপাশের সবাই শাহেদের দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে আছে। গুণ গুণ করে সবাই বলছে,
-আমাকে এখনও গোনা হয় নাই কিন্তু! আমাকে এখনও গুণিস্নাই তুই!
কিছুক্ষণ চোখ পিটপিট করে তাকাল শাহেদ। সে কোথায় আছে বুঝতে পারছে না। চারদিকে শুধু সাদা আর সাদা। হঠাৎ এত সাদা রং এলো কোত্থেকে? তার স্পষ্ট মনে আছে তাদের বাড়িটা গাড় নীল রংয়ের। না না হাল্কা সবুজ হবে হয়ত। বাড়ির রংটা ঠিকমত মনে পড়ছে না। শুধু মনে পড়ছে ঘুমানোর সময় বাবাকে দেখতে পেয়েছিল সে। মাকে কখনও স্বপ্নে দেখেনা শাহেদ। অনেক চেষ্টা করেও দেখতে পারে না। বারবার শুধু বাবাকেই দেখে। ভয়ংকর সব স্বপ্ন। স্বপ্নে মাঝে মাঝে বাবাকে কাপড় বিহীন অবস্থাতেই দেখে সে। বাবা পাগল অবস্থাতেই মারা যান। আর পাগলের কথা মনে হলেই কাপড় বিহীন একটা মানুষের ছবি ভেসে উঠে তার মাথায়। চোখ খুলতে ইচ্ছে হচ্ছে না তার। থাক্ যেখানে খুশি সেখানে থাকুক সে, তাতে কিছু যায় আসেনা।
-কে শিপু নাকি? কখন এসেছ?
-আমি নীলু
নীলুর চোখ কুঁচকে যায়। কেমন অসভ্যের মত শুধু শিপু শিপু করছে। চোখ না খুলেই ডাকাডাকি!
-এটা কোন যায়গা?
-এটা হাসপাতাল। রাতে একশ চার ডিগ্রি ক্রস করেছ তুমি। ডাক্তারদের চোখ ছানাবড়া করে দিয়েছ। তোমার বেঁচে যাওয়াটা নাকি একটা মিরাকল ঘটনা।
-কয়টা বাজে?
রুমের মধ্যে হাল্কা একটা আলো আছে। খুব দামী একটা কেবিনে শুয়ে আছে শাহেদ। এতটাকা পেলেন কোথায় চাচা! শাহেদ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকনোর চেষ্টা করে।
-বলতো দেখি কয়টা বাজে?
শাহেদের মনে হচ্ছে এখানে সময় বলতে কিছু নেই। একটা সময় হলেই হল। তবু চোখ বন্ধ করে বলে,
-রাত দশটা।
নীলু হি হি করে হেসে উঠে।
-তুমি কি ভেবেছ রাত দশটায় আমি তোমার পাশে এভাবে একা একা বসে থাকব? মাত্র সন্ধ্যে হয়েছে। তুমি ঝাড়া বিশ ঘণ্টা ঘুমিয়েছ। ঘুমিয়েছ বললে ভুল হবে, বিশ ঘণ্টা অজ্ঞান ছিলে তুমি। এখন আমার দায়িত্ব হল আধঘণ্টা পরপর তোমাকে একটু দেখে যাওয়া।
-আমি এখানে এলাম কি ভাবে?
নীলু আবার চোখ কুঁচকে তাকায়। কি অদ্ভুত প্রশ্ন!
-তুমি হাওয়ায় ভেসে আসনি! রীতিমত হুলুস্থুল কান্ড ঘটিয়ে এসেছ! রাত বারোটায় পাশের বাড়িতে গিয়ে ফোন করে এ্যাম্বুলেন্স আনাতে হয়েছে। এখন ঐ সব কাহিনী থাক্। তুমি কি একটু কষ্ট করে উঠবে?
নীলু ইচ্ছে করলেই শাহেদের ঘাড়ে হাত দিয়ে তাকে উঠাতে পারে, কিন্তু সে তা করবেনা। শাহেদকেই উঠতে হবে।
-মাথাটার ওজন যেন বিশ কেজি হয়ে গেছে, উঠব কি করে!
নীলু এসে তার মাথার পেছনে হাত রাখে। হাত রাখতেই ধীরে ধীরে উঠে পড়ে শাহেদ। নীলুকে কষ্ট করতে হয়নি। শাহেদ নিজে থেকেই উঠে পড়ে।
-ধর, অষুধটা খেয়ে নাও।
-অষুধ খাওয়ার মত কিছু হয়ে গেছে নাকি?
-হ্যাঁ হয়ে গেছে, তোমার নিওমোনিয়া প্লাস হেপাটাইটিস বি, টু ইন ওয়ান।
-ভালইতো ঝামেলা বাধালাম! দে অষুধ দে।
আরিফা এতক্ষণ উঁকি দিয়ে দেখছিল। ভেতরে ঢুকবে কিনা ভাবছে। শাহেদের সাথে চোখাচোখি হতেই একগাল হেসে ভেতরে ঢুকে পড়ে।
-বেঁচে আছ তুমি? আমিতো ভেবেছিলাম মরে টরে গেছ।
আরিফা শাড়ি পরে এসেছে। বার বার শাড়ির এদিক ওদিক টেনেটুনে ঠিক করে নিচ্ছে। শাহেদের মনে হচ্ছে যেন তার সামনে নীলু দুটো হয়ে গেছে। একটা বড় নীলু আর একটা ছোট নীলু। তার মানে মাথা এখনও ঠিক মত কাজ করছে না। ছোট নীলুর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে একটা হাসি দেয় শাহেদ।
-বোধহয় আজই শেষ, কাল পর্যন্ত বেঁচে নাও থাকতে পারি। এক কাজ র্ক, আমার মাপ নিয়ে যা, কবর খুঁড়তে হবে। মাপ কম বেশি হলে সমস্যা। পরে দেখা যাবে মরার পরও উঠে দাঁড়াব আবার।
নীলু গম্ভীর ভাবে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে। আরিফা খিল খিল করে হেসেই যাচ্ছে।
-তুমি একটা মিঃ বিন শাহেদ ভাই! তুমি মরলেও সবাই হাসাহাসি করবে! সবাই বলবে, শাহেদ মুখ অমন হা করে রেখেছে কেন? হি হি হি।
নীলুও ফিক্ করে একটু হাসে।
শাহেদ চোখ মেলে তাকাতেই জেবুন্নেছা বেগমকে দেখে। চাচী গুণগুণ করে কি যেন পড়ছেন। একটু আগেই নীলু এসেছিল। শাড়ি পরা আরিফাও এসেছিল। তাদেরকে কি স্বপ্নে দেখেছে কিনা বুঝতে পারছে না সে। তার মুখ কেমন যেন তেতো হয়ে আছে, স্বপ্নে নিশ্চয়ই সে অষুধ খায়নি।
জেবুন্নেছা বেগম গুণগুণ করে সূরা ইয়াছিন পড়ছিলেন। শাহেদ কিছুটা দ্বিধায় পড়ে গেল, সে কি মরে গেছে নাকি! শুনেছে মৃতের মাথার কাছে বসে সূরা ইয়াছিন পড়তে হয়। কিন্তু চাচী পায়ের কাছে বসে পড়ছেন। তারমানে এখনও বেঁচে আছে সে। চাচী মাঝে মাঝে কপালে এসে ফুঁ দিয়ে যাচ্ছেন। ফুঁয়ের সাথে তার মুখ থেকে জর্দার গন্ধ প্রকট ভাবে শাহেদের নাকে ঢুকে যাচ্ছে। তার মানে কিছুটা চেতনা এখনও আছে। তা না হলে জর্দার গন্ধকে জর্দার গন্ধের মত লাগতনা। পারফিউমের ঘ্রানের মত লাগত।
শাহেদকে চোখ খুলতে দেখেই জেবুন্নেছা বেগম এগিয়ে আসেন। এবার মাথার কাছেই বসেন তিনি।
-কি রে বাবা কিছু খাবি?
শাহেদ চারপাশে মৃদু গুঞ্জন শুনতে পায়। সেকি ভীন গ্রহের স্পেশশীপে শুয়ে আছে নাকি? মাঝে মাঝে আরিফার খিল খিল হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে।
**
বৃষ্টির মধ্যে হাফ প্যান্ট পরা একটা বাচ্চা ছেলে। বয়স নয় কি দশ হবে। প্যান্টের পেছনে দুটো কদম ফুল গুঁজে রেখেছে। এক হাত দিয়ে প্যান্টটাকে উপরে তোলার চেষ্টা করছে, আর অন্য হাত সামনে বাড়িয়ে বৃষ্টির পানি ধরছে। ছবিটাকে অসম্ভব জীবন্ত মনে হচ্ছে শিপুর। ছেলেটার চেহারায় অস্বাভাবিক একধরনের কোমলতা আছে। খালি গায়ে থাকার কারণে কোমলতা আরও তীব্র ভাবে ফুটে উঠেছে। অসাধারণ এই ছবিটা অর্নবের তোলা। শিপু আড়চোখে একবার অর্নবকে দেখে। নাহ্ তার মুখে অতটা বিজয়ীর হাসি নেই। ছবি তোলার ছিল তুলে ফেলেছে এমন ভাব ধরে অর্নব সামান্য একটু হাসে। শিপু বিষ¥য় প্রকাশ করতে পারে না। অধিক বিষ¥য়ে তার চোখ কুঁচকে যায়। এবারও তার চোখ কুঁচকে যায়, যেন ছবিতে কোন খুঁত ধরে ফেলেছে সে। বিষ¥য় প্রকাশ না করার আরেকটা হাল্কা ধরনের কারণও আছে। সন্ধ্যায় মায়ের সাথে মৃদু ঝগড়া হয় তার। ঘরে ঢুকতেই রাহেলা বেগম হাসি হাসি মুখ করে বললেন,
-শিপু একটু শুনে যাতো।
-আসছি মা, কাপড়টা পাল্টে আসি।
শিপু হাল্কা আকাশী রংয়ের শাড়িটা পরে আসে।
-কি বলবে তাড়াতাড়ি বল।
-কেন? এত তাড়া কিসের?
-আমার শরীর খারাপ লাগছে শুয়ে পড়ব।
-কিছু হয়নিতো তোর?
-কিছু মানে? বুঝিয়ে বল, আমি অস্পষ্ট কথা বুঝিনা।
-এরকম পট্পট্ করবিনা! বলতে চাইছি, কিছু করে বসিস্নিতো আবার!
শিপু হা করে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার কানে মনে হচ্ছে আগুণ লেগে গেছে। কিছুক্ষনের মধ্যে গলে গলে পড়ে যাবে। বিষ¥য় ঢাকতে পারছে না শিপু।
-এসব কি বলছ তুমি মা!
-কি বলছি তা স্পষ্টই বুঝতে পারছিস্! ভং ধরবিনা, ভং আমার একদম পছন্দ না!]
শিপু আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার গলা ধরে আসছে। কথা ঠিকমত বেরুতে চাচ্ছে না। কোনরকম নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
-আমি যাচ্ছি মা।
-যাবি তো অবশ্যই, তোকেতো আমি জেরা করতে বসিনি! আমিতো উকিল নই!
-তুমি কি এটাই বলতে ডেকেছ?
-অর্নব ছেলেটা ভাল, খুব ভাল ছেলে। আমি ঠিক করেছি ওর সাথেই তোর বিয়ে দেব! বিয়ের পর ওর সাথে চলে যাবি।
-আচ্ছা।
-আচ্ছা মানে?
-আচ্ছা মানে আচ্ছা, মাতৃআজ্ঞা শিরোধার্য।
-তুই কি আমাকে ইনসাল্ট করার চেষ্টা করছিস্? শোন আমার কথার কোন নড়চড় হবেনা। আর সরাসরি বলে দেই, উল্টাপাল্টা কিছু হলে এখুনি বল, তোকে হাসপাতালে নিয়ে যাব।
-উল্টাপাল্টা কিছু হয়নি মা।
শিপু আর দাঁড়াতে পারছে না। পায়ের ওপর বিশ্বাস রাখাটা কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যেকোন মুহুর্তে পড়ে যেতে পারে; এমন মনে হচ্ছে। একছুটে নিজের রুমে চলে যায় শিপু। দরজা বন্ধ করতেই চোখ ফেটে পানি গড়িয়ে পড়ে তার।
ঠক্ ঠক্ শব্দ করতেই অর্নবের গলা শুনতে পেল শিপু।
-ভেতরে আসুন।
দুটো কফির মগ নিয়ে ভেতরে ঢোকে শিপু। কফি দেখে অর্নবের চোখ চক্চক্ করে উঠে। -নিন্ কফি খান্, আর ভাববেন না আপনার সাথে খোশগল্প করতে এসেছি। আমি এসেছি আপনার তোলা ছবি দেখতে।
কয়েকটা ছবি দেখার পর একটা ছবি দেখে থমকে যায় শিপু। অদ্ভুত সুন্দর একটা ছবি। বার বার দেখতে ইচ্ছে করে।
-আপনার পছন্দ হয়েছে?
শিপু ওপর নিচ মাথা নাড়ে, যার অর্থ হল পছন্দ হয়েছে। অর্নব আবার বলে,
-কফি কি আরেক কাপ পেতে পারি?
শিপু হেসে আরেকটা ছবির জন্য হাত বাড়ায়। ছবি দেখেই চমকে উঠে শিপু। তারই ছবি সেটা। ভোর বেলা কফির মগ হাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল সে। কফি খেতে খেতে হঠাৎ চোখ কুঁচকে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। আর তখুনি পেছন হতে অর্নব ছবিটা তোলে। ছবিতে তাকে অসাধারণ লাগছে। ক্যামেরা হাতে অর্নবকে আশপাশে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছিল সে। একফাঁকে ছবিটা তুলে ফেলে। শিপু মেজাজ গরম করার চেষ্টা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়। ছবিতে তাকে সত্যিই সুন্দর লাগছে। শাহেদ দেখলে বলত, নীল জলকন্যা। সে নীল জলকন্যা ছাড়া আর কিছু জানেনা। সামান্য অন্যমনস্ক হয়ে যায় শিপু। শাহেদের চিন্তা এখনও পুরোপুরি আউট করতে পারছে না সে।
-আপনি কি রাগ করেছেন?
-ছবিটাকি আমি আমার কাছে রাখতে পারি?
-জ্বি, আপনাকে দেওয়ার জন্যেই ছবিটা তুলেছি। এক্ষেত্রে আমাকে একজন ফটোগ্রাফার না ভেবে জাষ্ট একজন ক্যামেরাম্যান ভাবুন।
শিপু শব্দ করেই হেসে উঠে। রাহেলা বেগমের ডাক শুনে তার হাসি মাঝ পথেই থেমে যায়।
-শিপু, এদিকে আয় তো মা।
শিপু একটু ভাবনায় পড়ে যায়। তাকে এভাবে -মা বলে আদর করে ডাকার মানে কি?
-কি মা?
-এক গ্লাস পানি দেতো, বুকের ব্যাথাটা আরেকটু বেড়েছে মনে হচ্ছে।
শিপু ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানির বোতল নিয়ে আসে।
-অতটা ঠান্ডা খেতে পারবনা, একটু মিশিয়ে দিস্।
-ধর মা, পানি বেশি ঠান্ডা হয়নি।
-বোস্ তুই, কথা আছে।
শিপু বসবে কিনা ভাবছে। রাহেলা বেগম কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে আছেন। কম্বল গায়ে দেওয়ায় তাঁকে আরো বেশি বয়স্কা মনে হচ্ছে। শিপু বিছানার একপাশে বসে।
-পা তুলে আরাম করে বোস্।
-পা তুলতে হবেনা, তুমি কি বলবে বলে ফেল, আমার ঘুম পাচ্ছে।
-তুই আমার সাথে এমন করে কথা বলছিস্ কেন? আমি কি দাসী বাঁদী?
-তুমি দাসী বাঁদি নও মা, আর আমিও উল্টাপাল্টা কিছু বলছিনা, উল্টাপাল্টা কথা বলেছ তুমি!
-আমিই উল্টাপাল্টা কথা বলি! তাই না? তুই যা খুশি তা করবি! আর আমি কিছুই বলতে পারবনা! কিছু বললেই উল্টাপাল্টা কথা!
-মা তোমার বুকের ব্যাথা বেড়ে যাবে। এখন থাক্ এসব, পরে বলো।
-পরে আবার কি? এখন হবে কথা! ফয়সালা এখন করব আমি! তার আগে তুই বল, কোথায় ছিলি এতদিন?
শিপুু বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। মৎস্যকন্যা ফুলদানীর দিকে তাকিয়ে বলে,
-আমরা বিয়ে করে ফেলেছিলাম।
-তাহলে এসেছিস্ কেন? তোর ইয়ের কাছে যা! এখানে দরকার কি ছিল!
শিপু কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। কি বলবে গুছিয়ে নিচ্ছে মনে মনে।
-দেখ মা, শুধু বাজে কথা বল না। আমাদের বিয়ে হয়েছিল এবং ডিভোর্সও হয়েছে, এটা অত সিরিয়াস কিছুনা।
রাহেলা বেগমকে দেখে মনে হচ্ছে একসাথে অনেক গুলো কথা তাঁর গলায় এসে জমে গেছে। কোনটা আগে বেরুবে সেটা এখনও ঠিক হচ্ছে না। অবশেষে একটা কথা বের হল,
-তারমানে তুই সপ্তাহে সপ্তাহে বিয়ে করবি! দুদিন ফূর্তি করে আবার আমার কাঁধে এসে চড়বি!
-আমি আর বিয়ে করছি না মা। আমার বিয়ের চিন্তা তুমি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল।
রাহেলা বেগম ভয়াবহ রাগে কথা বলতে পারলেন না। চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলেন। ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছেন তিনি। বুকের ব্যাথা আরেকটু বেড়ে গেছে।
-আমি কি চলে যাব মা?
-যাহ্! তুই যেখানে খুশি সেখানে যা! আমার সামনে আসতে পারবিনা!
নিঃশব্দে নিজের রুমে চলে যায় সে। রুমে ঢুকতেই হাল্কা একটা পিয়ানোর সূর শুনতে পায় সে। তারমানে ফোন এসেছে। ঘড়ি দেখল রাত এগারটা বাজে। এতরাতে আবার ফোন করল কে? রাতের বেলা ফোনের রিং পাল্টে যায়। রাহেলা বেগম কড়া রিং সহ্য করতে পারেন না। তাই স্পেশাল সেট নিয়ে আসা হয়েছে সিঙ্গাপুর থেকে। সিঙ্গাপুরে শিপুর মামা থাকেন। হয়তো মামার ফোন। ফোন ধরতে ইচ্ছে হচ্ছে না তার। মা-ই ধরুক।
**
দরজা খুলতেই ঝাড়া পাঁচ সেকেন্ড হা করে তাকিয়ে থাকে সফিক। দরজার ওপাশে এক অপ্সরী দাঁড়িয়ে আছে। অপ্সরী তাকে দেখে মিটি মিটি হাসছেও। রাত দশটায় তার কাছে একটা অপ্সরী চলে আসবে, এটা তার বিশেষ কল্পনা গুলোরও বাইরে ছিল। অপ্সরী সুন্দর কোন পারফিউম দিয়েছে। পারফিউমের গন্ধে সফিক বুঝতে পারে, এটা স্বপ্ন দৃশ্য নয়, বাস্তব দৃশ্য। স্বপ্ন দৃশ্য হলে সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতনা। উড়ে এসে দরজা খুলে দিত। খুঁড়িয়ে হাঁটার জন্য সামান্য ব্যাথাও পেয়েছে সে। অপ্সরী হল নীলু। নীলুই দরজায় নক করে।
-কি হল, অমন ছ্যাবলার মত কি দেখছেন?
-ভেতরে এস।
ভেতরে এস বললেও দরজা ছেড়ে দাঁড়াতে ভুলে গেছে সফিক।
-বসতে আসিনি, আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি। শাহেদ ভাইয়ের অবস্থা খুব খারাপ। এখন তখন অবস্থা।
সফিক কিছুক্ষণ এদিক সেদিক কি যেন দেখে। যেভাবে ছিল সেভাবেই বেরিয়ে পড়ে।
-কি হয়েছে?
-একগাদা অসুখ ধরা পড়েছে, কে জানে নাও বাঁচতে পারে।
নীলু হেসে হেসে খুব সিরিয়াস ধরনের কথা বলে ফেলে। সফিক তা খেয়াল করেনা। তার কাছে মনে হচ্ছে স্বপ্নে মাঝে মাঝে ঘ্রান পাওয়া আশ্চর্যের কিছুনা। আর পায়ের ব্যাথাও চলে গেছে মনে হচ্ছে।
হাসপাতালে কেবিনের আশপাশে যেন কোন অনুষ্ঠান হচ্ছে। সবাই এসে হাজির। খবর পেয়ে শাহেদের দুঃসম্পর্কের এক খালা এসে হাজির হয়েছেন। খালার নাম ফিরোজা বেগম। তাঁর হাতে সবসময় একটা পানের কৌটা থাকবেই। আরিফা তাই নাম দিয়েছে -পান খালা।
রহিমুল্লাহ সাহেব জেবুন্নেছা বেগমের সাথে শাহী মেজাজে ঝগড়া শুরু করে দিয়েছেন। মাঝে মাঝে আড়ালে গিয়ে সিগারেটে দুয়েকটা টানও দিয়ে আসছেন।
-তুমি এমন প্যান প্যান করে কথা বলবেনাত! ভদ্র ¯টাইলে কথা বল।
জেবুন্নেছা বেগমেরও ঝগড়া তুঙ্গে উঠেছে।
-তুমি আমাকে ¯টাইল শেখাতে এস না! তুমি ভেবেছ কি? চুরি করে গাঁজা খাবে, আর আমি টের পাব না!
রহিমুল্লাহ সাহেব কিছু বলার আগেই শাহেদের খালু এসে বাধা দেয়।
-আহা! দুলাভাই করছেন কি! এটা হাসপাতাল। তাছাড়া শাহেদের অবস্থাও সুবিধের নয়।
শাহেদের কথা আসতেই তাঁরা দুজন চুপসে যান। রহিমুল্লাহ সাহেব তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে কয়েকবার এদিক ওদিক তাকালেন। হাতে একটা সিগারেট নিয়ে ঘুরছেন তিনি। কিন্তু দিয়াশলাই খুঁজে পাচ্ছেন না। তাঁর ইচ্ছে হল স্ত্রীর কাছে দিয়াশলাই চাইবেন। উচিৎ শিক্ষা হবে তাহলে।
-নীলুকে দেখছিনা যে, নীলু কই?
জেবুন্নেছা বেগম বিড় বিড় করে বললেন, -মেয়ে ভেগেছে, রাস্তার চ্যাংড়ার সাথে ভেগেছে!।
আরিফা ফিক্ করে হেসে উঠে। রহিমুল্লাহ সাহেবের মেজাজ সপ্তমে চড়ে যায়। তার সাথে ইয়ার্কি করা হচ্ছে। দিয়াশলাই না থাকায় প্রচণ্ড আফসোস হচ্ছে তাঁর। ইচ্ছে করছে সিগারেটে টান দিয়ে স্ত্রীর সামনে একগাল ধোঁয়া ছাড়তে।
ফিরোজা বেগম গুটুর গুটুর করে শাহেদের সাথে গল্প করছেন। গল্পের ফাঁকে ফাঁকে থু করে পানের ফিকও ফেলছেন। ডাক্তার আর নার্স চোখ কুঁচকে পানের পিকের দিকে তাকান। কিন্তু ফিরোজা বেগমকে কিছু বলার সাহস হচ্ছে না তাদের। নার্সকে কাছেও ঘেঁসতে দিচ্ছেন না তিনি। নার্স কাছে আসলেই বিড় বিড় করে বলেন,
-ডাঙ্গর মাইয়া রাত বিরাতে অসপিটালে কি করস্! দেশের অবস্থা বালানা! সাইজ অইয়া যাবি!
নার্স পড়িমড়ি করে পালায়। শাহেদ আর ফিরোজা বেগম কুটকুট করে হাসে।
-খালা তুমি দেখি মহা অসভ্য!।
-আরে ঐ সব তুই বুঝবিনা! আইজকালকার মাইয়া বড়ই ডেঞ্জারাস! পিচ্কিরে দেখ্! বিয়ার বয়স অইয়া গেচে, এহনও ঢেং ঢেং কইরা ঘুরে!
পিচকি মেয়ে হল আরিফা। সে একবার শাহেদের কাছে আসছে আরেকবার মা বাবার ঝগড়া দেখার জন্য ছুটে চলে যাচ্ছে।
-মেয়েতো এখনও পিচকী, তাহলে বিয়ের কথা বলছ কেন?।
-কি কস্ তুই! আমার বিয়া অইছিল দশ বছরে। সে এক বিরাট হি¯টরী, হুন্! শাহেদ গভীর মনযোগ দিয়ে ফিরোজা বেগমের হিষ্টত্থী শুনতে থাকে।
হিষ্টত্থীর একফাঁকে ফিরোজা বেগম পানের পিক ফেলে বলেন,
-হুনলাম তুই নাকি বিবাহ করছিলি? মেয়ে নাকি পলাইছে!
-ঠিক শুনেছ খালা, তবে মেয়ে পলায়নি, মেয়ে বিদায় নিয়ে গেছে। যাকে বলে গুড বাই।
-গুড বাই টুড বাই বুজিনা, মাইয়ার লাইন নাম্বার ক, লইয়া আহি।
-লাইন নাম্বার মনে পড়ছে না খালা, আমার মনে হচ্ছে আমি সব ভুলে যাচ্ছি। মৃত্যুর পূর্বলক্ষণ।
-আরে ধুর! আমি কত বাড়ি ছাইড়া ভাগছি! তোর খালুজান পই পই কইরা খুঁজতাছে, আর আমি সোন্দর কইরা পান চাবাইয়া যাই। যত্ত পারে খুঁজুক। পরে অনেক মানাইয়া লইয়া আনে।
-ওকে বোধহয় মানিয়ে আনা যাবেনা খালা, কঠিন মেয়ে।
-চুপ র– হারামজাদা, মাইয়া অইল মাইয়া! চেংড়ির অন্তরে একখান ঘা দিলেই কারবার ফিনিশ! আমি ফিরু ছাড়া কাম অইবনা। হেইডা আমি আগেই বুঝছি।
-অন্তরে ঘা কিভাবে দেব! তার অন্তর অনেক গভীরে! আমি খুঁজে পাইনা।
-সাহিত্য মারবিনা! সাহিত্যে কাম অইবনা! তুই আমারে ঠিহানাটা দে, চেংড়ির চুলের মুঠ্ঠি ধইরা লইয়া আমু!
শাহেদ হো হো করে হাসতে থাকে। ফিরু খালা শিপুর চুলের মুঠি ধরে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসছে, এমন দৃশ্য কল্পনা করেই হেসে ফেলে শাহেদ। অনেক্ষণ পর একটু প্রান খুলে হাসে সে।
ঝাড়া দুই মিনিট রিং হওয়ার পর ফোন ধরল। কণ্ঠ শুনে নীলু বুঝল বয়স্ক কোন মহিলা ধরেছেন।
-হ্যালো
-জ্বী আপনি আমাকে চিনবেন না, আমি—-
-না চিনলে ফোন করেছেন কেন? তাও এত রাতে!
নীলু হঠাৎ কথা হারিয়ে ফেলে। অনেক কষ্টে ফোন নাম্বার জোগাড় করেছে সে। শাহেদের পুরনো একটা ডায়রী ঘেঁটে। শিপুর সাথে কথা বলাটা ভীষণ দরকার।
-জ্বী, আমি কি শিপুর সাথে কথা বলতে পারি?
-শিপু ঘুমাচ্ছে।
-ওকে বলুন নীলু ফোন করেছে, ওকে ভীষণ দরকার, প্লীজ!
-তোমার পাশে কে আছে? ছেলের কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছি। আমাকে বোকা ভেবনা মেয়ে! শিপুকে, তোমার কোন প্রয়োজন নেই! প্রয়োজন আছে তোমার পাশের ছেলের! কি ঠিক বলিনি!
-জ্বী না আপনি ঠিক বলেননি! আমি হাসপাতাল থেকে ফোন করছি।
-ওহ্ তাই নাকি! এতরাতে শিপুকে দরকার! তাও আবার হাসপাতাল থেকে! শোন মেয়ে, আমি কচি খুকী নই! আমি দুদু খাইনা! ঐ সব চ্যাংড়ামী আমার সাথে চলবেনা!
নীলু খট্ করে রিসিভার রেখে দেয়। বাইরে শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছে। ভয়াবহ ঝড়ের পূর্বলক্ষ্মণ। যেকোন মুুহুর্তে আকাশ কাঁপিয়ে ঝড় আসবে। টেলিফোনের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে আছে সে। মনে মনে টেলিফোনের আবিস্কারককে গালি দিল সে, -ব্যাটা ফাজিলের হাড্ডি! এই যন্ত্রনা কেন বানাতে গেলি!।
সফিক কিছুক্ষণ পরপরই নীলুর আশপাশে এসে ঘোরাঘুরি করছে। নীলুর সরু চোখ এবার সফিকের দিকে নিবদ্ধ।
-কি ব্যাপার ভ্যাগাবন্ডের মত ঘুরছেন কেন? কিছু বলবেন?
সফিক অন্যমনস্ক হয়ে বাইরের দিকে তাকায়। সিগারেট খেতে না পারায় তার মাথা ঠিকমত কাজ করছে না। এত রাতে সিগারেটও পাওয়া যাবেনা। তাছাড়া হাসপাতালে খেতে পারবেনা কিনা তারও ঠিক নেই।
-কি? সিগারেট নেই? ধরুন!
সফিককে অবাক করে দিয়ে স¤পুর্ন নতুন একটা প্যাকেট তার দিকে বাড়িয়ে ধরে নীলু। তার সরু চোখ এখনও স্বাভাবিক হচ্ছে না।
-আমি সিগারেট খাইনা।
বলেই সফিক মহা অস্বস্তিতে পড়ল। নীলুর সাথে মিথ্যে বলায় তার সামান্য অনুশোচনাও হচ্ছে।
-তাহলে থাক রেখে দেই!
-তুমি সিগারেট খাও নাকি!
-জ্বী খাই মাঝে মাঝে। খুব মন খারাপ থাকলে তখন খাই। এখনও খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। বাবা মার কারণে খেতে পারছি না। আপনি খেলে আমার একটু সুবিধে হত। আপনার কাছ থেকে নিয়ে দুয়েক টান দেওয়া যেত।
নীলু গম্ভীর ভাবেই কথা গুলো বলে। তার মনে এখনও ফোন সংক্রান্ত অস্বস্তিটা রয়ে গেছে। শিপুর সাথে কথা বলা দরকার। শাহেদ তাকে চিনতে পারছে না। সে এগিয়ে গেলেই বলে, কে? শিপু নাকি?। সবার সামনে একগাদা লজ্জায় পড়তে হয় তাকে।
শাহেদ কে ঘিরে সবাই বসে আছে। কিছুক্ষণ পরেই ইমার্জেন্সী ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হবে। এখন অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে। ডাক্তাররা খুব সিরিয়াস ভঙ্গীতে চলাফেরা করছেন। তাদের সিরিয়াস ভাব সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। সফিকের কাজ হল ডাক্তারদের পেছন পেছন ঘোরা।
ডাক্তার সাহেব বিরক্ত মুখে সফিকের দিকে তাকান,
-কি ব্যাপার বিরক্ত করছেন কেন?
-জ্বী ডাক্তার সাহেব ওর কি রক্ত লাগবে? বলছেন না কেন কিছু? আমার সাথে ওর গ্রুপ মিল আছে। যত লাগে আমি দেব।
-দেখুন্ রক্ত লাগবে না ব্যাস্! এখন দয়া করে শান্ত হয়ে বসুন। আপনি নিজেওতো দেখছি অসুস্থ, খুঁড়িয়ে হাঁটছেন।
-রক্ত লাগলেই বলবেন, আমি এখানেই আছি।
**
চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখ কুঁচকে ফেলে শিপু। ঘড়ির টিক্ টিক্ শব্দটা বর্শার মত মাথায় গিয়ে ঢুকছে। একবার ঢুকে গেলে রক্ষে নেই। বাজতেই থাকবে মাথায়। প্রতি সেকেন্ডে একবার করে টিক্ করে উঠবে। উঠে গিয়ে ঘড়িটাকে একটা আছাড় দিলে কেমন হয়? শিপু অনেকটা নিশ্চিত যে আছাড় খেয়েও একনাগাড়ে টিক্ টিক্ করে যাবে ঘড়িটা।
শিপু উঠে দাঁড়াল। রাত প্রায় সাড়ে এগারটা বাজে। ফ্রিজ থেকে কনকনে ঠান্ডা একগ্লাস পানি খেয়ে ফেলল সে। নির্ঘাৎ গলায় ঠান্ডা লেগে যাবে। এরপর শুরু হবে ম্যারাথন কাশি। লাগুক্ ঠান্ডা। পানি খেতে ইচ্ছে করছে খাবে। ঠান্ডায় কিছু এসে যায় না তার।
একপাশের জানালা খুলে দিতেই কাছে কোথাও বীকট শব্দে বাজ পড়ল। শিপু খানিকটা চমকে উঠে। সে বুঝতে পারছে না সে কি কোন কারণে অস্থির হয়ে আছে? আবার শুয়ে পড়বে কিনা ভাবছে। দেওয়াল ঘড়িটা অনেক উঁচুতে লাগানো। তা না হলে ঘড়ির ব্যাটারী খুলে ফেলা যেত। শিপু বুঝতে পারছে শুয়ে পড়লে ঘড়িটা আবার টিক্ টিক্ করা শুরু করবে। ভয়ংকর শব্দ। টিক্ টিক্ টিক্ টিক্। লাইট জ্বালিয়ে দেয় শিপু। আয়নায় নিজেকে অনেক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। আগের চেয়ে নিজেকে অনেক সুন্দরি মনে হচ্ছে। শুধু চোখের নিচে সামান্য একটু কালি ছাড়া। চিরুনী দিয়ে অনেক সময় নিয়ে চুল আঁচড়ায় শিপু। চোখে কাজল দিতে ইচ্ছে হচ্ছে তার। খানিকটা হাল্কা রংয়ের লিপ¯িটকও লাগায়। একটু আগেও তার ভয়াবহ ঘুম পাচ্ছিল। এখন সে উঠে সাজতে শুরু করে দিয়েছে। শিপু স্পষ্টই বুঝতে পারছে তার অবচেতন মনই এসব ঘটাচ্ছে। অবচেতন মনের কাছে সে সহজে হারেনা। আজ হঠাৎ ব্যাতিক্রম হল। ব্যাগ থেকে সবুজ কলাপাতা রংয়ের একটা শাড়িও পড়ে ফেলে। শাড়ির সাথে মিলিয়ে খয়েরী রংয়ের টিপ। অবচেতন মনের উদ্দেশ্যটা ঠিক বুঝতে পারছে না সে। তবে তা যে কোন ভয়ংকর কোন সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে তা স্পষ্টই বুঝতে পারছে শিপু। হঠাৎ করে একজনকে ভীষণ চমকে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে তার।
রহিমুল্লাহ সাহেব সিগারেট খেতে গিয়ে বমি করে ফেললেন। একেবারে নাড়ি ভুড়ি বের হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা। তাঁকে ধরে কাঠের বেঞ্চিতে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে। কথা বলতে গিয়ে দেখলেন গলা দিয়ে স্বর বেরুচ্ছে না। পাখির মত চিঁ চিঁ করছেন শুধু। চিঁ চিঁ করেই বললেন,
-হে মাবুদ তুমি আমাকে নিয়া যাও, কিন্তু ছেলেটাকে ভালোয় ভালোয় সারিয়ে দাও।
জেবুন্নেছা বেগম ধমক দিয়ে উঠলেন,
-এসব অলক্ষুনে কথা বলবেনা! তুমি বেঁচে গেলে ছেলেটা মরে যাবে নাকি!
রহিমুল্লাহসাহেব শূন্য দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকালেন। তিনি শুনেছেন মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছলে নাকি মৃত আত্মীয় সজনদের দেখা পাওয়া যায়। তিনি তাঁর বাবা ইয়াজউদ্দীন সাহেবকে খুঁজছেন বোধহয়।
-মা নীলু, নীলু কোথায়?
-নীলু বারান্দায় আছে, তাকে কি দরকার?
-হারামজাদী বৃষ্টির মধ্যে বারান্দায় কি করছে! জ্বর টর একটা কিছু বাঁধাবে!
-তাকে নিয়ে তোমার অত ভাবতে হবেনা! তুমি ঘুমাও।
-নাহ্ সব ভাবনা তুমিই ভাব! তুমিই লাটবাহাদুরের কন্যা!
-দেখ অদ্ভুত কথা বলবেনা!
-আমি অদ্ভুত কথা বলছিনা! সলিড কথা বলছি, ইউ আর এ ডটার অফ লাট বাহাদুর!
-আপনি কি! আপনি হচ্ছেন জমিদার পুত্র! জমিদার পুত্রের জন্য চাল না কিনে মন খানেক সিগারেট কেনা উচিৎ!
জেবুন্নেছা বেগম ভীষণ রেগে তুমি থেকে আপনিতে উঠে গেছেন। তারমানে ঝগড়া আবার প্রান ফিরে পেয়েছে। আরিফা মায়ের পাশেই বসে ছিল। অবস্থা বেগতিক দেখে উঠে চলে যায় সে। ফিরোজা খালার কাছে যেতে ইচ্ছে করছে না তার। খালা অসভ্য সব কথা বলেন। কাছে গেলেই শুধু বুকে হাত দিতে চান। হাত দিয়ে মুখ নেড়ে নেড়ে বলবেন, -মাইয়া ডাঙ্গর অইছে!। আর ভয়াবহ বিশ্রী জর্দার গন্ধতো আছেই। ওয়াক্ থু! আরিফা মুখ বাঁকিয়ে ফেলে। যদিও মনে মনে ফিরু খালাকে ভীষণ পছন্দ করে ফেলেছে সে। কিন্তু তার মতে ভীষণ পছন্দ করলে কাউকে তা জানাতে হয় না। খুব বড় ধরনের ফিলসফি। নিজেকে দার্শনিক ভাবতে খুব পছন্দ করে সে। বারান্দায় উঁকি দিয়ে দেখল আপু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছে। সে জানে আপু এখন কাঁদছে। আপু কেন কাঁদছে তাও জানে আরিফা। খুব সিক্রেট একটা কারণে কাঁদছে আপু। সিক্রেট ব্যাপার জেনে ফেলার আনন্দে তার মুখ কিছুটা চক্চক্ করছে। একটু দুরে সফিক দাঁড়িয়ে আছে। তার কাজ হল সার্বক্ষনিক আপডেটেড তথ্য সরবরাহ। প্রতি মিনিটে শাহেদের অবস্থা দেখে আসা। আরিফা তাকে একটা নাম দিয়ে দেয়। তার নতুন নাম হল ওয়ান লেগ পিওন। খুঁড়িয়ে হাঁটার কারণেই ওয়ান লেগ।
সফিক আড়চোখে একবার করে নীলুর দিকে তাকায়। নীলুকে কাঁদতে দেখে তার ইচ্ছে হল পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। কিছুটা শান্তনা দেওয়ার জন্য। কিন্তু ইচ্ছে হওয়াটাই এখন আনন্দের বিষয়। ইচ্ছে পুরনে এমন আনন্দ হয়তো পাওয়া যাবেনা। থাক্ কাঁদুক! একা একাই কাঁদুক। তার নিজেরও বার কয়েক চোখ ভিজে উঠেছিল। কেউ দেখলে মারাত্মক লজ্জার ব্যাপার হবে। খুব কৌশল করে চোখ মুছে সে। বিদ্যুৎ চমকের সাথে সাথে চারদিক অস্বাভাবিক রকম ফর্সা হয়ে যায়। নীলুর ফর্সা মুখে আলো পড়লে মনে হয় মুখটি জ্বলছে। জ্বলন্ত একটা অপ্সরীর মত মনে হয় সফিকের কাছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পরবর্তী বিদ্যুৎ চমকের অপেক্ষা করে সফিক।
**
টক্ টক্ টক্। খুব মৃদু ভাবে তিনবার টোকা দেয় শিপু। যেন ওপাশের মানুষের ঘুম না ভাঙ্গে এমন ভাবে টোকা দেওয়া। অর্নব জেগে ছিল কিনা বোঝা গেল না, তবে চতুর্থ বার টোকা দেওয়ার আগেই দরজা খুলে দেয় সে। শিপুর দিকে কিছুক্ষণ বোকা বোকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অর্নব। এতরাতে সাজগোজ করা অসাধারণ এক সুন্দরি মেয়েকে দেখে তার মাথা কিছুক্ষণ কাজ বন্ধ করে দেয়।
-আপনি এত রাতে!
শিপু দুষ্টুমি টাইপের হাসি দেয়। অর্নব আরেকটু চমকে যায়। হাল্কা আলোয় শিপুর হাসিকে কেমন যেন রহস্যময় হাসি মনে হয় তার কাছে। -ভেতরে আসুন বলবে কিনা ভাবছে অর্নব। তার আগেই শিপু বলে,
-কি! খুব চমকে গেছেন! তাই না? তার আগে বলুন আমাকে কেমন দেখাচ্ছে?
অর্নব কিছুটা হাসার চেষ্টা করে। কিন্তু তার সেই বিখ্যাত হাসি এখন বেরুতে চাইছে না।
-সুন্দর
-শুধু সুন্দর?
-সুন্দর সুন্দরই শুধু বা কম সুন্দর বলতে কিছু নেই।
কথাটা কেমন যেন পরিচিত মনে হল শিপুর। শাহেদ বোধহয় কথাটা বলতো।
-আপনি ঝট্পট্ তৈরি হয়ে নিন্! এখুনি বেরুতে হবে আমাদেরকে।
-ভেতরে আসুন।
শিপু ভেতরে ঢোকে। অর্নবের ঘুম পুরোপুরি চলে গেছে। সে এখনও বোধহয় তার বিষ¥য় কাটাতে পারছে না।
-এভাবে তাকাচ্ছেন কেন! আমি কোন খারাপ মেয়ে নই যে এত রাতে বদ উদ্দেশ্য নিয়ে আপনার কাছে এসেছি। কি? আমি খারাপ মেয়ে?
অর্নব এদিক ওদিক -না সূচক মাথা নাড়ে। শিপু আবার মিটি মিটি হাসে। হাসতে হাসতে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায় শিপু।
-জিজ্ঞেস করবেন না, কোথায় যাচ্ছি! তাও এত রাতে!
বারান্দা থেকে জিজ্ঞেস করল শিপু।
-আপনি খারাপ মেয়ে নন্, তাহলে ভাল কোন যায়গাতেই যাব মনে হচ্ছে। আমি ভাবছি ক্যামেরাটা নিয়ে যাব কিনা।
অর্নব খুব দ্রুত অনেক কিছু বুঝে ফেলেছে। শিপু কোথায় যাচ্ছে তা সে স্পষ্টই বুঝতে পারছে। কিন্তু শিপুকে তা জানাতে চাচ্ছে না।
অর্নবের কথা শুনে মৃদু হাসে শিপু। নাহ্ যতটা বোকা ভেবেছিল সে অর্নব সেরকম বোকা মোটেও নয়। বরং ভীষণ বুদ্ধিমান ছেলে মনে হচ্ছে তাকে। বোকা হলে এতক্ষনে হুলুস্থুল কান্ড ঘটিয়ে ফেলতো। অর্নবকে হঠাৎ ভীষণ ভাল লাগে শিপুর। খুব ভাল একটা বন্ধু হতে পারে অর্নব।
-আই এম রেডি!
-গাড়িটা ঠিক আছেতো?
-এভরি থিং ইজ ঠু মাচ ওকে!
-আমার ঠু মাচ ওকের দরকার নেই, শুধু মাঝপথে এসে চাকা পাংচার না হলেই হল।
যেন খুব মজার কোন কৌতুক বলা হয়েছে এই মাত্র। এমন ভাবে খিলখিল করে হাসতে থাকে দুজন।
**
বারান্দায় গ্রীলের সাথে অনেকটা জোর করে মুখ চেপে ধরেছে নীলু। মুখে গ্রীলের দাগ পড়ে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। বাতাসের ঝাপটার সাথে বৃষ্টির পানি এসে পড়ছে তার মুখে। সেদিকে আপাতত তার খেয়াল নেই। সে একদৃষ্টে বাইরে তাকিয়ে আছে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে তাকিয়ে দেখার মত কিছু থাকার কথা নয়। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকের অস্বাভাবিক রকমের উজ্জ¦ল আলো দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ করে উজ্জ¦ল আলো পড়ায় রাস্তাটাকে কেমন যেন ভৌতিক মনে হচ্ছে। তবে নীলু ভয় পাচ্ছে না। কেন না কান্না পেলে মানুষের ভয় অনেকটাই কমে যায়। নীলু কাঁদছে। বৃষ্টির পানি আর চোখের পানির রংয়ে তেমন একটা পার্থক্য নেই। নীলুর চোখের পানিও তাই ধরা যাচ্ছে না। বৃষ্টির সাথে ধুয়ে গাল বেয়ে পড়ে যাচ্ছে।
বিদ্যুৎ চমকাতেই কালো সেডান গাড়িটাকে দেখতে পায় নীলু। হাসপাতালের সামনে এসে থামে। সামনের দরজা খুলে লাল টি শার্ট গায়ে দেওয়া একটা ছেলেকে নামতে দেখে সে। ছেলের মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুল। নীলুর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে একটা হাসিও দিল সে। চোখে পানি থাকার কারণে চোখ কুঁচকাতে পারল না নীলু।
কোঁকড়া-চুলো ছেলেটার পেছনে গাড়ি থেকে একটা শাড়ি পরা মেয়েও নামে। মেয়ের চেহারা ঠিকমত বোঝা যাচ্ছে না। চেহারা বোঝা যেতে হলে আরেকটা বিদ্যুৎ চমকের অপেক্ষা করতে হবে। নীলু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। বিদ্যুৎ চমকাতেই মেয়েটার চেহারা দেখতে পায় নীলু। সাদা আলোয় শিপুর ফর্সা মুখ কিছুটা জ্বলজ্বল করে উঠে। নীলুর মনে হল সে অবাক হওয়ার গুণটা হারিয়ে ফেলেছে। শিপু তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। এই মুহুর্তে নীলুরও কিছুটা হাসা উচিৎ। কিন্তু উল্টো আরো বেশি করে কান্না পাচ্ছে তার। এবারো বৃষ্টির পানির কারণে তার চোখের পানি ধরা গেল না।
রহিমুল্লাহ সাহেব অনেক্ষণ তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাঁর মেয়েকে দেখলেন। মেয়ের গায়ে বৃষ্টি পড়ছে দেখে তাঁর বলতে ইচ্ছে হল, -বৃষ্টি থেকে সরে আয়! ঠান্ডা লাগবে! কিন্তু মেয়ের চোখে পানি দেখে তিনি তা বলতে পারলেন না। তার মনে হয় এই মেয়ে বড়ই অদ্ভুত! সময় অসময় নেই, কান্নাকাটি শুরু করে দেয়! একবার ভাবলেন কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করবেন, -ব্যাপারটা কি?। তিনি নিজেও জানেন ব্যাপার আসলে কিছুইনা। শুধু শুধু জিজ্ঞেস করার কি দরকার! মেয়ের দিকে তাকিয়ে তাঁর হঠাৎ মনে হল তিনি প্রচণ্ড ভালবাসতে জানেন। প্রচণ্ড ভালবাসার হঠাৎ এই আবিস্কারে তাঁর চোখ কিছুটা কুঁচকে যায়। তিনি চোখ কুঁচকে বৃষ্টি দেখতে লাগলেন। নাহ্ বৃষ্টিকে এখন আর অত মন্দ লাগছে না। বিড় বিড় করে বললেন, -পায়ে কাদা লাগাটা দোষের কিছুনা! পা তো আর পঁচে যাবেনা!
-চেংড়ি ফিরা আইছে, অহন সি¯েটম অইবো
ফিরু খালার পান খাওয়ার ¯টাইল দেখে মনে হল তিনি অমৃত খাচ্ছেন। মাঝে মাঝে হাসপাতালের দেওয়ালে অমৃতের পিক্ও ফেলছেন।
-সবকিছুরতো আর সি¯েটম হয় না খালা! কথাটা বলে আরিফা আড়চোখে সফিকের দিকে তাকায়।
সফিক চোখ কুঁচকে বারান্দার দিকে তাকিয়ে আছে। সে জানে নীলু এখনও বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাঁদছে। যেতে ইচ্ছে করলেও যেতে পারছে না সফিক। নীলুকে একা থাকতে দেখতেই তার ভাল লাগছে।
দরজার ফাঁক দিয়ে জেবুন্নেছা বেগম শাহেদ আর শিপুকে দেখছেন। তিনি বুঝতে পারছেন কাজটা ঠিক হচ্ছে না। তবু কৌতুহল সামলানো খুবই কঠিন একটা কাজ। তিনি কঠিন কাজে ব্যর্থ হয়েছেন। তবে তাঁর চেহারায় ব্যার্থতার কোন ছাপ নেই। বরং কিছুটা সফলতার ছাপ পড়েছে। তাঁর মনে হচ্ছে তিনি একটা কিছু পেয়ে গেছেন। কিন্তু কি পেয়েছেন তা নিয়ে অতটা চিন্তিত নন তিনি।
-কে? শিপু?
-হুঁ
-কেমন আছ?
-খারাপ আছি
শাহেদ অস্পষ্ট ভাবে একটু হাসে।
নীলুর হঠাৎ করে তার -তুমি গাছটার কথা মনে পড়ে। কিছুদিন আগে -তুমি গাছে দুটো কলি দেখেছিল সে। এতদিনে নিশ্চয়ই ফুল হয়ে গেছে সেগুলি। এই মুহুর্তে তার কিছু একটা উৎসর্গ করতে ইচ্ছে করছে। মনে মনে ফুলগুলোকে সে বিশেষ দুজনের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে দেয়। বৃষ্টির মাত্রা আরেকটু বেড়ে গেছে। কিন্তু তাতে তার কোন ভাবান্তর হয় না। সে গ্রিলে মুখ চেপে ধরে চোখে বৃষ্টির পানি লাগানোর চেষ্টা করছে। আপাতত কাঁদার কোন ইচ্ছে নেই তার। কিন্তু ভয়ংকর আনন্দে তার চোখ বারবার ভিজে যাচ্ছে। বৃষ্টির পানি দিয়ে সে কান্না ভেজা চোখকে বৃষ্টি ভেজা চোখ করার চেষ্টা করছে।
অর্নব বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছিল। নীলুকে দেখে হঠাৎ করে থমকে দাঁড়ায়। গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে একটা মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বৃষ্টি দেখছে। তার চোখের পানি আর বৃষ্টির পানি এক হয়ে মিশে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। ক্যামেরা না নিয়ে আসায় অর্নব প্রচণ্ড রকম হতাশ হয়। এরকম দৃশ্য সবসময় দেখা যায় না। বাইরে দাঁড়িয়ে নীলুর সরাসরি একটা ছবি তুলতে পারলে অসাধারণ হত। অর্নব নীলুর দিকে খানিকটা এগিয়ে আসে। নীলুকে দেখে মনে হচ্ছে সে বৃষ্টিটা তার নিজের মত করে উপভোগ করছে। তার হঠাৎ মনে হল পুরো পৃথিবীতেই এখন বৃষ্টি হচ্ছে এবং তা একান্তই নীলুর বৃষ্টি। আজ এই বৃষ্টি শুধুই তার। ছবিটা তুলতে পারলে ছবির নাম দেওয়া যেত -তাহার বৃষ্টি।