পৌরুষ বলতে আমরা কী বুঝি, সেটা ভাববার সময় এসেছে। পৃথিবী বদলে যাচ্ছে। এ অবস্থায় আমার মনে হয় যে পৌরুষের প্রমাণ বৈষম্য নয় বরং সমতার দিক থেকে আশা উচিত। আসল পুরুষ এবং পরিপূর্ণ মানুষ সে-ই হতে পারবে, যে নারীর প্রতি তার প্রাপ্য সম্মান দিতে পারবে। মানবজাতির অগ্রযাত্রায় নারী-পুরুষের অবস্থান নিয়ে ভেদাভেদ করবে না। সমতা এবং সম-অধিকারের উপলব্ধি হতে হবে ঘরে-বাইরে, ব্যক্তিগত এবং পেশাগত জীবনে।
নারী-পুরুষের বৈষম্য কমে আসছে এবং অদূরভবিষ্যতে বিলুপ্ত হয়ে যাবে এমন ভাবাটা এখন আর অবাস্তবিক নয়। এমন অবস্থায় আমাদের দৈনন্দিন জীবনে লিঙ্গবৈষম্যের কোনো কারণ আমি খুঁজে পাই না। অথচ আর্থসামাজিক বৈষম্য যতই কমছে ব্যক্তিগত এবং সামাজিক আচরণে বৈষম্য তো কমছেই না, বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেড়ে চলেছে। এর একটা কারণ হতে পারে যে অর্থনৈতিক আধিপত্য হারানোর কারণে পুরুষদের মধ্যে একধরনের হীনম্মন্যতা তৈরি হচ্ছে, এবং সেই হীনম্মন্যতা কাটানোর জন্য তারা ব্যক্তিগত জীবনে নারীদের ওপর আরও বেশি চড়াও হচ্ছে। আরেকটা কারণ হতে পারে ঐতিহাসিক অভ্যস্ততা। অনেক দিন ধরে বৈষম্য দ্বারা অভ্যস্ত হওয়াতে পুরুষ সমাজ হয়তো সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। পাশাপাশি সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ফ্যাক্টর তো আছেই। এখনো আমাদের নাটক, সিনেমা, গানে আমরা প্রতিদিন লিঙ্গবৈষম্য খুঁজে পাই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্য আরও উৎসাহিত করা হয়। বিশ্বের অন্যতম উন্নত দেশের প্রেসিডেন্ট যখন কথায় কথায় নারীদের ছোট করে এবং তাঁদের নিয়ে অশালীন কথা বলেন, তখন বুঝতে হবে যে ব্যক্তিগত পর্যায়ে বৈষম্য কাটানোর বিষয়ে আমরা অনেকটাই পিছিয়ে আছি। এ ক্ষেত্রে আমাদের করণীয় কী?
লিঙ্গবৈষম্যের অনেকগুলো কারণ আছে। প্রত্যেকটি কারণ এবং সমাধান এই একটা লেখায় আলোচনা করা সম্ভব নয়। কিন্তু আলোচনা করা জরুরি। এবং আমি বিশ্বাস করি যে আমার চাইতে অনেক বড় বড় মানুষ আছেন, যাঁরা এই আলোচনা করছেন এবং করবেন, সমাধানও বের করবেন। তবে একজন পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকে আমার মনে হয়েছে যে নারীর দৈহিক এবং যৌন পরিচয়ের বাইরে যে আরও পরিচয় আছে, সে ব্যাপারে হয়তো আমাদের নিজেদের আরও শিক্ষিত করতে হবে। এই বিষয়টা যদি আমরা মনেপ্রাণে ধারণ না করতে পারি, তাহলে পুরুষ হিসেবে নারীর সমান মর্যাদা আমরা কখনোই দিতে পারব না। আমি অনেক জায়গায় বলি যে হয়তো বৈষম্য দূরীকরণের ব্যাপারে আমাদের অন্যতম চ্যালেঞ্জ এটাই। একজন পুরুষের ব্যক্তিগত বা পেশাগত চরিত্র নিয়ে যখন সমালোচনা করা হয়, তখন প্রায় কখনোই তার দৈহিক বা যৌন সক্ষমতার কথা উঠে আসে না। কিন্তু লক্ষ করে দেখবেন যে একজন নারীর সমালোচনা শুরুই হয় এসব বিষয় নিয়ে। তার মানে হচ্ছে শরীর এবং যৌনতার বাইরে যে নারীর আরও অনেক বড় পরিচয় আছে সে ব্যাপারটি আমরা সমাজ হিসেবে বিশেষ করে পুরুষ সমাজ হিসেবে মনেপ্রাণে গ্রহণ বা ধারণ করতে পারিনি। এবং এটা যত দিন আমরা না করতে পারব, তত দিন বৈষম্য দূর করাটা এক অবাস্তব স্বপ্ন হয়েই থাকবে।
বৈষম্য দূরীকরণের ব্যাপারে সাংস্কৃতিক জগতের বাসিন্দা হিসেবে সেই জগতের ভূমিকা নিয়ে একটু বলতেই হয়। আমাদের সিংহভাগ নাটক-সিনেমায় এখনো নারীদের নেতৃত্বের জায়গা তো দূরের কথা একজন পুরুষের পাশে সমান জায়গাও দিতে পারিনি। হয়তো নারীকে সমানভাবে দেখে আমরা অভ্যস্ত না, সে কারণেই। কিন্তু আগেও বলেছি, বৈষম্যের ঐতিহাসিক অভস্ত্যতা এক দিনে বা নিজে নিজেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে না। সেটাকে দূর করতে আমাদের বিভিন্ন স্তরে এক হয়ে কাজ করতে হবে। বাসায়, আড্ডায় টেলিভিশন এবং সিনেমার পর্দায়। নারী-পুরুষ এখন সভ্যতার অগ্রযাত্রায় সহযাত্রী। যত দ্রুত আমরা একসঙ্গে পা ফেলে এগোতে পারব, তত দ্রুতই আমাদের সভ্য স্বপ্নগুলো সত্য হবে।
লেখক: অভিনয়শিল্পী