ধ্রুব নীলের গল্প
রেনু খুন হওয়ার দেড় মাসের মাথায় খুনিকে ধরেছে রশিদ। খুনি এখন তার সামনে ভারী কাঠের চেয়ারে হাত-পা বাঁধা বন্দি।
‘তুমি আমার একচল্লিশ নম্বর সাবজেক্টের… স্বামী। চিনতে পেরেছি আগেই।’
খুনি বলল। রশিদের স্ত্রী রেনুকে ভয়াবহ যন্ত্রণা দিয়ে সে-ই মেরেছে।
ফ্ল্যাট বাসার ভেতরের একটা রুম। ভেতরে ঝলমলে আলো। দুই লেয়ারের ভারী পর্দায় ঢাকা চারপাশ। রুমটা সাউন্ডপ্রুফ করতেই লাখ তিনেক খরচ করেছে রশিদ। অ্যাকুস্টিক প্লাস্টারবোর্ডের সঙ্গে ফোমও বসিয়েছে। তবে খুনি লোকটা একবারও চেঁচামেচি করেনি।
খুনির নাম জানা নেই। নাম নিয়ে রশিদের আগ্রহ নেই। পত্রিকার দেওয়া নামটা হলো ‘সলটেড কিলার’। ভিকটিমকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করতো। তারপর লবণ বা এ জাতীয় কিছু মেখে দিত। মরার আগ পর্যন্ত চলতো অমানুষিক নির্যাতন। দুয়েকটা ডেডবডিতে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড ও ভিনেগারের ট্রেস পাওয়া গিয়েছিল। যন্ত্রণা দেওয়া নিয়ে পড়াশোনা করেই খুন করতে নেমেছিল লোকটা।
মূলত রেনুর ডেডবডি পাওয়ার পর রশিদ খুনিকে খুঁজতে শুরু করে। রেনুর শরীরজুড়ে ছিল ক্ষতচিহ্ন। এক চোখের মণি ছিল না। সবকটা নখ ওপড়ানো। শরীরে কিছু রাসায়নিকের অস্তিত্ব পাওয়া যায় ময়নাতদন্তে। কাটা দাগগুলো ছিল সার্জিক্যাল ছুরি-কাঁচির। এসব সূত্র ধরে এগিয়েছে রশিদ। এলাকার সুপারশপ ও সার্জিক্যাল দোকানে আসা-যাওয়া করা ক্রেতাদের সিসিটিভির ফুটেজ থেকে শুরু করে দিনের পর দিন পথেঘাটে হন্যে হয়ে তৈরি করেছে সন্দেহভাজনের তালিকা। এরপর বিস্তর আঁকিবুকি আর অঙ্ক কষে বের করেছে সলটেড কিলারের খুনের প্যাটার্ন, খুন করার সময়, লোকটার বয়স কত হতে পারে… এসব।
লোকটাকে ধরে আনার পর রশিদের মনে হলো এখন আর কাজ নেই তার। সামনে থাকা ভারী চেয়ার আর চেয়ারে বাঁধা লোকটা রশিদের কাছে একই বস্তু। কাঠের ফার্নিচারের মতোই এখন সে চাইলে লোকটার দেহের প্রতিটি কোষ ঠুকরে ছেঁচে তুলে নিতে পারে।
খুনির চেহারা আর ঠিকানা জানার পর নিশ্চিত হতে আরও একটা খুনের সাক্ষী হতে হয়েছিল রশিদকে।
ঘটনা গত সপ্তাহের। রাত তিনটা পঁচিশ মিনিটে ফুটপাতে শুয়ে থাকা এক ভিক্ষুকের উরুতে আলগোছে সার্জিক্যাল স্ক্যালপেলের পোঁচ দিয়ে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে ছিল লোকটা। ভিক্ষুকের গগনবিদারী চিৎকারে আশপাশের অনেকে বিরক্ত হলো। ভেবেছিল, ওর ঘা হওয়া পায়ে বুঝি মশা কামড় দিয়েছে। মূলত ভিক্ষুকের যন্ত্রণাটা ছিল তারচেয়েও বহুগুণ বেশি। ভিকটিমের নিঃশ^াস দূরত্বে হা করে তাকিয়ে ছিল খুনি। যেন চোখ দিয়ে গিলছিল ভিক্ষুকের যন্ত্রণা। রশিদ এগিয়ে যায়নি, কারণ তাতে খুনি হাতছাড়া হয়ে যেত।
খুনির চোখেমুখে রাজ্যের তৃপ্তি। রশিদের দিকে তাকাচ্ছে ইন্টারভ্যু বোর্ডে থাকা কর্মকর্তাদের মতো করে। সে কী চায় সেই পরিকল্পনা যেন ঠিক করাই আছে। মুখটাকে বাঁকিয়ে নড়েচড়ে বসে সলটেড কিলার ওরফে খুনি জানান দিতে চাইল, ঠিক এভাবেই সে বন্দি হতে চেয়েছিল। মানে রশিদই মূলত তার পরবর্তী সাবজেক্ট।
‘সামনে এসে বসো। জোরে কথা বলা পছন্দ করি না।’
রশিদ সামনে এসে দাঁড়াল। তার ভেতর মহাশূন্যের মতো একরাশ বিষণ্নতা। লাশের মতো রাজ্যের নির্বিকারত্ব চোখে। খুনি থুথু ফেলল চকচকে টাইলসের মেঝেতে। এরপর মুখ নেড়েচেড়ে আয়েশ করে বলল-
‘ফাইনালি যখন গলা টিপে ধরি… আহা কী তুলতুলে গলা। চোখ দুটো ফুরুৎ করে ইঞ্চিখানেক বেরিয়ে এলো। আমার হাসিই পাচ্ছিল। তবে আমি মোটেও হাসতে চাইনি। আমি চেয়েছিলাম, তার কষ্টে কষ্ট পেতে। ব্যথা পেতে। সেটা আর হলো কই। তেতাল্লিশটা খুনই বৃথা।’
‘কষ্ট?’
‘মানে এই যে কষ্ট পাওয়ার ব্যাপারটা। তোমরা অন্য মানুষরা যে কষ্ট পাও, আমি তা পাই না। তবে আমার রাগ আছে। ছোটবেলায় একবার মুখে একগাদা আইসক্রিম মুখে পুরেও ঠান্ডা লাগার ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম না। শেষে নিজের একটা আঙুল কুড়মুড়িয়ে খেয়ে ফেললাম।
রশিদ চট করে খেয়াল করলো লোকটার ডান হাতের অনামিকা নেই। গোড়ার দিকটা থ্যাবড়ানো। ক্ষত শুকিয়ে চামড়ায় ঢাকা পড়েছে।
‘মেয়েদের কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা নাকি বেশি। হয়তো ভুল জানি। তবে ওই মেয়েটা, নাম তো আর জানা হয় না..।’
‘রেনু। ওর নাম রেনু। আমার স্ত্রী।’
‘তাকে বেছে নিলাম স্রেফ ওই ছেলেমেয়ের ব্যাপারটায় নিশ্চিত হতে। ছুরি দেখেই সে কি কান্নাকাটি। সামনের পাটির দুটো দাঁত তুললাম। চিৎকার। মাথা ছেঁচে চুল তুলে ফেললাম, সেই একই চিৎকার। চিৎকারের পর চিৎকার। কষ্ট পেলেই সবাই এমন কেন যে চেঁচায়। ছেলে হোক আর মেয়ে, ব্যথাটা দেখলাম একইভাবে পায়।’ আবার থুথু ফেলল লোকটা। রশিদকে খেপাতে চায়? সিগারেট ধরাল রশিদ।
“তারপর একটু একটু করে চামড়া তুললাম আর একটুখানি করে পারঅক্সাইড আর অ্যালকোহল ঢাললাম। মনে হলো এসব চিৎকার চেঁচামেচিরও একটা লিমিট আছে। কাউকে ছুরির ডগা দিয়ে কেটে দিলাম, যতটুকু ‘ব্যথা ব্যথা’ বলে কঁকিয়ে উঠল, দুটো নখ উপড়ে ফেললেও সেই একই ভল্যুমে চিৎকার। ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারি না।”
দীর্ঘ এলোমেলো কথাগুলো রশিদের ভাবান্তর ঘটাল না।
‘তুমি ব্যথা পাও না বললে..।’
‘হ্যাঁ, একদম ঠিক। এরপর..।’
বিদ্যুৎগতিতে লোকটার বাম পায়ের উরুতে প্যান্টের ওপর দিয়েই ভোঁতা ছুরির ডগা গেঁথে দিল রশিদ। থেমে গেল লোকটা। এমন করে ছুরিটার দিকে তাকাল যেন প্যান্টে কফি ছলকে পড়েছে। মূলত ওটা ছিল রক্ত।
‘দেখলে তো?’
ছুরিটাকে মুচড়ে দিলো রশিদ। লোকটা স্বাভাবিক চেহারায় ঘাড় ঘোরাল। রুমটাকে আরেকবার পর্যবেক্ষণ করলো।
‘তুমি কী চাচ্ছো রশিদ, আমি ব্যথা পাই?’
‘হ্যাঁ! ঠিক তাই! তিলে তিলে যন্ত্রণা দিতে চাই তোকে!’
‘আমিও চাই। জন্মের পর থেকে যা কোনোদিন পাইনি, সবসময় যা অন্যদের পেতে দেখেছি, সেটা আমিও চাই।’
আরও বারকয়েক ছুরি চালাল রশিদ। লোকটা সামান্য কেঁপেও উঠলো না। কাপড় খানিকটা ছিঁড়ে নিশ্চিত হলো রশিদ, ছুরিটা রক্তমাংসেই আঘাত করছে। মেঝেতে রক্তের ধারা। অথচ টুঁ শব্দটি নেই লোকটার মুখে।
‘তুমি আমাকে মেরে ফেলতে চাইলে ঠিক আছে। না চাইলে ব্যান্ডেজটা করে দাও। এভাবে রক্ত ঝরতে থাকলে সম্ভবত আমি বাঁচব না। আর জেনে রাখা ভালো যে মৃত্যুর যন্ত্রণা ব্যাপারটাও আমি বুঝতে পারি না। মাঝে কিছুদিন না খেয়ে থেকে দেখেছি, ঘুম ঘুম পায় শুধু। বেশ আরামের ঘুম।’
‘মারব না! তোকে মারা যাবে না, এত সহজে না!’
দ্রুত রক্তপড়া থামাল রশিদ। ব্যান্ডেজ, হেক্সিসল রাখা ছিল বাথরুমে। কিছুতেই মরতে দিতে রাজি নয় এই নরকের কীটকে।
‘ব্যথা কাকে বলে সেটাই জানি না। আমি যা বুঝি তা হলো ব্যথা ব্যাপারটা কেউ চায় না। আমার বেলায় ব্যতিক্রম। আমি চাই।’
রশিদের কানে কথাগুলো ঢুকছে না। ঢুকলেও মগজ অবদি গড়াচ্ছে না। মুহূর্তে ইচ্ছে হলো লোকটার মুণ্ডুটা ফেলে দিয়ে এই অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটায়। পরেই ভাবলো, একটা উপায় নিশ্চয়ই আছে। লোকটা যন্ত্রণা পেতে চায়। সে এই যন্ত্রণার প্রাপ্য। যেকোনো মূল্যে তাকে যন্ত্রণা দেওয়া চাই।
‘রশিদ, ব্যাপারটা হলো কি। তুমি ভাবছো…।’
‘চুপ! একদম চুপ!’
সজোরে ঘুসি মারলো। চেপে ধরলো গলা। বিষয়টাকে আরও ব্যক্তিগত বানানোর ব্যর্থ প্রয়াস মাত্র। লোকটা যথারীতি নির্বিকার।
‘তুমি ভাবছো তুমি আমাকে পাকড়াও করেছো? ফুটপাতে ভিখারিটাকে মারার সময়ই তোমাকে খেয়াল করেছিলাম। তখন অবশ্য জানতে পারিনি তুমি আমার একচল্লিশ নম্বর ভিকটিমের প্রেমিক প্রবর।’
লোকটার গলা চেপে দানবের মতো চিৎকার দিল রশিদ। ঝাঁকাল ইচ্ছেমতো। লোকটার দম আটকে গেলেও চোখেমুখে নেই বাঁচার আকুতি। রশিদ গলা ছেড়ে দিতেই শব্দ করে শ্বাস নিল বটে, তবে তাতে তৃপ্তির ছাপ নেই।
‘আমি তোমাকে ক্লু দিয়েছি। আমাকে যাতে সন্দেহ করো, সেজন্য তোমার সামনে বহুবার ঘুর ঘুর করেছি।’
‘কেন! কেন করেছিস!’
‘বুঝতেই পারছো কেন।’
‘কেন!’
‘আমি পাগল নই। তেতাল্লিশটা খুন এমনি এমনি করিনি। খুন করে করে আমি বিরক্ত। পরে ভাবলাম উল্টোটা করে দেখা। ধরা দিয়ে দেখি। তুমি আমার চুয়াল্লিশ নাম্বার সাবজেক্ট। আমি দেখতে চাই, আমাকে পাকড়াও করে যন্ত্রণা দেওয়ার কোনো টোটকা তোমার হাতে আছে কিনা।’
‘কেন! কেন এভাবে কষ্ট দিয়ে মারলি বল!’
রশিদের চোখ আগুন লাল। ক্রোধে পানিও ঝরছে। লাইটার জ¦ালিয়ে এরইমধ্যে লোকটার বাম হাতের তর্জনি পুড়িয়ে কালো করেছে। নাহ, পলকও ফেলেনি লোকটা। অথচ মাংস পোড়া গন্ধটা তীব্রভাবে নাকে বাড়ি খাচ্ছে।
‘উফফ! তোকে পোড়াব! একটু একটু করে। ইঞ্চি ইঞ্চি করে কাটবো!’
‘কী রশিদ! তুমি ব্যথা পাচ্ছে নাকিা! তুমি কেমন ব্যথা পাচ্ছো? বোঝাও তো আমাকে!’
লাইটার ছুড়ে ফেলে মেঝেতে মাথা চেপে বসে পড়ল রশিদ। যার ব্যথার অনুভূতিই নেই, তার ওপর প্রতিশোধ নেবে কী করে! কী করে তাকে যন্ত্রণার সাগরে ডোবাবে!
‘তুমি জেনে আরও হতাশ হবে যে, আমার খিদের অনুভূতিও নেই। না খেলে মারা যাব এটা জানি। কিন্তু কখনও খিদে ব্যাপারটাও বোঝা হলো না। ওই যে বললাম, একটু ঘুম ঘুম পায় শুধু।’
‘তোকে বাঁচিয়ে রাখবো না!’
‘আহা! এ জন্যই তো তোমার ঠুনকো জালে ধরা দিয়েছি রশিদ। সেদিন ঠিক বুঝতে পারছিলাম যখন তুমি কিনা যতীন কেমিক্যাল স্টোর থেকে ক্লোরোফর্ম কিনে আমার পিছু নিলে। সত্যি বলতে কি, আমি অজ্ঞানই হইনি। স্রেফ ভান করেছিলাম। এখন আমি তোমার হাতে এক প্রকারের বন্দি। অথচ তুমি কত অসহায় দেখলে?’
‘কী চাস তুই?’
‘আমি যা চেয়েছি তা বোধহয় পাব না। শেষ চেষ্টা করে দেখছি। তোমাকে দিয়ে।’
রশিদ ধাতস্থ হলো। লোকটা ভুল বলছে না। তার সাজানো ফাঁদেই পা দিয়েছে সে। খুনি স্বেচ্ছায় বন্দি হয়েছে তার হাতে। কেন? এতগুলো মানুষকে নারকীয় যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করার পর আর কী চায় সে?
‘আমি তোমার মতো কাউকেই চেয়েছিলাম। মানে যে মরিয়া হয়ে আমাকে যন্ত্রণা দিতে চাইবে এবং এর জন্য যৌক্তিক কারণও থাকবে। তুমি নিশ্চয়ই জানবে, আমাকে কী করে ব্যথা দিতে হবে। তাই না?’
রশিদ পাশের রুমে গেল। ফ্রিজে পানীয় আর স্যান্ডউইচ রাখা। খেলো ধীরেসুস্থে। ঘুসি মেরে নিজের হাত রক্তাক্ত করেছে। তাতে বরফকুচি মাখলো। বেডরুমের এক কোণে রেনুর শাড়িগুলো এখনও তাজা ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে।
খুনি তার হাতে বন্দি। বন্দি হয়েও সে মহানন্দে উপভোগ করছে রশিদের অসহায়ত্বের যন্ত্রণা।
ছাদে গিয়ে সিগারেট ধরাল রশিদ। হাতে হুইস্কির বোতল। রেনুর লাশ দেখে সেদিনই আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। প্রতিশোধের ইচ্ছের ওপর ভর করে চলেছে এ কয়টা দিন। লোকটার যন্ত্রণা কি তাকে স্পর্শ করতো? অন্যের যন্ত্রণা যেমন খুনিকে স্পর্শ করেনি…। রশিদ চোখ বুঁজে ষোলতলার ওপর থেকে শ^াস নিল। মগজটা অক্সিজেন পেলেই বর্তে যায়।
ঘরে ঢুকে বেডসাইড ড্রয়ার থেকে চাকু বের করলো রশিদ। ধারাল প্রান্তটার দিকে চেয়ে রইল। মগজের নিউরনগুলো শুঁয়োপোকার মতো কিলবিল করছে। তাদের কাজ একটাই- খুনিটাকে যন্ত্রণা দিতে হবে। খুঁজে বের করতে হবে একটা কিছু, যেকোনো কিছু!
ড্রয়ার থেকে আরও একটা তরল বের করলো। একটা অ্যাম্পুল। এতদিন নিজেই নিত এই ড্রাগ। অ্যামফিটামিনে ভরে ফেলল একটা সিরিঞ্জ।
‘ওহ। তোমাকে বুদ্ধিমান ভেবেছিলাম। এসব ছুরি চাকু…।’
‘তোর জন্য নয় এটা।’
‘ওহ। তাহলে?’
‘আমার জন্য!’
‘মানে কী! হো হো।’
রশিদ ঝুঁকে এলো খুনির ঠিক সামনে। চোখের কালো কুচকুচে তারারন্ধ্রের ভেতর দিয়ে খুঁজে নিল ভেতরের সত্ত্বাটাকে। তারপর ঠোঁট প্রসারিত করে হাসি ফোটাল। শব্দ করলো না। খুনির ঠিক চোখের সামনের দপ করে তুলে ধরলো সিরিঞ্জ। সোজা চালান করে দিল শিরায়।
এরপর দপ করে তুলে ধরল চাকুর ধারাল ফলা।
‘এই যে চাকু! এই দেখ! দেখ! আমি আমার আঙুল কাটবো!’
খুনির চোখের পঁচিশ সেন্টিমিটার সামনে বাম হাতের বুড়ো আঙুলটা তুলল রশিদ। খুনির চোখে একরাশ দ্বিধা।
‘ভালো করে দেখ শয়তান! আমি আমার বুড়ো আঙুলটা কাটবো! এরপর আমি যন্ত্রণা পাব। ব্যথা পাব! আগুন ঝরানো ব্যথা!’
ডান হাতে শক্ত করে চেপে চাকুটার ধারাল প্রান্ত ধীরে ধীরে নিজের বুড়ো আঙুলে বসালো রশিদ। চাপ বাড়তেই বিকৃত হলো মুখ। আঙুল কেটে চেপে বসলো ফলাটা। বাম হাতের কনুই বেয়ে গড়িয়ে পড়ল রক্তধারা। ততক্ষণে কাজ করতে শুরু করেছে ড্রাগ। খুনির চোখে ক্রোধ।
‘আহ! আ! আআ!’
খুনির চোখ থেকে চোখ সরাচ্ছে না রশিদ। চাকুর ফলা আঙুলের হাড়ে চেপে বসতেই তীব্র যন্ত্রণায় চেহারা আরও বিকৃত হলো তার।
‘কী! রশিদ! কী করছো! কেন!’
‘ব্যথা পাচ্ছি আমি বুঝলি শয়তান! অসম্ভব যন্ত্রণা! তুই কখনই বুঝতে পারবি না এটা! কখনই না!’
পরিষ্কার দেখলো রশিদ, ফুলে উঠছে খুনির নাক। চোখ থেকে নির্বিকারত্ব গায়েব। সেখানে ধিক ধিক করে উঠলো খুনে আগুন। মুখটা অন্যদিকে সরানোর চেষ্টা করলো খুনি। চোয়াল চেপে ধরে সেটা নিজের দিকে ঘোরাল রশিদ।
‘দেখ! দেখ আমি যন্ত্রণা পাচ্ছি! দেখ! তুই পাবি না। ব্যথাহীনের কোনো অস্তিত্ব নেই এ জগতে। তুই একটা নিতান্তই ব্যাকটেরিয়া! হা হা।’
‘নাহ! নাহ!’ আর্তচিৎকার খুনির গলায়। শারীরিক ব্যথা নয়, ড্রাগের ওভারডোসের কারণে বেড়ে গেছে তার ক্রোধ। চোখের সামনে আরেকজন যন্ত্রণা পাচ্ছে, সে পাচ্ছে না। রাগে পিত্তি জ¦লে যাচ্ছে খুনির।
কী বলবে বুঝতে পারছে না খুনি। প্রবল অস্বস্তির ভাবখানা লুকাতে পারছে না সে। এতদিন চোখের সামনে নিজের হাতে যন্ত্রণা দিয়েছে অন্যকে, সেই কষ্ট তাকে ছুঁতেই পারেনি। এখন কোথাকার কোন এক রশিদ তাকে নিয়ে শুরু করেছে অসহনীয় প্রহসন!
বুড়ো আঙুলটা নুইয়ে পড়েছে। এবার নিজের বাম হাতের অনামিকার গোড়ায় ছুরি বসালো রশিদ। মুহূর্তের মধ্যে সাউন্ডপ্রুফ রুমটা শুষে নিল রশিদের সমস্ত আর্তনাদ। খুনির কানের খুব কাছে গলার রগ ফুলিয়ে কাতরাচ্ছে রশিদ, হাউ মাউ করছে, ফুঁপিয়ে উঠছে কখনও বা। কপ কপ করে কেটে ফেলল নিজের আরও দুখানা আঙুল। যন্ত্রণায় তার চোখ ঠিকরে রক্ত বের হবে যেন এখুনি।
‘বন্ধ করো রশিদ! বন্ধ করো!’
‘হা হা হা! আআআ! আ! আমার কোষে কোষে যন্ত্রণা! কোষে কোষে! এই দেখ! আহ! আ!’
রশিদের বাম হাতের কিছু আর অবশিষ্ট নেই। কাঁপা হাতে চাকুর ফলা চেপে ধরলো নিজের কপালে। একের পর এক আঁকতে লাগল ক্রুশচিহ্ন। সঙ্গে দানবীয় চিৎকার।
‘আহ! আহ! ব্যথা! ব্যথা আছে মানে জীবন আছে! আমি কষ্ট পাচ্ছি, আমি জীবিত! তুই মৃত! তুই মৃত!’
খুনির চোখজুড়ে রাজ্যের অস্বস্তি। বাঁধন খুলতে মরিয়া। পারছে না। খুনি টের পাচ্ছে তার ভেতর ক্রমশ জেঁকে বসছে এক অসার শূন্যতা। আজন্ম লালিত আকাক্সক্ষায় ক্রমাগত বালি ঢেলে চলেছে রশিদ। নিজেকে বলছে, এ অধিকার রশিদের নেই! কিছুতেই নেই!
‘আমি মৃত নই! রশিদ। এমনটা করলে তুমি মরে যাবে! এমনটা তুমি করবে না!’
খুনি যেমনটা করতো তার ভিকটিমদের সঙ্গে, রশিদ তেমনটা শুরু করেছে তার নিজের সঙ্গে।
যন্ত্রণা কাকে বলে! প্রশ্নটা সাঁড়াশির মতো এভাবে যে চেপে ধরবে মগজটাকে, ভাবেনি খুনি। রশিদের এমন নির্লজ্জ¦ প্রহসন সে মেনে নিতে পারছে না কিছুতেই।
চাকুর ফলাটা নিজের গলার কাছে এনে ধরল রশিদ। খুনি বুঝে গেছে কী ঘটতে চলেছে। ভড়কে গেল। নিশ্চয়ই চূড়ান্ত যন্ত্রণার মুখোমুখি রশিদ। একটু পর… একটু পর..।
‘থামো! আমি চাই কষ্টটা! তুমি পাবে না! তুমি না! কিছুতেই না!’ চুয়াল্লিশ নম্বর সাবজেক্টের কাছে কিছুতেই ধরাশায়ী হতে রাজি নয় খুনি।
‘হা হা হা। আ! আ! আমি এখন দেখাবো তোকে যন্ত্রণা কাকে বলে! এই দেখ! ভালো করে দেখ! দেখবি কী করে যন্ত্রণায় মানুষ ছটফট করে! তুই তো এমনি এমনি মরে যাবি! তুই কোনোদিন বুঝতে পারবি না যন্ত্রণা কাকে বলে! তুই বুঝতেই পারবি না জীবনের সবচেয়ে বড় সত্য কী!’
রক্তাক্ত বিকৃত রশিদের মুখখানা খুনির ঠিক সামনে। এখুনি গলায় চাকু চালাল বলে রশিদ। অসহায়ত্বের চেয়েও বেশি কিছু টের পেতে শুরু করেছে খুনি। রশিদের কাছ থেকে চোখ সরাতে পারছে না। ক্ষীণ আশা, যন্ত্রণা নামক বস্তুটার ছিটেফোঁটাও যদি তার মগজে ঢোকে। রশিদ কি সেই সুযোগ দেবে? চোখের সামনে খুনি দেখল তার চুয়াল্লিশ নম্বর সাবজেক্ট নিজেই নিজের গলা কেটে দিল।
দরদর করে বের হচ্ছে রক্ত। আহা রক্ত! যন্ত্রণার বাসা কোথায়? রক্তে? নাহ! তা কী করে!
ছটফট করছে রশিদ। গলা দিয়ে ছলকে ছলকে বের হচ্ছে গোঙ্গানি। শব্দটা শূলের মতো বিঁধছে খুনির কানে। ছোটবেলার মতো নিজের আরেকটা আঙুল কপাকপ খেয়ে ফেলতে পারলে কি অস্বস্তিতা কাটবে? আহ! সেটাও পারা যাচ্ছে না। কঠিন গেরো হাতে। মরার আগপর্যন্ত এভাবেই তবে বসে থাকতে হবে চেয়ারে, যন্ত্রণাহীন!
প্রচণ্ড একটা কিছু ভর করলো খুনির ভেতর। এটাই কি তবে যন্ত্রণা? রশিদ নিজে মরে কি তাকেই শাস্তি দিয়ে গেল? এমন বিশ্রি গা গোলানো অনুভূতি পেতেই কি এতদিন অপেক্ষা করেছে সে? মানতে পারছে না খুনি। আহা ব্যথা! জীবনের একান্ত আখ্যান! রশিদের নিথর দেহটার দিকে বড় বড় চোখে রাজ্যের প্রশ্ন নিয়ে নিরবে তাকিয়ে রইল চেয়ারে বসা খুনি লোকটা।