সায়েন্স ফিকশন গল্প : ডালিম ভাইয়ের বাঁশি
Bangla science fiction story
‘জাদুটা আবার দেখবি?’
‘কোনটা?’
‘আরে ওইটা। তুই তখন ফাইভে। পেনসিলের মতো টিংটিঙা ছিলি। তোরে তো পেনসিলই ডাকতাম। ওই সময় যেটা দেখাইছিলাম।’
‘আমার তো মনে নাই।’
‘মনে থাকন লাগবো না। আমার আছে।’
দুঃসম্পর্কের আত্মীয় বলে একটা বিষয় আছে। কেউ বলে লতায়-পাতায় আত্মীয়। কাগজে কলমে ডালিম ভাই দূরের হলেও খাতিরের দিক দিয়ে খুব কাছের ছিলেন। অবলীলায় তার কাঁধে মাইলের পর মাইল ঘুরে বেড়াতাম। এখন সম্পর্কে ঢিল পড়েছে। কাঁধে ওঠার বয়স নেই।
ডালিম ভাইয়ের সঙ্গে কবে জাদু দেখতে গিয়েছিলাম, মনে পড়ে না। তবে কম অ্যাডভেঞ্চার তো করিনি। কোনো এক ফাঁকে জাদুর আসরে গিয়েছিলাম হয়তো। গ্রামে এখনও এসব আসর বসে নাকি?
ডালিম ভাই আমাকে দেখে কতটা খুশি হলো সেটার প্রমাণ পেলাম নাশতা শেষ হওয়ার পর। আমাকে রীতিমতো বগলদাবা করে হাঁটা দিলো নো ম্যান্স ল্যান্ডের দিকে। কামাল্লা নামের জায়গাটা আবার ভারতের সীমান্ত ঘেঁষে। উঁচু নিচু টিলাগুলো সব ঝোপ ঝাড়ে ঢাকা।
গোটাকয়েক পিঠা আর পানির বোতল ভরে নিয়েছে একটা ঠোঙায়। দীর্ঘ সফরের লক্ষণ। ব্যাগের মাথায় আবার একটা বাঁশির ডগাও উঁকি দিচ্ছে। ডালিম ভাই এখনও বাঁশি বাজায়?
ভাঙাচোরা পুকুরঘাটের পর ধানক্ষেত। সেটা পেরিয়ে কলাবতীর জঙ্গল। তারপর বনজুঁইয়ের একটা জটলার পেরিয়ে চিকন রাস্তা।
শীত আসি আসি করছে। মাটি শুকনো। বর্ষা হলে তিনবার পিছলে পড়তাম এবং ডালিম ভাই আমাকে শার্ট বদলানোর সুযোগ মোটেও দিতো না।
জংলা আর আশপাশে উঁচু-নিচু টিলা এত ঘন যে, এক কোণে চুপচাপ মাসখানেক বসে থাকলেও কেউ খুঁজে পাবে না। এদিকটা আগে যেমন ছিল তেমনই আছে। আশপাশের কয়েক বর্গকিলোমিটারে একটা বাড়িও চোখে পড়লো না। সুতরাং, এমন জায়গায় ঝিম মেরে বসে থাকার ইচ্ছে হতেই পারে।
ডালিম ভাইয়ের হাঁটার গতি দেখে মনে হচ্ছে তার এমন ইচ্ছে জীবনেও জাগেনি। তিনি তার গন্তব্যে একনিষ্ঠ।
এমন সব গাছ দেখছি, সত্যি বলতে কি, এ গাছগুলোর সঙ্গেও আমার বিশ বছর পর দেখা। পুরো ভ্রমণটাই যেন জাদু। যদিও এ পথে অনেকবার আসা-যাওয়া হয়েছে। তারপরও ডালিম ভাই নতুন করে কী দেখাবে, সেটার অপেক্ষা আছি।
ঢালু পথ। অতটা ক্লান্ত লাগছে না। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় যেমনটা লাগে। যাত্রাপথে কথা যে একেবারেই হচ্ছে না তা নয়। সবই অহেতুক। সোহরাব মামার ব্যবসা কেমন যাচ্ছে, আমার চাকরি এখন কোথায়, বিয়ে করছি না কেন, দুবাইর ভিসা চালু হলে ডালিম ভাই চলে যাবে কিনা, এসব। ডালিম ভাই ‘হ্যাঁ হুঁ’ আর ‘জানি না’ বলে দেদার চালিয়ে যাচ্ছে বাতচিত। আর আমার যত মনোযোগ তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলায়।
চিকন খাল। দেখেই মনে হলো আগে দেখেছি এটা। তখন আমি ক্লাস ফাইভে। মনে পড়লো খালের পাড়ে বাঁশের চাটাই দিয়ে ঘেরা ছোট একটা ঘরের মতো ছিল। এখন নেই।
মস্তিষ্ক সহজে প্রতারণা করে না। সঙ্গে আছে ঘ্রাণের যোগসূত্র। এ গাছগুলোর নাম কী যেন? মনে পড়লো না। কালো রঙের ফলগুলোও দেখি আছে। সব মিলে মিশেই বিশেষ সেই ঘ্রাণ।
স্মৃতি ফিরে আসছে হুড়মুড় করে। মনে পড়লো আমরা খালের পাশের সরু পথ ধরে বহুদূর গিয়েছি। কিন্তু না, বহুদূর যাইনি। শৈশবের স্মৃতিতে সব বড় বড় লাগে। রাস্তা অত বড় না।
খালটা এক জায়গায় সরু হয়েছে অনেক। আগে এখানটায় পানির স্রোত ধরেই পার হতাম। এখন দুজনে লাফিয়েই চলে গেলাম ওই পারে।
ওপারে সুপারি বাগানে কেউ কি দা হাতে দাঁড়িয়ে থাকবে? আরে তাই তো! এটাকে বলে দেজা ভ্যু। মনে হবে আগেও ঠিক এমনটা ঘটেছে। কী জানি, এটা কাকতালীয় ঘটনাই হবে।
‘সুপারি কয় মণ পাকলো মনুদা? পাকা সুপুরির পান কেউ খায়?’
ডালিম ভাইর কথার জবাব দিল না বুড়ো লোকটা। আমরাও জবাবের আশা না করে সমতল একটা জায়গায় এসে পড়েছি।
দাঁড়াল ডালিম ভাই। আশপাশে লজ্জাবতী গাছ অনেক। আমি অজান্তেই গাছের পাতা ছুঁয়ে দিচ্ছি আর সেগুলোর গুটিয়ে যাওয়া দেখছি। ডালিম ভাই ঠোঙা বাড়িয়ে দিল। পিঠায় এক কামড়, এক ঢোক পানি।
দূরে দিগন্ত। ডানে বেশ খানিকটা জুড়ে জঙ্গল। এদিকে ঘর-বাড়ি করার সুযোগ নেই। কেউ আসেও না। শীতে গাছের পাতা ঝরে যাওয়ায় জঙ্গলও পাতলা হয়ে আছে। ডালিম ভাই মাটিতে পা ছড়িয়ে বসলো। বাঁশি হাতে ফুঁ টু দিয়ে দেখল।
বাঁশি বের করল। ফুঁ টু দিয়ে একটু প্রস্তুতি নিয়ে নিল। এরপর সটান উঠে পড়ল। বাঁশি তুলে দেখাল ডানের জঙ্গলের মাঝ বরাবর একটা জায়গা।
‘ওই খানে না গেলে কাজ হবে না বুঝলি।’
‘ওকে। চলেন যাওয়া যাক।’
Bangla science fiction story
অদ্ভুত সুর। গায়ে কাঁটা দিলো। মনে হলো এই সুর পৃথিবীর না। অন্য কোনো গ্রহের। গ্রহ-নক্ষত্র মহাকাশ ছাড়িয়ে এ সুর অন্য কোনো মহালোকের। যেন কত আলোকবর্ষ জুড়ে ছড়িয়ে গেছে এটি। মনে হলো সুরটাকে দেখতে পাচ্ছি। সেটা কেমন বলতে পারবো না। হয়তো আমার ক্ষুদ্র মানব মস্তিষ্কে এই ঐন্দ্রজালিক সুরের একটা প্রতীকী রেখাচিত্র দাঁড় করাতে চাইছে।
ঘন ঘন রঙ বদলাচ্ছে সুরটা। এক রঙের ভেতরও আরো কত রঙ। রঙ ছাড়িয়ে সুর হয়ে গেলো তথ্য। যেন কত যুগ যুগ ধরে কত কিছু ঘটেছে, সব বন্দি হয়ে আসছে এ সুরে। ফ্রিকোয়েন্সির এক অদ্ভুত জাদু শুরু হয়ে গেছে। সীমান্ত ঘেঁষা গ্রামের ডালিম ভাই কী করে এ সুর তৈরি করল ভেবে পেলাম না।
মন্ত্রমুগ্ধের মতো কান খাড়া করে আছি। সুরটা কোনো গানের তো দূরে থাক, মেলোডির মধ্যেও পড়ে না। একবার এলোমেলো আবার মনে হয় ঠিকঠাক। চাবির উঁচুনিচু ধাতব ভাঁজগুলো যেমনটা হয়। অনেকটা ভাষার মতো। প্রকৃতির সঙ্গে কথা বলছে ডালিম ভাই? মহাজগতের সঙ্গে ডিরেক্ট একটা কমিউনিকেশন? ওই ভাষা কাউকে হয়তো শেখা লাগে না। আমার মনে হলো একটা নবজাতকও এই ভাষা জানে। তবু আমরা অনেকে না জানার ভাব ধরে বসে থাকি।
সুরের শুরু আর শেষ বা শেষ থেকে আবার শুরু ঠাহর করতে পারছি না। মধ্যবয়সী ডালিম ভাইকে মনে হলো সাধক পুরুষ। কত বছর ধরে সাধনা করেছেন কে জানে। হয়তো তাকে এ সুর ধরতে সাধনাই করতে হয়নি। ব্যাপারটা সহজাত। ঠিক যেভাবে মানুষের জিনোম সিকোয়েন্স এসেছে, সেভাবেই হয়তো। কতভাবে কত কিছুই তো ঘটতে পারে।
কতক্ষণ ধরে চললো জানি না। চোখের সামনে মনে হলো স্পেস-টাইম দেখছি। স্থান আর কাল হলো একবাটি স্যুপ। সেই বাটিতে মৃদুলয়ে ঘুঁটা দিচ্ছে ডালিম ভাইয়ের বাঁশির সুর। থামলো সুর। কারণ চোখের সামনে খুলে গেছে আরেক জগতের দরজা। কারও কাছে যা বিজ্ঞান, আমার কাছে আপাতত সেটা জাদু।
কালো গর্ত বা আয়নার মতো ঝকঝকে কোনো দরজা নয়। এগিয়ে দেখা যেতে পারে। রাস্তার আশপাশটা কেমন দলা পাকিয়ে আছে। যে তালগাছটা লম্বা ছিল, সেটা বেঁকে বৃত্তের মতো হয়ে আছে। কালো গর্তের ভেতর দিয়ে ওপাশটা আবছা দেখাও যাচ্ছে। সামনের মাঠটা মনে হচ্ছে পেঁচিয়ে আকাশে উঠে আবার গোত্তা খেয়ে নিচে নেমেছে। স্পেস-কার্ভ? ডালিম ভাইয়ের বাঁশির ফ্রিকোয়েন্সিতে বিশাল গোলমাল বেঁধে গেছে আমাদের চিরচেনা স্পেস-টাইম এর চাদরে।
ডালিম ভাই মুচকি হাসল।
‘চল।’
‘এর মধ্যে?’
‘না ঢুকলে তো ম্যাজিক হইব না।’
‘কিন্তু সব তো প্যাঁচ লেগে যাবে।’
‘আরে প্যাঁচ লাগলেই তো মজা। চল চল। দেরি করিস না। এই চোঙ্গা বেশিক্ষণ থাকে না।’
দুজন হাঁটা শুরু করলাম সেই ম্যাজিক চোঙ্গা ওরফে ওয়ার্মহোলের দিকে। এর চেয়েও সত্যিকারের জাদু আছে প্রকৃতিতে? অদ্ভুত সেই বাঁকানো, গোলানো, গোত্তা খাওয়া রাস্তায় ঢুকে পড়লাম দুজন।
Bangla science fiction story
ঘটনাচক্র-১
আমি ডালিম ভাইয়ের চুল খামচে ধরে আছি। ডালিম ভাই ব্যথা পায় না। ডালিম ভাইয়ের গায়ে অনেক শক্তি। ডালিম ভাই আমাকে বলল, ‘আমার চুল যত জোরে টান আমি ব্যথা পাই না।’ আমি জানি, ডালিম ভাইর কথা ঠিক না। ডালিম ভাই আমাকে এমনি এমনি বলে।
ডালিম ভাই আমাকে বলল, ‘পেনসিল! তুই আমার কাঁধ থেকে নামবি না?’
আমি বললাম, ‘না ডালিম ভাই। আমি এতদূর হেঁটে যেতে পারব না। আমাকে কাঁধে করে নিয়ে যাও।’
ডালিম ভাই আমাকে পেনসিল ডাকে। কারণ আমি শুকনো। তবে অত বেশি না।
ডালিম ভাই আমাকে বলল, ‘এই জাদুর চোঙ্গায় তোকে নিয়ে এলেই এক বিপদ। তুই কেমন যেন ছোট হয়ে যাস। এখন চুপচাপ বসে থাক। নড়াচড়া করবি না।’
আমি ডালিম ভাইকে একবার বলবো ঠিক করেছি যে, আমি এখন ছোট না। আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি। পরে আমি আবার মনে করলাম, এখন এই কথা বললে ডালিম ভাই আমাকে কাঁধ থেকে নামিয়ে দিতে পারে, কারণ আমি তো ছোট না।
আমরা হাঁটতে হাঁটতে দেখি বিশাল একটা খাল। ডালিম ভাই একা হলে লাফ দিয়ে পার হয়ে যেতে পারে। ডালিম ভাইয়ের গায়ে অনেক শক্তি। আমি জীবনেও পারবো না। এ কারণে ডালিম ভাই আমাকেসহ খালটা হেঁটে পার হলো। তারপর আমরা মনুদাকে দেখলাম, তিনি কাঁচি হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। মনুদা মনে হয় সুপারি গাছ লাগাবেন। সুপারি গাছের কথা আমার এমনি এমনি মনে হলো। আমি নিশ্চিত না। মনুদা আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসি দিলেন। তারপর আমি ডালিম ভাইকে জিজ্ঞাসা করলাম, ডালিম ভাই আমরা মনে হয় আরও অনেক অনেক দিন পর আবার এই জাদু দেখতে আসবো।
ডালিম ভাই আস্তে আস্তে বললেন, আমারও মনে হয়। তোর লগে আবার কবে দেখা হইব তা তো জানি নারে পেনসিল। আমি বললাম, আমার সামনে পরীক্ষা (দ্বিতীয় সাময়িক)। পরীক্ষা শেষ হলেই আবার বেড়াতে আসবো। ডালিম ভাই একটু দাঁড়ালেন। এরপর বললেন, দেখা হইব। আবার অনেক দিন পর হইলেও দেখা হইব। তারপর আমরা আবার জাদু দেখতে আসমু।
ঘটনাচক্র-২
স্পেস-টাইমের গোলকধাঁধা থেকে বের হতেই মনে হলো কত যুগ কেটে গেল এক লহমায়। ডালিম ভাইকে কেমন উদাস দেখাল। আমার মধ্যেও মিশ্র অনুভূতি। বিষাদময় একটা তৃপ্তি টের পাচ্ছি।
অনুভূতির কথা থাক। এই গোলকধাঁধার একটা বিশেষত্ব তো আছেই। কিছুই ঘটল না, আবার অনেক কিছুই ঘটিয়ে ছাড়ল। আমরা বা আমাদের মস্তিষ্ক সেটা ঠিকঠাক ঠাহর করতে পারেনি বোধহয়। মনে হলো, সময়ের গতি থেমে গিয়েছিল বা দ্রুত হয়েছিল। আমরা এমন এক সময়ের খপ্পরে পড়ে গিয়েছিলাম, যেখানে আমাদের মনে হতেই পারে যে অনেক সময় কেটেছে। আসলে সত্যি বলতে কি, এক মিনিটও কাটেনি।
‘চল, বাসায় চল। দুপুরের খাওয়ার টাইম হইসে।’
‘চলো চলো। আমাকে আবার অনলাইনে একটা মিটিং ধরতে হবে।’
ফিরে যাওয়ার সময় পেছনে না তাকিয়েও বুঝতে পারলাম পেছনের গোলকধাঁধার দরজাটা বন্ধ হয়ে গেছে। সামনে পেছনে সুবিশাল দিগন্ত। আমরা হেঁটে চলেছি চুপচাপ। মনে পড়ছে অনেক কিছু। আবার কিছুই পরিষ্কার না। কত স্মৃতি, কত হেঁটে চলা যেন এই ঝাঁঝাল বনজুঁইয়ের পথ ধরে।