খাঁচায় মাছ চাষ পদ্ধতি
যে সকল জলাশয়ে ভূ:প্রাকৃতিক অবস্থান বা গঠনগত কারণে জলনিষ্কাশন সম্ভব নয় বা সম্পূর্ণ আবরণ করা সম্ভব নয়, সেই সকল সুবিশাল জলাশয়গুলি যেমন জলাধার, হ্রদ, বিল, ব্যাকওয়াটার ইত্যাদিতে খাঁচায় মাছ চাষ করে অব্যবহৃত বা স্বল্প উৎপাদিত জলাশয়কে অধিক উৎপাদনশীল করা সম্ভব। এছাড়া উৎপাদনশীল জলাশয়গুলি থেকে আরো বেশি উৎপাদন পাওয়ার লক্ষ্যে খাঁচায় মাছ চাষ করা উচিত।
সবরকম কার্প (দেশী-বিদেশী পোনামাছ), পাঙ্গাস, রূপচাঁদা (পাকু), তেলাপিয়া, ভেটকি, চ্যানেল ক্যাটফিস প্রভৃতি মাছ খাঁচায় চাষের উপযোগী। খাঁচায় গলদা চিংড়ির মীন পালন খুবই সফল ও লাভজনক। কইকার্প, গোল্ডফিস, গাপ্পি প্রভৃতি রঙিন মাছের চাষও খাঁচায় করা যায়।
শক্ত দীর্ঘস্থায়ী, জলে বিষক্রিয়াহীন ও মাছের স্বাস্থ্য হানিকর নয় এরূপ বস্তু বা পদার্থ দিয়ে খাঁচা তৈরী করা হয়। খাঁচার কাঠামোর (ফ্রেমের) জন্য – বাঁশ, পি. ভি. সি কাঠ বা লোহার বড় এবং ভাসমান বস্তু (ফ্লোট) হিসাবে প্লাস্টিক ড্রাম/ ব্যারেল, প্লাস্টিক বল ইত্যাদির ব্যবহার করা হয়। খাঁচার জাল সাধারনত নাইলন বা প্লাস্টিকের হয়। খাঁচার জাল ভালো মানের নাইলনের হওয়া উচিত। সাবধানতা বজায় রাখার জন্য ডবল খাঁচা জাল হওয়া ভাল, অর্থাৎ একটি খাঁচার মধ্যে আর একটি খাঁচা থাকবে। বাইরের খাঁচার জাল অপেক্ষাকৃত বড় ফাঁসের হয়। যাতে কাকড়া বা মাছের শত্রু অন্যান্য জলজ প্রাণী ভেতরের জালে সহজে ক্ষতি করতে না পারে।
মজুতযোগ্য মাছের আকার আকৃতি অনুযায়ী খাঁচার জালের ফাঁস ঠিক করা হয়। জালের ফাঁস চিংড়ি মীন বা ডিম পোনা পালনের জন্য ১ মিলিমিটার বা তারও কম হওয়া উচিত। ৫-৬ ইঞ্চি মাছের জন্য ১/২ ইঞ্চি ফাঁস ভালো। খাঁচায় মাছ চাষে উদ্যোগী হওয়ার আগে জলাশয়ের অবস্থান, আয়তন, গভীরতা প্রকৃতি প্রভৃতি বিষয়ে লক্ষ্য রাখা উচিত। জলাশয়ের আয়তন কম পক্ষে ১/২ একর বা তার অধিক হওয়া ভাল। জলের গভীরতা ৬ ফুটের অধিক হওয়া ভাল। জলাশয়ে যেন প্রভূত আলো-বাতাস লাগে। জলের ভৌত রাসায়নিক গুণাবলী মাছচাষের উপযোগী হবে। জলাশয়ে যেন কোনভাবে জৈব বা রাসায়নিক বর্জ্য জমা না হয়। জলজ আগাছা, জলজ মৎসভূক প্রাণীর প্রকোপ যেন না থাকে। সব ঋতু বা সব আবহাওয়ায় জলাশয়ের নিকট যাতায়াতের পথ ব্যবস্থা থাকে।
খাঁচার নোঙর করা: নোঙরের সাহায্যে খাঁচাকে জলের নির্দিষ্ট গভীরতায় স্থির রাখতে হবে যাতে স্রোত বা ঢেউএ ভেসে না যায়। যেখানে প্রাকৃতিক নিয়মে যেমন, জোয়ার ভাটা, ঋতু পরিবর্তন প্রভৃতির কারণে জলের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে থাকে, সেখানে যেন ভাটার সময় বা শুখা মরসুমে জলের গভীরতা কমপক্ষে ৫ ফুট থাকে। কোনক্রমে খাঁচার জাল যেন পুকুর বা জলাশয়ের তলদেশ স্পর্শ না করে। খাঁচার নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও পরিচর্যার সুবিধার জন্য জলাশয়ের পাড় থেকে খাঁচার পাটাতন পর্যন্ত মই ব্যবহার করা হয় অথবা ছোট শালতি নৌকা ব্যবহার করা হয়।
মাছের মজুতকরণ: মজুতযোগ্য মাছের দৈর্ঘ্য সাধারত ৬-৭ ইঞ্চির বেশি হওয়া উচিত নয়। সাধারনত: পাঙ্গাস বা ক্যাটফিসের দৈর্ঘ্য ২ ইঞ্চি এবং মজুত সংখ্যা ৫-৬ টি প্রতি ঘনফুট হয়ে থাকে, পাকু (রূপচাঁদা) ২ ইঞ্চি মাপের ৬টি প্রতি ঘনফুট, ভেটকি ২ ইঞ্চি মাপের ৪টি প্রতি ঘনফুট, তেলাপিয়া (মনোসেক্স) ১ সেমি মাপের ৮-১০টি প্রতি ঘনফুট, পোনা মাছ বা কার্প ৪-৫ ইঞ্চি মাপের ৩-৪ টি প্রতি ঘনফুট।
খাঁচার পরিচর্যা:
জলের ভৌত রাসায়নিক গুণাবলী নিয়মিত পরীক্ষা করতে হবে এবং নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে। উপরোক্ত মাছগুলির জন্য জলের তাপমাত্রা ২০-২৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড হলে ভালো হয়। স্বচ্ছতা ১৫-২৪ সেমি, পি.এইচ ৭.৫-৮.০, দ্রবীভূত অক্সিজেন ৪ পি পি এম প্রতি লিটারের বেশি, মোট ক্ষারত্ব কমপক্ষে ২০ মিলিগ্রাম প্রতি লিটার, অ্যামোনিয়া ০.১ মিলিগ্রামের কম প্রতি লিটারে, নাইট্রাইট ০.১ মিলিগ্রাম প্রতি লিটার, ফসফেট ০.২-০.৫ মিলিগ্রাম প্রতি লিটার।
তথ্য সূত্র : ড: কিশোর ধাড়া, উপ মৎস অধিকর্তা, গৌড়বঙ্গ ও কেন্দ্রীয় অঞ্চল, মৎস দপ্তর; পশ্চিমবঙ্গ সরকার
খাঁচায় মাছ চাষ সম্পর্কে বিশদে জানতে কৃষিজাগরণ পত্রিকার এপ্রিল মাসের বিশেষ মৎস সংখ্যাদি পড়ুন।