পৃথিবীতে যে প্রাণীটার কারণে এখনও সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে সেটি হলো মশা। এর মধ্যে মশাবাহিত সবচেয়ে ভয়াবহ রোগটি হলো ম্যালেরিয়া। যার কারণে পৃথিবীতে প্রতি বছর মারা যাচ্ছে ছয় লাখেরও বেশি মানুষ। তবে সংখ্যাটা আরও অনেক বাড়তো, যদি না আবিষ্কার হতো আর্টিমিসিনিন নামের একটি অব্যর্থ ওষুধ। ১৯৭২ সালের নভেম্বরে যে ওষুধটি তৈরি করেন চীনা চিকিৎসাবিজ্ঞানী থু ইউইউ। সেই থেকে লাখ লাখ মানুষের জীবনে নতুন এক আলো হয়ে দেখা দিয়েছে ওষুধটি। কোটি মানুষের জীবন বাঁচানো সেই আর্টিমিসিনিন পুরোপুরি মেড ইন চায়না।
আর্টিমিসিনিনের আবিষ্কারের গল্পটা জানতে আমাদের যেতে হবে ৫৭ বছর পেছনে, ১৯৬৭ সালে। তখন চলছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধ।
মার্কিন সমর্থিত দক্ষিণ ভিয়েতনামের সঙ্গে যুদ্ধকৌশলে পেরে উঠলেও উত্তর ভিয়েতনামের সেনারা পড়েছিল ভিন্ন এক বিপদে। আর সেই বিপদের নাম ম্যালেরিয়া। যুদ্ধের ময়দানে সেনারা আক্রান্ত হচ্ছিল প্রাণঘাতি এ রোগে।
প্রচলিত কুইনিনে সারছিল না উত্তর ভিয়েতনামি যোদ্ধাদের ম্যালেরিয়া। তাছাড়া কুইনিনের কারণে দেখা দিচ্ছিল মারাত্মক সব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। ওই সময় উত্তর ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট হো চি মিন, চীনের কাছে সাহায্য চাইলেন নতুন একটা ওষুধ আবিষ্কারের জন্য। চীনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মাও সেতুং তার দেশের বিজ্ঞানীদের আদেশ দিলেন নতুন একটি ওষুধ নিয়ে সবাই যেন অতিসত্ত্বর গবেষণা শুরু করে।
চীনের পাঁচ শতাধিক বিজ্ঞানী নিয়ে গঠিত হলো একটি গোপন প্রকল্প। প্রকল্পের নাম দেওয়া হলো ‘প্রজেক্ট ৫২৩’। কারণ, গবেষণার কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৬৭ সালের মে মাসের ২৩ তারিখে।
রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে উৎসাহ পাওয়ার পর কোমর বেঁধে লাগলেন চীনা বিজ্ঞানীরা। একটার পর একটা রাসায়নিক যৌগ তৈরি করছেন ও সেগুলোর পরীক্ষা করে দেখতে শুরু করলেন তারা। কিন্তু কোনোটাতেই মিললো না কাঙ্ক্ষিত ফল। ওই সময় পিকিং ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করা ৩৯ বছর বয়সী চীনা নারী চিকিৎসাবিজ্ঞানী থু ইউইউ ভাবলেন, ভিন্ন কিছু করে দেখা যাক।
ভিন্ন কিছু করতে গিয়েই ইউইউ গবেষণা শুরু করেন চীনের ঐতিহ্যবাহী ভেষজ ওষুধ বা টিসিএম নিয়ে। একের পর এক তথ্য ও নমুনা সংগ্রহ করতে শুরু করেন ইউইউ। এক পর্যায়ে তিনি খুঁজে পান প্রায় দুই হাজার বছর আগে লেখা প্রাচীন চীনা চিকিৎসাশাস্ত্রের একটি বই। এ ছাড়া তিনি সংগ্রহ করেন ৬৪০টি প্রাচীন চীনা প্রেসক্রিপশন। সেগুলো নিয়ে গবেষণায় কেটে যায় চারটি বছর। ১৯৭১ সালে থু ইউইউ ও তার দল প্রায় দুই হাজার ঐতিহ্যবাহী চীনা ওষুধের রেসিপি অনুসরণ করে ২০০টি ভেষজ থেকে ৩৮০ ধরনের নির্যাস তৈরি করেন।
এর মধ্যে ইউইউ দেখলেন হাজার বছর আগে চীনে একটি গাছের নির্যাস থেকে তৈরি করা হতো জ্বর নিরাময়ের ওষুধ। গাছটির আঞ্চলিক নাম ছিংহাও।
ইউইউ দেখলেন ছিংহাওয়ের নির্যাসে আছে এমন একটি উপাদান যা মূলত জীবাণুর বিরুদ্ধে সরাসরি লড়াই করতে পারছে। তিনি উঠেপড়ে লাগলেন ওই নির্যাসে কী কী উপাদান আছে, সেটা জানার জন্য। দীর্ঘদিন কয়েকশ নমুনা পরীক্ষা করে অবশেষে ছিংহাওয়ের নির্যাস থেকে একটি কার্যকর রাসায়নিক যৌগ আলাদা করেন থু ইউইউ। তিনি এর নাম দেন, ছিংহাওসু, যার অর্থ হলো ছিংহাও গাছ থেকে পাওয়া উপাদান। আর সেই ছিংহাওসুকেই পরে ইংরেজিতে নাম দেওয়া হয় আর্টিমিসিনিন।
১৯৭২ সালে ইঁদুর ও বানরের ওপর আর্টিমিসিনিন প্রয়োগ করে ম্যালেরিয়ার জীবাণু ধ্বংস করার সফল পরীক্ষা করেন ইউইউ। কিন্তু মানুষের ওপর এ ওষুধ কাজ করবে কিনা তা তখনও জানা হয়নি। এখন প্রশ্ন হলো কার ওপর করা হবে সেই পরীক্ষা? গবেষণা দলের প্রধান হিসেবে বীরদর্পে এগিয়ে আসেন ইউইউ নিজেই। নিজের ওপর পরীক্ষার পর যখন নিশ্চিত হলেন ওষুধটি নিরাপদ তখন তিনি ম্যালেরিয়ার রোগীর ওপর ওষুধটির পরীক্ষা করেন ও সফলতা পান ।
এরপর থেকে আজ পর্যন্ত কোটি কোটি মানুষকে ম্যালেরিয়ার কবলে পড়ে অকালমৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছে চীনা গবেষক ইউইউর আবিষ্কার আর্টিমিসিনিন।
এমন একটি অনবদ্য আবিষ্কারের জন্য সর্বোচ্চ বৈশ্বিক স্বীকৃতি পেতে থু ইউইউকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ৪৩ বছর। ২০১৫ সালে আরও দুইজনের সঙ্গে যৌথভাবে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান আর্টিমিসিনিনের আবিষ্কর্তা ইউইউ। এর আগে চীনের অনেকগুলো সম্মানজনক পুরস্কার পান ইউইউ। পরে ২০১৬ সালে পান চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে সর্বোচ্চ পুরস্কার এবং ২০১৯ সালে পান মেডাল অব দ্য রিপাবলিক চায়না পদক।
২০২৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত চায়না একাডেমি অব চাইনিজ মেডিক্যাল সায়েন্সেস এর প্রধান বিজ্ঞানীর পদ অলংকৃত করে আছেন থু ইউইউ।
আর্টিমিসিনিন সম্পর্কে কিছু তথ্য
- ২০০৬ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ম্যালেরিয়ার চিকিৎসায় কুইনিনকে পুরোপুরি বাতিল ঘোষণা করে। এরপর থেকে আর্টিমিসিনিনই ম্যালেরিয়ার একমাত্র স্বীকৃত ওষুধ।
- আর্টেমিসিনিন ওষুধটি দ্রুত কাজ করে। এটি ম্যালেরিয়া রোগীদের রক্ত প্রবাহে পরজীবীর সংখ্যা দ্রুত হ্রাস করে।
- ম্যালেরিয়ার পরজীবী যাতে আর্টিমিসিনিন-প্রতিরোধী না হয়ে যায়, সে জন্য এর সঙ্গে ম্যালেরিয়ার অন্য ওষুধও মেশাতে হতে পারে। এ চিকিৎসাপদ্ধতিকে বলা হয় আর্টিমিসিনিন-ভিত্তিক কম্বিনেশন থেরাপি বা এসিটি।
- নির্দিষ্ট কিছু ক্যান্সারসহ অন্যান্য রোগের চিকিৎসায়ও আর্টিমিসিনিনের সম্ভাব্যতা নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছে। পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোমের চিকিৎসাতেও ব্যবহৃত হচ্ছে আর্টিমিসিনিন।
যে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সেনাদের বাঁচাতে ওষুধের খোঁজে শত শত চীনা বিজ্ঞানী নিরলস কাজ শুরু করেছিলেন, সেই যুদ্ধ শেষ হয় ১৯৭৫ সালে। অর্থাৎ ওষুধটা পাওয়া গিয়েছিল যুদ্ধের একেবারে শেষের দিকে। অবশ্য তাতে কী! বিশ্বে যে পরিমাণ মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন ও প্রতিনিয়ত হচ্ছেন তাদের জন্য যুগ যুগ ধরে আশীর্বাদ হয়ে থাকবে চীনা আবিস্কার আরটিমিসিনিন।
সূত্র: সিএমজি