অজ্ঞাত লাশের পরিচয় ১০ মিনিটেই!

অচেনা মৃত ব্যক্তির পরিচয় শনাক্তের ক্ষেত্রে ‘নবযুগে’ প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই ‘নবযুগের’ সূচনা করেছে। নির্বাচন কমিশনে রক্ষিত জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যভাণ্ডার ব্যবহার করে পিবিআই অচেনা মৃত ব্যক্তির পরিচয় শনাক্ত করছে মাত্র ১০ মিনিটে।

পিবিআই এটিকে বাংলাদেশে অজ্ঞাতপরিচয় মরদেহের পরিচয় শনাক্তের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক ঘটনা বলে উল্লেখ করেছে। পুলিশের এ বিশেষজ্ঞ ইউনিট বলছে, প্রতিবছরই দেশে কয়েক হাজার মরদেহ বেওয়ারিশ হিসেবে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের মাধ্যমে দাফন করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে ওই ব্যক্তির পরিবার জানতেই পারছে না, তার মৃত্যু কোথায়, কিভাবে হয়েছে। পরিবারের সদস্যরা স্বজনের পথ চেয়ে বসে থাকে বছরের পর বছর। কিন্তু সেই স্বজন আর ফিরে আসে না।

প্রক্রিয়াটির বিষয়ে জানতে চাইলে পিবিআই প্রধান উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) বনজ কুমার মজুমদার কালের কণ্ঠকে বলেন, কোনো এলাকায় অজ্ঞাতপরিচয় মরদেহ উদ্ধারের পর সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ বার্তা দেন সেখানকার পিবিআই ইউনিটপ্রধানকে। তখন পিবিআইয়ের একটি দল ঘটনাস্থলে যায়। ওই দলের সঙ্গে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, ল্যাপটপ ও ইন্টারনেট সংযোগসংবলিত ডিভাইস থাকে। তারা মরদেহের হাতের আঙুলের ছাপ নিয়ে প্রথমে পাঠায় পিবিআই সদর দপ্তরের সার্ভারে। সেই সার্ভার থেকে চলে যায় নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যভাণ্ডারে। সেখান থেকে একটি প্রতিবেদন আসে পিবিআই সদর দপ্তরের সার্ভারে। প্রতিবেদনটি মূলত আঙুলের ছাপের মিল-অমিল নির্দেশ করে। আঙুলের ছাপ মিলে গেলে ওই ব্যক্তির ছবি, নাম-ঠিকানা ইত্যাদি পাওয়া যায়। সেটা পিবিআই সদর দপ্তরের সার্ভার থেকে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তার কাছে চলে যায়। এটি মাত্র ১০ মিনিটের প্রক্রিয়া। যাদের জাতীয় পরিচয়পত্র আছে তাদের ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তি প্রযোজ্য। যারা এখনো জাতীয় পরিচয়পত্রের বাইরে আছে, তাদের তথ্য পাওয়া যাবে না বলে ডিআইজি বনজ কুমার জানান।

সাফল্য : অচেনা মৃত ব্যক্তির পরিচয় শনাক্তে প্রথম সাফল্য আসে গত বছরের ২১ অক্টোবর। ওই দিন পিবিআই ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিভাগের পরিদর্শক মোহাম্মদ জুয়েল মিঞা রেলওয়ে থানার একটি অপমৃত্যু মামলায় অচেনা ওই ব্যক্তির আঙুলের ছাপ গ্রহণ করেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ওই ব্যক্তির ছবি ও পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা ভেসে ওঠে ল্যাপটপে। মরদেহটি ছিল বগুড়ার ধুনট এলাকার জুলমত আলীর ছেলে রিপন সেখের। একই দিন রাজধানীর বনানী থানা এলাকায় উদ্ধারকৃত অজ্ঞাতপরিচয় মরদেহের হাতের আঙুলের ছাপ নিয়ে পরিচয় শনাক্ত করা হয়। ওই মরদেহ ছিল মাদারীপুর সদর উপজেলার নাজির উদ্দীন মুন্সির ছেলে আব্দুল মান্নান মুন্সির (৬১)। একইভাবে গত ৮ মার্চ খুলনায় উদ্ধার আট টুকরা লাশের পরিচয় শনাক্ত করা হয়।  ওই ব্যক্তি ছিলেন সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ব্রহ্মরাজপুর এলাকার আবদুল হামিদের ছেলে হাবিবুর রহমান। এরপর ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা, কক্সবাজার, গাজীপুর, টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন এলাকায় উদ্ধার বেশ কয়েকটি অচেনা লাশের পরিচয় শনাক্ত করেছে পিবিআই।

সাফল্যের পেছনে ছিল ব্যর্থতা : পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশে কর্মরত থাকার সময় ২০১১ সালের পরে মৃত এক তরুণীর পরিচয় বহু চেষ্টা করেও শনাক্ত করতে পারেননি। তার লাশ পাওয়া গিয়েছিল পাহাড়তলী এলাকার একটি কবরস্থানে। তদন্ত পর্যায়ে তিনি তরুণীর আঙুলের ছাপ পাঠিয়েছিলেন নির্বাচন কমিশনে। কিন্তু দুই বার চেষ্টা করেও তিনি নিরাশ হন। সে সময় জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যভাণ্ডার ব্যবহার বিষয়ে কোনো আইন ছিল না। পরে চট্টগ্রাম সফরে এসে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব তাঁকে ডেকে বিষয়টি জানিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। এরপর জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যভাণ্ডারের তথ্য ব্যবহার বিষয়ে আইন হয়। পদোন্নতি পেয়ে বনজ কুমার মজুমদার হন ডিআইজি। পিবিআইয়ের প্রধান হিসেবে যোগ দিয়ে তিনি জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যভাণ্ডার ব্যবহারের সুযোগ কাজে লাগান অজ্ঞাত লাশের পরিচয় শনাক্তে। এর জন্য সাহায্য নেন সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানের।

ডিআইজি বনজ কুমার কালের কণ্ঠকে বলছিলেন, ‘আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল ওই তরুণীর পরিচয় বের করতে না পারার বিষয়টি। কিভাবে অজ্ঞাত মরদেহের পরিচয় দ্রুত বের করা সম্ভব সেই বিষয়ে কাজ করতে চেয়েছিলাম। পরে সাফল্য পাওয়া গেছে। এটাই প্রশান্তির।’

চলছে প্রশিক্ষণ ও কর্ম এলাকা সম্প্রসারণ : অচেনা মরদেহের পরিচয় শনাক্ত করতে পিবিআই একটি দক্ষ দল গড়ে তোলার কাজ করছে। একটি সফটওয়্যার ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাদের চুক্তি হয়েছে। সেই চুক্তি অনুযায়ী পিবিআই সদর দপ্তরে চলছে কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি। প্রশিক্ষণের পর প্রয়োজনীয় ডিভাইস ও ল্যাপটপ সরবরাহ করা হচ্ছে সারা দেশের জেলা পর্যায়ের পিবিআই ইউনিটকে। এ পর্যন্ত ১২টি জেলায় সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়েছে। বাকি জেলাগুলোয় পর্যায়ক্রমে সরঞ্জাম সরবরাহ হবে বলে জানিয়েছেন ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার। তিনি বলেন, ‘সফলভাবে কাজ করে অজ্ঞাতপরিচয় লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফনের হার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে চাই।’

অজ্ঞাত