ধ্রুব নীলের অতিপ্রাকৃতিক গল্প : গোরখোদক

`শরিফুল আবার কবর খুড়বার লাগসেরে!’

চিৎকার করে পাড়ায় পাড়ায় কথাটা বলে বেড়ানোর জন্য একজনই যথেষ্ট। বরষার প্রবল বৃষ্টির ঝাপটা কাটিয়ে লোকটার চিৎকার যারা শুনতে পেল তাদের মনে তৈরি হলে দুই রকমের অনুভূতি।

এমনিতে মৃত্যুর খবর সবাইকে বিষণ্ন করে দেয়। কিন্তু জীবিত কেউ একজন যেকোনো সময় মারা যাবে, এ খবর চাঞ্চল্যকর। আজ কে কখন মারা যাবে সেটা কেউ জানে না। শুধু সবাই জেনে গেছে, আজ দিনের মধ্যে কেউ একজন মরবে। কারণ শরিফুল কবর খুঁড়ছে! মৃত্যুর খবর সে আগাম টের পায়।

মটুয়া গ্রামের গোরখোদক শরিফুল। তার বয়স তখন চৌদ্দ পনের। বাবা কবর খুড়ত। সে দাঁড়িয়ে দেখত। এরপর একদিন শরিফুলের শখ হলো কবর খোঁড়ার। সে যেদিন কবর খুঁড়ল সেদিনই পিছলে পড়ে যায় তার বাবা। গলা বরাবর ঢুকে যায় একটা সরু গাছের গোড়া। কারো মতে, ঘটনার শুরু নাকি এভাবেই।

গোরস্তানের পাশে চালাঘরে থাকে শরিফুল। গোরখোদক হিসেবে আশপাশে নামডাক তার। তবে পারতপক্ষে কেউ তার খোঁজ নেয় না। যখন থেকে আগাম কবর খোঁড়ার বিষয়টা জানাজানি হয়, গ্রামের সবাই ভয় করতে শুরু করে ওকে।

শরিফুলও কারোর সঙ্গে টুঁ শব্দ করে না। আজব এক ক্ষমতা বয়ে বেড়ায় ও। ওর হাতে শাবল-কোদাল দেখলেই আতঙ্কে জমে যায় গ্রামের দারুণ ক্ষমতাবান লোকগুলোও। তাদের বুকে তখন চিনচিনে ব্যথা করে। ‘আইজকা আমার দিন না তো!’ টাইপের চিন্তা ভর করে। তারপর যখন বেলা শেষে কোনো এক বাড়িতে কান্নার আওয়াজ শোনে, তখন লোকগুলোর বুকের চিনচিনে ব্যথা চলে যায়। তারা এক ধরনের স্বস্তি বোধ করে-‘নাহ, আইজ মরি নাই! অন্য কেউ গেছে! যাকগা!’

এটা প্রতিদিনকার ঘটনা না। মাসে একবার, দুইবার বা কখনো দুতিন মাস পর একবার। আবার সবসময়ই যে শরিফুল আগেভাগে কবর খুঁড়ে বসে থাকে এমনও না। কদিন আগে গ্রামের বৃদ্ধ আমিরুল মারা গেলেন। ওইদিন শরিফুল কবর আগে খোঁড়েনি। কিন্তু খুঁড়ল আজ। তাও আবার এমন ঝুম বর্ষার দিনে। পরিবেশটাই মন খারাপ করে দেওয়ার মতো।

কবরের জন্য খোড়া গর্তে যাতে পানি যাতে না জমে এ জন্য বাঁশের মাচা আর কলাপাতা দিয়েছে। গর্তের পাশে কাদামাখা উদোম গায়ে চুপটি মেরে বসে আছে একটা কিছু ঘটার অপেক্ষায়। কয়েকজন খবর পেয়ে উঁকি মেরে শরিফুলকে দেখে গেছে। শরিফুল কারোর দিকে তাকায় না। তাকালেও তার দৃষ্টিতে কিছু থাকে না।

‘আইজকা কার পালারে?’

বৃদ্ধ মজিবরের দিকে তাকাল না শরিফুল। মজিবরও ইনিয়ে বিনিয়ে প্রশ্ন চালিয়ে যায়।

‘আইজকা কি তাইলে মিতুলের মা মরব?’

মিতুলের মা হলো মজিবরের স্ত্রী। শ্বাসটানের রোগী। প্রতি রাতে চিঁ চিঁ করে শ্বাস নেয়। রাত বাড়লে সবাই মনে করে আজই শেষ। কিন্তু সকালের রোদের আলো ফুটলে বুড়ির গলা ফোটে।

 

গোরখোদক শরিফুলের বিষয়টা দিনে দিনে আরো জানাজানি হয়। মটুয়া গ্রামের বিজ্ঞানের শিক্ষক জালাল উদ্দিন এ ব্যাপারখানার ঘোরতর বিরোধী।

শরিফুলকে সামনে পেলেই বলেন, ‘তুই মিথ্যুক। গেরামের সবাইরে আতঙ্কে রাখসিস। তোর মতলব ক দেখি!’

জালাল উদ্দিনের ধমকে কাজ হয় না। ভাবান্তর নেই শরিফুলের। সে তার খোঁড়া কবরের পাশে বসে বিড়ি ফোঁকে।

‘টাকা পাস কোথায় বিড়ি কেনার শুনি! চুরিদারি করিস?’

যার জন্য কবর খোঁড়ে তাদের লোকেরাই টাকা পয়সা দেয়। এ ছাড়া মাঝে মাঝে ধানকাটার কাজ করে শরিফুল। তবে জালাল উদ্দিনকে এসব বলার প্রয়োজন বোধ করে না ও।

‘তুই কেমনে টের পাস আমারে বুঝা।’

‘এমনে এমনে টের পাই।’

‘কানে গায়েবি আওয়াজ আসে?’

নরম হতে থাকে জালাল উদ্দিনের গলা।

‘না।’

‘মানুষের চেহারা দেখে বুঝিস কে মরবে কে বাঁচবে?’

‘না।’

‘আইজকা কে মরব ক দেহি।’

‘জানি না।’

‘তাইলে কবর খুঁড়ছিস ক্যান?’

‘মন চাইছে খুঁড়ছি।’

‘মন চাইলে তো সব করতে পারবি না বাপু! গেরামের পুলাপাইন তোর কাম দেইখা ভয় খায়।’

‘ডর খাইলে বালা। ডরাক।’

‘খাড়া! হারামি! তোর কব্বরে আমি তোরে ফালামু!’

এই বলে হাতের ছাতা দিয়ে বাড়ি দিতে যান জালাল উদ্দিন। ছাতাটা খোলা থাকায় সুবিধা করতে পারেন না।

শরিফুল একচুল নড়ে না। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে পেছনের বেত গাছ ও পাটের জঙ্গলের দিকে।

জালাল উদ্দিন বিড়বিড় করতে করতে চলে যান। রাগের চোটে একদলা থুথু ফেললেও সেটা বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে যায়। সেটা দেখে মেজাজ আরো চড়ে যায় তার।

 

আছরের পর মারা গেল নুরুল আলম। লোকটা গাছির কাজ করত। ডাব গাছে উঠেছিল। গাছ পিছলা থাকায় পড়ে গেল। স্পট ডেড। মাথাটা বেকায়দায় পড়ায় ঘাড় ভেঙে গেছে বিকটভাবে।

যথারীতি লাশ নিয়ে যাওয়া হলো শরিফুলের কবরে। নুরুল আলমের আত্মীয় বলতে কেউ নেই। শরিফুল ঘোষণা দিল, টাকা ছাড়া সে তার কবরে নুরুলের জায়গা দেবে না। গ্রামের কেউ প্রথমে বিষয়টা গা করল না। একটু পর শরিফুল গলা চড়িয়ে বলল, ‘নুরুল যদি কবরে না যায় তবে আরেকজন যাইব। আইজকাই যাবই। কেডা যাইব কইতে পারি না। এইবার আপনেরা যাইতে পারেন।’

কেউ গেল না। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে গ্রামের লোকজন চাঁদা তুলে হাজার দুয়েক টাকা তুলে দিল শরিফুলের হাতে। অন্য সময়ের চেয়ে যা কয়েকগুণ বেশি।

 

রাত বারোটা। গ্রামের জন্য অনেক রাত। জালাল উদ্দিনের জন্য বেশি রাত না। তিনি রাত জেগে ঘোরাঘুরি করেন। অস্বাভাবিক জিনিসের প্রতি তার দারুণ আগ্রহ। মনে সূ² আশা কোনো এক রাতে অস্বাভাবিক কিছু ধরা পড়বে তার চোখে।

অবশ্য কয়েকদিন হলো তিনি শরিফুলকে নিয়ে পড়ে আছেন। এ পর্যন্ত যতবার কবর খোঁড়া ও মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে সব নোট রেখেছেন। পরিসংখ্যানের সূত্র খাটিয়েছেন। কাকতাল বলে চালিয়ে দেওয়া যাচ্ছে না বিষয়টা। সব ক্ষেত্রে কবর খোঁড়ার পর মৃত্যুর সম্ভাবনা এক শ তে এক শ। তার ধারণা, শরিফুল ভবিষ্যত থেকে এসেছে। সে জানে কে কবে মারা যাবে। কিন্তু সেটা সে কাউকে জানাচ্ছে না। জানালে জারিজুরি খতম। কিন্তু এত এত মানুষের মারা যাওয়ার সঠিক দিনক্ষণ মনে রাখে কী করে!

মেঘ একবার আসে, একবার যায়। একবার ভরা পূর্ণিমা, আরেকবার ঘোর আঁধার। আলো আঁধারিতে গোরস্তানের পাশে ঘাপটি মেরে বসে আছেন জালাল উদ্দিন। শরিফুলের চালাঘরের পাশে। শরিফুল বাইরে রান্না করছে। জালাল মাস্টার বিড় বিড় করে বললেন, খিচুড়ির খুব সুবাদ হইসেরে!

‘খাইতে চাইলে আসেন।’

জালাল উদ্দিন ধরা পড়েছেন। চুপচাপ বসলেন শরিফুলের পাশে। একটা প্লাস্টিকের টুল থাকা সত্তে¡ও পা গুটিয়ে বসলেন। দেখাতে চাইছেন তিনি শরিফুলকে বন্ধুর মতো ভাবছেন।

‘প্লেট একটাই। ওইটাতে খান। আমি পাতিলে খামু।’

‘রাইতে একবার খাইসি। কিন্তু তোমার খিচুড়ির সুবাস আসতেসে। না খাইয়া উপায় নাই।’

জালাল উদ্দিন তুই থেকে তুমিতে। অবশ্য লাভ হলো না।

‘আমার লগে খাতির জমাইয়া লাভ নাই। আমার শইলে কব্বরের গন্ধ।’

‘কব্বরের গন্ধ বইলা কিছু নাই। তোমার শইলে মাটির গন্ধ। সবার শইলেই থাকে। আমরা সবাই…।’

‘কী চান বলেন। আমি মন্ত্রফন্ত্র করি না। তাবিজ তুমারও নাই।’

‘কালকা কোনো কব্বর খুঁড়বা না?’

‘জে না।’

‘তোমার মনের মইদ্যে কি ইশারা ইঙ্গিত পাও?’

শরিফুল চুপ। স্ট্যাচু হয়ে গেল। এরপর তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। কান খাড়া করে কী যেন শোনার চেষ্টা করল। ভড়কে গেলেন জালাল মাস্টার। আবার কোনো অলক্ষুণে ইশারা পেল নাকি ছেলেটা!

‘কী হইসে! কী হইসে!’

‘চুপ করেন!’

বৃষ্টির কারণে গাছের কোনো পাতা শুকনো নেই। তবু ডালপালার ওপর দিয়ে মড়মড় শব্দটা শুনতে পেল শরিফুল। শুনেই বুঝল কী ঘটতে যাচ্ছে।

তিন সেকেন্ডের ঘটনা। পেছন থেকে গামছা দিয়ে মুখ ঢাকা একটা লোক আছড়ে পড়ল শরিফুলের ওপর। সতর্ক শরিফুল সুরুৎ করে নিজেকে গলিয়ে দিল একটা বনজুঁই ঝোপের আড়ালে। সেই ফুলের কড়া ঘ্রাণ ঝাঁকি দিয়ে গেল জালাল উদ্দিনের মাথায়। কবরস্থানেই বেশি ফোটে নাকি বনজুঁই? জালাল উদ্দিন কখনো কারো হামলার শিকার হননি। তাই হামলার ঘটনায় তিনি হতভম্ব হয়ে ফুলের দিকে তাকিয়ে আছেন। ততক্ষণে গরম খিচুড়ির পাতিলে আছড়ে পড়েছে আততায়ী। আগুনের আঁচে ক্ষণিকের জন্য চকচক করে উঠল দায়ের ধারাল পিঠ। গরম পাতিলে মুখ থুবড়ে পড়ায় দা ফেলে দিল লোকটা। দুহাতে মুখ আঁকড়ে চিৎকার দিতে দিতে চলে গেল।

কিছুই হয়নি মনে করে দুজন আবার রান্নায় মন দিল। ভরপেট খাওয়ার পর শরিফুল দেরি করল না। চালাঘরের এক কোণায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। জালাল উদ্দিনের সহজে ঘুম আসে না। শরিফুলের ঘুম দেখে কয়েকবার ভয়ও পেয়েছেন। ঘুমের মধ্যে নড়াচড়া নেই। নিঃশ্বাসের শব্দও নেই। যেন একটা লাশ পড়ে আছে।

 

দুই সপ্তাহ পর। শরিফুলকে কেউ দেখেনি এ কয়দিন। শরিফুল ছিল গ্রামের লোকজনের ব্যস্ত জীবনের ক্ষুদ্র একটা অংশ। তাই সে যখন ফিরে এলো, তখনও লোকজন বিশেষ খেয়াল করল না। খেয়াল করলেন শুধু জালাল উদ্দিন। যথারীতি রাত বারোটায় হাজির শরিফুলের ডেরায়।

‘কই ছিলা এতদিন?’

‘আমারে মাইরা ফালবার লাগছিল।’

‘তা তো ওইদিনই দেখলাম।’

‘না, এরপরও আইছিল। আমারে জিন্দা থাকতে দিব না।’

‘কারা?’

‘আছে।’

জালাল উদ্দিন রহস্য পছন্দ করেন। তাই কারা শরিফুলকে মারবে জানতে চাইলেন না।

‘গেরামের মাতবররাও চায় না আমি বাঁইচা থাকি। আমি বাঁইচা থাকলে বিরাট সমস্যা।’

জালাল উদ্দিন বুঝতে পারলেন না গ্রামের মাতবর আবার কারা। এখনকার গ্রামে মাতবর প্রকৃতির মানুষজন দেখা যায় না। থাকে কিছু রাজনৈতিক লোকজন। শরিফুলকে নিয়ে তাদের চিন্তিত হওয়ার কথা নয়। তার মানে শরিফুল তাদের কথা বলছে না। বলছে অন্য কারোর কথা।

‘আফনেরে একটা কথা কই। কাউরে কইয়েন না।’

জালাল উদ্দিন নড়েচড়ে বসলেন। রহস্য এবার ভাঙল বলে।

‘ঘটনা হইল আমি আগেভাগে কিছু টের পাই না।’

জালাল উদ্দিনের মনে হলো গোটা পৃথিবীটা যেই লাউ সেই কদু হয়ে গেল। শরিফুলের বিষয়টা কাকতালমাত্র। অলৌকিক কিছু নেই।

কিন্তু এরপর শরিফুল যা বলল তাতে জালাল উদ্দিন আবার চক্কর খেলেন। তার নাকে আবার ধাক্কা দিয়ে গেল বনজুঁই ফুলের কড়া ঘ্রাণ।

‘ঘটনা হইল আমি কবর খুঁড়লেই লোকে মইরা যায়। ধরেন আইজকা একটা কবর খুঁইড়লাম, আইজকাই একজন মরব। যে গেরামে কবর, সেই গেরামে মরণ।’

‘ও মাই গড! কস কী! ঘটনা সিরিয়াস!’

‘এ খবর কেউ জানত না। এখন আপনে জানেন, আরো কেউ কেউ জানে। কেমনে জানসে জানি না। এখন ধরেন, যাগো লোকজন মইরা গেসে, তারা এখন আমারে দোষ দিতাসে। তাদের কথা হইল, আমি কবর খুড়সি দেইখা তাগো আত্মীয় মইরা গেছে। এইটা অবশ্য সইত্য কথা। কিন্তু আমার দোষ কই!’

জালাল উদ্দিন হা করে বসে রইলেন। খিচুড়ির গন্ধ পাচ্ছেন না। পাচ্ছেন শুধু ফুলের গন্ধ। মগজের কোনো বিচিত্র কারসাজি।

জালাল উদ্দিন তাকিয়ে আছেন আগুনের দিকে। আগুনটা যেন মাথার ভেতর ঢুকে সব ঠাণ্ডা করে দিচ্ছে।

‘আপনে কী ভাবতেসেন আমি জানি। আমার দোষ হইল, আমি এইটা জাইনাও কেন কবর খুঁড়ি। কারণ, কব্বর খোঁড়া আমার নিশা! নিশা কেউ ছাড়তে পারে না স্যার!’

জালাল উদ্দিন ধীরে ধীরে মাথা দোলালেন।

‘ঠিক। নেশা ছাড়া কঠিন। ঠিক, একদম ঠিক।’

‘স্যার, কেউ আজীবন বাঁইচা থাকব না। আপনি মরবেন। আমিও। কবরটা আগে খুঁইড়া রাখলে লস তো নাই।’

‘এখন কী করবি?’

‘গেরাম ছাইড়া পলামু। নয়া এলাকায় গিয়া গোরখোদকের কাম নিমু। এই কামের অভাব নাই। এই কাম সহজে কেউ করবার চায় না।’

কিছুক্ষণ নীরবতা। শরিফুল বলল, ‘আমি জানি স্যার, আপনার এখন কী ইচ্ছা করতাসে। আপনের ইচ্ছা হইল ঘটনা আরেকবার টেস্ট কইরা দেখা।’

কথা সত্য। জালাল মাস্টার বিষয়টা পরীক্ষা করে দেখতে চান।

‘ঠিক আছে স্যার। আপনের যখন ইচ্ছা, আরেকটা কব্বর খুইড়া রাখি। টর্চলাইট জ্বালাইয়েন না। এইবার ধরলে আমারেই কব্বর দিব ওরা। হে হে হে।’

জালাল উদ্দিন নিষিদ্ধ আনন্দ পাচ্ছেন। অতিপ্রাকৃতিক বিষয়ের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার সঙ্গে যোগ হয়েছে অলৌকিক মৃত্যুর শিহরণ। শরিফুলের সঙ্গে তিনিও অকারণে হো হো করে হেসে উঠেছেন।

কবর খুঁড়তে খুঁড়তে রাত দুটো বেজে গেল। এরপর দুজন আবার ফিরে এলো চালাঘরের পাশে। ঠাণ্ডা খিচুড়ি গরম করে খেল। জালাল উদ্দিন ভাবলেন কিছুক্ষণ। শরিফুলকে বললেন, ‘এক কাম কর তুই আমার লগে ঘরে চল। বিজ্ঞানী হওয়ার বাসনা ছিল। বিয়াশাদি করি নাই। ঘর ফাঁকা। এইখানে থাকলে আবার কিডা না কিডা তোরে মাইরা…।’

কথা শেষ হওয়ার আগেই চুপ করে গেলেন জালাল উদ্দিন। আশপাশে পোকামাকড়ের ডাকাডাকিও নেই। তাই কেউ চুপিসারে আসলেই টের পাওয়া যায়। জালাল উদ্দিন টের পেলেন। তার মাথা এখন ভালোই কাজ করছে।

‘জালাল মাস্টার এইখানে কী করেন?’

মুখে গামছাবাঁধা মানুষগুলোকে চিনতে পারলেন না জালাল উদ্দিন। তার পেছনে আশ্রয় নিল শরিফুল।

মোট চারজন। দুজনের হাতে দা আর দুজনের হাতে শাবল। শরিফুলের এক হাত শক্ত করে ধরে রাখলেন জালাল। শরিফুল যদিও পালানোর চেষ্টা করছে না।

‘শোনেন আপনেরা। শরিফুলকে মারতে চান ভালো কথা। কিন্তু আপনারা ওর ক্ষমতা সম্পর্কে জানেন না। আমি জানি। এইজন্য রাইত বিরাইতে ওর কাছে আসছি। আপনারা বাঁইচা আছেন, কারণ আপনারা ভাইগ্যবান। আপনারা নিজেরাও এইটা জানেন না।’

জালাল উদ্দিন ঠাণ্ডা গলায় বললেন। গলা যত ঠাণ্ডা, কথা তত সিরিয়াস শোনানোর কথা। কিন্তু লোকগুলো পাত্তা দিল না।

‘আপনে সরেন। হারামিডারে আইজকা শেষ কইরা দিই।’

‘তাইলে কী হইব? গেরামে কেউ মরব না? আমি যদি কই, আপনারা যদি আইজকা এখন বিদায় না হন, তবে একজনরে মরতে হইব…। শরিফুলকে যারা মারতে আসে, তারাও মরে। এখন বলেন, কে মরতে চান?’

বনজুঁইয়ের ঘ্রাণ যত কড়া হচ্ছে জালাল উদ্দিন ততই ঘোরের মধ্যে পড়ে যাচ্ছেন। একটু আগে যে কবর খোঁড়া হয়েছে সেটা লোকগুলো জানে না। এখন সময়মতো কাজটা হলেই হয়।

‘উফফ!’

শব্দটা করল চারজনের একজন। হাত থেকে শাবল পড়ে গেল। অন্ধকারে সেটা হাতড়াচ্ছে।

‘কী হইসে শিমুল!’

‘কী জানি কামড়াইল! সাপ মনে হয়!’

জালাল উদ্দিন তার চোখের দৃষ্টিটা যথাসম্ভব শীতল রাখার চেষ্টা করছেন। শরিফুল এক হাত দিয়ে তার কাঁধ খামছে ধরে আছে।

সে রাতে আর কেউ মারল না শরিফুলকে। চারজন এলেও ফিরে গেল তিনজন। একজন মারা গেল বিষক্রিয়ায়।

 

প্রায় দুই মাস কেটে গেল। ওই রাতের পর শরিফুল ও জালাল উদ্দিন দুজনই আগের গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছেন। দুজন এখন মিঠানদী নামের এক গ্রামে উঠেছেন। জালাল উদ্দিনের এক আত্মীয় আছে এখানে। সেই আত্মীয়র ছেলেমেয়েদের পড়ান। বিনিময়ে থাকা-খাওয়া। শরিফুলের চিন্তা নাই। সে এটাওটা কাজ জুটিয়ে নেয়। সপ্তাহের একদিন জালাল উদ্দিন তার গবেষণা করেন। গবেষণা বলতে শুধু কবর খোঁড়া, অপেক্ষা করা আর নোট নেওয়া।

মঙ্গলবার রাতে কবর খোঁড়া হলে বুধবার সকালে মোটরসাইকেল অ্যাকসিডেন্ট করে মারা গেল এক যুবক। আরেক শনিবার পর পর দুটো কবর খোঁড়া হলো। বরযাত্রীসহ একটা গাড়ি খাদে উল্টে মারা গেল দুজন। দুজনের বাড়ি মিঠানদীতে।

আরেক বৃহস্পতিবার রাতে শরিফুলকে বলেন, ‘পাঁচটা কবর খুড়তে পারবি? নগদ এক হাজার দিমু।’

‘এত মানুষ মাইরা কী মজা পাইতেসেন?’

‘ফাউল কথা কবি না। আমি কোনো খুন-খারাবিতে নাই।’

‘আমি এত কবর খুড়তে পারুম না।’

‘আইচ্ছা যা, তিনটা কবর কাট।’

শরিফুলের ঘাম ছুটে যায় এক রাতে তিনটা কবর খুঁড়তে। পরদিন ভোরেই মৃত্যুর খবর নিতে জালাল উদ্দিন ঘুরতে থাকেন এ বাড়ি ও বাড়ি। সন্ধ্যার পর একটা চায়ের দোকানে ঢোকেন চা খেতে। চা খেয়ে উঠে দাঁড়াতেই একটা ট্রাক এসে দোকানটাকে তছনছ করে উল্টে গেল তার এক হাত সামনে। চমকে উঠলেন জালাল উদ্দিন। বুঝতে পারলেন, এই কবর খোঁড়াখুঁড়ির খেলায় তো তিনি নিজেও মারা যেতে পারেন!

 

‘গবেষণায় তো কিছু বাইর হইতাসে না। কী করি ক তো।’

‘এই কাম আর করুম না। নিশা কাইটা গেসে।’

‘উঁহু। তুই কইলে তো হইব না। আমার গবেষণা শেষ হয় নাই।’

‘কীয়ের গবেষণা করেন? খালি তো লেখেন কে কেমনে মরল, কয়ডা মরল।’

‘তুই বুঝবি না।’

জালাল উদ্দিন বুঝতে পারলেন, শরিফুলের নেশা এখন তাকে ধরেছে। জমি বিক্রির জমানো বেশ কিছু টাকা আছে তার। শরিফুলকে টাকা দিতে সমস্যা হয় না। কিছুদিন পর পর ছেলেটা বেঁকে বসলেও টাকাপয়সা পেলে আবার ঠাণ্ডা। মাঝে মাঝে ধরা খাওয়ানোর হুমকিতেও কাজ হয়। কিন্তু দিনে দিনে শরিফুল যেন নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।

এক শীতের রাতে লেপমুড়ি দিয়ে ভাবতে বসলেন জালাল উদ্দিন। নিজের সঙ্গে বিড়বিড় করে বকে চলেছেন।

‘এইভাবে গবেষণা হইব না। গবেষণার জইন্য আরো কিছু দরকার। কব্বরের দুই তিন মাইলের মইদ্যে মানুষ মরে। যাগো বসতি আছে তারা মরে চব্বিশ ঘণ্টায়। তাইলে ঘটনা দাঁড়াইল.. তাইলে..।’

চিন্তার খেই হারিয়ে ফেললেন জালাল উদ্দিন। তারপর আবার গোড়া থেকে ভাবতে শুরু করলেন। ঘুমাতে পারলেন না সারারাত। ভোররাতে তন্দ্রার মতো হলো। স্বপ্নে দেখলেন তিনি চায়ের দোকানে চা খাচ্ছেন। জানেন একটু পর একটা ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দোকানটার ওপর ঝাঁপ দেবে। কিন্তু তিনি বেঞ্চ ছেড়ে উঠতে পারছেন না।

দুঃস্বপ্নের পালা শেষে বেঘোরে ঘুমালেন বেলা পর্যন্ত। ঘুম ভাঙতেই চোখ ডলতে ডলতে নিজেকে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ গাধা বলে তিরষ্কার করলেন। বার বার বলতে লাগলেন, ‘এত সহজ জিনিসটা মাথায় আসল না ক্যান আগে?’

 

সপ্তাহখানেক পর। শরিফুল নতুন কাজ ধরেছে। এক খামারির বাড়িতে। গরু ছাগলের ঘাস কাটে। এক সপ্তাহ ধরে কবর খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ।

‘ঘাস কাটস ভালা কথা। রাইতে দুয়েকটা কবর কাটলে ক্ষতি কী?’

জালাল উদ্দিনের কথায় কান দিল না শরিফুল।

‘তুই ভাবছিস, তরে ছাইড়া দিমু?’

‘আপনের যা মন চায় করেন। কবর কাটা বন্ধ।’

‘আমার মন চায় তোরে আইজকাই ধরা খাওয়াই দেই। আমি থানা-পুলিশের কথা কইতাসি না। আগের গেরামে যামু আর অগোরে দাওয়াত দিয়া লয়া আমু। যাওনের আগে তোরে এইখানে বাইন্দা রাইখা যামু।’

‘যান। খাড়ায়া আছেন ক্যান। মরতে তো হইবই। মইরাই যাই।’

শরিফুল গরুর খাবার বানানোর কাজ বন্ধ করে মাটিতে বসে পড়ল। জালাল উদ্দিন এগিয়ে এসে শরিফুলের সামনে বসলেন। চোখের দিকে তাকালেন। গায়ে যত জোর ছিল, সব জড়ো করে চড় কষালেন গালে। লুটিয়ে পড়ল শরিফুল। উঠে প্রতিবাদ করতে গিয়েও করল না। জালাল উদ্দিন শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। বুঝতে পারলেন কাজ হয়েছে। ভয় পেয়েছে ছেলেটা।

‘আর একটা কি দুইটা। পাঁচ হাজার টেকা দিমু এইবার। চল আমার লগে।’

টাকার অংক শুনেও প্রতিক্রিয়া দেখাল না শরিফুল। জালাল উদ্দিন পাত্তা দিলেন না। তিনি তার গবেষণার শেষ ফর্মুলা পেয়ে গেছেন।

শরিফুলকে নিয়ে সে রাতেই সিলেটের বাসে উঠলেন জালাল উদ্দিন। সারাটা পথ এলোমেলো সব চিন্তা করতে করতে এসেছেন। ঘুমাননি এক ফোঁটা। শরিফুলের অত চিন্তা নেই। পুরোটা পথ ঘুমিয়ে কাটিয়েছে।

পরদিন সকালে দুয়েকবার গাড়ি বদলানোর পর গন্তব্য হাজির। শরিফুল জীবনেও সিলেট আসেনি। তবে জালাল উদ্দিনের জায়গাটা চেনা। কলেজে থাকতে একবার এসেছিলেন। আগের মতোই নির্জন। চারদিকে উঁচু ঢিবি আর ছড়ানো পাথর। বৃষ্টির সিজনে লোকজন ঘুরতে আসে। এখন কাঁপাকাঁপি শীত। আশপাশে কেউ নাই।

নরম মাটি দেখে একটা খোলা জায়গা বেছে নিলেন জালাল উদ্দিন। আশপাশে কোনো গাছ-গাছালি নেই। নেই কোনো বন্যপ্রাণী।

শরিফুল তার ব্যাগ থেকে ছোট সাইজের শাবলটা বের করল। ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে তৈরি হয়ে গেল কবর। এই শীতেও ঘেমে একাকার। জালাল উদ্দিন ব্যাগ থেকে কলা-পাউরুটি আর পানির বোতল বের করে এগিয়ে দিলেন তার দিকে।

খাওয়া শেষে কবরের পাশেই বসে রইলেন জালাল উদ্দিন। শরিফুল কিছুটা বিরক্ত ও বিভ্রান্ত। জালাল উদ্দিনের গবেষণা বোঝার চেষ্টা করছে। জালাল উদ্দিন তাকিয়ে আছেন দূরের পাহাড়ের দিকে। কুয়াশায় দৃষ্টি বেশিদূর যাচ্ছে না তার।

সন্ধ্যা সাতটা। কবর খোঁড়া হয়েছে বিকাল চারটায়। জালাল উদ্দিনের ব্যাগে এটা ওটা খাবার বোঝাই। একটু পর বের হলো মুড়ি আর গুড়। চুপচাপ খাচ্ছে দুজন। জালাল উদ্দিন গল্প জমানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু শরিফুলের মন নেই। সোয়েটারে শীত মানছে না। তার মধ্যে শরীর ভরা ক্লান্তি।

জালাল উদ্দিন ব্যাগ থেকে কম্বল বের করে দিতেই খুশিতে চকচক করে উঠল শরিফুলের চোখ।

মধ্যরাত। শরিফুল ঘুমাচ্ছে। হালকা নাক ডাকার শব্দ হচ্ছে। বড় করে শ্বাস নিলেন জালাল উদ্দিন। একটা ভুল ভেঙেছে তার। এতদিন যে বনজুুঁইয়ের গন্ধ পেয়ে এসেছেন, সেটা ছিল তার মাথার ভেতর। আশপাশে আগাছাও নেই। তবুও ফুলের কড়া ঘ্রাণ পাচ্ছেন। ঘ্রাণটা মাথায় ঝিম মেরে বসে আছে। একপাশে কাত হলেন জালাল উদ্দিন। দুদিন ধরে ঘুম নেই তার। চোখে রাজ্যের ক্লান্তি কিলবিল করছে। কিন্তু গবেষণার খাতিরে চোখ বন্ধ করছেন না। শেষে ভোরের দিকে আর টিকে থাকতে পারলেন না। ঘুমিয়ে পড়লেন জালাল উদ্দিন।

 

বুকের ওপর ঝুপ করে একটা মাটির দলা পড়তেই জালাল উদ্দিনের ঘুম ভাঙল। নড়তে চড়তে পারছেন না। ঘুমের রেশ না কাটায় ভালো করে তাকাতেও পারছেন না। চোখ ডলতে গিয়ে বুঝতে পারলেন তার হাত বাঁধা। এ পাশ ও পাশও করতে পারছেন না। উঠে বসতে যাবেন তার আগে বুকে প্রচণ্ড বাড়ি। হাড় ভাঙার কড়মড় শব্দটা পরিষ্কার শুনতে পেলেন। ব্যথার চোটে মিনিট খানেক মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না। পরে কোনোমতে শ্বাস নিয়ে বললেন, ‘আমি হইলাম সর্বশ্রেষ্ঠ গাধা। তোর ঘুম দেইখাই বুঝা উচিৎ ছিল রে শরিফুল! তুই তো লাশের মতো ঘুমাস! কিন্তুক গতকাইল তো তুই নাক ডাকছিলি!’

শরিফুলের ঝাপসা অবয়ব চোখে পড়ল জালাল উদ্দিনের। শরিফুলকে অনেক লম্বা মনে হচ্ছে। গায়ের ওপর মাটির দলা পড়তেই বুঝতে পারলেন কেন শরিফুলকে লম্বা লাগছে। তিনি শুয়ে আছেন শরিফুলের খুঁড়ে রাখা কবরে।

‘শোন! শোন! এইটা আমার গবেষণারে গাধা! তুই আমারে মাইরা ফেললে গবেষণা হইব না! তুই আমারে আইজকার দিনটা বাঁচাইয়া রাখ! আমি প্রমাণ কইরা দিমু তোর কবর খোঁড়ার লগে মরণের সম্পক্ক নাই! ওরে শরিফুল! আমি ইচ্ছা কইরা তোরে এখানে আনছি! এইখানে আশপাশের তিন চার মাইলে কোনো বসতি নাই। খালি আমি আছি আর তুই। এখন বল, আমাদের দুইজনের কেউ যদি না মরি তাইলে ঘটনা কী দাঁড়ায়!’

জালাল উদ্দিনের হঠাৎ খেয়াল হলো তার মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না। কথাগুলো তিনি বলছেন কল্পনায়। কারণ শরিফুল সবার আগেই তার মুখ শক্ত করে বেঁধে দিয়েছিল।

 

[লেখাটি ভালো লাগলে আমাদের লেখকদের জন্য নামমাত্র সম্মানি  পাঠাতে পারেন নগদ-এ নম্বর 01407-885500]

storiesকৃগল্প