এক আসামির ভয়ংকর বর্ণনা

বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদকে ক্রিকেটের স্টাম্প আর প্লাস্টিকের মোটা দড়ি (স্কিপিং রোপ) দিয়ে বেধড়ক পিটিয়েছিলেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। একপর্যায়ে অসুস্থ হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়েন তিনি। তাঁকে মাটি থেকে তুলে আবারও পেটাতে থাকেন তাঁরা। ঘণ্টা কয়েক পর বমি করতে শুরু করেন আবরার। তিনবার বমি করার পর নিস্তেজ হয়ে যান।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এই বীভৎস হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়েছেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সমাজসেবাবিষয়ক উপসম্পাদক ইফতি মোশাররফ ওরফে সকাল। তাঁর কক্ষেই ৬ অক্টোবর রাতে শিবিরকর্মী সন্দেহে পেটানো হয় ইলেকট্রনিকস অ্যান্ড ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদকে। এই ঘটনায় প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেন ইফতি। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে মহানগর হাকিম খন্দকার ইয়াসির আহসান চৌধুরীর কাছে তিনি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

 

আবরার হত্যার ঘটনায় গতকাল পর্যন্ত ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাঁদের মধ্যে ইফতিই প্রথম ব্যক্তি, যিনি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিলেন। ঘটনাটি তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র  জানিয়েছে, ইফতিই আবরারকে তাঁর কক্ষ থেকে ডেকে আনা থেকে শুরু করে পুরো হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দেন।

জিজ্ঞাসাবাদে ইফতি বলেছেন, ৪ অক্টোবর বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান ওরফে রবিন শেরেবাংলা হল ছাত্রলীগের একটি মেসেঞ্জার গ্রুপে একটি নির্দেশনা দেন। এতে বলা হয়, আবরার শিবির করে, তাকে ধরতে হবে। এরপর মেসেঞ্জার গ্রুপে সাড়া দেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের আইনবিষয়ক উপসম্পাদক অমিত সাহা। আবরার তখন বাড়িতে থাকায় তিনি ইফতিকে বলেন, ‘ওকে বাড়ি থেকে ফিরতে দেন।’

আবরার ফাহাদকে গত রোববার রাতে পিটিয়ে হত্যা করেন বুয়েট ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মী। ইফতি আদালতে বলেন, ৬ অক্টোবর রাত আটটার কিছু পর আবরারকে ২০১১ নম্বর কক্ষে নিয়ে আসা হয়। আবরারের দুটি মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপও সঙ্গে আনা হয়। তাঁর রুমমেট বুয়েট ছাত্রলীগের উপদপ্তর সম্পাদক মুজতবা রাফিদ একটি মোবাইল ফোন এবং মেকানিক্যাল ইঞ্জনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম ওরফে তানভীর আরেকটি মোবাইল ফোন চেক করেন। একই বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের মুনতাসির আল জেমি আবরারের কাছ থেকে তাঁর ল্যাপটপের পাসওয়ার্ড নিয়ে খুলে চেক করেন।

বুয়েটের শেরেবাংলা হলের এই কক্ষে আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। জবানবন্দিতে ইফতি জানিয়েছেন, আবরারের ডিভাইসগুলো তাঁরা যখন চেক করছিলেন, তখন মেহেদী হাসান এবং বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক মো. মেফতাহুল ইসলাম ওরফে জিয়ন (নেভাল আর্কিটেকচার মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র) কক্ষে আসেন। মেহেদী তাঁদের বুয়েটে কারা কারা শিবির করে তা আবরারের কাছ থেকে বের করার জন্য নির্দেশ দেন। এ সময় মেহেদী বেশ কয়েকটি চড় মারেন আবরারকে।

শেরেবাংলা হলের যে কক্ষে আবরারকে পেটানো হয়, তার আশপাশে বেষ্টনী দেওয়া হয়। ইফতি আদালতকে বলেন, ওই কক্ষে তখন ক্রিকেটের কোনো স্টাম্প ছিল না। বাইরে থেকে তখন কেউ একজন স্টাম্প নিয়ে আসেন। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সামসুল আরেফিন ওরফে রাফাত স্টাম্প এনে তাঁর হাতে দেন। আবরারের কাছ থেকে কথা বের করার জন্য স্টাম্প দিয়ে চার-পাঁচটি আঘাত করেন ইফতি। এতে স্টাম্পটি ভেঙে যায়। বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক অনিক সরকার (মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র) স্টাম্প দিয়ে আবরারের হাঁটু, পা, পায়ের তালু ও বাহুতে মারতে থাকেন। এতে আবরার উল্টাপাল্টা কিছু নাম বলতে শুরু করেন। তখন মেফতাহুল আবরারকে চড় মারেন এবং স্টাম্প দিয়ে হাঁটুতে বাড়ি দেন। এ সময় মেহেদী মুঠোফোনে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাসেলের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।

ইফতি আদালতকে বলেন, রাত সাড়ে ১০টার দিকে তিনি ক্যানটিনে খেতে যান। মিনিট বিশেক পর ফিরে এসে দেখেন, আবরার অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তিনি মেঝেতে শুয়ে আছেন। তিনি তখন আবরারকে ধমক দিয়ে উঠে দাঁড় করান। কয়েকটি চড় মারেন। ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র মুজাহিদুর রহমান তখন কক্ষে থাকা স্কিপিং রোপ দিয়ে আবরারকে মারেন। ইফতি আবার স্টাম্প দিয়ে আবরারের হাঁটু ও পায়ে আঘাত করেন। তাবাখখারুল তখন চড়-থাপ্পড় মারেন।

ইফতি ঘটনার বর্ণনা দেওয়ার এই পর্যায়ে বলেন, রাত ১১টার দিকে অনিক সরকার আবার কক্ষে আসেন। হঠাৎ অনিক স্টাম্প দিয়ে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে এলোপাতাড়ি শতাধিক আঘাত করেন। অনিক খুবই অনিয়ন্ত্রিতভাবে আবরারকে মারতে থাকেন। তাঁর মারা দেখে সবাই ভয় পেয়ে যান। আনুমানিক রাত ১২টার পর অনিক আবরারকে মারা থামিয়ে কক্ষের বাইরে যান।

ইফতি বলেছেন, তখন আবরার অসুস্থ হয়ে পড়ে ছিলেন। তিনি জানান, তাঁর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। তখন আবরারের মাথার নিচে দুটি বালিশ দেন তিনি। এর কিছুক্ষণ পরই আবরার বমি করেন। মুঠোফোনে বিষয়টি অনিককে জানানো হলে তিনি আবরারকে গোসল করিয়ে হাতে-পায়ে মলম লাগিয়ে দিতে বলেন। এ সময় আবরার দ্বিতীয়বার বমি করেন। তখন আবরারের কক্ষ থেকে তাঁর কাপড়চোপড় নিয়ে আসা হয়। তখন মেহেদী আবরারকে দেখে বলেন, ‘ও নাটক করছে’।

ইফতি বলেন, এরপর আবরারকে ২০০৫ নম্বর কক্ষে নিয়ে শুইয়ে দেওয়া হয়। এ সময় অমিত খুদে বার্তা পাঠালে তিনি সবকিছু জানতে চান এবং আবরারকে আরও মেরে আরও তথ্য বের করতে বলেন। আবরারের অবস্থা খুব খারাপ জানালে অমিত তাঁকে হল থেকে বের করে দিতে বলেন। এর কিছুক্ষণ পর মেহেদী ও অনিক ২০০৫ নম্বর কক্ষে আসেন। আবরারকে দেখে তাঁরা বলেন, ‘ও ঠিক আছে।’ এরপর তাঁরা চলে যান।

আবরার ফাহাদের মরদেহ তাঁর বাড়িতে পৌঁছালে কান্নায় ভেঙে পড়েন তাঁর মা ও ছোট ভাই। ইফতি বলেন, এ সময় আবরার আবার বমি করেন। মেহেদী তখন আবরারকে পুলিশের হাতে দেওয়ার জন্য নিচে নামাতে বলেন। ১৭ ব্যাচের ছেলেরা আবরারকে নিচে নামানোর চেষ্টা করেন। ব্যর্থ হলে তোশকসহ আবরারকে ধরে দোতলা ও নিচতলার সিঁড়িতে নামিয়ে রাখেন। তখন আবরার বলছিলেন যে তাঁর খুব খারাপ লাগছে। সাধারণ সম্পাদক রাসেল তখন নিচে নেমে হলের প্রধান ফটকে পুলিশের সঙ্গে কথা বলছিলেন। এ সময় মুনতাসির দৌড়ে এসে বলেন, আবরারের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। ইফতি তাঁকে মালিশ করতে বলেন। ইসমাইল ও মনির তখন অ্যাম্বুলেন্সে ফোন দেন। অ্যাম্বুলেন্স আসতে দেরি হওয়ায় তামিম বাইক নিয়ে বুয়েট মেডিকেলের চিকিৎসক নিয়ে আসেন। চিকিৎসক আসার পরপরই অ্যাম্বুলেন্স আসে। চিকিৎসক সিঁড়িতে আবরারকে দেখে বলেন, ‘ও মারা গেছে।’ পরে ইফতি একটি কক্ষে গিয়ে শুয়ে থাকেন। সেখান থেকে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে।

এর আগে গতকাল বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ও বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের আইনবিষয়ক উপসম্পাদক অমিত সাহাকে সবুজবাগ থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এ ছাড়া মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র শামসুল আরেফিন ওরফে রাফাত ও ওয়াটার রিসোর্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র মিজানুর রহমানকে গাজীপুর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।