পয়লা বৈশাখের উৎসব দুই বাংলায় একই দিনে হোক : তসলিমা নাসরিন

  পয়লা বৈশাখের উৎসব দুই বাংলায় একই দিনে হোক : তসলিমা নাসরিন

তসলিমা নাসরিন :  পয়লা বৈশাখের উৎসব দুই বাংলায় একই দিনে হোক। হ্যাঁ, একই দিনে হোক। আজ বাংলাদেশে পয়লা বৈশাখ, কাল পশ্চিমবংগে, এর কোনও মানে হয় না।

পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে বাংলাদেশে পয়লা বৈশাখের উৎসব বেশি ঘটা করে হয়, কিন্তু উগ্রপন্থী বাঙালি মুসলমানরা বাংলাদেশ থেকে বাঙালি সংস্কৃতি প্রায় ধ্বংস করে দিয়ে আরবীয় সংস্কৃতি আমদানি করছে বলে ভবিষ্যতে আদৌ এই ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি উৎসবটি বাংলাদেশে পালন করা সম্ভব হবে কি না আমার সন্দেহ। এমনিতে বাংলাদেশে পয়লা বৈশাখের তারিখ বদলে দিয়েছে এরশাদ সরকার। ১৪ই এপ্রিল তারিখটিতে প্রতি বছর বাংলা নববর্ষ পালন করার সরকারি আদেশ জারি হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি হিন্দুরা যা পালন করছে, তা থেকে যেন একটু বদল হলেই মুসলমানিত্বটা ভালো বজায় থাকে।

কী আর বলবো, মূর্খতার কোনও কুল কিনারা নেই! পাকিস্তানি শাসকরা চাইতো বাঙালি হিন্দু আর বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতিতে বিভেদ বাড়ুক। ওরা বিভেদ না বাড়াতে পারলেও বাংলাদেশে ওদের যে অনুসারীদের ওরা রেখে গেছে, তারাই বিভেদ বাড়াচ্ছে এখন। তারাই বাংলা ক্যালেণ্ডারকে মুসলমানের ক্যালেণ্ডার বানিয়েছে। বাংলা ক্যালেণ্ডারের পেছনে মোগল সম্রাট আকবরের অবদান ছিল বলে আকবরের ধর্মের কিন্তু কোনও অবদান ছিল না। কেবল কৃষিকাজের, কেবল ফসলের, কেবল খাজনা আদায়ের হিসেব রাখতে হিজরি ক্যালেণ্ডারের বদলে বাংলা ক্যালেণ্ডার সুবিধে বলেই ওই ক্যালেণ্ডারের সূচনা করা হয়েছিল।

আমার নানি চৈত্র সংক্রান্তিতে তেতো রাঁধতেন। নানি রাঁধতেন, কারণ নানির মা রাঁধতেন। নানির মা রাঁধতেন, কারণ নানির মা’র মা রাঁধতেন। নানির মা’র মা রাঁধতেন, কারণ নানির মা’র মা’র মা রাঁধতেন। চৈত্র সংক্রান্তিতে আমার খালারা বা মামিরা কিন্তু এখন আর তেতো খাবার রাঁধেন না, তেতো খাবার খানও না। চৈত্র সংক্রান্তিতে গ্রামে গ্রামে চড়ক পুজো হত। আমার দাদারা বাঁশবন পার হয়ে চড়ক পুজো দেখতে যেতো। ওখানে বাঁশ – দড়ির খেলা দেখতো হাঁ করে।

ওই দিনই লোকনাথ পঞ্জিকা কিনতো সবাই। আমার দাদারাও। বৈশাখের প্রথম দিনে নানারকম মাটির কাজ, বেতের কাজ, কাঠের কাজ, শোলার কাজের মেলা বসতো। পশ্চিমবঙ্গে একই দিনে বৈশাখের উৎসব হত। বাংলাদেশে হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খিস্টান সব বাঙালিই বৈশাখের উৎসবে অংশ নিত। নানারকম খেলা প্রতিযোগিতা হত গ্রামে, নৌকা বাইচ, কুস্তি, লাঠি খেলা, এসব।

আমাদের মফস্বল শহরে আমরা ছোটরা সকাল থেকে বাজাতাম বাঁশি-বেলুন। বিকেলে বিন্নি ধানের খই, চিনির হাতি ঘোড়া, মাটির পুতুলের মেলায় যেতাম।
সেই সবও কি আর আছে আগের মতো! এখন শুনেছি যা হওয়ার শহরেই হয়, যারা বাঙালি সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করছে, সেই শিল্পী সাহিত্যকদের দলটিই ভোরবেলা গান গায় রমনার অশ্বথ্ব তলায়। সারা দিন গাইতে থাকে জীর্ণ পুরাতন যাক ভেসে যাক, যাক ভেসে যাক, যাক ভেসে যাক। রমনায় সংস্কৃতমনা, মুক্তমনা বাঙালির ভিড় বাড়ে বৈশাখের ভোর থেকেই। পান্তাভাত, কাঁচা লংকা, ইলিশ মাছ খাওয়ার ধুম পড়ে।

সুতি শাড়ি আর পাজামা পাঞ্জাবিতে ছেয়ে যায় রমনা। ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানট নামের বিখ্যাত এক গানের দল বর্ষবরণ অনুষ্ঠান করছে রমনায়। পাকিস্তানি শাসকের অত্যাচার সয়েছে। তার চেয়েও বেশী অত্যাচার সইছে স্বাধীন বাংলাদেশে। মুসলমান মৌলবাদিরা গ্রেনেড ছুঁড়েছে পয়লা বৈশাখে, ছায়নাটের গানের অনুষ্ঠানে। তারা পছন্দ করে না ইসলামি সংস্কৃতির বাইরে অন্য কোনও সংস্কৃতি। বিশেষ করে বাংলা সংস্কৃতি।

পয়লা বৈশাখে ছায়ানট ছাড়াও উল্লেখযোগ্য উৎসব ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে সকালে এই শোভাযাত্রাটি বের হয়ে শহরের বিভিন্ন সড়ক ঘোরে। রং-বেরঙের মুখোশ, বিশাল বিশাল কাগজের বাঘ ভালুক হাতি ঘোড়া থাকে শিল্পীদের হাতে হাতে। ঢাক ঢোলক বাজে। আটপৌড়ে শাড়ি, ধুতি পরে ছেলে মেয়েরা নাচে। রাস্তা আগের রাতেই মুড়ে দেওয়া হয় চমৎকার আল্পনায়। এই বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা দেখার জন্য আজও ভীষণ ভিড়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই নিরাপদ জায়গাটুকুতেই। শুনেছি সোনারগাঁয়ে নাকি বউমেলা হয়। সিদ্ধেশ্বরী দেবীর পুজো করতেই মূলত লোক আসে।মনের গোপন বাসনা পুরণের আশায় নাকি মেয়েরাই বেশি আসে। পাঁঠাবলির রেওয়াজও নাকি আছে।

সোনারগাঁর কাছেই আরেক অঞ্চলে ঘোড়ামেলাও হয়। কোনও এক সময় কোনও এক লোক নাকি ঘোড়ায় করে এসে নববর্ষের দিনটিতে সবাইকে প্রসাদ খাওয়াতেন। লোকটি মারা যাওয়ার পর তাঁর স্মৃতিস্তম্ভ বানিয়েছে গাঁয়ের লোক। প্রতিবছর পয়লা বৈশাখে ওই স্মৃতিস্তম্ভে একটি মাটির ঘোড়া রাখা হয়। আর ওটির আশেপাশেই রীতিমত হৈ হৈ করে মেলা বসে যায়। এ মেলার অন্যতম আকর্ষণ যারাই মেলায় আসে, সবাইকে কলাপাতায় খিচুড়ি খাওয়ানো। এক দিনের এ মেলায় হাজারো লোকের সমাগম ঘটে। এই ঘোড়ামেলায় শুনেছি নাগরদোলা, পুতুল নাচ আর সার্কাসও থাকে। কীর্তন হয় মধ্যরাত পর্যন্ত। এখন জানি না কীর্তন আগের মতো হয় কি না বা এখনও আদৌ ওই ঘোড়ামেলাটাই হয় কি না। আর হলেও জানিনা ঠিক কতদিন হতে পারবে এসব মেলা।

বাংলাদেশে দু’ যুগের বেশি হল বাঙালি সংস্কৃতিকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করে আরবীয় সংস্কৃতি আনার যে কাজ জীবন –মরণ পণ করে চালাচ্ছে ধর্মান্ধ মূর্খরা, তাতে তারা অবিশ্বাস্য রকম সার্থক। একশয় একশ না পেলেও ষাট সত্তরের কাছাকাছি নম্বর জুটে যাচ্ছে। ধর্মের রীতি টুকু বাদ দিলে, সব ধর্মের বাঙালির আচার অনুষ্ঠান একই ছিল এতকাল। কিন্তু আচার অনুষ্ঠানেও ধর্ম আনা হচ্ছে।একটা অসাধারণ সংস্কৃতিকে, পূর্বপুরুষের ঐতিহ্যকে, নিজ পরিচয়কে খৎনা করে দেওয়া হচ্ছে চোখের সামনে। আর খৎনা করার হাজমগুলো, হাতে ছুরি নিয়ে তাণ্ডব নৃত্য করছে। মুখ বুজে হাজমদের নাচ দেখছে সবাই। দেশ হাজমে গিজহিজ করছে। নতুন প্রজন্মের অনেকে হয়তো দেখেইনি হালখাতা, গ্রামে গ্রামে পয়লা বৈশাখের মুড়ি মুড়কির, পিঠেপুলির মেলা।

আমি বাংলাদেশের হাজমের নাচ বন্ধ করতে পারবো না। ও দেশ থেকে আজ চব্বিশ বছর হল আমাকে বের করে দেওয়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের পয়লা বৈশাখের উৎসব আরও বর্ণাঢ্য করতেও আমি পারবো না।

ও রাজ্য থেকেও আমাকে বের করে দেওয়া হয়েছে। দু’ অঞ্চলেই মূর্খদের সংখ্যা প্রচুর। ওই মূর্খদের খুশি করতেই নাকি আমার উপস্থিতি বাংলায় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মূর্খরাই মূর্খদের খুশি রাখে। আমি আজ শুধু একটি আবেদনই করছি– দুই বাংলায় দুটো ভিন্ন দিনে নয়, একই দিনে, একই তারিখে, পয়লা বৈশাখটা অন্তত করা হোক। বাঙলা ক্যালেণ্ডারের পয়লা বৈশাখ গ্রেগরীয় ক্যালেণ্ডারে কখনও তেরো, কখনও চৌদ্দ, কখনও পনেরো। কিন্তু বাংলাদেশে চৌদ্দ তারিখকে পয়লা বৈশাখের জন্য শেকল দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়েছে।

ঈদ রোজাগুলোর তারিখ কিন্তু বাঁধা হয়নি। হিজরি ক্যালেণ্ডার অনুযায়ীই সেসব পালন করা হয়। তবে বুড়ো হাজম ডেকে বাংলা ক্যালেণ্ডারের মুসলমানি করাটার দরকার কী ছিল! হিন্দু থেকে পৃথক হওয়ার জন্য ভিনদেশি সংস্কৃতি আনা, বাঙালি সংস্কৃতি বিলুপ্ত করা, আরব না হয়েও জোর করে আরব হওয়ার চেষ্টা –এসবই কি সত্যিকারের মুসলমান হওয়ার রাস্তা! নিজেদের ঐতিহ্যের সবটুকু বিসর্জন দিয়ে অন্য অঞ্চলের সংস্কৃতিকে নিজের সংস্কৃতি বলে বরণ করায় কোনও গৌরব নেই। ওই আরব দেশে বসে কোনও এক কালে কোনও এক লোক ধর্ম রচনা করেছিল, যে ধর্মের তুমি অনুসারি কারণ ওই অঞ্চলের কিছু লোক তোমার অঞ্চলে তাদের ধর্মকথা শোনাতে ঢুকেছিল, হয় তোমার পূর্বপুরুষ বা পূর্বনারী ওদের কথায় ও কাজে মুগ্ধ হয়ে ভিনদেশি মরুভূমির ধর্ম বরণ করেছে, নয় নিচু জাত বলে বা গরিব বলে তাদের নিজেদের ধর্মের কতিপয় দুষ্ট লোক দ্বারা উপেক্ষিত আর শোষিত হতে হতে ধর্মান্তরিত হয়েছে।

আরব দেশেও কিন্তু ‘ভিক্ষুক, মিসকিন’ বলে তোমাকে ঘেন্না ছিটোচ্ছে আরবরা।কবে যেন আট জন বাঙালি মুসলমানকে জনসমক্ষে জবাই করলো। কারা জবাই করলো মুসলমানদের? মুসলমানরা। যা তোমার বাপ দাদার সংস্কৃতি নয়, তাকেই তোমার বাপ দাদার সংস্কৃতি হিসেবে লুফে নিচ্ছ আজ। এমন নয় যে ভালোবেসে নিচ্ছ, ভয়ে নিচ্ছ, বিভ্রান্তিতে নিচ্ছ। আর পরিণত হচ্ছ নামহীন, ঠিকানাহীন, পরিচয়হীন একটা ধর্মের পিণ্ডে। ময়ুরপুচ্ছে কাকের লেজ লাগাচ্ছো মুসলমান হওয়ার জন্য। না, এই অসততা করে তুখোড় মুসলমান হয়তো হওয়া যায়, ভালো মানুষ হওয়া যায় না।

দুই বাংলায় পয়লা বৈশাখের তারিখটা এক হলে অন্তত মনে হবে, উৎসবটা বাঙালির উৎসব। দুই দেশের বাঙলা একাডেমীর কর্তারা অন্তত পয়লা বৈশাখের উৎসবটিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কথা বলুন। অন্তত একদিনের জন্য হলেও না হন হিন্দু, না হন মুসলমান। অন্তত একদিনের জন্য একবার একটু বাঙালি হন। বাংলাদেশের বাংলা একাডেমি এবং হাসিনা সরকার, শুনছেন? ক্যালেণ্ডারের কোনও ধর্ম নেই, লিঙ্গ নেই। ধর্মহীন, লিঙ্গহীন ক্যালেণ্ডারকে কুপিয়ে মুসলমান বানিয়েছেন মনে করছেন, আসলে ও মুসলমান হয়নি। ও এখনও আগের সেই ধর্মহীন লিঙ্গহীন বাংলা ক্যালেণ্ডারই রয়ে গেছে। ক্যালেণ্ডারকে মানুন। আল্লাহ জানেন যে আপনারা বাঙালি, এ কোনও লজ্জার কথা নয়। আরবরাও জানে আপনারা বাঙালি, নকল আরব সাজার চেয়ে ভালো বাঙালি হন, এতে আরবদের শ্রদ্ধা পাবেন। তা না হলে যে মিসকিন, সে চালচুলোহীন নাম পরিচয়হীন মিসকিনই জীবনভর রয়ে যাবেন।

ফেসবুক থেকে

তসলিমা নাসরিনতসলিমা নাসরিনের কলাম