প্রাচ্যের ডান্ডি নামে খ্যাত নারায়ণগঞ্জ জনপদ হিসেবে আজ হতে তিন হাজার বছরের প্রাচীন। আর এই জেলার পাচঁটি থানার (সদর, বন্দর,আড়াইহাজার, রুপগঞ্জ ও সোনারগাঁও ) মধ্যে সর্বাধিক পুরাতন ও ঐতিহাসিকভাবে বিখ্যাত স্থান ‘সোনারগাঁও । একদা যা ছিল বাংলার রাজধানী। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসনামলে শীতলক্ষ্যা নদীর দুই পাড়ে কলকারখানা ও আধুনিক নগরী গড়ে ওঠে। বানিজ্যিক সুবিধার্থে গড়ে ওঠে বৃহৎ নদীবন্দর। যোগাযোগ ঘটে সুদূর প্রাচ্য -পশ্চিম এশিয়ার সাথে। নারায়ণগঞ্জের নামকরণ নিয়ে একাধিক তথ্য পাওয়া যায়। জানা যায় যে, ১৭৬৩-১৭৬৬ সালের দিকে হিন্দু সম্প্রদায়ের জনৈক নেতা বিকললাল পান্ডে এই অঞ্চলে বসবাস করতেন। যিনি বেণুর ঠাকুর কিংবা লক্ষ্মী নারায়ণ ঠাকুর নামেই সর্বাধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে এই অঞ্চলের মালিকানা গ্রহন করেন। এরপর তিনি দেবতা প্রভু নারায়ণের সেবার ব্যয়ভার নির্বাহের নিমিত্তে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে অবস্থিত বাজারটিকে ইচ্ছাপত্রের মাধ্যমে ‘দেবোত্তর’ সম্পত্তি ঘোষণা করেন। উক্ত দেবতা নারায়ণের নামেই এই অঞ্চেলের নামকরণ করা হয় নারায়ণগঞ্জ। কেউ বা মত পোষণ করেন দেবতার নামে নয় বরং নিজের নামেই এলাকার নাম হয় ‘ নারায়ণগঞ্জ’। আর ১৮৭৬ সালে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা, ১৮৮২ সালে মহকুমা এবং ১৮৮৪ সালে জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
ঢাকা শহর থেকে আনুমানিক ২৬ ও নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রায় ১১ কি: মি: পূর্বদিকে প্রাচীন ব্রক্ষপুত্র নদীর বাম তীরবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত সোনারগাঁও এর প্রাচীন নাম ছিল সুবর্নগ্রাম। প্রাচীনকালের সুবর্ণগ্রাম একটি সমৃদ্ধশালী জনপদ ছিল বলে নানা সূত্রে জানা যায়। আর এর পূর্বে মেঘনা নদী, পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরী নদী এবং পূর্বে ব্রহ্মপুত্র নদ দ্বারা সীমাবদ্ধ প্রাচীন সুবর্ণ গ্রামের ইসলামী নাম ছিল সোনারগাঁও। সোনারগাঁও নামের উৎপত্তি সম্পর্কে কেউ কেউ বলেন যে, বাংলার বার ভূইয়াদের নেতা ঈসাঁখানের স্ত্রীর নাম ছিল সোনাবিবি এবং তার রাজধানী শহর। ঈসাখান তার পত্নীর নামানুসারে এই শহরের নাম হয় সোনারগাঁও। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে স্থানীয় রাজা দনুজ মর্দন দশরথ দেবের রাজধানী ছিল এটি। সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজশাহ ১৩০৫ সালে এখানে একটি টাকশাল স্থাপন করেন, ফলে এটি মধ্যযুগীয় বাংলার একটি অন্যতম শহর হিসেবে আর্বিভূত হয়। পরবর্তীকালে একশতকেরও বেশি সময় এটি টাকশাল হিসেবে চালু ছিল। গিয়াস উদ্দিন বাহাদুর শাহ ১৩২২ সালে এটিকে তার আঞ্চলিক প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন।বাংলার সুলতান ফখরউদ্দিন মুবারক শাহ ১৩৩৮-১৩৪৯ সালে এবং তার পুত্র ইখতিয়ার উদ্দিন গাজী শাহের ১৩৪৯-৫২ শাসনামলে এটি একটি স্বাধীন সালতানাতের রাজধানী শহর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। মুগলদের আমলে সুবা বাংলার ১৯টি সরকারের মধ্যে এটি ছিল অন্যতম। সপ্তদশ শতকের দিকে বিখ্যাত বারো ভূইয়ার অর্ন্তভুক্ত ঈসা খান ও পুত্র মুসা খানের (১৬১১খ্রিঃ) অধীনে শহরটি পুনরায় বাংলার রাজধানীর মর্যাদা ফিরে পায়। সুবা বাংলার রাজধানী হিসেবে ঢাকার আত্নপ্রকাশ এবং ব্রহ্মপুত্র -মেঘনা নদীর গতিপথ পরিবর্তনের ফলে শহরটির ক্রমাবনিত ঘটে। ঊনিশ শতকের দিকে এখানেই পানাম-নগর নামে আরেকটি শহর গড়ে ওঠে। মধ্যযুগে সোনারগাঁও এ পরিখাসহ দুর্গ-প্রাচীর -বেষ্টিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা, রাস্তাঘাট ,বাজার ছিল এবং সব ধরনের পণ্যদ্রব্য সংগ্রহ ও বন্টনের জন্য বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হত। দক্ষিণ-পূবাঞ্চলীয় দেশগুলোর সঙ্গে এর সরাসরি বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল। খাসা নামে পরিচিত একধরনের মসলিন কাপড় এবং দাস ও দাস ও নপুংসকের বিশাল বাজারের জন্য শহরটি বিশেষভাবে পরিচিত ছিল। বুখারার সুফি সাধক শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা এখানে একটি খানকাহ ও মাদ্রাসা স্থাপন করেন এবং তারই পৃষ্ঠপোষকতায় শহরটি শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে খ্যাতিমান হয়ে ওঠে। ১৩৪৫ সালে বাংলার সুলতান ফখরউদ্দিন মুবারক শাহের শাসনামলে (১৩৩৮-৫০ খ্রিঃ) মরক্কোর বিশ্ববিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা তৎকালীন বাংলার রাজধানী ও প্রধান প্রশাসনিক কেন্দ্র এই সোনারগাঁও ভ্রমন করেছিলেন।পরবর্তী সোনারগাঁও থেকে তিনি জাহাজে চড়ে চীনের পথে বর্তমানে ইন্দোনেশিয়ার জাভা গমন করেন। তাছাড়া পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে চীনদেশীয় দূতগণ সোনারগাঁও ভ্রমন করেছিলেন।বার ভূইয়াদের নেতা ঈসা খান মুগলদের নিকট পরাজিত হলে সোনারগাঁও মুগলদের অধিকারে চলে আসে। পরবর্তীতে বাংলার রাজধানী সোনারগাঁও এর পরিবর্তে ১৬১০ সালে মুগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে আধুনিক ঢাকা নগরী বাংলাদেশের রাজধানী হিসেবে গড়ে ওঠে। ফলে এই সোনারগাঁও ধীরে ধীরে শ্রীহীন হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে মোগল ও ইংরেজ শাসনামলে বহু সংখ্যক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবার এই স্থান ত্যাগ করে অন্যান্য স্থানে চলে যায়। তদস্থলে এই অঞ্চলের হিন্দুরা ধনেমান বিদ্যাবুদ্ধিতে বিশেষ সমৃদ্ধ হয়ে ওঠেন। আর তাদের এ সময়ের অসংখ্য ইমারতের অস্তিত্ব সোনারগাঁও এর সবর্ত্র বিশেষ করে পানাম এলাকায় আজও দেখা যায়।
নারায়ণগঞ্জ জেলা ও সোনারগাঁও অঞ্চলের প্রাচীন স্থাপত্যকীর্তি ও প্রত্নসম্পদ:
১. দমদমা বা দুর্গ। সোনারগাঁও এর বেশির ভাগ পুরাকীর্তির চিহ্ন বর্তমান কালের দমদমার অভ্যন্তরেই দেখা যায়। যেমন: সুলতান জালাল উদ্দিন ফতেহ শাহ এর মসজিদ, শাহ ইব্রাহিম দনিশমন্দ প্রমূখদের মাযার, মান্না শাহর মাযার, সংলগ্ন শাহী কবরখানা, নহবত খানা, টাকশাল ও প্রাচীন ইমারতের ধ্বংসাবশেষ।
২. সোনারগাঁও কলেজের পিছনের পাকা কবরসমূহ ও প্রাচীন মসজিদের ধ্বংসাবশেষ।
৩. ইউসূফগঞ্জ মসজিদ ( সোনারগাঁও বাস স্ট্যান্ড থেকে প্রায় ৪০০ মিটার পশ্চিমে অবস্থিত।
৪. বাংলার সুলতান গিয়াস উদ্দিন আযম শাহের (১৩৮৯-১৪১১খিঃ) মাযার । মোগরাপাড়া খানকা শরীফ থেকে প্রায় ৩ কি:মি: উত্তর-পশ্চিমে খালের দক্ষিণ পাড়ে অবস্থিত।
৫. পাচঁপীরের মাযার ও মসজিদ (১৮৮০ খ্রি:) টি গিয়াসউদ্দিন আযম শাহের মাযার থেকে ৫০০ মিটার পশ্চিমে অবস্থিত।
৬. গোয়ালদি মসজিদ ( ১৫১৯ খ্রিঃ নির্মিত) ।
৭. শাহ আব্দুল হামিদ মসজিদ ( ১৭০৫ খিঃ নির্মিত) ( গোয়ালদি মসজিদের ১৪৫ মিটার উত্তরে)
৮. পানাম শহর ও পুল (সোনারগাঁও শহরের উত্তর-পূর্বকোনে ও পঙ্খিরাজ নামক একটি ছোট নদীর দক্ষিণ তীরে পরিখাবেষ্টিত একটি উপশহর গড়ে ওঠেছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পনীর শাসনামলে। শহরের একটিমাত্র প্রধান সড়ক ছিল এবং এর দুপাশে গড়ে ওঠেছিল আকাশচুম্বি সব অট্রালিকা।
৯. কদম রসুল ও তোরণ-ইমারত (নবীগঞ্জ) । জানা যায় ঈসা খানের সেনাপতি মাসুম খান কাবুলী এখানে ১৫৮০ খ্রিঃ বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ সা: এর পদচিহ্ন সম্বলিত ইমারতটি নিমার্ণ করেছিলেন।
১০. হাজী বাবা সালেহর মসজিদ বা শাহী মসজিদ, বন্দর থানা। কদম রসূল থেকে ১.৫ কি:মি: দক্ষিণে শীতলক্ষ্যা নদীর বাম তীরে সুলতান জালালুদ্দিন ফতেহ শাহ ১৪৮২ খ্রিঃ নিমার্ণ করেন।
১১. হাজী বাবা সালেহর মসজিদ ও মাযার। বন্দর শাহী মসজিদ থেকে ১ কি:মি: দক্ষিণে অবস্থি হাজী বাবা সালেহ কতৃর্ক ১৫০৪ খ্রিঃ নির্মিত হয়েছে।
১২. সোনাকান্দা দুর্গ ( হাজী বাবা সালেহ মসজিদ ও মাযার থেকে ১.৫ কি:মি: দক্ষিণে শীতলক্ষ্যা নদীর বাম তীরে অবস্থিত। (মুগল আমল)।
১৩. হাজীগঞ্জ দুর্গ ( নারায়ণগঞ্জ শহরের উত্তর-পূর্বদিকে হাজীগঞ্জ এলাকায় মুগল আমলের একটি দুর্গ রয়েছে।
১৪. হাজীগঞ্জ চার গম্বুজ মসজিদ (হাজীগঞ্জ দুগের্র উত্তর-পূর্বে অবস্থি)।
১৫. বিবি মরিয়মের মসজিদ( হাজীগঞ্জ দুর্গের দক্ষিণে ও নারায়ণগঞ্জ শহরের উত্তরভাগে অবস্থিত)।
১৬. বিবি মরিয়মের মাযার,নারায়ণগঞ্জ।
১৭. মজমপুর মসজিদ,নারায়ণগঞ্জ। সোনারগাঁও থেকে এটি ৮ কি:মি: উত্তরে অবস্থিত।
১৮. দিওয়ানবাগ মসজিদ (ঈসাখার নির্মিত মতান্তরে হোসেন শাহী শাসনামল। শীতলক্ষ্যা ব্রীজ পার হয়ে সোনারগাঁও এর পথে কিছুদূর অগ্রসর হলে সড়কের ১৮০ মিটার উত্তরে অবস্থিত।
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি:
১. আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া,বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ, দিব্যপ্রকাশ, বাংলাবাজার, ২০০৭, ঢাকা।
২. সূফি মোস্তাফিজুর রহমান (সম্পাদক),প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, নিমতলী, ঢাকা-১০০০,বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সমীক্ষামালা-খন্ড.১।
৩. বিলু কবীর, বাংলাদেশের জেলা: নামকরনের ইতিহাস, গতিধারা, বাংলাবাজার, ঢাকা, ২০১০