প্রবাসে ঈদ মানে দেশকে পাওয়া আর পেয়েও হারানো

আমেরিকায় বেশ কয়েকবার ঈদ করা হলো আমার। একবার ছিলাম আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেটা ২০১০ সালের কথা। ঈদের দিনটা কোথা দিয়ে গেছে, টেরও পাইনি। রাতের বেলা সঙ্গীতসাধক মেঘনা আমীন গাড়ি করে এসে নিয়ে গেলেন তাঁর বাসায়। দুই মেয়েসহ তিনি আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই থাকতেন। তিনি উন্নত মানের খাবার খাইয়েছিলেন। পরের রোববারে গাড়ি করে নিয়ে গেলেন পাশের শহরে। সেখানে বাংলাদেশিরা একটা হল ভাড়া করে ঈদের অনুষ্ঠান করছেন। খাওয়া-দাওয়া হলো। গানবাজনাও হলো।
কুরবানির ঈদ একবার করেছিলাম নিউইয়র্কে। নামাজ পড়তে গেলাম বাংলাদেশিদের পরিচালিত মসজিদে। ওই ঈদের জামাতে গিয়ে মনে হলো, আরে এ তো পুরোই বাংলাদেশ। পরিচিত

মানুষদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হলো। তারপর সেই রাতেই উড়াল দিলাম ঢাকার দিকে। ঈদের পরের দিন সকালবেলা পৌঁছালাম ঢাকায়। সেবার কুরবানি দেয়া হয়েছিল একদিন পরে। মানে ঈদের দ্বিতীয় দিন।

গত বছর ঈদের দিন ছিলাম বস্টনে। এখানে একটা মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়লাম। বিভিন্ন দেশের মুসলিমরা এসেছেন নামাজ পড়তে। নারীরাও এসেছেন। মসজিদের দু একটা রীতি দেখলাম, বাংলাদেশের চেয়ে একটু ভিন্ন। তারপর এ বাড়িতে দুপুরে দাওয়াত। ও বাড়িতে রাতে দাওয়াত। অনেক খাবার রান্না করে রাখা। অতিথিরা সবাই সেই বাড়িতে আসছেন। খাচ্ছেন।
গৃহকর্তা–গৃহকর্ত্রী প্রতি ঈদে নাকি এ রকম করে থাকেন, সবাইকে দাওয়াত করেন, সবাই এইখানে সমবেত হয়ে খাওয়াদাওয়া করে, দেখা সাক্ষাৎ হয়। সবাই যে ছুটি নিতে পারেন, তা নয়। কেউ কেউ ঈদের পুরো দিনটা ছুটি নিয়ে নেন। কেউ বা শুধু নামাজের সময়টায় ছুটি নেন।
আমার মনে হয়, প্রবাসীরা সবাই ঈদের দিনটায় বিশেষভাবে বাংলাদেশকে অনুভব করেন। এর কারণ, বড়দের জন্য ঈদ আসলে স্মৃতিকেই বেশি উসকে দেয়।
মনে পড়ে যায়, শৈশবে কীভাবে ঈদ করতাম। ভাইবোনেরা মিলে কীভাবে অপেক্ষা করতাম ঈদের দিনটার জন্য। আগের বিকালে আকাশের দিকে তাকিয়ে চাঁদ খুঁজতাম। কে প্রথমে দেখবে, এই ছিল প্রতিযোগিতা। ওই যে ওই যে… একজন দেখেছে চাঁদ। আঙুল তুলে ধরেছে। সবাই তার কাছে গিয়ে ভিড় করছে।
মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হলো শৈশবের স্মৃতি। স্মৃতি সততই সুখের। ঈদের দিনগুলোতেও বড়রা শৈশবের কথাই মনে করবে। তা আপনি দেশে থাকুন আর দেশের বাইরে থাকুন। দেশের বাইরে থাকলে শৈশবের দিনগুলোকে মানুষ কেবল মনে করে তাই নয়, শৈশবকাটানো জায়গাগুলো—সেই নদীতীর, সেই ঈদের মাঠ, কিংবা পাড়ার মসজিদ, সেই খতম তারাবি, সেই বিকালবেলা দাঁতন নিয়ে বেরিয়ে পড়া, ঈদের কেনাকাটা, ঈদের রান্না, মায়ের হাতের স্পেশাল সেমাই—সব কিছু এসে প্রবাসীর মনের মধ্যে ভিড় জমাতে থাকে।
প্রবাসে যারা বাবা-মা নিয়ে থাকেন, তাঁদের সান্ত্বনা আছে। যারা একলা থাকেন, তাঁরা বাবা-মার কথা ভাবেন। আর যাদের বাবা কিংবা মা দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন, তাঁদের বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।
এখন অবশ্য সুবিধা হয়েছে। দেশের খবর সহজেই জানা যায়। অনেকেই টিভিতে বাংলাদেশের চ্যানেল দেখেন। মেসেঞ্জার হোয়াটসঅ্যাপে স্বজনের সঙ্গে ভিডিও-চ্যাট করা যায়। ফেসবুকে ঢুকলেই জানা যায় দেশে কী ঘটছে।
প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে ঈদ আসে দেশকে আরেকবার পাওয়ার আর পেয়েও হারাবার উপলক্ষ হয়ে। প্রবাসের জীবন মানেই ব্যস্ততা। সেই ব্যস্ততার ফাঁকে একটুখানি স্মৃতিতর্পণের উপলক্ষ হয়েই না হয় ঈদ আসুক।
এবার আমি ঈদে থাকব কানাডার এডমন্টনে। ঈদে কী করলাম, জানাব আপনাদের।
সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা।

সূত্র: প্রথম আলো